ছোটগল্প : অরূপ তোমার বাণী

ছোটগল্প : অরূপ তোমার বাণী

রাত প্রায় দুটো। নার্সিং হোমে নিজের কেবিনে বসে থাকতে থাকতে তন্দ্রার ঘোরে চোখ দুটো বুজে এসেছিল ডক্টর সুভদ্রা ঘোষের। তন্দ্রা ছুটলো নার্স এর ডাকে। ইমার্জেন্সি তে নতুন রোগী এসেছে, ডক্টর ঘোষ যদি নিজে একবার দেখে আসেন রোগীর কন্ডিশন! আজকাল মানুষের অর্থের দিক দিয়ে যেমন কোনো অভাব নেই, তেমন রোগভোগও যেন লেগেই রয়েছে। সারাক্ষণ আই.সি.ইউ. আর অপারেশন থিয়েটার নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয় ডক্টর ঘোষকে। নিজের কর্মপ্রচেষ্টায় তৈরী করেছেন এই বিশ্বমানের চিকিতসাকেন্দ্র। আর তাতে পেরিয়ে গেছে অনেকগুলো বছর। চুলে কখন যেন হাল্কা রূপালী আভা ধরেছে বুঝতেও পারেন নি। আর তাই সংসার বলতে সেরকম কিছু আর করা হয়ে উঠল না। না! মনের মানুষ যে একেবারেই পান নি তা কিন্তু নয়। কিন্তু এত ব্যস্ততার মধ্যে কি একজন মানুষ বা তাঁর পরিবারকে সময় দিতে পারবেন? এই দ্বন্দ্ব থেকেই বিয়েটা আর করা হয়ে উঠল না। এই ব্যস্ততার বাইরেও তাঁর আলাদা একটি সংসার রয়েছে যে। প্রতি সপ্তাহে নিয়ম করে সেই সংসারের ক্ষুদে গুলোকে দেখতে যাওয়া, তাদের পড়াশোনা ঠিকমত হচ্ছে কিনা সেই সব কিছুর সরেজমিনে ব্যবস্থা করা, এইসব তো তাঁকেই করতে হয়। সহযোগী হিসাবে পেয়েছেন তাঁর কিছু সহপাঠীকে। এই ক্ষুদেগুলোর জন্য তাদের পছন্দমত কিছু খাবারও করে নিয়ে যেতে হয়, কারণ তারা তাদের সুভদ্রা মায়ের হাতের স্বাদ বড় ভালই চেনে।

ADVERTISEMENT

সেইজন্য মেডিক্যাল এর কৃতি ছাত্রী সুভদ্রা ঘোষ কে একটু বেশি আয় এর দিকে নজর দিতে হয় বইকি। অর্থের সীমা পরিসীমা নেই আবার রোগের ও ছাড়ান নেই এমন লোকেদের কাছ থেকে দু পয়সা বেশি ফিজ নেওয়াকে পাপ বলে মনে করেন না তিনি। কারণ তাঁর মত কয়েকজন সহৃদয় মানুষের চেষ্টায় “পাঞ্চজন্য অনাথ আশ্রম” টি চলে। প্রায় সত্তর জন অনাথ শিশু বিনামূল্যে বিশ্বমানের শিক্ষা, খাদ্য ও বস্ত্র পায়। তাদের নিজের পায়ে দাঁড় করানোর জন্য সুভদ্রা ঘোষের চেষ্টার অন্ত নেই৷ এরাই তো তাঁর সন্তানসম। এদের মধ্যে থেকে যদি একটিও মানুষ হয়ে বেরোয়, তাহলে তাঁর মধুদাদা কে দেওয়া কথা তিনি রাখতে পারবেন, এই প্রচেষ্টায় সর্বদা নিজেকে মগ্ন রাখেন ডক্টর ঘোষ।

পাঞ্চজন্য অনাথ আশ্রমে এলেই মনটা ছুটে চলে যায় আশ্রম সংলগ্ন বড় মাঠ টার দিকে। কিছুক্ষণ সময় কাটান মাঠ সংলগ্ন ছোটো মন্দিরটিতে। প্রতি রবিবারের মত এই রবিবারেও এসেছেন সুদূর কলকাতা থেকে হুগলি জেলার ছোট্ট এই গ্রামটিতে। মন্দির চত্বরে যখন বসে থাকেন তখন তিনি আর দেশের অন্যতমা নামকরা রাশভারী ডাক্তার নন, তখন তিনি বহুদিন আগের ছোট্ট সেই সুবি। স্মৃতির সরণি বেয়ে ভেসে যান কোন অতীতে!

এই অনাথ আশ্রম সংলগ্ন মাঠে সুবি খেলে বেড়ায় দিনরাত। ধূলিধূসরিত রুক্ষ বেশ, শাসনহীন বৈচিত্রহীন জীবন। বাবা সুবির জন্মের আগেই মৃত। মা কাজ করেন অনাথ আশ্রমে, আরো কয়েকবাড়ি। সুবি একটাই মেয়ে, সেই মেয়েও দুদিন পরে কাজ করে খাবে, নেহাত বয়েসে বড্ড ছোটো, তিন কি চার। আশ্রমের পরিচালন সমিতির সদস্যেরা প্রায়ই বলেন, “সুবির মা, নিজে তো লোকের বাড়ি ফাই ফরমাশ খেটে জীবন কাটালে, তা মেয়েটাকে দু পাতা লেখাপড়া তো শেখাতে পারতে। তোমার মেয়েটা বুদ্ধিমতী। আশ্রমের বাচ্ছাদের যখন পড়ানো হয় তখন দরজায় উঁকি মেরে দেখে। ওদের দলে মেয়েকে বসিয়ে দাও, দু কলম লিখতে অন্তত শিখুক।” সুবির মা বলে, “আমাদের আর ল্যাকাপোরা বাবু, আর বলেন নি। দুদিন পরে তো নোকের বাড়ি ঘর মুছতে ঢুকবে, তাই কিনা বলেন। ও থাকগে, কাজ লাই ল্যাকাপোরায়।” আশ্রম আধিকারিকরা বেশি বলেন না। যে যার কাজে চলে যান। সুবিকে ভালবাসেন, চোখের সামনে জন্মাতে দেখলেন, বাপটা কে নেশা করে মরতে দেখলেন, মা টা কে দিনরাত খেটে মরতে দেখছেন তাই বলেন। “ভাল পরামর্শ লোকজন আর নেয় না”, এই বলে তারা গজগজ করতে থাকেন।

সুবির কিন্তু পড়াশোনা করার খুব ইচ্ছে। একটু বড় হওয়ার সাথে সাথে ওই ক্লাসরুমের দরজার বাইরে থেকেই অক্ষর পরিচয় আর নামতা শিখেছে সে। জেনেছে আমাদের পৃথিবী নামক গ্রহটার আকৃতি গোল। শিখেছে চাঁদের আলো আসলে সূর্যেরই আলো, এরকমই আরো কত কিছু। মধুদাদা যে বলেছে, পড়াশোনা না শিখলে ভাল মানুষ হওয়া যায় না! সে তো ভাল মানুষ হতে চায়। তার মায়ের চামড়া ওঠা ফোস্কা পরা হাতদুটোকে তো একটু মলম দিতে চায়। তবে উপায় কি? তার জেদের কাছে ক্রমে তার মা হার মানে। আশ্রমের প্রাথমিক বিভাগে জোরজার করে ভর্তি হয় সুবি। তখন তার বয়েস আট। প্রথম শ্রেণীর পক্ষে একটু বেশি বয়েস। তাতে কি? সে তো কিছুটা পড়াশোনা শিখেছে। সে পারবে। শিক্ষকগণ ও খুশি। অবশেষে সুবির মায়ের সুবুদ্ধি হলো। খুশি মধুদাদাও।

সুবি অনাথ আশ্রমের বাচ্ছাগুলোর সাথে বিকেলে মন্দিরের মাঠে খেলে। মন্দিরের পূজারী আবার বড্ড গোঁড়া, নোংরা কাপড়ে কিছুতেই মন্দির চত্বরে বদমাশ ছেলেপুলেদের ঢুকতে দেন না। আর সুবির তো ওই পোশাকের ছিরি। তাই সে কোনোদিন মন্দিরে ঢুকে দেবতার মুখদর্শন করার সুযোগ পায় নি। কয়েকবার ঢোকার চেষ্টা করে বকুনি খেয়ে আবার বড় দাদা দিদিদের সাথে ফেরত এসেছে। এভাবেই একটু একটু করে বড় হচ্ছে। মাঠে ফিরতেই হোহো হাসির শব্দ। “কিরে, আজও ঢুকতে দেয়নি তো তোদের? বেশ হয়েছে। এখন বোস দেখি এখানে। গপ্পো হোক একটু”। এই বলে মধুদাদা সর্বক্ষনের সঙ্গী হাতের বাঁশিটি নামিয়ে রাখে। “না না মধুদাদা আগে তোমার বাঁশি শুনব তার পর গপ্পো হবে”, বাচ্ছাদের আবদারে কিছুক্ষণ আবার বাঁশি বাজাতেই হয় মধুদাদাকে। তারপর শুরু হয় গপ্পো। সে যে সে গপ্পো নয়, পুরান মহাভারত থেকে শুরু করে মনীষীদের গপ্পো, ভারতের গপ্পো, ভারতবাসীর গপ্পো! মহারানা প্রতাপ থেকে ঝাঁসির রানী, ছত্রপতি শিবাজী থেকে ভারতবর্ষের সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন, সব গল্পই আছে। এসব গল্প শুনতে শুনতে আঁধার নামে। বাচ্ছারা আশ্রমে ফিরে যায়, সুবি ফেরে নিজের কুঁড়েঘরে।

কেটে যায় বেশ কয়েকটা বছর এভাবে। প্রাথমিকের পড়া শেষ করে সুবি এবার পঞ্চম শ্রেণীতে ওঠে। আশ্রমের গন্ডির বাইরে সে এবার আশ্রম সংলগ্ন বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। সেই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বৃত্তি পরীক্ষার ফল দেখে সুবিকে নিখরচে পড়াশোনার সুযোগ করে দেন। আর এ ব্যাপারে সবথেকে আগ্রহী সুবির মধুদাদা। সেই প্রধান শিক্ষক আর গ্রামপ্রধানকে বলে কয়ে সুবির পাকাপাকি একটা ব্যবস্থা করে দেয়। সুবি এখন মন দিয়ে পড়াশোনা করে, স্কুল যায় আর পাড়ার মুদির দোকানে সন্ধের দিকে ঘন্টা তিনেক হিসেব লেখার কাজ করে। সুবি আর সুবির বন্ধুরা মাঝে মাঝে মধুদাদার কাছে পড়তেও যায়। লোকে বলে মধুদাদা নাকি পড়াশোনায় খুব ভাল ছিলো। খুব ভাল রেজাল্ট ও করত সব পরীক্ষায়। কিন্তু পড়াশোনা শেষ করে কি যে তার মাথায় ভূত চাপলো, নেমে পড়ল গরীবগুর্বো ঘরের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর অভিযানে। তার বাবা ছিলেন ধনী ব্যবসায়ী। সেই বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তির টাকায় এই অখ্যাত গ্রামে অনাথ আশ্রম আর স্কুল খুলে সেখানে গরীব ছেলেমেয়েদের রেখে পড়াশোনা করাতে লাগলো, হাতের কাজের ট্রেনিং ও শুরু করেছে ইদানিং।

তাকে কেউ বাহবা দেয়, কেউ পাগল বলে আবার কেউ তার এসব কাজকে নাটক বলে। কিন্তু এতে মধুদাদার কিছু যায় আসে না। সে যেন সব নিন্দা প্রশংসার ঊর্ধে। দিনরাত পাগলের মতো নামজাদা লোকজনের বাড়ি বাড়ি ঘুরে টাকা জোগাড় করে যাতে সমাজের এই পিছিয়ে পড়া ছেলেমেয়েগুলোর মধ্যে কাউকে অন্তত মূলস্রোতে আনতে পারে। তার সংসার এই ছেলেমেয়ে গুলোকে নিয়েই। এরাই তাকে দাদা বলে ডাকে শুধু নয়, তাকে ভাইফোঁটাও দেয়। ছেলেমেয়েগুলো তার ডাকে এক পায়ে খাড়া।

ইতিমধ্যে তার প্রতিষ্ঠা করা স্কুল থেকে একজন ডাক্তারি পড়ছে, আরেকজন পড়ছে আর্ট স্কুলে। তবে মধুদাদার সঠিক বয়স কেউই জানে না। এই গ্রামের সে আদি বাসিন্দা নয়। একদিন হঠাত করে এসে বাঁশির সুরে ক্রমশ সবার মন জিতে নিলো। তার বাবা মা কেউ নেই৷ এই গ্রামের লোকেরাই তার আত্মীয়ের মত। গ্রামের সবার বিপদে আপদে সে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। গ্রামের বয়স্ক লোকেরাও খুব মান্য করে মধুদাদাকে, এমনই প্রখর তার ব্যক্তিত্ব! যুবসমাজকে নেশা করা থেকে দূরে রাখার জন্য সমাজসেবার কাজে তাদের ব্যস্ত রাখাটাও মধুদাদার একটি বড় কৃতিত্ব। সে এই যুবসমাজের নেতা। কিন্তু এখনও সে একটা ব্যবস্থা করতে পারেনি। তার প্রতিষ্ঠা করা আশ্রমটির দায়িত্ব কাকে দেবে, তার অবর্তমানে ওই অনাথ গরীব শিশুগুলোর কি হবে এই নিয়ে সে চিন্তায় থাকে। দেশে কি আর এইকটা মাত্র গরীব মানুষ? আরও তো কত আছে মেধাবী ছাত্রছাত্রী! কিন্তু এই আশ্রম আর বিদ্যালয়ের দায়িত্ব কারো হাতে সঁপে না দিয়ে সে অন্য কোথায়ই বা যায়?

সময় গড়িয়ে যায়। সুবি আর তার বন্ধুর দল আস্তে আস্তে বড় হতে হতে মাধ্যমিকের দরজায় এসে উপস্থিত হয়। ছোটো থেকে লক্ষ করে সুবি, পরীক্ষার আগে সবাই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে ঠাকুর কে মন্দিরে গিয়ে প্রণাম করে আসে। কিন্তু সুবি একটু অন্যরকম মেয়ে। তার মধুদাদাই তার কাছে ঈশ্বর। তাই সে কোনো মন্দিরে যাওয়ার আগ্রহ দেখায় না। স্বয়ং মধুদাদাও তাকে দিনান্তে একবার ঠাকুরের মন্দিরে নিয়ে যেতে পারে না। সুবি এখন বড় হয়েছে, তার নিজস্ব মতামত তৈরী হয়েছে। সে বলে, “মধুদাদা, তুমি না থাকলে পড়াশোনাটাও আমার হত না, আর পাড়ার মুদির দোকানে কাজটাও আমি পেতাম না। আমার মায়ের মত লোকের বাড়ি ন্যাতা ঝাঁটার কাজ করতে হত। মায়ের বয়েস হয়েছে, তোমার জন্যই আমাদের সংসার টা চলছে। আমার কাছে তুমিই ঈশ্বর। অন্য ঈশ্বর আমি চিনি না আর জানতেও চাই না, আশীর্বাদ কোরো যেন তোমার মত কিছুটা হলেও মানুষের কাজে লাগতে পারি।” তার তীক্ষ্ণ জোরালো মতের কাছে মধুদাদাও কিছু বলতে পারে না। শুধু একটু আশার আলো মধুদাদার মনে উঁকি দিয়ে যায়।

প্রত্যাশামতই মাধ্যমিকে খুব ভাল ফল করে সুবি প্রথমেই ছুটে আসে মধুদাদার বাড়ি! বরাবরের মত, “কিরে, এবারেও ফেল করেছিস তো”, বলে হোহো করে মধুদাদা হেসে ওঠে। সুবি কিন্তু তার এই দাদাটির স্বভাব ভালমত জানে। সে রাগ করে না। পায়ে প্রণাম করে রেজাল্ট দেখায়।

গোটা রাজ্যের মধ্যে এক অখ্যাত গ্রামের এক অখ্যাত স্কুলের ততোধিক অখ্যাত এক ছাত্রী মাধ্যমিকে সপ্তম স্থান পেয়েছে। সেদিন গ্রামের লোকেদের মধ্যে যেন এক উতসব লেগে যায়। কত সম্মান, কত পুরস্কার যে সুবি পেল তার পরের কদিনে তার ইয়ত্তা নেই৷ এর পরের দুটো বছরের যাত্রা যেন কোনো সিনেমার থেকে কম নয়। উচ্চ মাধ্যমিকেও নবম হয়ে সুবি ওরফে সুভদ্রার জয়যাত্রা অব্যাহত। তার চোখে তখন ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন। ছোটো থেকে বিনা চিকিত্সায় অনেক প্রিয়জনকে মরতে দেখা, ধুঁকতে দেখা মেয়েটা গরীব মানুষের জন্য কিছু করার স্বপ্নে বুঁদ। আরো একজন কিন্তু স্বপ্ন দেখছে এই বলিষ্ঠ চরিত্রের মেয়েটাকে নিয়ে। মধুদাদা। সে এতদিন ধরে চোখের সামনে তিলে তিলে গড়ে উঠতে দেখেছে তার যোগ্য উত্তরসুরি। আর বেশিদিন নয়। সুবির ডাক্তার হওয়া এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। আর তারপরই…….!

দিন কাটতে থাকে নিরলস। গ্রামের যুববাহিনীর সাথে হাত মিলিয়ে সুবির মতই আরো মেধাবী কয়েকজন ছাত্রছাত্রী, মধুদাদার দলে যোগ দিয়েছে। তারা যে শুধু পড়াশোনাতেই ভাল তা নয়, গ্রামের সবার প্রয়োজনে তারা একপায়ে খাড়া। মধুদাদা এখন খুব নিশ্চিন্ত। এবার তার সময় হয়েছে। এবার তাকে যেতে হবে এই ক্ষুদ্র গন্ডি ছাড়িয়ে দেশের অন্য কোনো প্রান্তে। আবার খুঁজে পেতে তৈরী করতে হবে কোনো যুবদল। মধুদাদা মাঝে মাঝেই বলে, “তোরা তৈরী হ! এবার আমায় হয়ত অন্য কোথাও চলে যেতে হবে”। কিন্তু ছেলেমেয়েরা তার এই কথা কে ঠাট্টা হিসাবেই নেয়। সুবি ও।

সময়মতো ডাক্তারি পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোয়। এবারেও তাক লাগানো রেজাল্ট করে সুবি প্রণাম করতে আসে মধুদাদাকে। কিন্তু মধুদাদা ঘরে নেই৷ অনেক খোঁজে সুবি মধুদাদাকে। কোথথাও নেই তো। মনে কু ডাকতে থাকে সুবির। আজ তার রেজাল্ট অথচ মধুদাদা কোথায় গেলো? পাগলের মত খুঁজতে খুঁজতে মধুদাদার ঘরে এসে একটি চিঠি পায় সুবি। তাতে লেখা—

“স্নেহের সুবি,

তোর ওপর অনেক আশা রেখে এই পাঞ্চজন্য অনাথ আশ্রম আর স্কুলের দায়িত্ব রেখে গেলাম। তুই আর তোর বন্ধুরা আমায় নিরাশ করবি না, নিশ্চিত জানি। আমি সবসময় থাকব তোদের সাথে। তবে আরো আছে আর্ত নিপীড়িত আমাদের এই পোড়া দেশে। তাদের মধ্যে থেকেও তো খুঁজে বের করতে হবে তোদের মত কাউকে।

তোরা আমায় বুঝবি, এগিয়ে যাবি, এটুকু জানি। আশীর্বাদ রইল।

মধুদাদা।”

চোখের জল বাঁধ মানে না সুবির। যে মন্দিরে কোনোদিন ঢোকে নি আজ সেখানে অভিযোগ জানাতে যায়। মধুদাদা কেন চলে গেলো একথা মন্দিরের ভগবানকে জিজ্ঞাসা করবে সে। আজ আর তাকে কেউ বাধা দেয় না মন্দিরে ঢুকতে। কিন্তু মন্দিরে কার কাছে সে অভিযোগ করবে। মন্দিরের ওই বংশীধারী কালো মূর্তিটির চোখ মুখ যে একজনের সাথে বড় মিলে যাচ্ছে। একি মনের কোনো ভ্রম? এ তো সুবির মধুদাদার মত মুখ একেবারে!

এক আকাশ প্রশ্ন নিয়ে সুবি আকাশের দিকেই তাকায়। এভাবেই কি তুমি কাঁদিয়ে চলে যাও যুগে যুগে? এভাবেই কি তুমি তৈরী কর নতুন মানুষ? সুবিরা ও পারবে। তুমি যা বলে গেছ তা করে দেখাবে। কেননা তোমার আসল স্বরূপ যে এই নিখিল বিশ্বে মিশে আছে, তা সুবিরা আজ বুঝতে পেরেছে।

মন্দিরপ্রাঙ্গণে কার যেন ডাকে সম্বিত ফেরে ডক্টর সুভদ্রা ঘোষের। মন্দিরের কালো মূর্তির মুখে তখন একরাশ সূর্যের আলো। দূর থেকে কার যেন বাঁশির সুর ভেসে আসে, যেন রবিঠাকুরের ওই গানটা, ”অরূপ তোমার বাণী, অঙ্গে আমার চিত্তে আমার মুক্তি দিক সে আনি।”

প্রণাম মধুদাদা।।


0 comments

Mousumi Mukhopadhyay

Mousumi Mukhopadhyay

Shared publicly - 28th Apr, 21 01:56 am

কী ভালো লেখা! জল এলো চোখে!

Piyali Kushari

Piyali Kushari

Shared publicly - 28th Apr, 21 01:55 am

অসাধারণ ,,অসাধারণ লাগলো। বাস্তবে এমন মধুদাদার সত্যি খুব প্রায়োজোন।

Saurav Chakraborty

Saurav Chakraborty

Shared publicly - 31st Aug, 20 11:31 am

Inspiring story...

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait