ছোটগল্প: আজি ঝড়ের রাতে

ছোটগল্প: আজি ঝড়ের রাতে

বাজার করে কলকাতার অভিজাত অঞ্চলের হাজার স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাটে হন্তদন্ত হয়ে  ফিরছেন অনিল মজুমদার। গৃহস্থালির কাজে সাহায্য করে একটি মহিলা, নাম মালতি, সে হয়ত এসে দাঁড়িয়ে আছে দরজার বাইরে। অনিলের বয়েস পঞ্চান্ন ছুঁতে চললো কিন্তু শরীরে বেশ ভালোই সুস্থ আছেন। বছর দুয়েক হলো ভি আর এস নিয়েছেন কর্পোরেট জগতের ইঁদুর দৌড়ে আর নিজেকে সামিল করবেন না বলে। বিশাল অঙ্কের মাস মাইনের হাতছানিও ধরে রাখতে পারেনি তাঁকে। একমাত্র মেয়ে তিয়াস কে ভালো করেই মানুষ করতে পেরেছেন, মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন, মেয়ে জামাই নিজেদের জগতে সুপ্রতিষ্ঠিত। মাঝে মাঝে আসা যাওয়া লেগে থাকে অনিল বাবুর এই ফ্ল্যাটে তাদের, যদিও তিনি বেশি যেতে পারেন না মেয়ের ফ্ল্যাটে। অনিল ভীষণ ব্যাস্ত থাকেন প্রতিদিনের কাজে।

এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে তিনি এতো ব্যাস্ত কেনো? আসলে ব্যস্ততার কারণ তাঁর স্ত্রী, অমৃতা। বছর কয়েক হলো কোনো এক জটিল রোগে তিনি বাকশক্তি এবং চলনশক্তি হারিয়েছেন। নামি দামি ডাক্তার দেখিয়ে, বড় বড় চিকিৎসাকেন্দ্রে চিকিৎসা করেও ডাক্তাররা হার মেনেছেন, কারণ অমৃতাদেবী বোধহয় নিজেই লড়ার শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন শেষ দিকটায়।

রোগের শুরু অনেকদিন আগে থেকেই। যৌথ পরিবারে থাকাকালীন অমৃতাদেবীর ওপর অনিলবাবুর আত্মীয়দের মানসিক নির্যাতন লেগে থাকার ঘটনা একসময় নিত্যদিনকার রুটিনে পরিণত হয়েছিল। অমৃতাদেবীর শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল শ্বশুরবাড়ির সম্পর্কের  অনেকের থেকেই অনেকটা বেশি, কিন্তু তা সত্ত্বেও নিজের কেরিয়ার এর প্রতি তিনি কোনোদিনই মনোযোগী হন নি। কারণ তাঁর একমাত্র কন্যা তিয়াস। অমৃতার যুক্তি ছিল তিনি যদি পাগলের মতো কেরিয়ারের পিছনে ছোটেন তাহলে মেয়েকে বোধহয় তিনি ভালো করে মানুষ করতে পারবেন না। অনিল তাঁর এই যুক্তি মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু যেমন হয়, অমৃতার এই মানসিকতাকে শ্বশুরবাড়িতে সবাই ঠাট্টার চোখে দেখতো। তারা অমৃতার এই স্বার্থত্যাগ কে তো বুঝলই না, বরং বলল যে চাকরি পান নি বলে নাকি তিনি ওই যুক্তি খাড়া করছেন। অমৃতা ছিলেন যুক্তিবাদী, স্বাধীনচেতা। তাঁর অন্যান্য অনেক গুনই ছিল, ভালো কবিতা লিখতেন এক সময়।  গান করতেন ভালোই। পড়াশোনায় বেশ  ভালো ছিলেন। কিন্তু অনিলের সাথে বিয়ে হবার পর কি যে দুর্মতি হলো, সংসারের প্রতি মনোযোগী হয়ে পড়লেন। প্রকৃত গুণী এক মহিলার গুন গুলি হঠাৎ করে সংসারের  কাজের চাপে কিছুটা আর লোকজনের হাসিঠাট্টার নিচে অনেকটাই চাপা পরে যেতে থাকে। কথা কম বলতেন, সেজন্য অনেকে তাঁকে অহংকারী ভাবতো।

অনিল কোনদিন চান নি যে অমৃতা ঘরের কাজে মগ্ন থাকুন শুধু, অমৃতা নিজে চেয়েছিলেন। অমৃতার হেনস্থা দেখে তিনি একসময় অন্যত্র সংসার পাতার চিন্তাভাবনাও করেছিলেন, কিন্তু অসুস্থ শ্বশুর এবং শ্বাশুড়ি কে ছেড়ে, বিশেষত পৈত্রিক বাড়ি থেকে অমৃতা স্বামীকে  বিচ্ছিন্ন করতে চান নি, অনিলকে বলতেন, 'যে যা করছে করুক, কিন্তু যতদিন ওঁরা বেঁচে আছেন ততদিন মুখ বুজে সহ্য করা ছাড়া আমার উপায় নেই।' অনেক লাঞ্ছনা গঞ্জনা মুখ বুজে সহ্য করে গেছেন শুধুমাত্র মেয়ের এবং স্বামীর মুখ চেয়ে। কিন্তু একসময়  পনেরো বছরের বিবাহিত জীবনে বারো বছরের মেয়ে এবং নিজের কর্মক্ষেত্রে অত্যাধিক ব্যাস্ত স্বামীকে সামলাতে সামলাতে নিজের অস্তিত্বকে ক্রমে ভুলতে বসেছিলেন অমৃতা। এবং দুঃখ তখন পেতেন যখন নিজের যন্ত্রণার কথা কারো সাথে ভাগ করে নিতে পারছিলেন না। মেয়ে ছোট, স্বামী ব্যাস্ত, বন্ধুদের কাছে বেশি বললে তারা শুনতো সবটা, কিন্তু আড়ালে হাসাহাসি করতো। তারা অন্যান্যদের সাথে আলোচনা করত, অবশ্যই অমৃতাকে লুকিয়ে, 'ওর নাটক সব, বর ভালো চাকরি করে, অভাব নেই, শুধু দুঃখ দুঃখ ভাব করে। আরে গৃহবধূ, গৃহবধূই থাক, তা নয়, সব কথাতে জ্ঞান জাহির করা স্বভাব। ওরে, ওই বদগুণ নিয়ে কি আর সংসারে টেকা যায়? ওর যা হয়েছে ঠিকই আছে।' অমৃতা ভাবতেন, প্রকৃত বন্ধুই বা কজন পেলেন? তিনি বুঝতে পারতেন না কিকরে প্র্যাকটিক্যাল হবেন। নিজের মধ্যে ক্রমশ এক স্প্লিট পার্সোনালিটি তৈরি হচ্ছিলো তাঁর। ক্রমশ শরীর জবাব দিতে শুরু করলো, চোখের সামনে এমন কিছু দেখতে শুরু করলেন যা অন্যেরা দেখতে পেতো না, যেমন হয়ত আপন মনে বিড়বিড় করে বকে চলেছেন, কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলছেন যে, 'এইতো তিয়াসের সাথে কথা বলছি'। কিন্তু তিয়াস তখন স্কুলে। ক্রমশ এক কথা বারবার বলতে শুরু করলেন, যা কখনো কখনো অনিল বা তিয়াসেরও বিরক্তির কারণ হয়ে উঠতে লাগলো, কিন্তু আসল সমস্যা তখন শুরু হলো যখন ছোটোখাটো জিনিসও ভুলে যেতে শুরু করলেন।

সমস্যা যে একটা হচ্ছে তা একমাত্র অনিল বুঝতে পেরেছিলেন, বাকিরা ততক্ষণে বুঝে নিয়েছে যে অমৃতার মাথার গন্ডগোল দেখা দিয়েছে। ডাক্তার দেখানো হলে ক্রমশ জানা গেলো যে অমৃতা জটিল মানসিক অসুখে ভুগছেন।  ডাক্তার বলেছিলেন, 'এরকম চলতে থাকলে আশায়ালামই হবে ওঁর ঠিকানা, তাই যত দ্রুত সম্ভব ওঁকে একটু আলাদা রাখার চেষ্টা করুন অনিলবাবু।' আসলে অমৃতার একমাত্র সমস্যা ছিল, যাদের প্রতি করুনা করা উচিত ছিল তিনি তাদেরকে মাত্রাধিক গুরুত্ব দিয়ে ফেলছিলেন। কিছু মানুষের উপহাস, কটূক্তিকে বড্ড গুরুত্ব দিতে শুরু করেছিলেন, যা ক্রমে জটিল মানসিক অসুখে পরিণত হতে শুরু করেছিল। আর এই রোগ বাসা বাঁধতে শুরু করেছিল তাঁর শরীরে নয়, মস্তিষ্কে। চিৎকার, চেঁচামেচি, অশান্তি অনিলের সংসারে নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছিল। ক্রমে পাড়ার লোকজনও কানাঘুসো শুরু করলো।

এরকম 'পাগল' কে পাড়া থেকে তাড়াতে বদ্ধপরিকর ছিল একশ্রেণীর লোক। হুমকি, চোখরাঙানি এবং সমস্ত কিছুকে উপেক্ষা করে অমৃতা কে নিয়ে অনিল যখন ছ' তলার এই ফ্ল্যাটে উঠে এলেন, ভেবেছিলেন আস্তে আস্তে অমৃতাকে সুস্থ করে তুলবেন। কিন্তু ক্ষতি যা হবার ততক্ষনে হয়ে গিয়েছিলো। তিয়াস মাকে ভয় পেতে শুরু করেছিল, যে তিয়াসের জন্য অমৃতা সবকিছু ছেড়েছিলেন।

সে বলেছিলো, -'বাবা, আমি হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করতে চাই'।

ADVERTISEMENT
Tuhu Momo Video Teaser

অনিল কারণ জিজ্ঞাসা করেছিলেন, উত্তর এসেছিলো,

-'আমার মাকে ভয় লাগে বাবা, বিড়বিড় করে নিজের মনে বকে, কাঁদে, আমার পড়াশোনা এখানে থেকে হবে না'।

অনিল কিছুটা বাধ্য হয়ে পাহাড়ি অঞ্চলের ভালো কনভেন্ট স্কুলে একমাত্র মেয়েকে ভর্তি করিয়েছিলেন, কেনোনা চাকরি সামলে তাঁর পক্ষে অসুস্থ স্ত্রী আর ক্রমশঃ বড় হয়ে ওঠা মেয়েকে সামলানো সম্ভব হচ্ছিলো না। মেয়ের পড়াশোনা চলতে লাগলো, অনিলের অফিসও চলতে লাগলো, আর মালতির হাতে চলতে লাগলো অমৃতার দেখভাল। এই কুড়ি বছরে মালতি  যেন তাঁদের ঘরের মেয়েই হয়ে উঠেছে, বয়স তো তারও কম হলো না।

বাজার থেকে ফিরে অনিল দেখলেন ঠিক তাই, মালতি দাঁড়িয়ে আছে বন্ধ  দরজার সামনে।

-'দাদা, তাড়াতাড়ি দরজাটা খোলো গো, রান্নাবান্না করতে হবে তো নাকি'।

-'দাঁড়া দাঁড়া, আগে জমিয়ে এক কাপ চা খাওয়া দেখি।'

-' না দাদা, আগে ঘর দোর পরিষ্কার করে নিই, তারপর রান্না করবো।'

সেটাও ঠিক কথা, অমৃতা একদম পছন্দ করেন না ধুলোবালি, কথা হয়ত বলতে পারেন না, কিন্তু সব দেখেন, তাই তাঁর পছন্দের কাজগুলি, যেমন ঘর পরিষ্কার, ধুলো ঝাড়া, বারান্দার গাছগুলিতে সযত্নে জল দেওয়া, বিছানার চাদর পাল্টানো, বাসি জামাকাপড় কাচা, রাতের বাসন মাজা, এসব আগে করে তবে রান্নায় হাত দেওয়া যায়। অনিল কি আর করেন, নিজেই চা বসালেন।

মালতি হাসতে লাগলো, বৌদি কথা না বললে কি হবে, গোটা ঘরবাড়ি জুড়ে তাঁর প্রখর দৃষ্টি এবং অস্তিত্ব সবসময় অব্যাহত। কাজ সেরে রান্না করে মালতি যখন বিদায় নেয়, তখন বেলা হয়েছে। 'আবার সন্ধ্যায় সে এসে রাতের রান্না করব দাদা, আমি আসার আগে যেন বেরিয়ে যেও না', বলে মালতি বিদায় নেয়। এ বাড়ির সাথে এক অচ্ছেদ্য বন্ধনে সেও যেন বেঁধে আছে আজ এতগুলো বছর, দাদার জন্যই আজ তার মেয়েটাও সরকারি স্কুলে গিয়ে লেখাপড়া শিখতে পেরেছে, দাদাই ব্যবস্থা করে তাকে সেলাই স্কুলে ট্রেনিং নিতে পাঠিয়েছিল, তাই আজ তার মেয়ে কাকলি স্বনির্ভর হতে পেরেছে, নাহলে হয়ত তাকেও লোকের বাড়ি কাজ করতে হতো। ভাবলেই শিউরে ওঠে মালতি। দাদার প্রতি তার অনেক ঋণ।

মালতি কাজ মিটিয়ে চলে যাওয়ার পর অনিলেরও অনেক কাজ থাকে। নিভৃত অবসরে বসে তিনি আর অমৃতা গল্প করেন, অমৃতা কথা হয়ত বলতে পারেন না কিন্তু তাঁর চোখ সর্বদাই সবদিকে আছে, অনিলের মনে হয়। এরপর দুপুরবেলার খাওয়াদাওয়া, বিকেলের দিকে নিজেই চা করে নেওয়া, টিভি চালিয়ে খবর দেখা সবকিছুই চলে দুজনে মিলে। খবর দেখার ফাঁকে একটু খুনসুটিও হয়, যেরকম আগে হতো। মাঝে মাঝে অনিল অমৃতার হুইলচেয়ারটার সামনে এসে ঘন হয়ে বসেন, লক্ষ পড়ে সেটিতে ধুলো জমেছে। ধুলোবালিতে অমৃতার কষ্ট হয়, তাই সেটিকে তিনি ঝেড়েপুঁছে সাফ করে দেন। অমৃতা গান শুনতে ভালোবাসতেন, অনিল এককালে গাইতেন ভালো। একান্তে বসে এখনো গান গেয়ে শোনান স্ত্রীকে।

এই তো যেন সেদিনকার কথা মনে হয়, কথা ফুরোতে চাইত না তাঁদের, কিন্তু মেয়ের জন্মের পর অমৃতাও ব্যস্ত হয়ে পড়লেন সংসার নিয়ে, অনিল তাঁর নিজের কাজে। কথা কমে যেতে লাগলো দিন প্রতিদিন। কখনো কখনো কথার উত্তর না পেয়ে রেগে গিয়ে অমৃতা বলতেন, 'যেদিন থাকবো না সেদিন বুঝবে, কথা বলার লোক পাবে না।' অনিল হেসে উড়িয়ে দিতেন।

সেদিন,আর আজ?

--'আজকে দেখো অমৃতা, কত সময়, কত গল্প, কত আড্ডা। তোমার জন্য, শুধু তোমার জন্য সময় চুরি করে রেখে দিয়েছি। একদিন যা তোমার অভিযোগ ছিল, এই সময়ে দাঁড়িয়ে সে চাহিদাও পূরণ করতে পেরেছি তো?'

অনিলের চায়ের কাপে চা শেষ, অমৃতার টা অমৃতা খেতে পারেন নি। কোনোদিনই পারেন না, তবুও নিয়ম করে স্ত্রীর হুইলচেয়ারের সামনে চা, বিস্কুট, খাবার রেখে দেন অনিল। অমৃতা অপলক চোখে দেখেন। কি ভাবেন, তিনিই জানেন। অভিমান কি এখনো ভাঙেনি তাঁর? কথা বলবেন না আর কোনোদিন অনিলের সাথে তিনি? ছায়াপথ ধরে আর হাঁটা হবে না কোনোদিন তাঁদের?



আজ বেশ কয়েক বছর হয়ে গেলো হুইলচেয়ারটা ফাঁকা। তবুও অমৃতার ছবিটি জ্বলজ্বল করছে দেয়াল থেকে। আজ বেশ কয়েকবছর হয়ে গেলো ছবির নীচে থেকে সরানো হয়নি সেটিকে। অনিলের বিশ্বাস, অমৃতা এখনো বসে রয়েছেন সেই চেয়ারে।

অনিল তো একা নন এই ফ্ল্যাটে। সবকিছু আছে, আগে যেরকম ছিল। অমৃতার শারীরিক উপিস্থিতি হয়ত নেই, কিন্তু তিনি অনুভবে রয়েছেন এখনো। এই অনুভব অনিলের একান্ত ব্যক্তিগত।

বাইরে বৃষ্টি এসেছে আকাশ ঘোর কালো করে। যেন এক্ষুনি রাত নামবে। অমৃতা  তাঁকে গান গেয়ে শোনাতে বলতেন বৃষ্টির সময়ে, আজও গাইবেন অনিল।

গুনগুন করে গেয়ে ওঠেন, "আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার, পরানসখা, বন্ধু যে আমার।"


0 comments

Chiranjit Mukherjee

Chiranjit Mukherjee

Shared publicly - 01st Jun, 21 07:23 am

আমার পরিচিত, মানে বলতে পারেন আমার এক আত্মীয়ের জীবন কাহিনীর অনেকটা মিল পেলাম আপনার এই লেখায়। অনেক অতীতের ঘটনা মনে পরে গেলো।

Saurav Chakraborty

Saurav Chakraborty

Shared publicly - 01st Jun, 21 03:44 am

চোখে জল এলো...

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait