হন্তদন্ত হয়ে ল্যাবে ঢুকেই বরুণ হাতঘড়িতে সময় দেখল রাত আটটা। সামান্য দেরী হয়ে গেলো পৌছাতে। নাটালিয়ার জরুরী তলব অনুযায়ী সাড়ে সাতটার মধ্যে হাজির হওয়ার কথা ছিল। শুক্রবারে সূর্য কাত হলেই বোতল নিয়ে বসার অভ্যেস তার। একলা একলা নেশা নাকি শুধু মদ্যপরাই করে। কেউ তাকে মাতাল বললে অবশ্যি বরুণের বয়েই গেছে। দোকলা থাকলে আয়েস করে সুরাপানের সুযোগ যে দুর্লভ হত তাতে সে নিশ্চিত। যাইহোক, প্রজেক্ট ডাইরেক্টরের মেসেজ পেতেই তড়িঘড়ি সব গুটিয়ে ছুটে আসতে হয়েছে। বরুণ উঁকিঝুঁকি মেরে দেখল ল্যাব একেবারে জনশূন্য। এই সময় কারো টিকি দেখতে পাওয়ার কথাও নয়। টিমের প্রায় সকলেই এতক্ষণে জন বেইলির টেক্সিকো পাবে হ্যাপি আওয়ারের হুল্লোড়ে ব্যস্ত। বরুণ নানারকম অজুহাতে ওদের সঙ্গ এড়িয়ে যায়। ভিড়ের মধ্যে তার খুব অস্বস্তি বোধ হয়। তাই সব অফিস পার্টিতেই সে সর্বদা অনুপস্থিত। আজকে আর ওরা বরুণকে নিয়ে বিশেষ জোরাজুরি করেনি। বরং এলেনোরাও যাবে না শুনে সবাই গাল ফুলিয়েছিল। মেয়েটার নাকি কি সব জরুরী কাজ আছে বাড়িতে।
সারাদিনের হইচইয়ের পরে ল্যাব এখন অসম্ভব শান্ত। মাঝেমধ্যে মেশিনের হাল্কা ব্লিপ-ব্লপ শব্দ ছাড়া আর কোনো আওয়াজ নেই। চতুর্দিকে ছন্নছাড়া ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে চেয়ারগুলো। বরুণ একে একে তাদেরকে নিজস্ব ডেস্কে গুছিয়ে রেখে দিল। এলেনোরার টেবিলের কাছে গিয়ে হাসি ফুটল ওর মুখে। মনিটরের সামনে খুব সুন্দর অরিগ্যামি সাজানো রয়েছে। ছোট্ট ছোট্ট, মিষ্টি গোলাপি কাগুজে প্রজাপতির দল। হাসিখুশি এলেনোরার সাথে দারুণ ভাবে মানানসই। তবে ও সামনে আসলে বরুণ কেমন যেন গুটিয়ে যায়। বন্ধুত্বের আহ্বানে সাড়া দিতে গেলেও গলা শুকিয়ে যায় ভয়ে। মেয়েটাও এই সুযোগে খুব পিছনে লাগে তার। মাঝেমধ্যেই ডেস্ক থেকে এটা ওটা লুকিয়ে রেখে দেয়। বরুণ হন্যে হয়ে খুঁজতে লাগলে হেসে কুটিপাটি হয়ে যায়। ওপরে ওপরে বিরক্তি প্রকাশ করলেও এই খুনসুটিগুলোতে মজাই পায় বরুণ। সে ভালোবাসে এই সান্নিধ্য। তবু কখনও মনের কথা বলার সাহস জোগাড় করে উঠতে পারবে না।
ভালোলাগার আবেশ মাথা থেকে মুছে ফেলে বরুণ নিজের টার্মিনালে বসলো। প্রতিদিনের মত খুব ভালো করে ঘেঁটে দেখল ড্রয়ারগুলো। ব্যক্তিগত ছোট ডায়রিটা সে হারিয়ে ফেলেছে বেশ কিছুদিন হল। বারবার একই জায়গায় সন্ধান করলে ফলের বিশেষ পরিবর্তন হবে না সে জানে। নিস্ফল অন্বেষণ শেষে চোখের রেটিনা স্ক্যান সেরে নিল। আইডেন্টিটি কনফার্মড হতেই জ্বলল স্বচ্ছ, পাতলা মনিটরের নীলাভ আলো। টেবিলে ফুটল কিবোর্ডের প্রজেকশন। এবারে কাজ শুরু করার পালা। দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিতে হবে মেডুলিনার গুরুত্বপূর্ণ পরিসংখ্যানগুলোতে। অসময়ে ছুটে আসার যদি কিছু ক্লু পাওয়া যায় সেখানে।
“শুভ সন্ধ্যা বরুণ। তোমাকে এইভাবে আচমকা আসতে বলার জন্যে খুব দুঃখিত।“
ল্যাবের স্লাইডিং দরজা নিঃশব্দে সরে যেতে নাটালিয়া ভিতরে প্রবেশ করলো। ভদ্রমহিলার সুঠাম চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই যে বয়স প্রায় সত্তর ছুঁয়েছে। সুদীর্ঘ কর্মজীবন শুরু করেছে নিউ ইয়র্কের ব্যাঙ্কে পাঞ্চ কার্ড প্রোগ্রামার হিসেবে। আজ পৃথিবীর এক নম্বর গেমিং কোম্পানি, ডিজি স্পোর্টসের ক্রিয়েটিভ ডাইরেক্টর। মেডুলিনার কনসেপ্ট ওরই মস্তিস্কপ্রসূত।
“নাটালিয়া, শুভ সন্ধ্যা,” হাসিমুখে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো বরুণ। “কোনো গোলমাল হয়েছে নাকি? আমি কিন্তু নম্বরগুলো মিলিয়ে দেখলাম। মেডুলিনাতে সব ঠিকই তো মনে হল।“
“উঁহু। ওখানে কিছু পাবে না। আসল জিনিস ক্লাসিফায়েড ফাইলে আছে।”
নাটালিয়া জায়ান্ট স্ক্রিনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। তার হাতের ইশারায় পর্দায় ভেসে উঠলো নানারকম নম্বর আর চার্টের গ্রাফিক্স। টপ সিক্রেট ডেটাবেসের বেড়া ডিঙ্গাতেই মেডুলিনার সর্বশেষ পরিসংখ্যান দৃশ্যমান হল পর্দায়। সর্বমোট অধিবাসীর সংখ্যা পাঁচ মিলিয়ন ছুঁয়েছে। গত একঘণ্টায় নাগরিকত্ব পেয়েছে প্রায় শপাঁচেক নতুন মানুষ। উষ্ণতার পারদ ফারেনহাইটে নব্বই অথবা সেলসিয়াসে মাপলে বত্রিশ ডিগ্রি। মনোরমই বলা যায়। ওয়েদার রিপোর্টে কোনো ঝড় বাদলের ভবিষ্যৎবাণী নেই। গণ্ডগোলের ইঙ্গিত নেই মেডুলিনার খবরের কাগজেও। এইসকল নানাবিধ, ভিড় করে আসা রিপোর্টের মাঝেই চাপা ছিল লাল রঙয়ের অ্যালার্ট। নাটালিয়া অস্ফুটে বলল, “এই প্রথম কোনো ক্রাইম হয়েছে ওখানে।”
“মেডুলিনাতে ক্রাইম?” বিড়বিড় করে উচ্চারণ করলো বরুণ। “ধুস, যত আজগুবি। কেউ হয়তো কলার খোসায় পা পিছলে পড়েছে। চিন্তা করো না।“
“চিন্তার বিষয় না হলে আমরা দুজনে এখানে থাকতাম কি?” নাটালিয়া অস্থির ভাবে পায়চারি শুরু করলো ল্যাবের মধ্যে। ভুরূর ভাঁজে গভীর উদ্বেগের কালো ছায়া। পিছনে, দেওয়াল জোড়া ইলেকট্রনিক পর্দায় রঙচঙে আলোর কারসাজি অথবা কন্ট্রোল প্যানেলে অত্যাধুনিক টাচ-প্যাডের ছড়াছড়ি দেখলে এটাকে নাসার মহাকাশযান উৎক্ষেপণের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ বলে ভুল হতে পারে। রকেট সায়েন্স না হলেও সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারার জটিল কাজকর্ম হয় এখানে।
টেক্সাসের ধূসর মরুভূমির এক কোণায়, ডিজি স্পোর্টসের এই বিরাট টেকনোলজি হেডকোয়ার্টার থেকে পরিচালিত হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় গেম মেডুলিনা। মেডুলিনা একটি ভার্চুয়াল শহরের নাম, যাকে গড়ে তোলা হয়েছে লস এঞ্জেলেসের আদলে। সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত, পূর্ণিমা-অমাবস্যা থেকে শুরু করে ঋতু পরিবর্তন সবই এখানে হয় বাস্তব পৃথিবীর সাথে সামঞ্জস্য রেখে। নব্বই বিলিয়ন নিউরন সহযোগে, ডিপ লার্নিং নিউরাল নেটওয়ার্ক ও’নিল, কন্ট্রোল করছে নগরের সবকিছু। তার সম্মতি বিনা পাতাও নড়ে না মেডুলিনাতে। তবে একটা গোটা সিমুলেটেড শহর পরিচালনা করা চাট্টিখানি কথা নয়। ও’নিলকেও শিখতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ওর আত্মশিক্ষার জন্যে প্রয়োজন অফুরন্ত ডেটা পয়েন্টের। খান দশেক সুপার কম্পিউটার তাই অতিকায় ভ্যাকুয়াম ক্লিনার হয়ে অনবরত গিলে চলেছে ইনফরমেশন, বাস্তবের লস এঞ্জেলেস থেকে। সাথে রয়েছে দুহাজার কিউবিটের কোয়ান্টাম কম্পিউটার। এদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ও’নিলের ডিপ লার্নিং পদ্ধতিতে এসেছে অকল্পনীয় গতি। সেই এখন মেডুলিনার অদৃশ্য সুপার মেয়র এবং একাধারে বিধাতাও।
সমসাময়িক বাকি ভিডিও গেমের থেকে মেডুলিনা খেলার অভিজ্ঞতা একেবারেই আলাদা। এক্সটেন্ডেড রিয়্যালিটির চমৎকারে হিউম্যান গেমাররা অনুভব করে মেডুলিনার রোদ, জল, বৃষ্টি। মিলেমিশে থাকে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স পরিচালিত কৃত্রিম অধিবাসীদের সাথে। একসাথে চলে হাসি, কান্না আর আড্ডা। এমনকি, দুতরফের সম্মতিতে ভার্চুয়াল সংসারও গড়ে ওঠা সম্ভব। মেম্বারদের পরিচয় থাকে একান্তভাবে গোপনীয়। তাই, নিউ ইয়র্কের ঘুপচি ঘরে খেলায় ডুবে থাকা যুবক বুঝতেই পারে না মেডুলিনার সমুদ্রতটে উষ্ণ ছোঁয়ায় কাঁপতে থাকা সঙ্গিনী, আরেকজন মানুষের ডিজিটাল অবতার না আর্টিফিশিয়াল সিমুলেশন। নিঃসন্দেহে এটাই গেমের প্রধান আকর্ষণ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন লোকজন নাওয়া খাওয়া ভুলে ডুবে রয়েছে নকল দুনিয়ায়। সেখানে বন্ধু যেমন সহজলভ্য তেমনই ব্যভিচারও গ্লানিহীন। নির্দ্বিধায় নিজেকে হারিয়ে ফেলার উচ্ছ্বাসে ভর করে মেডুলিনাতে চলে নিরন্তর উৎসব। প্রাপ্তবয়স্কতার প্রমাণ দিয়ে প্রতি মাসে হাজার ডলার ভাড়া গুনতে পারলে মিলবে এক চিলতে মাথা গোঁজার ঠাই। বিশেষ ভাবে বানানো পোশাক গায়ে গলালেই গেমারের শরীরের বায়োলজিক্যাল নিউরন সরাসরি যোগ স্থাপন করতে পারে ও’নিলের সাথে। ব্যস, তাহলেই কেল্লা ফতে। শুরু হয়ে যায় সমান্তরাল জীবন।
“কিন্তু কি হয়েছে ওখানে? কি ধরণের অপরাধ?” বরুণ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চাইলো।
“খুন!”
“বল কি, খুন! একেবারে মারি তো গণ্ডার আর লুটি তো ভাণ্ডার অবস্থা,” বরুণের চোখ চকচক করে উঠলো। গলায় পরিহাসের ছাপ স্পষ্ট।
“খুব মজা পেলে মনে হচ্ছে?”
“নাঃ, মানে মেডুলিনার একঘেয়ে দিনগুলোতে প্রথমবার ব্রেকিং নিউজ আসবে। ভাবলে মন্দ লাগছে না। সবাই জানলে বরং আমাদের পাবলিসিটি হবে।“
“কি ভাবে?”
“ভেবে দেখো, মেডুলিনার আগে পৃথিবীর সবচেয়ে পপুলার ভিডিও গেমগুলো কি ছিল? গ্র্যান্ড থেফ্ট, কল অফ ডিউটি, ডুমস ডে ইত্যাদি। এদের সকলেরই কমন থিম ভায়োলেন্স, তাই না? ভুলে যেওনা, হিউম্যান ডিএনএ ইভল্ভ হয়েছে হিংসা এবং সেক্সকে কেন্দ্র করেই। আমাদের রুল বেস্ড সোসাইটির বিধি নিষেধের কারণে এই প্রবৃত্তিগুলোর নিরসন সম্ভব হয় না। তাই মাউস ক্লিক বা জয়স্টিক এনে দেয় সেই আদিম উল্লাসের ছোঁয়া…“
“দাঁড়াও বরুণ,” নাটালিয়া কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়ে বরুণকে থামিয়ে দিলো।
“তুমি মনেহয় জানো না প্রজেক্ট মেডুলিনা শুরু হওয়ার পিছনে কি কারণ ছিল।”
“কি আবার? ব্যবসায় লাভ করা কি যথেষ্ট কারণ নয়?”
“সেতো থাকবেই। তাছাড়াও, আমাদের উদ্দেশ্য ছিল গেমিং এক্সপিরিএন্সের মাধ্যমে সোশ্যাল চেঞ্জ আনা। টেকনোলজির বিকাশের সাথে সাথে, সমাজের কোণায় ক্রমশ হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়া লোকগুলোকে অন্যভাবেও বাঁচার সুযোগ দেওয়া। মনুষ্যত্ব যেখানে ওদেরকে নিষ্ঠুর ভাবে দূরে সরিয়ে দিয়েছে, সেখানে ওরা সান্ত্বনা খুঁজে পেয়েছে মেডুলিনার পরিচ্ছন্ন প্রশান্তিতে। সারাদিনের দুঃখ, কষ্ট মন খুলে উজোর করেছে পাশের বন্ধুর কাছে। তার শরীরকে ছোঁয়ার অনুভূতি কৃত্রিম উপায়ে জাগরিত করা হলেও গেমারের মন ভালো হয়ে যাওয়াটা এক্কেবারে বাস্তব। সেই গভীর শান্তির মধ্যে হানাহানি কে চাইবে?”
“বাঃ, দারুণ নৈতিকতাবাদী ভাষণ,” হেসে ফেলল বরুণ। “ঘরকুনো মানুষদের বাইরে বেরিয়ে স্বাভাবিক হতে না বলে তাদের আরও একাকীত্বে ঢুকিয়ে দিচ্ছি আমরা। আবার তাতেও নিজেদের পিঠ চাপড়াচ্ছি। পারফেক্ট সেলস পিচ।”
“তাহলে তোমার কি মনে হয়? আমরা দুহাজার পঁচিশ থেকে আরম্ভ করে পর পর দুবছর সেরা গেমের শিরোপা কি করে পেলাম?”
“মেডুলিনার জনপ্রিয়তার একমাত্র কারণ পাপবোধহীন সেক্সুয়াল প্লেজার নাটালিয়া। অস্বীকার করে লাভ নেই। এক্সটেন্ডেড রিয়্যালিটি এক্সপিরিএন্স গেমারদের একে অন্যের অথবা এআই ক্যারেক্টারদের শরীর ছোঁয়ার অনুভূতি এনে দিচ্ছে। তাই অবাধে চলছে দ্বিধাহীন অ্যাডাল্টরি। সেই একই প্রযুক্তি যদি কারো বুকে ছুরি ঢোকানোর ফিলিং দেয় তাহলে ভাবতে পারছ জনপ্রিয়তা কোথায় পৌঁছাবে? যথেচ্ছ অপরাধ করেও, কোনো শাস্তি নেই। ক্রিমিনালরা খেলা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লে বাস্তবের অসামাজিক কাজকর্মও অনেক কমে যাবে। সেটাই হয়তো আসল সামাজিক পরিবর্তন হবে।“
জিভ দিয়ে চুকচুক শব্দ করে ব্যঙ্গের হাসি হাসল নাটালিয়া। বলল, “পরিস্থিতির গুরুত্ব বোঝার ক্ষমতা হারিয়েছ দেখছি। তোমার নিজের হাতে লেখা সিক্যুরিটি প্রোগ্রামের সেলফ লার্নিং অ্যালগরিদম আজ ফেল করেছে আর তুমি সেটা জাস্টিফাই করে যাচ্ছ? আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ও’নিল, নিজের থেকে খুনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই খবর একবার বাইরে বেরোলে মেডুলিনার ভবিষ্যৎ অন্ধকার। আজকে রাতের মধ্যে ডিজি স্পোর্টসের উচ্চ আধিকারিকদের জানাতে হবে। ওরাই সিদ্ধান্ত নেবে প্রেস রিলিজের ব্যাপারে। আমাদের যে করে হোক তার আগেই ডিফেক্ট ফিক্স করতে হবে।“
কথাটা ঠিক। ইউটোপিয়ান শহর হিসেবে বানানো হয়েছে মেডুলিনাকে। ও’নিলের সেলফ লার্নিং সিলেবাস থেকে তাই ইচ্ছাকৃত ভাবেই বাদ পড়েছে অপঘাতে মৃত্যু। যেকোনো সিটি প্ল্যানিংয়ের স্বাভাবিক অংশ হিসেবে যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছে অপরাধ দমনের বিষয়ও। খেলায় যোগ দেওয়ার আগে সকল হিউম্যান গেমারদের অনেকগুলো শর্ত মেনে নিতে হয়। তারমধ্যে অন্যতম হল নো ক্রাইম। ইচ্ছাকৃত ভাবে অন্য কোনো গেমার বা এআই চরিত্রকে শারীরিক ভাবে আঘাত বা অত্যাচার করার ন্যূনতম প্রচেষ্টা দেখলেই তাদের চিরকালের জন্যে বহিস্কার করা হয় মেডুলিনা থেকে। ও’নিলের নিউরাল নেটওয়ার্ককে ফাঁকি দেওয়া সেখানে অসাধ্য। মেডুলিনার বাকি আর্টিফিশিয়াল অবতাররা অসিমভের ল অফ রোবটিক্স দ্বারা চালিত। তারা স্বেচ্ছায় অন্যের ক্ষতি করতে অক্ষম। খুন তাহলে হল কি ভাবে?
“ইউরেকা!” লাফিয়ে উঠলো বরুণ। “মনে পড়েছে। আমার ব্রিচ প্রোটেকশন স্টেপস।“
“সেটা আবার কি?” নাটালিয়ার স্বরে বিরক্তি প্রকাশ পেলো। ওকে না জানিয়ে মেডুলিনার প্রোগ্রামে কেউ কিছু যোগ করুক সেটা ওর একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত। তা সে যতই মহৎ উদ্দেশ্যে হোক না কেন।
“আরে হ্যাকারদের সাথে একটু মজা করা। তেমন সিরিয়াস কিছু নয়,” বরুণ আস্বস্ত করার চেষ্টা করলো। “কাজের ফাঁকে ও’নিলকে শিখিয়েছিলাম। কেউ সিক্যুরিটি সিস্টেম হ্যাক করে ফোকটে গেম খেললে তাকে খেলা থেকে বহিষ্কার তো করা হবেই। সেই সঙ্গে তীক্ষ্ণ ব্যাথার অনুভূতি জাগানো কোনো র্যানডম ইভেন্টও ঘটানো হবে তাদের সাথে। সাজার ধরণ-ধারণ বা মাত্রা অবশ্য ও’নিল নিজেই ঠিক করবে। ওটাতেই হয়তো একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে।“
“হতে পারে তোমার অনুমান সঠিক,” নাটালিয়া বরুণের চোখে চোখ রেখে বলল। “দুজন হ্যাকার ছিল। শাস্তি পেয়েছে ওদের মধ্যে একজন।“
“তার অবতারের নাম জানা যাবে? নাকি সেটাও ক্লাসিফায়েড?” বরুণ রিভলভিং চেয়ারে আধপাক ঘুরে জানতে চাইলো। হাবভাবে গর্বের চাঞ্চল্য। মেডুলিনার সুরক্ষা কবচ কাজ করেছে। নাটালিয়া নিশ্চয়ই বুঝবে।
“জুলিয়া অনিক,” ছোট্ট চাপা উত্তর এলো নাটালিয়ার কাছ থেকে।
“হোয়াট?” চূড়ান্ত বিস্ময়ে লাফিয়ে উঠলো বরুণ। তারপরে নিজের ডেস্কে হুমড়ি খেয়ে কোডিং প্যানেলে ঝড়ের মত চালাতে লাগলো আঙ্গুল। এই যে, খুঁজে পেয়েছে পুলিশ ফাইলে, মেডুলিনার প্রথম প্রাণঘাতী দুর্ঘটনার রেকর্ড। মৃত্যু হয়েছে এক ছাব্বিশ বছরের তরুণী, জুলিয়ার। কারণ বলা আছে, বার্ন ইনজুরি। অথচ শহরের একমাত্র নিউজ চ্যানেল, মেডুলিনা লাইভে এর কোনো হদিশ নেই। সেখানে রূপসী সাংবাদিক ঝকঝকে আবহাওয়া এবং আসন্ন মেলা নিয়ে কথা বলে যাচ্ছে। রূপকথার স্বর্গপুরীর মত শান্ত চারিদিকের পরিবেশ।
বরুণকে দেখে বোঝা যাচ্ছে ওর ভিতরে চলছে ঝড়। মুখেচোখে স্পষ্ট, অসহায় বিপন্নতা। বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচালে ভেসে যেতে যেতে মরিয়া হয়ে উপায় খুঁজছে জুলিয়াকে আবার বাঁচিয়ে তোলার। কিন্তু বাস্তব পৃথিবীর আদলে তৈরি সেই ভার্চুয়াল জগতেও কেউ একবার চলে গেলে তাকে ফেরত আনা যায় না। বরুণ বেশ অবাকই হল দেখে যে ওর অ্যাডমিন অ্যাক্সেস আর কাজ করছে না। মেডুলিনার সকল ব্যাকডোর ও’নিল বন্ধ করে দিয়েছে ওর জন্য।
“জুলিয়াকে তুমি চিনতে?” নাটালিয়া পাশে এসে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলো।
ফ্যাকাশে মুখ তুলে তাকাল বরুণ। কি উত্তর দেবে? ডিজি স্পোর্টসের পলিসি অনুসারে এমপ্লয়িদের ফ্রি এন্ট্রি নেই গেমে। মাসে মাসে হাজার ডলার খরচা করে ঢুকতে হবে নিজেরই সৃষ্টি করা খেলাতে? হজম হয়নি বরুণের এই নিষেধ। দুরন্ত দস্যিপনা থেকেই সুরক্ষা পদ্ধতিতে দুতিনটে ফাঁক-ফোঁকর বা ট্রোজান হর্স রেখে দিয়েছিল সে। বিশেষ কোডের ব্যবহারে বাইপাস করা যাবে ও’নিলের নিউরন কাপলিংয়ে নজরদারি। মাস খানেক আগে, এক নিঃসঙ্গ বিকেলে ও হঠাৎই ঢুকেছিল মেডুলিনাতে। ব্রিচ ধরতে পারেনি ও’নিল। প্রথমদিনেই নেশা ধরে গেছিলো বরুণের। কৃত্রিম মানুষদের ভিড়ে নিশ্চিন্তে হারিয়ে যেতে পারে সে। অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডারের ভয় থাকে না। কেউ বক্রচক্ষু করে না চেহারার গড়ন অথবা চামড়ার রঙকে। যেমন করেনি জুলিয়া। হপ্তা তিনেক আগে আচমকা আলাপ হয়েছিল ওর সাথে। সেই থেকে তাকে চোখে হারায় বরুণ। কতবার রাত জেগে ভেবেছে জুলিয়াকে নিয়ে। মেয়েটা ও’নিলের সৃষ্ট কোনো ডিজিটাল চরিত্র নাকি সত্যিকারের মানবী। সামনা সামনি দেখা হলে কি একইভাবে ভালোবাসবে বরুণকে? আজকেও অফিস থেকে ফিরেই আধ ঘণ্টার জন্যে চলে গেছিলো মেডুলিনায় নিজের ভার্চুয়াল এপার্টমেন্টে। সেখানে যথারীতি ওর অপেক্ষায় ছিল প্রেয়সী। সুন্দর মুহূর্তগুলো কাটানোর সময় স্বপ্নেও ভাবেনি এতোটা ক্ষণস্থায়ী হবে সেই সম্পর্ক।
“হ্যাঁ, আমরা ডেট করতাম। এক ঘণ্টা আগেই দেখা হয়েছিল ওর সাথে,” অস্ফুটে বলল বরুণ।
“তুমিই তাহলে ইকাবন, জুলিয়ার প্রেমিক। কিন্তু তোমার তো কোনো অ্যাকাউন্ট নেই গেমে… তাহলে?“
“হ্যাঁ, ইকাবন আমার মেডুলিনা অবতারের নাম,” মাথা হেঁট করে বলল বরুণ। “আমি বাইপাস কোড ইউজ করেছি।“
বরুণের স্বীকারোক্তিতে ভুরূ কপালে উঠলো নাটালিয়ার। টিমের স্টার পারফর্মার নিজেই হ্যাকার হলে বিস্ময়ের সীমা থাকে কি করে। ইন্টারকমে সিক্যুরিটি স্টাফদের ডেকে আবার ঘরের মাঝখানে এসে দাঁড়ালো সে। বরুণকে দেখে খারাপ লাগছে তার। নিজের হাতে থাকলে হয়তো ক্ষমাই করে দিত। কিন্তু ভগবান সবাই হতে পারে না।
“তুমি খুন বললে কেন? ডেটাবেসে বলছে রান্নাঘরে দুর্ঘটনা…,“ বিধ্বস্ত বরুণ এখনও খাবি খাচ্ছে তার ডিজিটাল বান্ধবীর মৃত্যুর খবরে।
“দুর্ঘটনার পরিস্থিতি বানানো হয়েছে। ও’নিল অসিমভের ল এড়াতে সামান্য ঘুরপথ নিয়েছে। জুলিয়ার রান্নাঘরে সে গ্যাস লিক করিয়ে রেখেছিল। মেয়েটা চেন স্মোকার ছিল, তুমি নিশ্চয়ই জানো। তোমার সাথে দেখা করে ফিরে ঘরে সিগারেট জ্বালাতেই…। জুলিয়া আসলে কি তোমার দেশে ফেলে আসা বান্ধবী? শারীরিক দূরত্ব মেটাতে শেষ অবধি আমাদের গেমিং প্লাটফর্ম ব্যবহার করলে?“ নাটালিয়ার গলায় তীব্র শ্লেষ ধরা পড়লো।
“না না, আমি জানিনা। সত্যি বলছি,” বরুণ মরিয়া হয়ে অস্বীকার করলো। “আমি কারোর সাথে শেয়ার করিনি।“
ঝাঁঝিয়ে উঠলো নাটালিয়া, “মিথ্যে কথা। তুমি আর তোমার সঙ্গী বা সঙ্গিনী দুজনেই একই বাইপাস কোড ব্যবহার করেছ। ও’নিলকে কতবার ফাঁকি দেবে ভেবেছিলে? নিজের ভুল থেকে বার বার শিক্ষা নেওয়াই যে ওর কাজ। তোমার ট্রোজান হর্স ধরতে ওর সময় লেগেছে দু’মাস। নট ব্যাড।”
সিক্যুরিটি স্টাফেরা বরুণকে ল্যাব থেকে বের করে নিয়ে গেলো নিচের ডিটেনশন রুমে। গ্রেফতার হওয়ার আগে সেখানেই ওর দীর্ঘ অপেক্ষা। ডিজি স্পোর্টসের মাল্টি লেয়ার ফায়ারওয়াল ভাঙ্গার উদাহরণ এখন পর্যন্ত একটাও নেই। কোম্পানির সুনাম বজায় রাখতে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে ওরা পিছপা হবে না। দুহাতে মুখ ঢেকে বসে রইলো বরুণ সেখানে। এই দিনটার আশঙ্কা যে সে কখনও করেনি তা নয়। ও’নিলের সদা সতর্ক মগজকে ফাঁকি দিয়ে প্রতিবার মেডুলিনার মাটিতে পা দিলে, বরুণের কিঞ্চিৎ গর্বও হতো। হুল্লোড়ে মেতে উঠতেই অবশ্য ভুলে যেত সে’সব। আনন্দের আতিশয্য ড্রাগের নেশা হয়ে আড়াল করেছিল ঠিক বেঠিকের চেতনা বোধ। একালসেরে জীবনে সুখের আশায় দিনের পর দিন ঝাঁপিয়ে পড়েছে ভার্চুয়াল প্রেমিকার বাহুডোরে। ও’নিল একঢিলে দুই পাখি মেরেছে। জুলিয়াকে হত্যা করে সাজা দিয়েছে নিজের স্রষ্টা বরুণকেও। মেয়েটার কথা মনে পড়তেই কষ্ট দলা পাকিয়ে উঠলো বরুণের গলার কাছে। কে ছিল সেই হ্যাকার? ও’নিলের শাস্তির খাঁড়ায় কি পরিণতি তার হতে পারে সেটা বরুণের কল্পনাতীত। কিন্তু কি ভাবে সে জানলো বরুণের একান্ত নিজস্ব বাইপাস কোড? ডায়রিতে লিখে রেখেছিল অনেকদিন আগে। কোথায় আছে সেই ডায়রিটা? কিছুতেই মনে পড়ছে না বরুণের।
ক্যাম্পাস থেকে মাইল খানেক দূরে, সুউচ্চ আবাসনের দশ তলার সাজানো ঘরে, গেমিং কনসোলের ভিতরে তখনও নিঃস্পন্দ হয়ে পড়ে রয়েছে এলেনোরার দেহ। এক্সটেন্ডেড রিয়্যালিটিতে শাস্তির তীব্রতা, পুড়িয়ে ঝাঁঝরা করে দিয়েছে তার সুন্দর চোখদুটোকে। সামনের টেবিলে খোলা রয়েছে বরুণের ডেস্ক থেকে লুকিয়ে নিয়ে আসা ডায়রির পাতা। জুলিয়া হয়ে ইকাবনের সাথে মিলনের গল্পের এখানেই হল ইতি।।
Comment 0
Share
I always felt passionate about writing while in school and college. Once I started my career in IT there was a lull of many years because of multiple reasons. Recently, I have picked my keyboard again and reignited my old flame. In last few months I have posted short stories in various facebook groups and got encouraging response. Hopefully readers here would also like my limited contributions.
FOLLOWEnter your email address to reset your password.
The very name 'SWADES' denotes the philosophical essence and ideological standpoint of our vision. We envisage serving our 'Swades' by providing news, special stories and literary works of the new generation writers which would cater to the interest of the Nation.
Swades Times © 2020 , All rights Reserved
0 comments