একবিংশের বিকর্ণ

একবিংশের বিকর্ণ



অবশেষে কুরুক্ষেত্রের রক্তিম সূর্য ম্লান হয়ে এলো। ফিকে হয়ে আসছে বৃদ্ধ শকুনের পাখা। সে আজ বহুকাল পর তৃপ্ত। ক্রমে তার অবয়ব আকার থেকে বিন্দুতে পরিণত হতে লাগলো। ডানায় যে তীক্ষ্ণ রব প্রতিধ্বনিত করে চলেছিল মৃত্যুর উল্লাস , এখন তা স্তিমিত। 

অনেককাল পর পশ্চিম আকাশে কালো মেঘের বিস্তার। বিদ্যুতের আর বজ্রের আলোয় দূরে দেখা যায়  মৃতের স্তুপ। ধরণীর শোণিত আঁচল দেখে হয়তো মেঘেদের এই  অশ্রুহীন ঘুমরে ওঠা। 

এখানে না আছে সমুদ্র , না আছে নদী , না আছে প্রেম, না আছে জীবন। থাকার মধ্যে রয়েছে নোনা অশ্রুর পলকা স্তর। থাকার মধ্যে রয়েছে হত্যার পর উল্লাস। 
" আমি বিকর্ণ। কৌরব পক্ষের হতভাগ্য যোদ্ধা , যার হাত আত্মীয় রক্তে পরিপূর্ণ।" বিকর্ণের এই আত্ম হাহাকার কেই বা শোনার আছে? কেই বা ছিল সেদিনও …হ্যাঁ সেদিনও! যেদিন অক্ষ ক্রীড়ায় পান্ডবদল সব হারিয়েছিলেন , যেদিন অন্ধ পিতা নির্বাক হয়ে পাঞ্চালীর তীব্র হাহাকার শুনেছিলেন। যে দিন পঞ্চপাণ্ডবের পৌরুষ শকুনির নখের আঁচড়ে ছিন্নভিন্ন হয়েছিল। লুণ্ঠিত হয়েছিল যাজ্ঞসেনীর স্বাধীনতা, তাঁর আত্মসম্মান। ঠিক সেদিন বিকর্ণ তীব্র প্রতিবাদ করে উঠেছিলেন । তার প্রতিবাদের স্বর কালের ইতিহাস মনে রেখেছে কিনা সন্দেহ। তবুও ভাতৃবধুর মান কেবলমাত্র দ্রৌপদীর সম্মান নয়, সম্মানহানী হয়েছিল সুবিশাল মহান দেশ ভারতেরও। 
“ সামন্ত-পঞ্চকে মহাযুদ্ধ ধর্মের সাথে অধর্মের যুদ্ধ। কুরুক্ষেত্রের এই যুদ্ধে আমি আমার দুরাচার ভাইদের পক্ষ  নিলাম। বিধাতা কিন্তু কেন আমার সাথে পরিহাস! হে কেশব আর কত নেবে পরীক্ষা? “ 
রোদন ভরা কণ্ঠে বিকর্ণ আস্তে আস্তে বসে পরলেন রক্তে ভেজা সামন্ত পঞ্চকের মাটিতে। যুদ্ধ শুরু হতে, রক্তে ভিজতে এই রাতের অন্ধকার তাকে ক্রমশ গ্রাস করে নিচ্ছে।

ADVERTISEMENT

 


মৃত্যুর করাল গ্রাসে আজ ঘুমিয়ে আছে প্রতিবিন্ধ্য, সুতসোম , শ্রুতকর্মা , শতানীক , শ্রুতসেন। বেঁচে গেছেন পঞ্চপাণ্ডব , লজ্জায়  মুখ ঢাকতে হয় নি বিদেহীকে। কী উত্তর দিতেন তাঁদের পিতারা? কেন পারে নি তাঁদের মা’কে নির্লজ্জদের হাত থেকে রক্ষা করতে সেই রাত্রে? অক্ষ ক্রীড়ায় কথার দাম বড় , না , নারীর মানসম্ভ্রম আব্রু্র মুল্য? আর দেশ , সে তো কিছু সীমানার রেখা মাত্র। কিন্তু এই সীমানার কাঁটাতারে আবদ্ধ একটুকরো ভূমি-দেশ ঠিক যেন দ্রৌপদীর মত। সকল অত্যাচার সহ্য করেও বুক দিয়ে আগলে রেখেছেন আপন সন্তান স্নেহে  সু আর কু পুত্র-কন্যাদের।
পুরাণে সেই কবে পুঁথিধারীরদল মৃত ঘোষণা করে গেছেন ধৃতরাষ্ট্রের একমাত্র প্রতিবাদী পৌরুষ বীর্য বিকর্ণকে। 
সমুদ্রের জল হাজার হাজার বছর ধরে বাষ্পীভূত হয়েছে , পাহাড়ের চূড়ায় সুখের সংসার বেঁধে পুনরায় ঝাঁপিয়ে পরেছে শুষ্ক চোখের মত মাটির বুকে।  এই কণার সাথে কণার নিয়ত মিলনে প্রতি যুগেই এসেছেন কৌরব বংশের উদার অথচ উপেক্ষিত চরিত্র বিকর্ণ।
হ্যাঁ আমি সজ্ঞানেই বলছি হে বিধাতা , হে জন-মানব।  বিকর্ণ আজও আছে বেঁচে – সীমান্তে কিংবা সিয়াচেনের তুষার ভূমিতে সর্বদা সঙ্গিন ধরে। হে নারী তোমার গর্ভস্থ শিশুর স্পন্দন একটিবার কান পেতে শোনো। পাচ্ছ শুনতে?  জানি জানি, আমি জানি তুমি বা তোমরা কানপেতে আছো ভ্রূণের আগমনের অপেক্ষায় । তারপর হয়ত , পাঁজি খুলে হিসেবে বসবে …। নয়ত , কোন এক নিশীথের সাথে পাল্লা দিয়ে তোমার বা তোমাদের অন্ধ হৃদয় আস্তাকুড়  খুঁজবে।
আর মনে মনে অভিসম্পাত করে বলবে , “ এই যে মশাই বড্ড যে বলেছিলেন বিকর্ণ আসছে। ছিঃ ছিঃ বিকর্ণ কবে হল মেয়ে… আপনি একটি মিথ্যাবাদী।“

সত্যি বলছি আমি ভেবেই বলছি ধৃতরাষ্ট্র পুত্র বিকর্ণ হয়ত নারীই ছিল। মননে নারী ছিল বলেই একবার হলেও তীব্রতা ভেসে এসেছিল তার কণ্ঠে। বুঝেছিল নারীর যন্ত্রণা। 

বিকর্ণের কোন লিঙ্গ নেই। লিঙ্গ পরিচয় নেই। সে কেবলই মানুষ, এটা ভেবে নিতে কী খুবই কষ্ট হবে হে মাননীয়-মাননীয়রা!?

যা বলতে গেছিলাম। দুঃখিত পাঠকবর্গ। এবার বলি।  এত সহজ ছিল না যদিও কাজটা। যাত্রাপথ দীর্ঘ, অতি দীর্ঘ। কণ্টকময় তার ইতিহাস, তার গতিপথ। 
ইংরেজের গুলিতে মারা গেছিলেন অনেকবার বিকর্ণ। বিকর্ণের রক্ত যতবার ভারতের মাটিকে লাল করেছিল ততবার কেঁদে উঠেছিল দেশমাতৃকা। আর তার চোখের অশ্রুকে বুকের শক্তি করে পুনরায় জন্ম দিয়েছিল আরেক দল বিকর্ণদের। একটাই আশা যদি তার শৃঙ্খল মুক্ত হয় , যদি আসে স্বাধীনতা। বিকর্ণের দল ঠিক সেই মহাভারতের কাল থেকে সেদিনও করেছিলেন প্রতিবাদ। এসেছিল স্বাধীনতা। কিন্তু তারপর? তারপরও সময়ের চক্র উত্তর খুঁজে ফেরে। খুঁজে ফেরে স্বাধীনতার অর্থ। 

 


সকালে দৌড়াতে বেরিয়েছিল মেয়েটি। অদূরেই প্রবাহমানা আদি অনন্ত কালের স্রোতস্বিনী গঙ্গা। অনাদিকালের ইতিহাসের সাক্ষী ; পিতামহ ভীষ্ম যখন শর শয্যায় নিজের মৃত্যুর জন্য প্রতীক্ষমাণ তখন মাতা গঙ্গা তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন হয়তো , “ হে অনন্ত মহাপ্রাণ , আমার সন্তান হয়েও তুমিও কী একবারের জন্য প্রতিরোধ করতে পারো নি। কৌরবের সম্মান তোমার সম্মান, কিন্তু নারীর মর্যাদা!”
চোখের দু’পাশ দিয়ে যে অশ্রু নির্গত হয়েছিল মহা তপস্বীর  , দেবী গঙ্গা হয়ত বুঝেছিলেন। তরঙ্গিণীর হৃদয় হয়তো অনুভব করেছিল , ভীষ্ম কী চাইছেন বলতে। হয়তো মনে প্রানে মহীরুহ পিতামহ একবারের জন্য সাধুবাদ দিয়েছিলেন পৌত্রসম  বিকর্ণকে।

সময়ের লয়ে তার আপন ছন্দে শিবালিকের জমাট তুষারের বক্ষ ভেদ করে এখনও বয়ে চলেছেন গঙ্গা-যমুনা। আর ছায়ার মত পরিভ্রমণ করে সেই মেয়েটা। পরিভ্রমণ আজকের নয়, বহুকালের। কুন্তি থেকে  দ্রৌপদী থেকে গায়েত্রী  আরও কত নারীর, যাদের গ্রাস করেছে মহাকালের চক্র।

আজও আরেক ঊষা। এদিক ওদিক পথচারী।  ঠিক তখনই উন্মত্ত দুর্যোধনেরা প্রভাতের নির্মল আলোয় প্রারম্ভ করে একবিংশের অক্ষ ক্রীড়া। অদূরেই স্থবির হয়ে যায় বর্তমানের পাণ্ডবকুল। 
 হাজার হাজার বছরের রক্তবীজরা পাঁজাকোলা করে নিয়ে যায়  সকলের পাঞ্চাল রাজকন্যাকে -আড়ালে।  আর সেই সকালেও বিকর্ণ উন্মাদের মত দৌড়েছিল দ্রৌপদীকে বাঁচাতে , দেশের আরেক লজ্জার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি রোধ করতে। পেরেছিল কী?
একবিংশ শতকের বিকর্ণ চীৎকার করে সেই ভোরে জাগিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন একুশ শতকের শহরবাসীকে , “ এই কী স্বাধীনতা? আর কতকাল পাঞ্চালীরা , দেশমাতৃকা অন্যায়ের শিকার হবে ? আমি ক্লান্ত । আমি বিধ্বস্ত উন্নত স্বাধীন ভারতের ধৃতরাষ্ট্র! একবার তো চোখ খোল পিতৃকুল।“

কোথায় কেশব আজ? কোথায় মোহন বংশীধারী মাধব?  চোখের বাঁধন কোন ধর্ম মতে আজও পরে রয়েছন গান্ধার কন্যা? সেদিনও যদি একটিবার উন্মোচন করতেন, যদি একটিবার স্বামীকে প্রভু না ভেবে সঙ্গী মেনে পরামর্শ দিতেন  
 পথের কোণে পরে থাকে একবিংশের পাঞ্চালীর দেহ। বৃদ্ধ পিতামহ দেবব্রত আজও নীরবে চোখের জল ফেলে যান। আঠারো দিনের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ সাড়ে তিনশো বছরের পরাধীনতার রক্ত এখনও বহন করে নিয়ে যায় গঙ্গা মহা সমুদ্রের উদ্দেশ্যে। 
স্বাধীনতা তোমার অর্থ কী? কারণ কী? লাভ কী? প্রশ্নগুলি আজও বাতাসে জাগায় লয়হীন প্রশ্ন। বিকর্ণের মনে প্রশ্ন!

শকুনির মত স্বার্থান্বাষীরা অনন্তকাল ধরে এই বসুন্ধরার বুকে পাশা খেলে আসছে। দুর্যোধনের মত দুর্বল মানুষের হৃদয় থেকে সুযোগ বুঝে তীক্ষ্ণ নখের আঁচড়ে আবেগের গরিমা ক্ষুণ্ণ করেছে বৃদ্ধ শকুনিরা। একা বিকর্ণ পারবেই বা কি করে?

আজ বহুকাল পর শহর ভিজে চলেছে বৃষ্টির চোখের জলে। যে অশ্রু কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে হয় নি , যে অশ্রু মুছে দিতে পারেনি রক্তধারা ।  ঠিক সেদিন থেকে হয়তো মেঘ থেকেছিল গুমরে কিন্তু আজ অকাল বর্ষণ …এ শান্তির-সৃষ্টির বর্ষণ , না , হৃদয় ভাঙা অশ্রু ?
 গঙ্গার জল বিস্তার লাভ করছে …পরিপূর্ণ হয়ে উঠছেন বারিধারায় । যে নদীগুলো হারিয়েছিল নাম , আজ তারাও খলখল ছলছল রবে মায়ের বুকে লীন হয়ে চলেছে ।
যে পাঞ্চালী পথের কোণে আবর্জনার স্তুপে মুখ গুঁজে পরেছিল , বৃষ্টি লেগেছে তার দেহেও। শান্ত হচ্ছে তনু। 
চমকে ওঠে মেয়েটি! কে তার হাত ধরে! কে তার নগ্ন দেহে দেয় ছেঁড়া এক খানি বস্ত্র। তবে কী গান্ধারী আজ চোখের বাঁধন খুলেছেন। 
চকিতে তাকায় ভীরু হরিণ শিশুর মত ওদের মুখপানে। ঘোলাটে চোখে অশ্রু রাশি রাশি ; এ যে বিকর্ণ , এ যে কেশব , এ যে রাধা , এ যে গায়েত্রী , এরা যে পথের শিশুকিশোর । এরাই মাধব , আগামীর প্রতিনিধি । এদের হাতে নেই মোহন বাঁশী , নেই হাতে কাঁচের কাঁকন। এদের ঠোঁটে সেই জেদ , হৃদয়ে সেই উষ্ণতা যার কাছে নতি স্বীকার করবে শকুনিরা- দুর্যোধনেরা । এরা একবিংশের বিকর্ণ ।
এই বিকর্ণেরা আবহমানকাল প্রতিবাদ করে , নিভৃতে কাঁদে , কালের পাতায় গোত্র-নাম সবই হারায় । তবুও পাহাড়ের বুকে আছড়ে পরে মেঘ। বৃষ্টি হয়ে ঝাঁপিয়ে পরে সেই নামহীন  এরা একবিংশের বিকর্ণ। কাল মহাকালে লীন হবে । ভাষা এঁকেবেঁকে কালের মত অবয়ব নেবে । বিকর্ণ রূপ পরিবর্তন করবে । অন্যায়ের প্রতিবাদ থেকে যাবে একই ।। ( সমাপ্ত )

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait