প্রতিযোগিতার গল্প – অলৌকিক প্রকৃতি

প্রতিযোগিতার গল্প – অলৌকিক প্রকৃতি

“ও মা, শোনো না ভালো লাগছে না,একটা গল্প বলো না।”
“হ্যাঁ রে,পড়াশোনা ছেড়ে দে তুই আর আমিও বাড়ির কাজ ছেড়ে তোর সাথে গল্প করতে বসি এখন! যা পড়তে বস।”
“না নাআআ!প্লিজ মা ।একটা গল্প বলো। দেখো বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার আর কি সুন্দর ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ছে।এমন দিনে একটা ভূতের গল্প না হলে হয়!জাস্ট জমে যাবে!”


“আচ্ছা দাঁড়া আমি আসছি” মা এর এই কথায় আমি সঙ্গে সঙ্গে দু কাপ কফি তৈরি করে নিয়ে, ঘরে গিয়ে বসলাম। শুরু হলো মার গল্পের আসর – শ্রোতা আমি।বেশ গা ছমছমে পরিবেশ বাইরে ।মুষল ধারায় বৃষ্টি পড়ছে আর ঘনঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।
এমন পরিবেশে মা গল্প বলতে শুরু করল,”সে প্রায় কুড়ি বছর আগের কথা।শিয়ালদা স্টেশনে হুলুস্থুলু কান্ড।বছর তেইশ ও ছাব্বিশের এক দম্পতি চলেছে মধুচন্দ্রিমায়।বাড়ির বড়দের কাছে তারা এখনো দুগ্ধ পোষ্য শিশু!তাই জনা কুড়ির এক দল এসেছে তাদের বিদায় জানাতে।আসলে সাবধান করতে।কি কি করবে আর কি কি করবে  না, তা আর একবার মনে করিয়ে দিতে।ঠিকই ধরেছিস, সেই দিনের সেই দুগ্ধ পোষ্য দম্পতি হলো,আজকের মধ্য চল্লিশের এই আমি আর তোর বাবা।”
আমি তো হেসেই মরি। মাসির কাছে একবার শুনেছিলাম বটে মা আর বাবা নাকি একেবারে রাজযোটক ছিল।তাদের হানিমুনে কি সব ঝামেলা হয়েছিল।

ADVERTISEMENT


“উফ্ অতো হাসির কি হলো। এত হাসলে আমি কিন্তু আর গল্প বলব না।” গল্প বলাতে বাধা পেয়ে মা বিরক্ত হলো।
আমি আর কথা না বাড়িয়ে চুপ করে গেলাম।মা আবার শুরু করলো,”তোর ঠাম্মা তো কেঁদেই ভাসাছিলো।যেন,আমি তার ছেলেকে ইলোপ করে নিয়ে চলেছি। আর তোর দিম্মা তো আরো এক কাঠি ওপর দিয়ে যায়।  পুরো লেডি অমরেশ পুরীর কায়দায় কোমরে হাত দিয়ে থ্রেট করেছে তোর বাবাকে।” বলেছে,”এই যে শোনো, শোনো, আমার একমাত্র বড় মেয়েকে নিয়ে যাচ্চো যাও কিন্তু শহি সলামত ফেরত আনবে তাকে”।
এবার মা হেসে ফেলে বললো,”ভাগ্গিস ট্রেন ছাড়ার ঘন্টাটা বাজলো। না হলে যে, কি হতো!”

মা কফিতে চুমক দিয়ে বললো, “হুম,একটু তো চিনি দিবি। এক্কেবারে তেতো।”
আমি ছুট্টে গিয়ে রান্নাঘর থেকে চিনি এনে দিলাম।
মা আবার বলতে শুরু করল,”বড়দের ছত্র ছায়া ছেড়ে আমরা হাজির হলাম নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে।এই প্রথম আমাদের দুজনের একার যাত্রা।উত্তেজনায় একেবারে টগবগ করে ফুটছি।পাহাড়কে ভালোবেসে, ডিসেম্বরের ঠান্ডাকে উপেক্ষা করে আমি আর তোর বাবা গিয়েছিলাম কালিম্পঙ  জেলার লাভা, লোলেগাঁও আর রিশপ।তোর কফি খেয়ে মনে পড়ে গেলো হোটেলের সেই কফিটার কথা। খেয়ে একবারে গা গরম হয়ে গিয়েছিল।।” আমি একগাল হাসলাম।
“লোলেগাঁওতে  আরেক বিপত্তি। সংসার নামক যাঁতাকলে কলে তো আমরা তখনো এত পিসিং এন্ড পিসিং হই নি,তাই বোধহয় চোখে মুখে তার ছাপও পরে নি।বলতে নেই,তখন  বেশ বাচ্চা বাচ্চাই দেখতে ছিলাম।সেই জন্যই বোধহয় পুলিশের লোকেরা আমাদের ধরে ঠিকুজি-কুষ্ঠী জানতে চেয়েছিলো। হয়তো ভেবেছিলো দুটি নাবালক ছেলে মেয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে!লাভার জিরো পয়েন্টে গাড়ির তেল ফুরিয়ে গিয়ে আর এক অভিজ্ঞতা হয়েছিলো।সে গপ্পো না হয় পরে আর এক একদিন বলবো তোকে।”


আমার আর তর সইছিল না।সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলাম, “আচ্ছা, আচ্ছা ,আজ তাহলে কি বলবে তাড়াতাড়ি বলো।অপেক্ষা করতে পারছি না আর।আমার হিরোইন  মা আর হিরো বাবার গল্প।উফফ!”
“তখন কিন্তু লাভা থেকে রিশপ যাবার রাস্তা খুব দুর্গম ছিলো।কাঁচা,এবড়ো-খেবড়ো সরু রাস্তা চলে গেছে পাইন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে।আর কি খাড়াই রাস্তা!পথের এক একটা বাঁক এতই সরু যে,মনে হচ্ছে এর পর আর রাস্তা নেই। যেন পৃথিবীর শেষ প্রান্তে চলে এসেছি।লাভ থেকে রিশপের দূরত্ব দশ কিলোমিটার।বেলা বারোটার সময় আমরা সেখানে পৌঁছলাম।রিশপ প্রায় সাড়ে আট হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত একটা ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম।এর অর্থ হলো – পাহাড়ের মাথায় একলা গাছে”।
মা কে থামিয়ে আমি বলে উঠলাম,”জানো মা,ফেসবুক এ দেখলাম রিয়ারা রিশপে বেড়াতে গেছে।”
“তবে এখনকার রিশপের সঙ্গে কিন্তু কুড়ি বছর আগের রিশপের কোনো মিল নেই।তখন রিশপ  আক্ষরিক অর্থেই ছিলো ছোট্ট পাহাড়ি  গ্রাম।সে গ্রামে কোনো আধুনিকতার ছোঁয়া  ছিল না।এমন কি বিদ্যুৎ ও  পৌঁছায় নি সেখানে। মাত্র কয়েক ঘর লেপচা জাতির মানুষ আর একটামাত্র হোটেল নিয়ে ছিলো তখনকার রিশপ। কোনো দোকানপাটও ছিলো না।আমাদের হোটেল “কাঞ্চন কন্যা” ছিলো পাহাড়ের চূড়ায়,খাদের ধারে।আশেপাশে আর কোনো বাড়ি ছিল না।চারিদিক পাইন গাছের জঙ্গল আর তুষারশুভ্র পাহাড় দিয়ে ঘেরা।”বলে মা আবার কফিতে চুমুক দিলো।
“বাহ,একবারে রোমাঞ্চকর ব্যাপার।”
“সে যে কি রোমাঞ্চকর তা একমাত্র আমি আর তোর বাবা ই  জানি।”
“কেন?কি হয়েছিল?” অবাক মুখ নিয়ে মার দিকে তাকালাম।
“রিশপকে ঘিরে রয়েছে কাঞ্চনজঙ্ঘা, কাব্রু, সিনিয়ালচু, পান্ডিম সহ নানান শৃঙ্গ৷ এখান থেকে হিমালয় পর্বতমালার একশো আশি ডিগ্রী ভিউ পাওয়া যায়। প্রকৃতির  অপরূপ মনোমুগ্ধকর রূপ দেখে  মুগ্ধ হয়ে গেলাম আমরা।ঝিঁঝিঁর ডাক ছাড়া আর কোনো শব্দ  সেখানে নেই।শহুরে কোলাহলে জর্জরিত আমাদের কান যেন একটু শান্তি পেলো।আনন্দে আটখানা হয়ে পাহাড়ি রাস্তার আঁকে বাঁকে অনেকক্ষণ ঘুরে বেড়ালাম।  ‘ভিউ পয়েন্ট’ থেকে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখলাম।ডুবন্ত সূর্যের লাল আভা যখন পাহাড় চূড়ায় বরফের ওপর পরছিলো,তখন তার যে কি অপরূপ শোভা, তা ভাষায় বর্ণনা করার মতো ক্ষমতা আমার নেই।সূর্য ডুবতেই চারিদিক অন্ধকার আর অদ্ভুত নিস্তব্ধতায় ঢেকে গেলো। এমনকি ঝিঁঝিঁর ডাকও আর শোনা যাচ্ছিল না।সেদিন অমাবস্যা ছিলো।বাইরের নিকষ কালো অন্ধকারের মধ্যে তুষারশুভ্র পাহাড়গুলোকে  মনে হচ্ছিলো যেন সাদা-কালো ছবি। ঘুটঘুটে অন্ধকারে বাধ্য হয়ে হোটেলে ফিরে এলাম।হোটেলের মালিক প্রধানজীর সঙ্গে গল্প করে ওখানকার মানুষদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে অনেক কিছু জানলাম।কি কষ্ট করে ওরা জীবন কাটায়!পাহাড়ের ঢালে চাষবাস করে ওরা জীবনধারণ করে।জলের খুবই অভাব।সামান্য কিছু জিনিস কিনতে হলেও ওদের দশ কিলোমিটার দূরে লাভায় যেতে হয়। তোর মত মুখের সামনে সব কিছু পেয়ে যায় না ওরা। পড়াশোনা করে সব হ্যারিকেনের টিম টিমে আলোয়। বাবু,ওদের অনেক কষ্ট রে।”
আমি আর কি বলবো, সত্যিই তো আমরা কত আনন্দে আছি।
“ছাড় যা বলছি শোন।রাত আটটায় রাতের খাবার আর একটা হ্যারিকেন হাতে ধরিয়ে দিয়ে,  প্রধানজী  গ্রামে তার নিজের বাড়ি চলে গেলেন আর বলে গেলেন কাল সক্কাল সক্কাল  এসে  উনি আমাদের ‘বেড টি’ দেবেন।প্রধানজী চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই বহির্জগত থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম।পৃথিবীর মধ্যে থেকেও আমরা যেন ভিন গ্রহের বাসিন্দা হয়ে গেলাম।কারোর সাথে আর কোনো যোগাযোগ নেই।তখন অতো মোবাইল ও ছিলো না।আর থাকলেও টাওয়ার পাওয়াই যেত না।হ্যারিকেনের তেল শেষ হয়ে যাবে,এই ভয়ে তাড়াতাড়ি খেয়ে  ঘুমিয়ে পড়লাম।”
“যাহ্! এতে আর রোমাঞ্চ কি হলো?”
“আহা!এত অস্থির হলে হবে?আগে তো পুরোটা শোন।তারপর  বলবি।”
“রাত তখন কটা জানি না।হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো।এ দিকে হ্যারিকেনের তেল শেষ।আলো জ্বলছে না।কে যেন  দরজায় ধাক্কা মারছে!আমি তো অবাক !ওতো রাতে আবার কে ? কারা যেন ফিসফিস শব্দে কথা বলছে। বাইরের সেই নিস্তব্ধ পৃথিবী আর নেই।এক তীক্ষ্ণ শীষের শব্দে কান পাততে পারছি না।কে যেন নূপুর পরে আমাদের ঘরের চারিদিকে হেঁটে বেড়াচ্ছে!সেই নিক্কণ ধ্বনি বৃত্তাকার পথে আমাদের ঘিরে রেখেছে।সময়ের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দরজা ধাক্কার শব্দ আর সেই নূপুরের ধ্বনি। শব্দের দাপটে তোর বাবার ও ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো।বাইরে গিয়ে দেখতে চাইছিলো কে ডাকছে? ভয়েতে আমি বেরোতে দিই নি।ভয়ের চোটে লেপের তলায় ঠকঠক করে কাঁপছিলাম আমি। তোর বাবা তবু সাহস করে টর্চ মেরে ওই নিকষ কালো অন্ধকারের মধ্যে কাঁচের জানলা দিয়ে বাইরেটা দেখেছিলো।কিন্তু বিশ্বাস কর কোনো জনমানুষের চিহ্ন সেখানে ছিলো না। “



“সে কি!তাহলে কারা ছিলো ওখানে ?  আমার তো মনে হয় ভূত। আমি হলে ওখানেই …”

“কি আতঙ্কের মধ্যে দিয়ে যে, সে রাত কাটিয়েছি,তা কেবল আমরাই জানি! দুজনে হাত ধরাধরি করে ভোরের আলোর অপেক্ষা করে গেছি।”
“আচ্ছা তোর কি মনে হয় সত্যি ওটা কোনো অশরীরীর কীর্তি?”
“অবশ্যই। নয়তো কি?”
মা একটু থেমে  আবার বলতে শুরু করলো,”ভোর রাতে শব্দের দাপট কমতেই আমরা তড়িঘড়ি করে প্রধানজীর বাড়ি চলে যাই। উনি  প্রথমে অবাক হলেও আমাদের রাতের অভিজ্ঞতা শুনে হাসতে থাকেন।আমরা অবাক হয়ে ওনার দিকে চেয়ে ছিলাম।পরে এর ব্যাখ্যাও দেন তিনি।আসলে হয়েছিল কি, সেদিন রাত্রে ঝড় উঠেছিল।ফাঁকা জায়গায় ঝোড়ো হাওয়া পাহাড় আর পাইন বনে ধাক্কা খেয়ে, প্রতিফলিত হয়ে ওইরকম অপ্রাকৃতিক শব্দের সৃষ্টি করেছিল।”
আমি মনে মনে ভাবলাম ,”প্রকৃতি সত্যিই রহস্যময়ী!”

 

(সমাপ্ত)

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait