ভক্তবাঞ্ছা কল্পতরু

ভক্তবাঞ্ছা কল্পতরু

১৮৮৫ সালের শেষের দিক। ঠাকুরের শরীরটা প্রায়ই খারাপ যাচ্ছে। একে গলরোগ,তায় প্রচন্ড ঠান্ডা পড়েছে সেবছর। ঠাকুরকে কাশীপুরে শ্রীযুক্ত গোপাল ঘোষ মহাশয় এর বাগানবাড়িতে নিয়ে এসে রাখা হয়েছে চিকিতসার স্বার্থে। বাড়িটি বেশ বৃহৎ, খোলামেলা। চতুস্পার্শ্ব বাগান ও গাছপালা পরিবৃত। ঠাকুরের বাড়িটি পছন্দ হয়েছে। এই বাড়িতেই দুতলার ঘরে চলে তাঁর সেবা। সে ঘর সর্বদা তাঁর সন্ন্যাসী সন্তানেরা ঘিরে রাখেন। নিরঞ্জন মহারাজের চোখ এড়িয়ে সেখানে একটি মাছি গলারও উপায় নেই৷ এত সাবধানতা অবলম্বনের কারণ, ঠাকুরের কথা বলা বারণ। ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার বলেছেন কথা বললেই তাঁর অসুখ বাড়বে। ঠাকুর ওই শরীরে ভক্তদের আবদার রক্ষা করার জন্য কথা বলেই চলেছেন। ফলত তাঁর গলরোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেইজন্য এত সাবধানতা।

 

এই বাড়িতেই একতলায় একটি ঘরে শ্রীমা বসবাস করছেন। এবং অলক্ষ্যে থেকে সর্বদা ঠাকুরের সেবা করে চলেছেন নিরলস। তাঁর চোখ সর্বদাই দুতলায় ওঠার সিঁড়ির দিকে। ওই পথ দিয়েই ভক্তেরা সর্বক্ষণ ওঠানামা করছেন, তাঁদের কথাবার্তার মাধ্যমেই শ্রীমা খবর পাচ্ছেন ঠাকুরের। নাহলে অত ভক্তের ভিড়ে তো ঠাকুরের কাছে দিনমানে তাঁর যাওয়ার উপায় নেই৷ ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে ঠাকুর বিছানা ছেড়ে একদমই উঠতে পারছেন না। নরেন্দ্রনাথ কে তিনি নানা উপদেশ দিচ্ছেন। তাঁর অবর্তমানে নরেন্দ্রের উপরেই সন্ন্যাসী সংঘের দায়িত্ব তিনি দিয়ে যেতে চাইছেন। কিন্তু গলার স্বর তাঁর দিনে দিনে ক্ষীণ হয়ে আসছে। লাটু মহারাজ ঠাকুরের নিরন্তর সেবায় নিরত। ঠাকুরের যখনই প্রকৃতির ডাক আসছে তখনই লাটু মহারাজ তাঁকে গাড়ু (বেডপ্যান) এগিয়ে দিচ্ছেন। এরকম ভাবেই চলছে। ঠাকুর সেরকম কিছু খেতেও পারছেন না। আশা একপ্রকার নেই বললেই চলে। শুধু ঠাকুরের ভক্তপ্রবর নাট্যাচার্য গিরিশচন্দ্র ঘোষ মন খাঁটি করে বসে রয়েছেন। তাঁর বিশ্বাস, ঠাকুর অসুখের ঢং করছেন। তিনি আজ বলবেন ভাল হয়ে যাবেন, তো সঙ্গে সঙ্গে ভাল হয়ে যাবেন। দুর্জয় ক্যানসার রোগ কে হারিয়ে তিনি উঠে বসবেন। তিনি চতুর্দিকে বলে বেড়াচ্ছেন যে ঠাকুর অবতার, তিনি যা বলবেন তাই হবে, হতে বাধ্য। ঠাকুরের কানেও বিভিন্ন সূত্র থেকে এসব খবর এসে পৌঁছে যাচ্ছে। এভাবেই বছরটি শেষ হতে চলল।

ADVERTISEMENT

৮৮৬ সালের পয়লা জানুয়ারি। ঠাকুর সেদিন একটু ভাল আছেন। ঠাকুর কারো সাথে দেখা করছেন না এ কথা জানা সত্বেও দলে দলে তাঁর গৃহী শিষ্যেরা তাঁর একবার দর্শন পাওয়ার জন্য আসছেন দূরদূরান্ত হতে। তাঁদের মনোগত ইচ্ছে, যদি ঠাকুর একবার জানালা দিয়েও দর্শন দেন বছরের প্রথম দিন, তাহলে তাঁরা ধন্য হবেন। আসলে তাঁরা প্রত্যেকেই জানেন, হয়ত ঠাকুরের শরীর আর বেশিদিন থাকবে না।

ভক্তবৎসল ঠাকুরের এই ইচ্ছার কথা অজানা নয়। ওইদিন একটু বেলার দিকে শ্রীমা পুজোয় বসেছেন। হঠাত দেখলেন উপরের সিঁড়ি বেয়ে নিচের দিকে যেন এক ছায়ামূর্তি চলে গেল। পুজো করতে করতে তিনি ভাবলেন হয়ত বা তাঁর ছেলেদের মধ্যে কেউ বাগানের দিকে গেল। অত গুরুত্ব না দিয়ে পুজোয় মনোনিবেশ করলেন। কিন্তু গৃহী ভক্তেরা এ কি দেখছেন!! নতুন ধুতি পরিহিত, গরমের জামা সোয়েটার টুপি পরিহিত ক্ষীণতনু ঠাকুর স্বয়ং বাগানের পথ পেরিয়ে পায়ে পায়ে তাঁদের দিকে এগিয়ে আসছেন যে !! তাঁদের মধ্যে শোরগোল পরে গেল। উপরে ঠাকুরের ঘরের জানালা দিয়ে তাঁর সন্ন্যাসী ছেলেরা এ দৃশ্য দেখলেন কিন্তু তাঁরা ভাবলেন, ঠাকুর নীচে নেমেছেন, এই অবসরে তাঁর বালিশ বিছানা একটু রোদ্দুরে দেওয়া যাক। তাঁরা আর নীচে নামলেন না।

ঠাকুর গৃহী ভক্তদের ভীড়ে এসে সেখানে সর্বাগ্রে গিরিশ কে দেখতে পেয়ে তাঁকে শুধোলেন, “গিরিশ, তুমি এর মধ্যে (নিজেকে দেখিয়ে) কি এমন দেখেছ যে লোকজনকে যাতা বলে বেড়াচ্ছ?” প্রত্যুত্তরে গিরিশ জোড়হাতে তাঁর পদতলে বসে বলে উঠলেন, “ব্যাস বাল্মীকি যাঁর ইয়ত্তা করতে পারেন নি, আমি আর তার কি বলব?” সমবেত জনতা এই বাক্য শুনে সাধু সাধু করে উঠল। ঠাকুর বেশ খুশি। নিজের স্বরূপ নিজে লুকোলেন চিরটাকাল, শেষ লগ্নে গিরিশের মুখ দিয়ে তা ব্যক্ত করিয়ে নিলেন। এরপর সমবেত ভক্তমন্ডলী কে তিনি কিছু বর চেয়ে নিতে বললেন। কেউ অর্থ চাইল, কেউ বা মোক্ষ চাইল, কেউ বা চাইল অন্য কিছু। শেষে দয়াল ঠাকুর সেই অনবদ্য কৃপা করলেন তাঁর ভক্তদের, বললেন, ‘তোমাদের চৈতন্য হোক’!!! ভক্তরা সর্বদিকে ঠাকুরকে দেখতে লাগল। তাদের মনে অপূর্ব ভাবের সঞ্চার হল। তারা কেউ হাসতে লাগল, কেউ বা হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগল, কেউ ভাবাবিষ্ট হল। ঠাকুরকে ছুঁয়ে দেখার জন্য তাদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। কেউ তাঁর প্রসাদ থেকে সেদিন বঞ্চিত হল না।

এই বাড়িতেই একতলায় একটি ঘরে শ্রীমা বসবাস করছেন। এবং অলক্ষ্যে থেকে সর্বদা ঠাকুরের সেবা করে চলেছেন নিরলস। তাঁর চোখ সর্বদাই দুতলায় ওঠার সিঁড়ির দিকে। ওই পথ দিয়েই ভক্তেরা সর্বক্ষণ ওঠানামা করছেন, তাঁদের কথাবার্তার মাধ্যমেই শ্রীমা খবর পাচ্ছেন ঠাকুরের। নাহলে অত ভক্তের ভিড়ে তো ঠাকুরের কাছে দিনমানে তাঁর যাওয়ার উপায় নেই৷ ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে ঠাকুর বিছানা ছেড়ে একদমই উঠতে পারছেন না। নরেন্দ্রনাথ কে তিনি নানা উপদেশ দিচ্ছেন। তাঁর অবর্তমানে নরেন্দ্রের উপরেই সন্ন্যাসী সংঘের দায়িত্ব তিনি দিয়ে যেতে চাইছেন। কিন্তু গলার স্বর তাঁর দিনে দিনে ক্ষীণ হয়ে আসছে। লাটু মহারাজ ঠাকুরের নিরন্তর সেবায় নিরত। ঠাকুরের যখনই প্রকৃতির ডাক আসছে তখনই লাটু মহারাজ তাঁকে গাড়ু (বেডপ্যান) এগিয়ে দিচ্ছেন। এরকম ভাবেই চলছে। ঠাকুর সেরকম কিছু খেতেও পারছেন না। আশা একপ্রকার নেই বললেই চলে। শুধু ঠাকুরের ভক্তপ্রবর নাট্যাচার্য গিরিশচন্দ্র ঘোষ মন খাঁটি করে বসে রয়েছেন। তাঁর বিশ্বাস, ঠাকুর অসুখের ঢং করছেন। তিনি আজ বলবেন ভাল হয়ে যাবেন, তো সঙ্গে সঙ্গে ভাল হয়ে যাবেন। দুর্জয় ক্যানসার রোগ কে হারিয়ে তিনি উঠে বসবেন। তিনি চতুর্দিকে বলে বেড়াচ্ছেন যে ঠাকুর অবতার, তিনি যা বলবেন তাই হবে, হতে বাধ্য। ঠাকুরের কানেও বিভিন্ন সূত্র থেকে এসব খবর এসে পৌঁছে যাচ্ছে। এভাবেই বছরটি শেষ হতে চলল।

 ১৮৮৬ সালের পয়লা জানুয়ারি। ঠাকুর সেদিন একটু ভাল আছেন। ঠাকুর কারো সাথে দেখা করছেন না এ কথা জানা সত্বেও দলে দলে তাঁর গৃহী শিষ্যেরা তাঁর একবার দর্শন পাওয়ার জন্য আসছেন দূরদূরান্ত হতে। তাঁদের মনোগত ইচ্ছে, যদি ঠাকুর একবার জানালা দিয়েও দর্শন দেন বছরের প্রথম দিন, তাহলে তাঁরা ধন্য হবেন। আসলে তাঁরা প্রত্যেকেই জানেন, হয়ত ঠাকুরের শরীর আর বেশিদিন থাকবে না।

ভক্তবৎসল ঠাকুরের এই ইচ্ছার কথা অজানা নয়। ওইদিন একটু বেলার দিকে শ্রীমা পুজোয় বসেছেন। হঠাত দেখলেন উপরের সিঁড়ি বেয়ে নিচের দিকে যেন এক ছায়ামূর্তি চলে গেল। পুজো করতে করতে তিনি ভাবলেন হয়ত বা তাঁর ছেলেদের মধ্যে কেউ বাগানের দিকে গেল। অত গুরুত্ব না দিয়ে পুজোয় মনোনিবেশ করলেন। কিন্তু গৃহী ভক্তেরা এ কি দেখছেন!! নতুন ধুতি পরিহিত, গরমের জামা সোয়েটার টুপি পরিহিত ক্ষীণতনু ঠাকুর স্বয়ং বাগানের পথ পেরিয়ে পায়ে পায়ে তাঁদের দিকে এগিয়ে আসছেন যে !! তাঁদের মধ্যে শোরগোল পরে গেল। উপরে ঠাকুরের ঘরের জানালা দিয়ে তাঁর সন্ন্যাসী ছেলেরা এ দৃশ্য দেখলেন কিন্তু তাঁরা ভাবলেন, ঠাকুর নীচে নেমেছেন, এই অবসরে তাঁর বালিশ বিছানা একটু রোদ্দুরে দেওয়া যাক। তাঁরা আর নীচে নামলেন না।

ঠাকুর গৃহী ভক্তদের ভীড়ে এসে সেখানে সর্বাগ্রে গিরিশ কে দেখতে পেয়ে তাঁকে শুধোলেন, “গিরিশ, তুমি এর মধ্যে (নিজেকে দেখিয়ে) কি এমন দেখেছ যে লোকজনকে যাতা বলে বেড়াচ্ছ?” প্রত্যুত্তরে গিরিশ জোড়হাতে তাঁর পদতলে বসে বলে উঠলেন, “ব্যাস বাল্মীকি যাঁর ইয়ত্তা করতে পারেন নি, আমি আর তার কি বলব?” সমবেত জনতা এই বাক্য শুনে সাধু সাধু করে উঠল। ঠাকুর বেশ খুশি। নিজের স্বরূপ নিজে লুকোলেন চিরটাকাল, শেষ লগ্নে গিরিশের মুখ দিয়ে তা ব্যক্ত করিয়ে নিলেন। এরপর সমবেত ভক্তমন্ডলী কে তিনি কিছু বর চেয়ে নিতে বললেন। কেউ অর্থ চাইল, কেউ বা মোক্ষ চাইল, কেউ বা চাইল অন্য কিছু। শেষে দয়াল ঠাকুর সেই অনবদ্য কৃপা করলেন তাঁর ভক্তদের, বললেন, ‘তোমাদের চৈতন্য হোক’!!! ভক্তরা সর্বদিকে ঠাকুরকে দেখতে লাগল। তাদের মনে অপূর্ব ভাবের সঞ্চার হল। তারা কেউ হাসতে লাগল, কেউ বা হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগল, কেউ ভাবাবিষ্ট হল। ঠাকুরকে ছুঁয়ে দেখার জন্য তাদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। কেউ তাঁর প্রসাদ থেকে সেদিন বঞ্চিত হল না।


দয়াল ঠাকুর অকাতরে কৃপা বিলিয়ে সেইদিন সেই যে শয্যা নিলেন, আর তাঁকে উঠতে দেখা গেল না। নীলকণ্ঠ শিব যেমন অকাতরে অমৃত বিলিয়ে নিজকণ্ঠে কালকূট বিষ ধারণ করেছিলেন, সেরকম ঠাকুরও তাঁর দিব্য অঙ্গে গ্রহণ করলেন মানুষের যত পাপ, আর মানুষকে অমৃত দিলেন অকাতরে। বললেন, “সন্ন্যাসীরা তো ঈশ্বরকে ডাকবেই, কিন্তু সংসারে থেকে যারা ঈশ্বরকে ডাকে তারাই বীরভক্ত।” এরকম বাণী জগতে আর কোনো গুরুর মুখ দিয়েই বেরোয় নি, এ সন্দেহাতীত। অন্ধকারে পোকার মত  কিলবিল করা মানুষগুলোকে উদ্ধার করতে যুগে যুগে তিনি আবির্ভূত হন, আরও একবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে তা দেখিয়ে গেলেন।

আজ নতুন বছরের প্রথম দিনে তাঁর কাছে প্রার্থনা, হে ঠাকুর, আর কিছু না, আমাদের চৈতন্য দাও, কৈবল্য দাও। হে মহাভাগ, আমাদের নিঃশেষ করে নিংড়ে তোমার কোলে তুলে নাও।

অবতারবরিষ্ঠ, তোমাকে কোটি কোটি প্রণাম। রামকৃষ্ণ শরণম!!

 

স্বদেশ টাইমস এখন টেলিগ্রামেও। সাবস্ক্রাইব করতে এখানে ক্লিক করুন।

স্বদেশ টাইমস ফেসবুক পেজ লাইক করুন।

 

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait