ভ্রমণ কাহিনী : সান্দাকফু - হাতের কাছে স্বর্গ

ভ্রমণ কাহিনী : সান্দাকফু - হাতের কাছে স্বর্গ

মার্চের শেষ সপ্তাহ৷ ছেলেমেয়েদের সব পরীক্ষা শেষ ৷ মন চায় না আর ঘরে বসে থাকতে৷ তাই এই ভ্রমনপিয়াসী মনটাকে নিয়ে সাথে পরিবারের ১২জন সদস্য নিয়ে চেপে পড়লাম বাগডোগরার প্লেনে৷

ভোর সাড়ে ৫টায় গাড়িতে মালপত্র গুছিয়ে রওনা দিলাম দমদম বিমান বন্দরের উদ্দেশ্যে৷ সকাল ৯টার প্লেন৷ একঘন্টা দশ মিনিটে পৌঁছে গেলাম বাগডোগরা আগে থেকেই আমাদের দুটো গাড়ি বলা ছিলো ৷ তাই খুব তাড়াতাড়ি দুটো গাড়িতে আমাদের সব লাগেজ চাপিয়ে চললাম প্রথম গন্তব্য দার্জিলিং এর উদ্দেশ্যে ৷ আমাদের পরিবারের সবারই যদিও দার্জিলিং এর আগে ঘোরা হয়ে গেছে তবুও আরেকবার এসে পৌঁছলাম সেই পুরনো স্মৃতির ঝুলি হাতড়ে কিছু মধুর স্মৃতি তুলে নিয়ে আসার উদ্দেশ্যে ৷ তিনরাত দার্জিলিং এ কাটিয়ে চললাম আমাদের স্বপ্নের রাজ্যে ৷ স্বপ্নের রাজ্যটির নাম এর আগে অনেকের মুখেই শুনেছি ৷ তার রূপের বর্ননাও পেয়েছি ৷ কিন্তু নিজের চোখে দেখার উদ্দেশ্যে এবং তার রূপের মাদকতায় নিজেকে আসক্ত করতে চললাম সান্দাকফু ৷

ADVERTISEMENT
খুব সকালে তাড়াতাড়ি উঠে হোটেলে সকালের জলখাবার খেয়ে সবাই মিলে হইহই করে উঠে বসলাম দুটো গাড়ীতে উত্তেজনাকে সঙ্গী করে৷ মনের মধ্যে তোলপাড় করছে সান্দাকফু ৷

প্রথম গেলাম মানেভঞ্জন৷সব গাড়ী এই পর্যন্তই আসে৷ এখান থেকে আলাদা করে গাড়ী বুক করতে হয়৷ল্যান্ডরোভার,মাহিন্দ্রা থর আর বোলেরো একমাত্র সান্দাকফু যাওয়ার অনুমতি পায় ৷ এখানে এসেই গাড়ী বুক করতে হয়,অগ্রিম বুকিং এর কোনো ব্যবস্থা নেই ৷ প্রতিটি গাড়ীতে ছয়জনের বেশী পারমিশন পাওয়া যায় না ৷ এই মানেভঞ্জন থেকেই সিঙ্গালিলা ন্যাশনাল পার্কে ঢোকার টিকিট নিতে হয়৷সঙ্গে ক্যামেরাও এন্ট্রি করতে হয় ও তার জন্য চার্জ দিতে হয় ৷ আমাদের জন্য দুটি গাড়ী একটি ল্যান্ডরোভার ও একটি থর গাড়ী বরাদ্দ হলো ৷  সমস্ত লাগেজ আবার এই গাড়ীতে চাপিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু হলো স্বপ্নের দেশ সান্দাকফুতে ৷মানেভঞ্জন থেকে সান্দাকফু ৩১কিলোমিটার রাস্তা,শুরু হলো পথচলা ৷

মানেভঞ্জন থেকে ৩ কিলোমিটার প্রচন্ড চড়াই পথ অতিক্রম করার পর প্রথম বিরতি চিত্রে তে ৷ চোখ জুড়িয়ে গেল, চিত্রের অপরূপ সৌন্দর্য মন ভরিয়ে দিল ৷ এখানে পনেরো মিনিট গাড়ী বিশ্রাম নেওয়ার পর আবার শুরু হলো পথচলা ৷ পথের পাশে মাঝেমাঝেই ট্রেকিং রুট এসে মিশছে আবার আলাদা হচ্ছে ৷ কিছুটা যাওয়ার পর রাস্তার পাশে অদ্ভুত এক ধরনের ফুল দেখে অবাক হয়ে গেলাম৷বড় বড় গাছে কোনো পাতা নেই,শুধু পদ্মফুলের মত সাদারংয়ের ফুল ৷ ড্রাইভারকে জিঞ্জাসা করে জানতে পারলাম এটা ম্যাগনোলিয়া ফুল ৷ এ এক অপরূপ দৃশ্য ৷ মুখে বর্ননা করা যায় না ৷ দুরে পাহাড়ের গায়ে সাদা হয়েআছে ম্যাগনোলিয়া ৷ আবার কখনো কখনো হাতের নাগালের মধ্যেই তাকে ছোঁয়া যায়৷কিছুটা এইভাবে যাওয়ার পর আরো এক বন্ধু সঙ্গী হলো আমাদের৷লাল রংয়ের রোডোডেনড্রন ৷ অদ্ভুত রং এর বাহার,সাদা ম্যাগনোলিয়া আর তার সাথে লাল রোডোডেনড্রন ৷ এরপর এলো সাদা রোডোডেনড্রন ৷ যদিও এই সময়টায় প্রচুর রোডোডেনড্রন দেখতে পাওয়া যায় না ৷ তবুও যা দেখলাম তাতে দুচোখ ভরে গেলো ৷


আবার একটু বিরতি টুংলুতে ৷তবে এই বিরতি বেশিক্ষনের জন্য নয়৷শুধু অনেকক্ষন বসে থাকার থেকে সামান্য নিস্কৃতি৷পাঁচ মিনিটের মধ্যে প্রচুর কুয়াশা এসে আমাদের সবাইকে ঢেকে দিলো ৷ এক অদ্ভুত অভিঞ্জতা ৷ আবার চলার শুরু ৷ চড়াই উতরাই করতে করতে আর সিঙ্গালিলা ন্যাশনাল পার্ক অতিক্রম করে আমরা এসে পৌঁছলাম টুমলিং এ৷সত্যিই অসাধারন প্রকৃতির দৃশ্য ৷ অনেকটা ফাঁকা জায়গা,সঙ্গে কুয়াশাঘেরা সকাল আর কিছু হোমস্টে৷যারা ট্রেকিং করে আসেন তারা অনেকে এখানের হোমস্টেতে প্রথম রাত কাটান ৷

কিছুক্ষন বিশ্রামের পর আবার চলার শুরু ৷ এরপর এসে দাঁড়ালাম গৈরিবাসে ৷ এখানে সবাই মিলে খেলাম চা কফি সাথে মোমো ৷ এদিকে শুরু হয়েছে বৃষ্টি ৷ সংগে গরম গরম চা কফি আর মোমো……আহাঃ অপূর্ব শান্তি ৷ এই গেরিবাস পর্যন্ত মানেভঞ্জন থেকে ১৯কিলোমিটার রাস্তা গত একবছর হলো তৈরী হয়েছে ৷ এরপর আবার চলা শুরু বাকি ১২কিলোমিটার বোল্ডার ফেলা রাস্তার ওপর দিয়ে৷মাঝে মাঝে আবার কাদা রাস্তা৷রাস্তার পাশের প্রিমুলা ফুল,রোডোডেনড্রন আর ম্যাগনোলিয়া পথের কষ্ট অনেকটা লাঘব করে৷ এই গৈরিবাসেও আছে কিছু হোমস্টে।

এরপর এল কালপোখরি ৷ এখানে একটা খুব ছোট কালো জলের জলাশয় আছে ৷ তাই এর নাম কালপোখরি ৷ কালপোখরির কিছুটা পরেই এলো আমাদের অনেক অভিপ্রেত সেই সান্দাকফু৷ যখন এলাম তখন ভীষন বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে ৷ আমাদের রুম আগেই বুক করা ছিলো সানরাইজ হোটেলে ৷ হোটেলটি যথেষ্ট ভালোমানের ৷ হোটেলে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে হোটেল কতৃপক্ষ গরম গরম স্যুপ ও গরম গরম জল পানের ব্যবস্থা করে দিলেন৷ এই ঠান্ডায় এইগুলো যেন মনে হলো অমৃত৷ আমাদের ক্লান্ত শরীরে যেন নতুন করে আবার উদ্যম জেগে উঠলো ৷ আমাদের পছন্দমত খুব সাধারন খাবারের মেনু দুপুরের লাঞ্চের জন্য বলে দিয়ে হোটেলের সামনেই বেরিয়ে পড়লাম বৃষ্টির মধ্যে ৷ এই জায়গায় বলে রাখি,এখানে কিন্তু শুধু দুপুরেই চিকেন পাওয়া যাবে আর রাত্রে খাবারে ডিম ৷ কিন্তু অনেকসময় এইরকমও হতে পারে যে শুধুই ডিম পাওয়া যায়৷ কিন্তু ম্যাগি বা নুডুলস সবসময়ই পাওয়া যায় ৷


দুপুরে ডাইনিং হলে খেতে খেতেই বাইরের দিকে হতাশ নয়নে সবাই তাকিয়ে আছি,যে কখন আবহাওয়া পরিস্কার হবে ৷ মনের মধ্যে আশা এবং বিশ্বাস নিয়েই সবাই বললো কাল নিশ্চয়ই আমরা এভারেষ্ট ও কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পাবো ৷ কিছু পরে সন্ধের মুখে কিছু পর্যটক আবার এলেন আমাদের হোটেলে৷অনেকের সাথেই আলাপ পরিচয় হলো এবং অনেকেই তাদের অভিঞ্জতা আমাদের সাথে বিনিময় করলেন ৷


ধীরে ধীরে রাত বাড়তে লাগলো ৷ কিন্তু আবহাওয়ার কোনো পরিবর্তন হলো না৷ আরো অনেক রাত্রে শুরু হলো তুষারঝড় ৷ প্রথম অভিঞ্জতা হলো তুষারঢঝড়ের গতিবেগ,তার আওয়াজ এর সাথে৷এর সঙ্গে বন্ধুর মত যোগ দিয়েছে ঘন অন্ধকার ৷ কারন সান্দাকফুতে রাত ৯.৩০টার পর ইলেকট্রিক থাকে না ৷ সারারাতটাই একইভাবে কাটলো ৷ জানলার কাঁচে আওয়াজ পাচ্ছি বরফ পড়ার ৷


পরেরদিন দেখলাম পুরো জায়গাটাই বরফে ঢেকে গেছে৷ কিন্তু আবহাওয়ার কোনো পরিবর্তন নেই৷ সবারই মন খুব হতাশ৷ আগের দিন সন্ধায় যে পর্যটকেরা এসেছিলেন তারা সবাই একে একে বিদায় নিলেন৷ দুপুর ১২টা নাগাদ অবশেষে সূর্যের দেখা পাওয়া গেলো৷ কিন্তু কোথায় এভারেষ্ট আর কোথায় কাঞ্চনজঙ্ঘা? যেটা হলো সেটা আরো মন খারাপ করে দিলো৷ সব বরফ দুঘন্টার মধ্যে গলে জল হয়ে গেলো৷ এর কিছুক্ষন পর আবার পর্যটকদের আগমন শুরু হয়ে গেলো৷ কিন্তু হোটেল কতৃপক্ষ সবসময় আমাদের আশা জুগিয়ে যাচ্ছেন৷ বললেন, প্রার্থনা করুন যেন আরো বেশী ঝড় ও তুষারপাত হয়৷ তা হলে কাল ঝকঝকে আকাশে নতুন সুর্য উঁকি মারবে৷ যত রাত বাড়ে আবহাওয়া তত খারাপের দিকে যায়।


অবশেষে ভোর ৫.৩০নাগাদ সেই নতুন সুর্য আকাশে উঁকি মারলো৷ সবাই হৈ হৈ করে হোটেলের ছাদে গিয়ে দেখলাম স্বর্গকে৷ বাঁদিকে এভারেষ্ট আর ডানদিকে কাঞ্চনজঙ্ঘা৷ সূর্যের প্রথম আলো এসে পড়লো এভারেষ্টে৷ কি অপরূপ সে দৃশ্য৷ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এভারেষ্ট৷ আস্তে আস্তে সেই আলো এসে পড়লো কাঞ্চনজঙ্ঘায়৷ এর আগে এত সামনে থেকে এত বিরাটভাবে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখিনি৷ প্রকৃতি শিক্ষা দিল, জীবনে অনেক ঝড় আসবে,কিন্তু হেরে যেও না, ধৈর্য রাখো৷ নতুন সকাল আসবেই আসবে৷ আর সবকিছু সহ্য করার পর যে সকাল আসবে যে তোমার কল্পনার বাইরে৷
এই সুন্দর সকালকে মনের গভীরে ফ্রেমে বাঁধিয়ে নিয়ে ফিরে যাবার জন্যে প্রস্তুত হলাম আমাদের গন্তব্য কোলকাতায়৷ কল্লোলিনি কোলকাতা,তিলোত্তমা কোলকাতায় ৷

মনে রাখবেনঃ—মানেভঞ্জন থেকেই সান্দাকফু যাবার গাড়ী বুক করতে হবে৷ কোনো অগ্রিম বুকিং হয় না৷ দুপুর ২টোর পর কোনো গাড়ী মানেভঞ্জন থেকে আর ছাড়ে না৷  সান্দাকফুতে ইলেকট্রিসিটি সন্ধা ৬টা থেকে রাত সাড়ে ৯.৩০টা ৷ অযথা অনেকরকম খাবারের বায়না না করাই শ্রেয় ৷ কারন সমস্ত সরঞ্জাম অনেক নীচে থেকে অনেক কষ্ট করেই আনতে হয় ৷ খাবার জল,চকোলেট,বাদাম,বিস্কুট সব মানেভঞ্জন থেকেই নিয়ে নিবেন ৷ কারন সান্দাকফুতে অনেক দাম দিয়ে এগুলো কিনতে হয় ৷

 

কোথায় থাকবেনঃ— থাকার সবথেকে ভালো জায়গা সানরাইজ হোটেল ও শেরপা শ্যালেট৷ এ ছাড়া ট্রেকার্স হাটও আছে৷ আর কয়েকটা হোমস্টে আছে৷

 

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait