গল্প প্রতিযোগিতা  অচেনা তিথি

গল্প প্রতিযোগিতা অচেনা তিথি

সকাল সকাল ঘুমটা ভেঙে গেলো তিথির, আসলে  জানলার একটুখানি চুলচেরা ফাঁকটা  দিয়ে একটা আলোর রেখা সকাল সকাল ই তিথির চোখে ঘুমের দফা রফা করে দিয়েছে । ছেলেটা পাশে অঘোরে ঘুমোচ্ছে । কোনো রকমে ঘুম ঘুম চোখে পাশ ফিরে শুলো সে । খেয়াল হল , এখনো ঘুমটা হবার দরকার ছিল। রাতে ঘুম আসতে দেরি হয়েছিলো । ইন্দ্র টা আসলে এখনো এত বাচ্চা , মাঝে মাঝে একটু কড়া না হলে ওকে সামলানো মুশকিল হয়। বিয়ের ১০ বছর হয়ে গেছে কিন্তু ইন্দ্র যেন পরে রয়েছে আজ থেকে ১৫ বছর আগের সেই সময়টায় , সেই যে যেদিন হঠাৎ ই ওকে চমকে দিয়ে ওর প্রিয় বন্ধুটা হঠাৎ বলে উঠেছিল, “আমি তোকে ভালোবাসি তিথি ।”

তিথি খুব হকচকিয়ে  গিয়েছিল। প্রথমটায় কিছু বলতে পারেনি, আসলে ওভাবে তো কখনো ভেবে দেখেনি ? তারপর অনেক ভেবেছিলো , সারারাত ভেবেছিলো। তারপর মনে হয়েছিলো, সত্যি তো ইন্দ্রর চেয়ে বেশি কাকেই বা চেনে সে, ইন্দ্রর চেয়ে ভালো আর কেই বা বোঝে তাকে? তাই পরদিন ইন্দ্রর ডিপার্টমেন্ট এ ছুটে গেছিলো , তখন ইন্দ্রর ক্লাস চলছে। কিন্তু এতো গুরুত্বপূর্ণ কথাটা ছেড়ে আর কীই বা বেশি দরকারি থাকতে পারে? ক্লাস-এর দরজার  পাশ থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে একটা ছোট্ট কাগজ ছুঁড়ে মেরেছিলো ইন্দ্রর মাথায়। তারপর কি হয়েছিলো দেখার জন্যে আর দাঁড়াতে পারেনি তিথি, ছুট্টে পালিয়ে এসেছিল , কিরকম একটা লজ্জা লাগছিলো , হৃৎপিণ্ড টা যেন ছটফট করে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছিলো, সেই ছোট্ট চিঠিতে লিখে দিয়ে এসেছিল , “থ্যাংক ইউ ইন্দ্র তুই আমায় নতুন করে আবিষ্কার করলি বলে। আজ থেকে তিথি তোর শুধু বন্ধু নয় , তিথি তোকে আরো কাছে টেনে নিলো। আমিও তাই ভালোবাসতে শিখলাম তাকে, যে আমার প্রাণের বন্ধু।”

ADVERTISEMENT

তারপর কতগুলো বছর কেটে গেছে , ওরা আজ আর শুধু বন্ধু নয়। ওরা স্বামী স্ত্রী । ইন্দ্রর চাকরি টা আমেরিকায় । প্রতিবছরের মতন এবারেও জানুয়ারী তে এসেছিল ওরা কলকাতায়। তবে তিথির কিছু কাজ ছিল । তাই তিথির টিকিট ছিল এক মাস পরেই । আর তার মধ্যেই সারা পৃথিবী জুড়ে হানা দিল করোনার থাবা । তাই তিথি এখনো যেতে পারেনি , বুঝতেও পারছেনা কবে যেতে পারবে । ইন্দ্রটা অত দূরে একা একা রয়েছে , খারাপ লাগে তিথিরও । কিন্তু ইন্দ্রটা যে এমন করে, যেন ওকে একাই এই অবস্থায় থাকতে হচ্ছে । কাল রাতে তিথির মাথাটা ধরেছিল , কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না , বলেছিল,”আজ ফোন টা রাখি সোনা? কাল সকালে কথা বলি?”

ইন্দ্র অভিমান করে বলেছিলো , “এইটুকু তো কথা হয় তোর সাথে , এরপর তো ৮ ঘন্টা কথাই হবেনা ।”

তিথি একটু বিরক্ত হয়ে বলেছিল , “আচ্ছা আমরা কি এখনো ছোট আছি বলতো? তোকে  বলছি মাথাটা ধরেছে। রোজ ই তো কথা বলছি । ” 
ইন্দ্র আবার বলেছিল , “কতদিন দেখা হয়নি বলতো ।তোর বোধহয় আমার জন্য মন খারাপ করেনা না ?”

তিথি বলেছিল , “আমার ও টিকিট টা ক্যানসেল করতে হয়েছে ইন্দ্র ।তোর শুধু মনে হয় তুই একাই প্রব্লেম এ আছিস ।আর কটা তো দিনের ব্যাপার ।একটু শক্ত হতে পারিসনা?কত লোক তোর থেকে কত খারাপ অবস্থায় আছে জানিস ? আর এরকম একা তো অনেকেই থাকে ।”

ইন্দ্র বলেছিল , “সবার তো আর তিথি থাকেনা ।”

তিথি হেসে বলেছিল , “ন্যাকামো করিসনা , অনেক বয়স হয়েছে ।প্লিজ এখন রাখ ফোন টা , বড্ড ঘুম পেয়েছে, টাটা ।”
“টাটা” বলে ফোন টা রেখেছিলো ইন্দ্রও। তিথির খারাপ লাগেনি শেষ কথাটা । কিন্তু ইন্দ্রর ওপর মাঝে মাঝে বিরক্তও হয় ও। আসলে বড্ড আষ্টে পিষ্টে বেঁধে রাখতে চায় যেন তিথিকে । কোনোকিছুই বেশি বেশি ভাল না । মাঝে মাঝে মনে হয় নিজেকেই বলে “প্রেমে পড়া বারণ।”

বালিশের পাশ থেকে ফোনটা হাতে নিলো তিথি। ঘুম থেকে উঠেই ফোনটা হাতে নেওয়া একটা অভ্যেস হয়ে গেছে। একবার হোয়াটস্যাপ আর একবার ফেসবুক চেক করে, আর তারপরেই ফোন করে ইন্দ্র কে, প্রতিদিন । ওর সকাল মানে ইন্দ্রর রাত্রি । ওর সাথে কথা বলে তারপর ঘুমায় ইন্দ্র । এ হে , ফোন টা বন্ধ হয়ে গেছে । রাতে চার্জ এ বসিয়ে শোবে বলে ভুলে গেছিলো । লাফ দিয়ে উঠলো তিথি, তারপর চার্জ এ বসিয়ে বিছানায় ছটফট করতে শুরু করলো । না আর ঘুম হবেনা । ফোন টা অন করলো সে। আর তারপরে ই দুটো বড় বড় মেসেজ ঢুকলো । দুটোই ইন্দ্র পাঠিয়েছে । পড়তে শুরু করল তিথি।


“আজ তোর জানলাটার সামনে বসে কাজ করছিলাম । হ্যাঁ ঠিকই  শুনেছিস, তোর জানলাই ওটা , কারণ এই জানলাটার চারিধারে তুই ।তোর হাতে লেখা দেওয়ালে আটকানো কাগজ গুলোই  ধর না,কি ইনোসেন্ট, যখন এই এপার্টমেন্ট টা ছেড়ে দেব , তখন নাকি এটা ছিঁড়ে ফেলতে হবে । সহ্য করা যায় বল? তাই তুই দেওয়ালে যে সুন্দর সুন্দর কোটেশনগুলো লিখে রেখেছিস সেগুলো যত্ন করে তুলে রাখলাম একটা বাক্সে , না না ভালো ভালো কোটেশন আছে বলে নয়, লেখাগুলোয় তোর হাতের ছোঁয়া আছে বলে । তাকালাম বাইরের দিকে,বাইরের যে গাছটার বিভিন্ন ঋতুর সৌন্দর্য তুই চিনিয়েছিলিস সেই গাছগুলো সারা গায়ে ফুলের কুঁড়ির রঙ মেখে দাঁড়িয়ে আছে বসন্ত উৎসবের অপেক্ষায়।তাই আবার মিস্ করলাম তোকে, নতুন করে , সেই প্রথমদিনের মতন করে ।এই সৌন্দর্যের বেশীরভাগটা আমি তোর ভাষায় দেখতে পাই যে। তুই হয়তো বলবি ,“এবার তোর চোখে দেখব”।না সেটি হবার নয়,সবার দৃষ্টিশক্তি কি সমান হয়? গোটা আমেরিকা জুড়ে এখন ওয়ার্ক ফ্রম হোম ।ভাগ্যিস এটা হয়েছে , নাহলে অফিস থেকে ফাঁকা বাড়িতে ফিরতে কিযে কষ্ট হত কি বলব । তুই নেই তাই বোধহয় পাখিগুলোও আর আসেনা। দেখবি ওরা আবার সেদিন আসবে যেদিন আমি আবার বলব ,” আই লাভ টু কাম হোম টু ইউ”, গাছটায় সেদিন অন্য রং থাকবে,পাখিগুলোও সুর করে ডাকবে।আর যদি গাছ আর পাখি দুজনেই ঠান্ডায় লুকিয়ে থাকে তাও ঘরে বসন্ত থাকবেই,আমাদের মুখে হাসি থাকবে যে,আর থাকবে অনেক কথা ,যে কথা আমাদের ১৫ বছরেও শেষ হয়নি।আজকাল কি মনে হয় জানিস? স্বামী ,স্ত্রী,দাম্পত্য এগুলো বড় কঠিন কথা।বরং আমাদের দুজনকে কাছে রেখেছে আরেকটা সম্পর্ক,আমরা দুজনে আসলে খুব ভালো বন্ধু।”

মনটা একটু ভারী ভারী হয়ে গেলো তিথির , কিন্তু ভালোও লাগলো । তিথির মনে হল এক্ষুনি ফোন করে ইন্দ্রকে । পরক্ষনেই ভাবলো না থাক অন্য মেসেজ টা আগে পরে নিক ।তাই পড়তে শুরু করলো ।

“দিনের এই সময়টা বড় অদ্ভূত।আমি বসে আছি সাত সমুদ্র পাড়ে,অথচ ৮০০০ মাইল দূরে একটা মানুষ যখন সারাদিনের ক্লান্তিকে চোখে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে ,কেমন যেন আমার বুকটা খালি হয়ে যায়।কেন ? আমি তো সারাদিন তোর সাথে কথা বলিনা! তাতে কি? ওই যে জানি চাইলেই ফোনটা তুলে ডায়াল করতে পারি নাম্বারটা,আর ওপার থেকে একটা চেনা গলা বলে উঠবে “হ্যালো”।আরে এটাই তো আমাদের গল্প। পনেরো বছর আগের সেই দিনটায় ওই একই গলা এমন করেই সাড়া দিয়েছিল।ভেবেছিলাম পারব জানিস  ,একা থাকা আর কী এমন ব্যাপার? মিথ্যে বলব কেন ,পারছিও হয়তো ,কিন্তু বই পড়লে মনে হয় আরে এই লাইনটা তো বেশ ,চোখ তুলে দেখি আমি তো একা,বলব কাকে?চোখটা নামিয়ে নিই।গাড়ি চালানোর সময় তাকিয়ে ঘাবড়ে যাই,আরে পাশের সিটটা খালি কেন? পরক্ষণেই মনে পড়ে সে থাকলে তো মোবাইলে মুখ গুঁজে থাকত,আর তখনই আমার ভিতর থেকে কে যেন বলে,”তবু থাকত তো” ! সিনেমা দেখে হাসি পায় যখন ,তখন হঠাৎ মনে হয় একা একা হাসতেই আমি শিখিনি।হাসতে হাসতে আমি পাশে তাকিয়ে সেই হাসি মুখটা যদি দেখতেই না পাই তবে কি হবে আমার সে হাসিতে? আর এরকম প্রতিটা মুহূর্তেই আমি বুঝে যাই,সবকিছু এত সুন্দর কেন জানিস ? তুই আছিস বলে,আর আমি আমার সব একাকীত্ব মেনে নিয়ে কেন থাকতে পারছি জানিস?শুধু তুই আসবি বলে।”

চোখটা জলে ভরে গেছে  তিথির । কিরকম যেন ছুটে চলে যেতে ইচ্ছে করছে ইন্দ্রর কাছে । এই ছেলেটা বার বার ওকে নতুন করে প্রেমে পড়ায়। সাথে সাথে ফোন করল তিথি। কিন্তু এ আবার কি? বারবার ভয়েস মেল্ এ যাচ্ছে কেন ? প্রথমটায় মনে হল নেটওয়ার্ক প্রব্লেম। কিন্তু পনেরো মিনিট ধরে একই জিনিস হবার পর একটা ছটফটানি হচ্ছিল। তিথি এবার ফোন করলো ওদের আরেকটা বন্ধু মৃন্ময়কে , আমেরিকায় ওদের সব থেকে কাছাকাছি ও-ই থাকে। ওদিক থেকে ফোন তুলে মৃন্ময় উত্তেজিত গলায় বলল , “তোর ফোন বন্ধ ছিল কেন? কতবার রিং করেছি ।”
বুকটা কেঁপে উঠলো তিথির মৃন্ময় এর গলার স্বরে , “কেন কি হয়েছে রে? ফোনটাতে চার্জ ছিলোনা ।ঘুম থেকে উঠে খেয়াল হল। ” 
“তিথি , ইন্দ্র আসলে কোভিড-১৯ পজিটিভ । গত সাতদিন হোম কোয়ারান্টিনে ছিল। তুই চিন্তা করবি বলে বলতে বারণ করেছিল । কিন্তু আজ হঠাৎ খুব শ্বাসকষ্ট শুরু হয় ।
নাইন ওয়ান ওয়ান কল করতে ওরা হাসপাতাল এ নিয়ে যায় । ভেন্টিলেশন এ রয়েছে এখন। তুই চিন্তা করিস না । আমি খোঁজ নিয়েছি । ডাক্তার রা আশাবাদী । বলছে , বয়স কম , নিশ্চয়ই সুস্থ হয়ে যাবে । আর  আমরা তো আছি ।”
তিথির পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছে আসতে আসতে । না ওর এখন ক্ষমতা নেই চাইলেও ছুটে গিয়ে ইন্দ্র কে একটু ছোঁয়ার , ওর কাছে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেবার । কি করবে ঠিক করতে পারলোনা। ছুটতে ছুটতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো । ছোট্ট বছর পাঁচেকের ছেলেটা ঘুম ভেঙে পিছন থেকে ডাকছে , “মা কোথায় যাচ্ছ ?”
সে আওয়াজ যেন কানে পৌঁছালোনা তিথির , সে ছুটে চলেছে । একটা সময় লকডাউনের রাস্তায় দৌড়াতে দৌড়াতে হাঁফিয়ে গেলো সে, যতই দৌড়াক পৌঁছাতে সে পারবেনা, কিছুতেই না।দাঁড়ালো তিথি , তারপর জল ভরা ঝাপসা চোখে  আকাশের দিকে তাকালো , আর্তনাদের মতো করে একটা আর্ত  চিৎকার বেরিয়ে এলো তার গলা দিয়ে অজান্তেই, “ইন্দ্র , আমায় ছেড়ে যাসনা , ফিরে আয় , আমি আর কখনো তোকে একা থাকতে দেবনা , দেখিস । আর অভিমান করিস না আমার ওপর ।”
তার সে শব্দ মিশে গেলো আকাশে , না আজ আর তার কাছে কোনো রাস্তা খোলা নেই ,  তার সমস্ত ইচ্ছা অনিচ্ছার মালিক শুধু নিয়তি।

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait