নি-ছক আলাপ

নি-ছক আলাপ

সময়টা ছিল আষাঢ় মাস। আকাশের অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। মালিনী সক্কাল সক্কাল উঠে ফ্রেশ হয়েই বেরিয়ে পড়ল অফিসের পথে।  রোজকার মত  আজও তাড়াহুড়ো করেই বেড়িয়ে পড়ল সকাল ৭:২০ বাসটা ধরবে বলে। 
সেদিন বাসে খুব একটা ভীড় ছিলনা বললেই চলে। সামনের দিকের কয়েকটা সিট ছেড়ে জানলার ধারে সিটটিতে গিয়ে বসল । জানলার দিকটা বড্ড প্রিয়। একই রাস্তা , সারসার দোকানপাট ,নানা মানুষের কর্মব্যস্ততা রোজই দেখে। নতুন না হলেও মালিনী তাও দেখে। সময় কেটে যায়। পাশেই ব্যাগটা রাখল। 
বাসের চাকা ভিড় এড়িয়ে এগিয়ে চলে। নির্দিষ্ট জায়গায় খস্‌ করে ব্রেকের শব্দ । অফিসের বাসস্টপের একটু আগে উঠল নিখিল। সুপুরুষ, শরীর-স্বাস্থ্য বেশ ভালোই,ডিপ মভ কালারের একটা ফরমাল শার্ট, হাতে ঘড়ি, চোখে চশমা একদম রাজপুত্তুরের মত দেখতে লাগছিল।  এককথায় বাবা মায়ের আদরের ছেলে আর কি । 
মালীনির কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল নিখিল ,”আচ্ছা ম্যাডাম ব্যাগটি কি আপনার?” 
জানলা থেকে মুখ সরিয়ে উত্তর আসে,”হ্যাঁ।“  ব্যাগটি নিজের কোলে তুলে নিখিলের উদ্দেশ্যে  খানিকটা নীচু গলায় মাথাটা একবার কাত করে বলল,” বসুন।“  
মালীনির অফিসে আজ নিখিলের প্রথম দিন নয়। না! মালিনী এই অফিসের বস্‌ নয়। ওখানে দেখতে দেখতে দু’টি বছর টানা কাটিয়ে দিয়েছে । অবশ্য নিখিলের জয়েনিং এখানে হলেও অন্য ডিপার্টমেণ্টে ছিল । কিছুমাস হল দুজনাই একই ডিপার্টমেণ্টে কাজ করে চলেছে ।
অফিস থেকে খুব একটা দূরে বাসস্টপ না । সুতরাং পা চালিয়ে দুজনে একই সাথে অফিসে ঢুকল। খুব স্বল্প সময়ে আলাপচারিতা দুজনের। আগেও হয়েছে । তবে সেটা বলার মত নয় । কয়েকবার ক্যান্টিনে চোখাচোখিও হয়েছে । ব্যাস ওই পর্যন্তই । 
যদিও নিখিলকে আজ বাধ্য হয়েই বাসে আসতে হয়েছে। কারণ তার ভাই আজ বাইক নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে যাবে ঠিক করেছে। 

 

ADVERTISEMENT
Tuhu Momo Video Teaser


প্রাইভেট কোম্পানি । ফেরার সময়ের ঠিক থাকে না । অফিসের কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরবে বলে মালীনি দাঁড়িয়ে আছে বাস স্ট্যান্ডে। ক্লান্ত শরীর ।  সিগারেট খেতে খেতে হঠাৎ নিখিল দেখল মালীনিকে। সিগারেটটি ফেলে কাছে গেল। অনেক মেয়েরা  স্মোকিং পছন্দ করে না। নিখিল যদিও এইসব পরোয়া করে না। তবে আজ কেন ফেলে দিল বেশ দামী ব্র্যান্ডের সিগারেট সেটা ভগবান জানে!
“হাই ম্যাডাম“-  খানিকটা উঁচু গলায় বলে। মালীনি পিছন ফিরতেই দেখল নিখিলকে। 
মুচকি হেসে মালীনি বলে,” হ্যাঁ বলুন।“ 
উত্তরে জবাব আসল, “ তেমন কিছু না, বলছি একটা চা খাবেন !” 
সকাল থেকেই মুখটা গোমড়া । সন্ধ্যের আলো আরেকটু গভীর হতেই ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি নামলো । মাটির বুক থেকে মায়াময় সোঁদা গন্ধ । 
কিছুই না বলে মালীনি ধীর গতিতে এগিয়ে চলল  চায়ের দোকানের দিকে। অনেকদিন পর নিখিল ভালো করে দেখলো মালিনীকে । আজ ওর গায়ে হালকা সবজে শাড়ি । বেনুনীটা খুব একটা মোটা না হলেও বেশ সুন্দর ভাবে পিঠের সাথে লেপটে আছে । নিখিলের নাকের কাছে ঘুরে ফিরে আসছে হাল্কা অথচ মিষ্টি একটা গন্ধ । হয়তো পারফিউম ! ইটালিয়ান মনে হয় !
 ভাঁড়ে চুমুক দিয়ে দুজনের হালকা চালে গড়িয়ে চলে কিছু কথা । পুরুষের মন নাকি পলকা । মেয়েদের গভীর । বোঝা দায় ! কে যে এই জটিল তত্ত্ব উদ্ভাবন করেছে তা জানা মুশকিল । হয়তো সময় এই পরিসংখ্যানের নির্মাতা । তবে এই কথাটা বেশ জোর দিয়েই বলা যায় যে, নিখিল যাকে এতদিন খুঁজে চলেছিল তা আজ পেয়েছে । মনের মানুষ ।  
মন যেন বলছে, “নিখিল এগিয়ে চল। এই তো তোর সামনে । সাহস করে একবার বল ।“
নিজের অজান্তেই ঠোঁটের কোণে ঝুলে থাকে হালকা হাসি । মালিনীর না দেখারই কথা সেই হাসি । বোঝার কথাও নয় হাসির অর্থ ।
  সন্ধ্যে থেকে রাত নেমে এসেছে। আকাশও তার রং পরিবর্তন করে ফেলেছে ইতিমধ্যে । গাঢ় কুচকুচে কালো রং । তুমুল বৃষ্টি আসার অপেক্ষা রইলো না। ফোঁটা ফোঁটা থেকে চড়বড়িয়ে ধুম বৃষ্টি  । দুজনেই আটকা পড়ল চায়ের ঘুমটিতে।  নিখিলের কোন তাড়া নেই । মনের কথা বৃষ্টি বুঝেছে । সময়ও দিচ্ছে । 
মালিনীর মন পরে আছে বাড়ির দিকে । বাবা বাড়িতে একা । মালিনী না গেলে ওষুধটাও খাইয়ে দেবে তেমন কেউ নেই । মায়ের মুখটা আবছা মনে পরে । স্কুলের চাকরী আর ছোট্ট মেয়ের দেখভাল একাই সামলিয়েছেন শ্যামলবাবু । আর এখন ! এখন সেই মেয়েই  ছোট্ট হয়ে যাওয়া  বাবাকে প্রাণ দিয়ে সারিয়ে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে । 

 

 

৩ 
কিছুক্ষন পর বৃষ্টি থামতেই হাঁটা লাগালো দুজনে। 
পরের দিন সকাল হতেই  তড়িঘড়ি উঠে পড়ল নিখিল। বাইক আপাতত স্থগিত । আজ সে বাসে করেই অফিসে যাবে। নাকে মুখে কোনরকমে জলখাবার গুঁজে বেরিয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ব্যাতিব্যস্ত হয়ে পড়ল । ঘড়িটা মনে হচ্ছে বেশ জোরেই কাটা ঘোরাচ্ছে । দেখছে আর বিড়বিড় করে কি যেন একটা বলে চলেছে নিখিল।
 কিছুটা সময় পর বাস আসল। বাসে উঠেই চারিদিকে চোখ বুলিয়ে দেখল । মালীনি নেই ! মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল নিখিলের । ভাবতে থাকে, বোধ হয় আমার আগেই মালিনী চলে গেছে অফিসে। 
অফিসে ঢুকতেই কানাঘুষো শুনতে পেল । বিয়ের কথা। মালীনির বিয়ে। কাল সে অফিসে এসেছিল রিজাইন লেটার দিতে। মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল। আর হয়তো দেখা হবে না তাদের । 
“ দেখা হয় নি আর ?” পাশ থেকে ফুট কাটে তিতিন । নিখিলের মেয়ে । কলেজে পড়ে । বাপকা বেটি । নিখিল মনে করে ছেলেমেয়ের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক থাকা উচিৎ। গোপনীয়তা যত কম থাকবে বিপদও উঁকি মারবে কম । 
খানিক পরেই মধুর অথচ জড়ালো ডাক “কই তোরা খাবি আয়।”  
ইটালিয়ান গন্ধ ঘরের কোণায় । নিখিল বিয়ের পর ওই ব্র্যান্ডই কিনে দিয়ে এসেছে । আজও সেই ধারা অব্যাহত । খোলা চুল । চুল খুলে রাখার অভ্যাস করে নিয়েছে নিখিলের মিসেস । 
বিয়েটা সেদিন হয় নি । বাবার মৃত্যু । বাগদত্তা মেয়েকে ছেড়ে বিদেশেই পাড়ি দেয় মালিনীর হবু বর । একা মহিলা । সুন্দরের পাশাপাশি হিংস্রতা নখ বার করে শান দেয় । মালিনীর মুখে যেদিন অ্যাসিড ছোঁড়ার খবর কানে আসে নিখিল হসপিটালে পৌঁছাতে দেরী করেনি ।
নিছক আলাপ থেকে গভীরতা । সান্নিধ্য থেকে মনের স্পর্শ মালিনীর বুকেও জেগে ওঠে । অর্ধ পোড়া বুকেও বেঁচে থাকার মানে নি-ছক বাঁচা নয় । বরং ভালো করে বেঁচে থাকা । নি-ছক প্রেমের আবছায়াতেই  বিয়ের ছক কাটতে দেরী করেনি নিখিল ।

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait