ছোটগল্প - পিং

ছোটগল্প - পিং

 

১.
'এই যে ম্যাডাম, শুনছেন?'

পিছন থেকে পুরুষকণ্ঠের আওয়াজ শুনে থমকে দাঁড়ালো বৃষ্টি। সে একটু থতমত খেয়েছে। পিছন থেকে যিনি ডাকছেন তিনি যে তাকেই ডাকছেন, সেটা বুঝতে কয়েকটা মিনিট সময় লাগলো বৃষ্টির। যিনি তাকে ডাকছেন তিনি অন্তত ছয় ফুট দূরে দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ভদ্রলোককে বৃষ্টি সেভাবে চেনে না। তার মেয়ে ঝিলম যে ক্লাসে পড়ে, সম্ভবত সেই ক্লাসে একই সেকশনে ভদ্রলোকের ছেলেও পড়ে। কয়েকদিন ধরে ছুটির সময় ভদ্রলোককে দেখেছে বৃষ্টি।

খানিকটা এগিয়ে গিয়ে বৃষ্টি জিজ্ঞাসা করে, 'আমাকে কিছু বলছেন?'

'হ্যাঁ, মানে আপনাকেই বলছি। আমার নাম সৌরিক। সৌরিক মিত্র।'

'বৃষ্টি মজুমদার। বলুন আমি কিভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?'

'আমার ছেলে আর আপনার মেয়ে একই ক্লাসে পড়ে। আমার ছেলেকে এই ক্লাস ওয়ানেই ভর্তি করেছি এই স্কুলে। আমি বিজনেস সামলাই, আর আমার ওয়াইফ চাকরি করেন। উনি তো স্কুলে আসতে পারেন না, আমিই আনা নেওয়া করি আমার ছেলেকে। তো আপনারা মহিলারা দেখলাম স্কুল শেষ হলে কি কি পড়া হল বা ক্লাসে কি কি হল সেটা আলোচনা করেন। আর যে বাবারা নিতে আসেন তাঁরা দেখছি চায়ের দোকানে গল্প করছেন। সমস্যাটা আমার এখানেই।'

ADVERTISEMENT

'মাফ করবেন আমি এখনো সমস্যাটা ঠিক বুঝতে পারছি না।'

'বুঝিয়ে বলছি ম্যাডাম। আমার হয়েছে যত জ্বালা। আপনাদের মহিলা মহলে গিয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করতে লজ্জা লাগে আবার বাবাদের দলের কাছটা থেকে পড়া কিছুই পাইনা। ওঁরা বলেন ওঁদের দায়িত্ব শুধু স্কুলে আনা আর বাড়িতে নিয়ে যাওয়া। সমস্যা হল আমার ছেলে অনেক নোটস পুরোপুরি টুকতে পারে না। তাই... বলছিলাম আপনি...মানে আপনারা যদি আমাকে একটু নোটস বা পড়াগুলো পেতে সাহায্য করেন তাহলে...'

'ওহ! এই কথা? অবশ্যই সাহায্য করব। আপনার ছেলের নামটা কি যেন?'

'রায়ান। রায়ান মিত্র।'

'রায়ানকে কাল থেকে আমাদের দলে পাঠিয়ে দেবেন। ও কি কি লিখেছে বা লেখে নি, সেটা ওর কপিতে আমরা ঠিক করে বুঝিয়ে বলে দেব।'

'আর আমি?'

'সৌরিকবাবু আপনি ঐ বাবাদের দলে দাঁড়িয়ে চা সিগারেট খাবেন। রায়ানের হয়ে গেলে ওকে নিয়ে চলে যাবেন।' বৃষ্টি বলে।

'বাঁচালেন ম্যাডাম। খুব চিন্তায় পড়ে গেছিলাম। আসলে আপনাদের ছেলেমেয়েরা বোধহয় এই স্কুলে প্লে হাউজ থেকেই পড়ে, আমি তো কিছুই জানিনা আপনাদের স্কুলের নিয়ম সম্বন্ধে।'

'বললাম তো সৌরিকবাবু কোনো চিন্তা নেই। আমরা আছি তো। রায়ান তো আমাদেরও ছেলের মতই।'

'থ্যংক্স ম্যাডাম। আজ আসি তাহলে?'

'শুনুন! আপনার নম্বরটা দিন। আমাদের হোয়াটস্যাপ গ্রূপে নিয়ে নিচ্ছি আপনাকে। সেখানেও সব ইম্পরট্যান্ট অ্যানাউন্সমেন্ট আপনি পেয়ে যাবেন।' এই কথা বলে সৌরিকের ফোন নম্বরটা নিয়ে বৃষ্টি সটান হাঁটা দেয় তার বান্ধবীদের জটলার উদ্দেশ্যে।

সেখানে যেতেই বান্ধবীদের একঝাঁক প্রশ্ন। 'কে রে ছেলেটা?' 'কি জিজ্ঞাসা করছিল রে?' 'মনে তো হল ফোন নম্বর দিল, কেন রে?'

'ওরে দাঁড়া দাঁড়া একটু বসতে দে। সব বলছি।' স্কুল শেষে স্কুলের পাশের এই পার্কটায় একটু বসে ওরা। ওদের ছেলেমেয়েরা পার্কে খেলে আর ওরা নিজেদের মত করে একটু গল্পগাছা করে। প্লে হাউজের পর থেকে কেটে গেছে প্রায় তিনটে বছর, ওদের সম্পর্কটা অনিশার মা, অভিকের মা, সোহমের মা বা তন্নিষ্ঠার মা হয়ে, 'তুমি'র গন্ডি পেরিয়ে এখন রুহানা, শুচিস্মিতা, দেবদত্তা বা মোনালিসায় এসে ঠেকেছে। ওরা এখন 'তু্ই'তে নেমেছে। এক একদিন এক একজনের আনা খাবারে ওদের নিত্যদিনের ফিস্ট জমে ওঠে এখন, ওদের বন্ধুত্বের পরিসর এখন ঘর হয়ে শপিং মলে একসঙ্গে যাওয়া, মাঝে মাঝে ছুটির দিনে দল বেঁধে কোথাও খেতে যাওয়া বা মুভি দেখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই শুধু, ওরা এখন একে অপরের অবিচ্ছেদ্য অপরিহার্য অঙ্গ। নিজেদের স্কুল কলেজের বান্ধবীদের থেকেও বেশি বিশ্বাসযোগ্য এখন ওরা এই মায়েদের দলটা একে অপরের কাছে।

মাঝে মধ্যে পরনিন্দা, পরচর্চার আড়াল খোঁজা, স্কুলের অন্য মায়েদের গ্রূপটা কে কি করছে সেসব ফেসবুকে নজর রাখা, কোন মা একটু বেশি বেশি কাজল পরে স্কুল আসছে এবং কেন আসছে সেসব হাঁড়ির খবর ওদের খুঁজতে ভীষণ ভালো লাগে। চলে নিপুণ হাতের কর্মদক্ষতা দেখানোর প্রতিযোগিতাও। এর টবে ফুল ভালো হয় তো ওর হাতের সেলাইয়ের জবাব নেই, এর ফেসবুক পোস্টে তিরিশটা কমেন্ট তো ওর আটচল্লিশটা, এ সিঙ্গারা ভালো বানায় তো ও গরমের দিনে আমপোড়ার শরবত-এইসব খুঁটিনাটি ভালোলাগা মন্দলাগা নিয়েই ওদের জীবন কেটে যাচ্ছে অনায়াস ভঙ্গিতে। বাড়ির রোজের কাজ থেকে বেরিয়ে এইটুকু সময় যেন ওদের কাছে অক্সিজেন বয়ে আনে। একে অপরের গুপ্তকথাও ওদের কারো অজানা নয়।

দেবদত্তা সব শুনে বলে ওঠে, 'যাই বল ভাই, ভদ্রলোককে দেখছি কদিন, মনেই হয় না ছেলে ওয়ানে পড়ে। বেশ হ্যান্ডসাম কিন্তু, বিয়ে হয়েছে বলে মনে হয় না একদমই।'

রুহানা বলে, 'দেখেছিস রোজ রোজ নতুন নতুন রোদচশমা পরে আসে। ফ্যাশন স্টেটমেন্ট বেশ অভিনব।'

মোনালিসা বলে, 'জিম টিমও করে বোধহয়। সুন্দর চেহারা...'

'ওহ! তার মানে ভদ্রলোককে তোরা ভালই স্টাডি করেছিস। শুধু আমিই দেখিনি ওঁকে।' বৃষ্টি নোটসের খাতা চেক করতে করতে বলে ওঠে।

'তুমি স্টাডি না করলে কি হবে সোনা, তোমাকে ও ভালই স্টাডি করেছে। দেখছ না দেখে দেখে তোমাকেই ডেকে নম্বর দিল।' বান্ধবীদের হাসির ছটায় যোগ দেয় বৃষ্টিও। বলে, 'বাজে বকিস নি বাপু। উনি নম্বর দেন নি, আমিই নিয়েছি।'

'ভাল করেছিস। আমি তো বলি ওকে এখানে দাঁড়াতে বল কাল থেকে। আড্ডা জমবে ভাল।'

'উনি দাঁড়াবেন কেন? মহিলাদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকলে বাকি বাবাদের দলটা ওঁকে আওয়াজ দেবে না?' বৃষ্টি বলে।

'হ্যাঁ সেটাও ঠিক। এই চল চল, রোদ মাথার ওপর উঠছে। এবার ফিরতে হবে। কাল আসছিস তো সব?' রুহানা বলে।

'হ্যাঁ আসছি। আসবনা কেন?' এইসব টুকটাক কথা বলতে বলতে যে যার জিনিসপত্র গুছিয়ে ওরা বাড়ির দিকে রওনা দেয়।

                                  ২.
                                  
রাতের দিকে বৃষ্টি মেয়েকে পড়াতে বসিয়েছিল। এমন সময় হোয়াটস্যাপ গ্রূপে একটা মেসেজ, 'থ্যংক্স টু অল অফ ইউ।' পাঠিয়েছে সৌরিক। সেটা দেখে গ্রূপের বাকিদের 'ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম' জানানোর কি ধুম। রীতিমতো গল্প হচ্ছে গ্রূপে। টুংটাং আওয়াজ হয়েই চলেছে ফোনে। বৃষ্টি বিরক্ত হয়ে ফোনটা মিউট করে দেয়। মনে মনে ভাবে, সৌরিকের ফোন নম্বর নিল ও, গ্রূপে জয়েন করালো ও, সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিল ও আর লোকটা গল্প করছে অন্যদের সঙ্গে? ভারী চালাক লোক তো! যাক গে! যা পারে করুক। আর মেয়েগুলোরও মরণ দশা। ছেলে যেন দেখেনি কোনোদিন। যাক! বেশি পাত্তা না দেওয়াই ভালো এইধরণের গায়ে পড়া লোকেদের।

কিন্তু কি যে হল বৃষ্টির? এত রাগ কেন হচ্ছে সৌরিকের ওপর? ফোনটা মিউট থাকলেও মাঝে মাঝেই চোখটা ওদের হোয়াটস্যাপ গ্রূপের মেসেজগুলোর দিকেই চলে যাচ্ছে যে! সে একটাও উত্তর দিচ্ছে না, কিন্তু সৌরিকের সঙ্গে বাকিদের আড্ডা তো ভালই চলছে! একশো নব্বই খানা পিং ঢুকেছে এই আধ ঘন্টায়! বাহ্! চমৎকার! কাউকেই বিশ্বাস করা যায়না দেখা যাচ্ছে।

পরের দিন স্কুল থেকে মেয়েকে আনতে গিয়ে দেখে সৌরিক দাঁড়িয়ে আছে। বলল, 'হাই ম্যাডাম, কেমন আছেন?'

'ভাল আছি। রায়ানকে পাঠিয়ে দেবেন, কপি চেক করে দেব।' এইটুকু বলে সৌরিককে এড়িয়ে ভিড়ের মধ্যে গিয়ে বান্ধবীদের সঙ্গে কথাবার্তায় মত্ত হয়ে ওঠে বৃষ্টি।

রাতের দিকে বৃষ্টির মোবাইলে টুং করে একটা পিং আসে। সৌরিকের মেসেজ। এটার জন্যই মনে মনে অপেক্ষা করেছিল বৃষ্টি।

'আমি কি কোনো ভুল করেছি ম্যাডাম?'

'কেন বলুন তো?' বৃষ্টি কিছু না বোঝার ভান করে।

'আপনি আজ ভালো করে কথা বললেন না! আমি সকাল থেকে ভাবছি কি হল? অনেকবার ভেবে ভেবে আপনাকে মেসেজ করেই ফেললাম।'

'না না সেরকম কিছু নয়। আসলে আজ একটু তাড়া ছিল...'

'সরি! সরি ইফ আই হ্যাভ ডান সামথিং রং।' বৃষ্টির কথাটা শেষ হওয়ার আগে সৌরিক লেখে। 'আসলে আপনাকে আমার আলাদা করে ধন্যবাদ জানানো উচিৎ ছিল, কিন্তু... কিন্তু সাহস হয়নি। আসলে আপনার বান্ধবীরা কাল আমাকে নানারকম প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করছিল...আর তাইজন্য...'

'সেরকম কোনো ব্যাপার নয় সৌরিকবাবু। আচ্ছা আমি এখন রাখি? ওদের খেতে দেব।' বৃষ্টি কথা ঘোরাতে চায়।

'আবার কখন কথা হবে ম্যাডাম?'

বৃষ্টির ভাল লাগছে খুব। সেদিনের পর থেকে মাঝে মাঝেই সৌরিকের সঙ্গে ওর কথা হয়। সকালবেলা আর রাতেরবেলা গুডমর্নিং আর গুডনাইটের ফাঁকে ফাঁকে সারাদিনে অজস্র কথা হয় ওদের। প্রথম প্রথম বৃষ্টি সৌরিকের মেসেজগুলো সিন করে রেখে দিত। কিছুক্ষণ পরেই সৌরিকের পিং আসত, 'তুমি বুঝি খুব ব্যস্ত মানুষ? রিপ্লাই দেওয়ারও সময় পাও না? এদিকে আমি বেকার মানুষ সারাদিন ভাবি ম্যাডামের রিপ্লাই কখন আসবে?'

বৃষ্টি বলত, 'তা তোমার কাজের এত অভাব তো কোনো কাজ খুঁজে নাও না!'

সৌরিক বলত, 'কাজে তো আসছে এই বেকারত্ব। তোমার সঙ্গে কথা বলছি তো, এটাও বা কম কি?'

এভাবেই ওদের দুজনের মধ্যে আস্তে আস্তে একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠতে থাকল। সৌরিকের পৈতৃক ব্যবসা, সে নিজেও তার বাবার ব্যবসা দেখে আর তার সঙ্গে ফ্রিলান্স ফোটোগ্রাফি করে। ঘন্টার পর ঘন্টা কোনো নদী বা ঝিলের ধারে একটা পাখির ছবি তোলার জন্য সে বসে থাকতে পারে ধৈর্য ধরে। আজকাল সেরকম কোনো ছবি সর্বপ্রথম সে বৃষ্টিকে পাঠায়। ওদিকে বৃষ্টি ভালবাসে নিত্যনতুন গাছে ফুল ফোটাতে। তার এক ছাদ ফুলের বাগানের মধ্যে থেকে একটি করে ফুলের ছবি রোজ পাঠায় সৌরিককে। তার মাঝেই বৃষ্টি নিজের মেয়ের খাতা থেকে যত্ন করে নোটসগুলো ফেয়ার করে পাঠিয়ে দিতে ভোলে না সৌরিককে।

কিন্তু ওরা যে এই কয় মাসে এতটা ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েছে, সে কথা স্কুলে বুঝতে দেয় না ওরা কাউকে। সবার চোখ তো আর সমান নয়, বন্ধুত্বকে 'প্রেম' বলে দাগিয়ে দিতে সমাজের একটা মিনিটও লাগে না। একটা মিষ্টি সম্পর্কের গায়ে কাদা ছেটাতে সবাই তৈরী হয়ে থাকে সবসময়। সেইজন্য স্কুলে ওরা 'আপনি', 'ম্যাডাম' আর 'সৌরিকবাবু' হয়েই আছে সবার সামনে।

                               ৩.
এভাবে কেটে গেছে প্রায় তিনটে বছর। রায়ান বা ঝিলমরা এখন ক্লাস থ্রিতে পড়ে। সৌরিক আর বৃষ্টি এখন ভীষণ ভালো বন্ধুতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু ওদের এই গাঢ় বন্ধুত্বটা কেবলমাত্র হোয়াটস্যাপ এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কখনো কখনো সৌরিক যে বৃষ্টিকে আমন্ত্রণ জানায়নি এরকমটা নয়। হয়ত বলেছে, 'চল না, কোনো একটা ফাঁকা নদীর ধারে গিয়ে বসি। দেখবে কত পাখী সন্ধের দিকে ঘরে ফেরে, কত সুন্দর লাগে ঐসময় চারপাশটা।' বৃষ্টি উত্তর দিয়েছে, 'না গো। আমার বাড়ি খুব রক্ষণশীল। কেউ দেখে ফেললে ব্যাপারটার অন্য মানে করবে।' সৌরিক নিজেও বুঝেছে বৃষ্টির অক্ষমতা। রাতে হোয়াটস্যাপে কখনো কখনো বলে, 'তোমার সঙ্গে আমার আগে দেখা হল না কেন বেয়ান? তাহলে হয়ত...'

বৃষ্টি বলে, 'তুমি আমাকে বেয়ান বানিয়ে নিও না সৌরিক। রায়ান যে ঝিলকেই বড় হয়ে বিয়ে করবে সেটা তুমি জানলে কিকরে?'

'আরে আমার ছেলে তোমার মেয়েকে বিয়ে করুক চাই না করুক, আমার সেটা মনে ভাবতে তো বাধা নেই। আর ধরো যদি বিয়েও করে, তাহলে তুমি আর আমি আত্মীয়তার বন্ধনে বাঁধা পড়ে যাব। ভালই হবে, কি বলো? সারাজীবন তোমাকে দেখতে তো পাব অন্তত! ভয় হয়, ওদের ক্লাস টুয়েলভ এর পর যদি তোমার সঙ্গে দেখা না হয় আর?'

বৃষ্টি হাসে। ওদের এই অর্থহীন কথাগুলোই বোধহয় ওদের এখনো বাঁচিয়ে রেখেছে। নাহলে বৃষ্টির সদাব্যস্ত বর আর সৌরিকের নামী কোম্পানিতে কর্মরত স্ত্রী, দু'জনে কোথাও একটা এক। দু'জনেই রাতের বেলা ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফেরে, এখন তো ওঁদের সঙ্গে ভালো করে কথাও হয়না বৃষ্টি বা সৌরিকের। একটা অভ্যস্থ দাম্পত্য সম্পর্কের মধ্যে থাকতে থাকতে ওরাও যখন ক্লান্ত, তখন এই বন্ধুত্ব ওদের জীবনে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। সেই সম্পর্ক অনেকটা ভরসার। কখনো সৌরিকের কোনো দরকারে বৃষ্টি নিজের মত জানায়, তো কখনো বৃষ্টির কোনো তথ্য জানার থাকলে সৌরিক সঙ্গে সঙ্গে ইন্টারনেট ঘেঁটে বৃষ্টির যা দরকার তার সামনে পৌঁছে দিতে কসুর করে না। এইত, কয়েকদিন আগে জিমে গিয়ে ঘাড়ের কাছটা ব্যাথা হল সৌরিকের। তখন বৃষ্টি বকাবকি করল তাকে, বলল, 'বয়সটা তো বাড়ছে নাকি সৌরিকবাবু? এখনো নিজেকে হিরো ভাবলে হবে?' সেরকমই বৃষ্টির অনেকদিনের ইচ্ছা ব্লগ কিভাবে করে সেটা শেখার। দিনকয়েক হল বৃষ্টির কিছু রান্নার ভিডিও এডিট করে তাকে ব্লগ বানাতেও শিখিয়েছে সৌরিক। ভিউ মন্দ হচ্ছে না সেগুলোয়।

কয়েকদিন বৃষ্টি স্কুলে আসেনি। তার ফোনটাও সমানে নট রিচেবল। অথচ ওর জন্মদিনের দিনটাতেও সৌরিকের সঙ্গে ওর কথা হয়েছে। সেদিন বৃষ্টির বর অফিস বেরিয়ে যাওয়ার পরেই একটা কুরিয়ার এল বৃষ্টির দরজায়। একটা ফুলের আস্ত গাছ! কে পাঠালো জানেনা বৃষ্টি। মোড়ক খুলে দেখে একটা দুর্লভ গাছ। এটার কথা কিছুদিন আগেই সৌরিককে বলেছিল না সে?

সৌরিককে কথাটা বলতে সে বলল, 'শুধু বলো তোমার ভাল লেগেছে কিনা?'

সে আর বলতে? খুব খুশি হয়েছে বৃষ্টি।

সৌরিক বলল, 'আজ আর তোমাকে বিরক্ত করব না বেয়ান। ঝিলের সাথে, সোহমের সাথে ভাল করে কাটাও দিনটা। কিন্তু একটা কথা, আমার একটা রিটার্ন গিফট চাই।'

'কি বলো তো?' বৃষ্টি অবাক হয়।

'যে গাছটা তোমায় দিলাম, ওটার প্রথম ফুটে ওঠা ফুলটা কিন্তু আমার চাই। ওটা বেয়াইমশাইকে দিলে হবে না।'

'তুমি কিকরে এত সুন্দর কথা বলো সৌরিক? আমার বরকে কতদিন বলছি গাছটা খুঁজতে, সে এনে দেওয়ার সময়ই পায়নি। এইত তুমি কত সহজে এনে দিলে।'

'তোমার বর ব্যস্ত মানুষ, খুঁজে পায়নি হয়ত। আর আমি খুঁজে পেয়েছি কারণ...'

'কি কারণ সৌরিক?' এক অসম্ভবের নেশায় বৃষ্টি পাগলের মত জিজ্ঞাসা করে সৌরিককে।

'আমি তোমার প্রেমে পড়ে গেছি বেয়ান।'

মুহূর্তে শিহরণ খেলে যায় বৃষ্টির শরীরে। সে সহসা কোনো কথা বলতে পারে না। উত্তরটা তার ভাল লেগেছে, কিন্তু এ ভাললাগা এমনই, যে মুখ ফুটে বলা যায় না যে কতটা ভাল লেগেছে। বৃষ্টি শুধু বলে, 'কি বলছ তুমি? এ যে অসম্ভব চাওয়া সৌরিক। এ দেওয়ার ক্ষমতা তো আমার নেই!'

'এ প্রেমে কিছু চাওয়ার নেই, শুধু সকাল বিকাল এই পিংটুকু ছাড়া। এটুকু যদি চলে যায়, তাহলে বৃথা হয়ে যাবে আমার ছবি তোলা, তোমার ফুল বোনা। অনেকদিন থেকে এই কথাটা তোমায় বলতে চাইছিলাম, পারিনি। সরি।'

বেশ কিছুক্ষণ কোনো উত্তর না পেয়ে সৌরিক আবার পিং করে, 'বেয়ান! কিছু মনে করলে? আমার কিন্তু সত্যিই তোমার কাছ থেকে কিছু চাওয়ার নেই, তোমার ভাল থাকাটুকু ছাড়া।'

'সৌরিক, এভাবে আমাকে কেউ কোনোদিন বলেনি, তুমি জানো? অন্য লোকের বৌকে এসব বলতে নেই!'

'তুমি অন্য লোকের বৌ হতে পারো, কিন্তু আমার তো বেয়ান তুমি। যাইহোক ছাড়ো। শুভ জন্মদিন। আবার কাল কথা হবে।'

এইটুকুই শেষ কথা হয়েছিল তিনদিন আগে বৃষ্টির সঙ্গে সৌরিকের। তারপর থেকে বৃষ্টির ফোনটা বন্ধ। ঝিলমও তিনদিন স্কুল আসেনি। প্রথম দু'দিন ছটফট করেছে সৌরিক, বৃষ্টিকে স্কুলে দেখতে না পেয়ে। কিন্তু তৃতীয় দিনের দিন পড়া মেলানোর সময় রায়ানকে নিয়ে এসে দেবদত্তাকে প্রশ্নটা করেই বসে সে। বলে, 'বৃষ্টি ম্যাডামকে দেখছি না, কোথাও বেড়াতে গেছেন নাকি?'

দেবদত্তা বলে, 'না দাদা, বেড়াতে যায়নি। আসলে ওর ভীষণ শরীর খারাপ। তবে আসবে দু'একদিনের মধ্যে।'

বৃষ্টির শরীর খারাপ? ঐজন্য দু'দিন ধরে অনলাইনে আসেনি। কিন্তু কিছু করারও তো নেই। ওর বাড়ি তো আর যাওয়া যায়না! সৌরিককে ধৈর্য ধরতেই হবে যতক্ষণ না বৃষ্টি ফোনটা না খোলে।

কেটে গেছে আরো দু'দিন। সহ্যসীমা পেরিয়ে যাচ্ছে সৌরিকের, এসময় হঠাৎ দেখল বৃষ্টি অনলাইন। হোয়াটস্যাপে পিং করে সৌরিক, 'কেমন আছো বেয়ান? কি হয়েছিল?'

বৃষ্টি মেসেজটা সিন করেছে অনেকক্ষণ। কিন্তু রিপ্লাই দেয়নি। বারবার পিং করে করে সৌরিক উত্তর পায়না, শেষে বলে, 'এবার যদি উত্তর না দাও তাহলে সটান তোমার বাড়ি চলে যাব বেয়ান। কি হল? কি হয়েছে কিছু বলবে? কি করলাম আমি যার জন্য তুমি আমাকে এতটা শাস্তি দিচ্ছ?'

'সৌরিক, তোমার পাঠানো গাছটায় আর কোনোদিন ফুল হবে না।'

'কেন?' সৌরিক কিছু বুঝতে পারে না।

'আমার আর তোমার বন্ধুত্বের ব্যাপারটা সোহম আর তোমার স্ত্রী ভালভাবে নিচ্ছে না। রিয়ার বোধহয় সোহমদের অফিসের কাছাকাছিই অফিস। উনি বোধহয় তোমার ফোনে আমাদের মেসেজগুলো দীর্ঘদিন ধরে চেক করেন। তুমি বোধহয় যে কুরিয়ারের মাধ্যমে গাছ পাঠিয়েছিলে তাঁদের থেকে রিয়া আমার ঠিকানাটা পেয়েছেন। সোহমের ফোন নম্বর উনি কিভাবে যোগাড় করলেন আমি জানিনা তবে আমাদের কথোপকথনের স্ক্রিনশটগুলো এনে উনি সোহমকে দেখিয়েছেন আমার জন্মদিনের দিনেই। সোহম তোমার পাঠানো গাছটা আমাকে ঘরে রাখতে দেয়নি। খুব অশান্তি হয়েছে আমাদের।'

'কি বলছ বেয়ান? কিন্তু আমি তো কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে কিছু পাঠাই নি তোমায়?'

'পৃথিবীতে সবার চোখ একরকম নয় সৌরিক। আমাদের বোধহয় আর হোয়াটস্যাপ করা উচিৎ হবে না। রায়ানের সব পড়া তুমি পেয়ে যাবে, চিন্তা কোরো না। আমার পাঠানো সব মেসেজ মুছে দিও তুমি।' বৃষ্টি কি কাঁদছে?

'কক্ষনো না। তোমার আর আমার মধ্যে এমন কোনো খারাপ কথা হয়না যেটা মুছে ফেলতে হবে। তুমি কিচ্ছু ভেব না বেয়ান। আমি আছি তোমার সঙ্গে।'

'কিন্তু আমার বর আর তোমার বৌ যে আমাদের আসল মানুষ সৌরিক! ওদের নিয়েই তো আমাদের ঘর! এই সন্দেহটা ওদের মনে বাড়তেই থাকবে, বাড়তেই থাকবে। আমাকে তো সোহম আর স্কুলে যেতে দেবে কিনা সন্দেহ। বলেছে ঝিলকে পুলকার করে দেবে।'

'আমি ওসব শুনতে চাই না। আমরা বন্ধু ছিলাম আর বন্ধু থাকব। এত কিছু হয়ে গেছে আর আমার বেয়ান মুখ ভার করে বসে আছে। একবারও আমাকে জানাওনি কেন কিছু?'

'এটা তো লজ্জার ব্যাপার সৌরিক।'

'সব বন্ধুত্বকে "পরকীয়া" যারা ভাবে, লজ্জা তাদের লাগা উচিৎ বেয়ান। আমি তো কোনোদিন তোমাকে ফোন পর্যন্ত করিনি, তোমার কোনো ছবি চাইনি, তোমার মিথ্যে প্রশংসা করিনি। যা করেছি, শুধু এই পিং করেছি। মন থেকে যা ভেবেছি তাই বলেছি। তাহলে?'

'তাহলে কি সৌরিক?'

'তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়ালো, নিজের কথাটা পরিষ্কার করে জোর গলায় বলা। কষ্ট পেয়ো না। বরং ব্লগ করার দিকে মন দাও। তোমার ইউটিউব প্রোফাইলের সাবস্ক্রাইবার কত হয়েছে খেয়াল আছে? তিনহাজার। তাও মাত্র এই ক'দিনে। আমার ভিডিও এডিটিং এর কামাল।'

'সত্যি বলছ? আমি দেখিনি তো?'

'দেখে নাও। মন খারাপ ঝেড়ে ফেলে ওঠো দিকি বাপু। এখন সবকিছু ভিডিওগ্রাফির কামাল। দেখো না তোমার প্রোফাইলকে কোথায় নিয়ে যাই আমি। তারপর দু'জনে মিলে একটা রেঁস্তোরা খুলব আমরা।'

'ওহ! কত স্বপ্ন! আমি তো সেখানে রান্না করব, তুমি কি করবে?'

'আমি? দাঁড়াও ভাবি একটু। আমি নাহয় বেকার মানুষ, তোমার রান্নার ভিডিও তুলে সেগুলো এডিট করে পোস্ট করব! সেটুকু ধৈর্য আমার আছে। তারপর তোমার ঐ গোঁফওয়ালা বর আর আমার মডেল টাইপ বৌয়ের নাকে ঝামা ঘষে দেব।'

'উফফফ! তুমি পারোও বটে হাসাতে!' এত কষ্টের মাঝেও বৃষ্টির মুখে হাসি, চোখে জল।

'পারি তো? ঐটুকুতেই হবে। এইটুকু ছোট্ট ব্যাপার, আর আমি ভাবছি আমার বেয়ানের কি না কি হল? আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম জানো?'

'কিসের এত ভয় সৌরিক?'

''তোমাকে আর দেখতে না পাওয়ার ভয় বেয়ান! তুমি বুঝবে না।'' কথাটা লিখতে গিয়েও লিখল না সৌরিক। বলল, 'ধরে নাও, তুমি না থাকলে আমার ছেলে কোথা থেকে পড়া পাবে সেই ভয়।'

বৃষ্টি বুঝেছে পুরোটাই। এই ভরসা, এই বন্ধুত্বের হাত, এই সমর্থন সে পায়নি কারো কাছ থেকে আগে। ঘরের বৌ হয়ে থাকতে থাকতে নিজের অস্তিত্বটা সে তিনবেলা খাবার তৈরী করা, ঘর গেরস্থালির কাজ অথবা সবার হুকুম তামিল করার মধ্যে দিয়ে হারিয়ে ফেলতে বসেছিল যেন। সৌরিকের মত বন্ধুকে জীবনে না পেলে সে চিন্তাও করতে পারত না যে সেও কিছু করতে পারে বলে। নাহ! মনের জোর তাকে আনতেই হবে। দুনিয়া যা বলে বলুক, সে আর সৌরিক পাপ কিছু করেনি। বন্ধু নামের কোনো পদবী সত্যিই নেই।

কেটে গেছে আরো পাঁচটা বছর। ঝিল, রায়ান, তন্নিষ্ঠা, বিনায়করা এখন ক্লাস এইট। সৌরিক জিম করাটা এখনো ছাড়েনি, নিত্যনতুন রোদচশমা পরে এসে সে এখনো ছেলের স্কুলের সেই হিরোই রয়ে গেছে। বদলায়নি বৃষ্টিও। তবে স্কুল চত্বরে সে আর সৌরিককে 'সৌরিকবাবু' বলে ডাকে না। এখন সে রীতিমতো জনপ্রিয় ফুড ব্লগার। তার প্রত্যেকটি রান্নার ভিডিওতে লক্ষ লক্ষ ভিউ হয়। তারা দু'জন এখন বিজনেস পার্টনার। নিজেদের শহরে একটা রেঁস্তোরা খুলেছে তারা, আরেকটা খুলেছে একটা এমন জায়গায়, যেখান থেকে সোহম আর রিয়ার অফিস খুব বেশি দূরে নয়। সোহম বা রিয়ার আবার এখন ঐ রেঁস্তোরার মধ্যাহ্নভোজের আইটেমগুলো খুব প্ৰিয়। বলাই বাহুল্য, তাদের জন্য বৃষ্টি স্পেশাল ডিসকাউন্ট এর ব্যবস্থাও রেখেছে। সৌরিক আপত্তি করেছিল, বলেছিল, 'ওদের থেকে চড়া দাম নাও বেয়ান'। কিন্তু বৃষ্টি সৌরিকের আপত্তি কানে তোলেনি।

তাদের রেঁস্তোরার নাম কি জানো? ''পিং''।

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait