ভৌতিক ছোটগল্প : জীবনের হাতছানি

ভৌতিক ছোটগল্প : জীবনের হাতছানি

সকালবেলা সবে চোখের পাতাটা খুলেছে পিকু এমন সময় রাই-এর ফোন-
-"কিরে পেলি?"

-"হুমম"
-"কি হুমম... আরে ডায়েরিটা খুঁজে পেলি?"
-"হুম"

-"তাড়াতাড়ি বিছানা ছাড়, আর আমাকে ফোন কর ল্যাদখোর।"

ধড়াম করে ফোন রেখে দিল রাই। মেয়েটা এরকমই-চঞ্চল, খামখেয়ালি, জেদি। কিন্তু ওর স্বভাবে একটা মিষ্টতা আছে যা পিকুকে টানে। দশ বছরের ও বেশি সময় হয়ে গেছে রাইয়ের পরিবার চৌধুরী বাড়ির এক তলার ভাড়াটে হিসেবে রয়েছে। ছোটোবেলা থেকেই পিকুর খেলার সঙ্গী সে। এখনও ওরা সবরকম বিদঘুটে কাজের দোসর যেমন এই ডায়েরি। পিকুদের কোনো এক পূর্বপুরুষ আদিত্য নারায়ণ চৌধুরী কোন কালে প্রেতসাধনা সম্পর্ক তার বিস্তারিত অভিজ্ঞতা এক ডায়েরিতে নথিভুক্ত করে গেছেন। সেই ডায়েরি সম্পর্ক অদম্য কৌতূহল রাইয়ের, যদিও পিকু ভূত-প্রেত থেকে বহু হাত দূরে। সে এসব ঝামেলায় পড়তে চায় না কিন্তু রাইয়ের জেদের কাছে হার মানতেই হয় তাকে। গত পরশু তাকে চিলেকোঠার ঘর থেকে পুরনো লাল ডায়েরিটা উদ্ধার করতে হয়েছে। ডায়েরিটা হাতে নিয়ে পিকু বেশ অবাক হয় - রাই যেমন বর্ণনা দিয়েছিল হুবহু সেই রকম-লাল রঙের ওপর সোনার কালিতে জ্বলজ্বল করছে নামটা-আদিত্য নারায়ণ চৌধুরী। নিচে সালটা-১৯২০। কিন্তু রাই এত নিখুঁত ভাবে এই ডায়েরি সম্পর্ক জানলো কিভাবে? মনে মনে উত্তর খুঁজতে থাকে পিকু।

ADVERTISEMENT


জলখাবার শেষ করেই রাইকে ফোন করল পিকু।
-"তুই যেমন বলেছিলি ঠিক তেমনি ডায়েরিটা.. কিন্তু তুই এত জানলি কি করে এত কিছু?"
-ওপাশে চাপা হাসির শব্দ

-"আমি জানব না তো কে জানবে..নে নে পড়া শুরু কর.. বিশেষ করে প্ল্যানচেটের অংশগুলো। আমাকে সব জানাবি কিন্তু..."। পিকু মনে মনে হাসে-রাই নির্ঘাত অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়েছে।
রাতে খাবার পর ডায়েরিটা খোলে পিকু। হলদেটে পাতাগুলোর মধ্যে মুক্তোর মত হাতের লেখায় আদিত্য নারায়ণ লিখে রেখে গেছেন তার অদ্ভূত ইতিহাস। একটু শিহরিত হয় পিকু। নিজের প্রপিতামহ সম্পর্ক তার জ্ঞান সীমিত। নিজের বাবা-কাকাদের মুখে যেটুকু শোনা-অত্যন্ত মেধাবী এই মানুষটির বহু শখের মধ্যে একটি শখ ছিল প্ল্যানচেট। তার প্রাণাধিকা স্ত্রী সাবিত্রীর মৃত্যুর পর প্ল্যানচেটের প্রতি আরো আসক্ত হন তিনি। ওনার নিজের মৃত্যুটাও রহস্য - আজও সেই পর্দা সরেনি। সবাই অনুমান করে যে তাঁর প্রেত সাধনাই তাঁর মারা যাবার কারণ। তাঁর এক সহকারীও ছিল নাকি -এক ভৃত্য কন্যা.. আদিত্য নারায়ণ মারা যাবার পর সেও নিখোঁজ হয়ে যায়। খাটে উঠে একটা বালিশে আধশোয়া হয়ে পড়তে শুরু করে ডায়েরিটা।


৪ঠা জুলাই ১৯২০

"প্রেতসাধনার ব্যাপারে সবার অজ্ঞতা সত্যি অবাক করে।মানুষের মৃত্যুই যে শেষ কথা নয়; মৃত্যুর পরেও যে একটা জগৎ আছে -এই কথাটা কেউ মানতেই চায় না। এই দুটি জগতের মাঝে মিডিয়ামের সাহায্যে যোগসূত্র স্থাপন করা যায় এই ব্যাপারটা পশ্চিমের বিজ্ঞানীরা মানেন। এই মিডিয়ামের কিছু বিশেষ শারীরিক বা মানসিক ক্ষমতার জন্য সে আত্মার সঙ্গে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়। অবশ্য এই সঙ্গে কিছু আধুনিক যন্ত্রের সাহায্য নিয়েও হয় যদিও মিডিয়ামের মাধ্যমই আমার বেশি পছন্দ। কিন্তু সেরকম মিডিয়াম কোথায় পাবো? ইরা কি পারবে! বুঝতে পারছিনা… দেখি।" 

এত অবধি পড়ে পিকু বেশ অবাক হল। সেই সহকারিণী তাহলে ইরা নামের কেউ ছিল। কিন্তু সেই নাম তো বাড়ীর কারো মুখে আজ অবধি শোনেনি।
পরদিন রাইএর সাথে ছাদে দেখা করে সব বলল পিকু।

-"ইরার কথা আর কিছু বলা নেই?"রাইএর চোখে মুখে কৌতূহল

-"না রে আর তো কিছু নেই"
হতাশ হয় রাই। কারণটা ধরতে পারেনা ঠিক পিকু।

-"এক কাজ করলে হয়, ভজহরিকাকাকে জিজ্ঞাসা করা যেতে পারে, কাকা যদি কিছু জানে।"
 

ভজহরিরা অনেক পুরুষ ধরে চৌধুরী বাড়ির আজ্ঞাবহ। চৌধুরীদের বাড়ির একতলায় একটা ঘরে বিপত্নীক ভজহরি বসবাস করে। খুবই অমায়িক মানুষ সে।পিকুদের প্রশ্নের উত্তরে মাথা চুলকে সে বলল,"দাদাবাবু বেশি কিছু তো জানি না.. তবে আমার দাদুর বড় সন্তান ছিল মেয়ে.. নামটা তো মনে নেই গো দাদাবাবু.. তবে কিছু ছবি থাকলেও থাকতে পারে.. আমি খুঁজে দেখবোখন।"

সেদিন রাতে আবার পড়তে শুরু করে পিকু।


৮ই জুলাই, ১৯২০

"সত্যি অভাবনীয়। মিডিয়াম হিসেবে ইরার ক্ষমতা অতুলনীয়। আজ আমার প্রপিতামহ বীরনারায়ণ চৌধুরির সাথে সম্পর্ক স্থাপনে সক্ষম হলাম। ইরার শরীরে ওনার আত্মার উপস্থিতি সত্যি ভাবা যায় না।এমনকি ইরার গলার স্বরে ওনার কথা বলা, আমার প্রশ্নের উত্তর দেয়া.. এক পরম প্রাপ্য। আজ আমি পারলৌকিক জগতের সাথে সম্পর্ক স্থাপনে সক্ষম। কিন্তু ওনার একটা কথা ভুলতে পারছিনা-আমার অভিসন্ধিই আমার পতনের মূল.. মানে কি? তাহলে সাবিত্রী কে ফিরিয়ে আনার যে পরিকল্পনা আমার সেটা কি কার্যকর হবে না? কিন্তু হাল ছাড়ব না আমি কিছুতেই। ইরার সাহায্য প্রয়োজন শেষ বারের জন্য।"

এরপর কিছু পাতা ফাঁকা। পরের লেখা কয়েকদিন বাদে -১৭ই জুলাই। আদিত্যনারায়ণ লিখেছেন-"ইরার অবদান আমি এ জন্মে ভুলব না। সত্যি, সে না থাকলে সাবিত্রীকে আবার নিজের এত কাছে পেতাম না। সাবিত্রী এখন আমার কাছে আমার সাথেই থাকবে। ধন্যবাদ ইরা। আমাকে আমার কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা করিস, কিন্তু এটা না করলে আমি সাবিত্রীকে পেতাম না। সাবিত্রীর গলা পাচ্ছি.. ডাকছে আমায়। লেখা বন্ধ করি।"
পিকুর মাথায় বিদ্যুৎ ঝলকের মত একটা কথা মনে পরল-মা কে বলতে শুনেছিল কবে ১৭ই জুলাই আদিত্য নারায়নের মৃত্যুর ১০০ বছর পূর্ণ হচ্ছে। এরপর ডায়েরিতে আর কোনো লেখা নেই।

 

রাই ধীরেধীরে ভজহরির ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। যা করার এখনি করতে হবে। হাতে সময় অল্প..
-"কাকা..ও কাকা ঘুমিয়ে পরলে?"
-"কে.. রাই দিদিমণি.. এস গো ভেতরে.. দেরি আছে গো ঘুমতে। "
সন্তর্পণে ঘরে ঢোকে রাই।

-"ছবি পেলে কাকা? তোমার জন্য নাড়ু নিয়ে এসেছি.. তুমি ভালবাসো তো..


-"বেশ করেছ দিদি.. তা ছবি দেখবে নাকি তুমি.."
-"আমার না দেখলেও চলবে কাকা.. তুমি দেখেছ?"

ভজহরির চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে
-"নামটা ছবির পেছনেই লেখা-ইরা..আর মুখটা ঠিক.. "ভজহরির স্থির দৃষ্টি রাইয়ের দিকে। রাইয়ের ঠোটে এক চিলতে হাসি খেলে যায়।
-"ছবিটা আমায় দাও কাকু আর নাড়ুগুলো খেও।" কথাগুলো বলে আর দাঁড়ায় না রাই। ছবিটা নিয়েই একছুটে নিজের ঘরে চলে আসে সে।কাজটা করতে তার একদম ভাল লাগেনি কিন্তু এই মুহূর্তে পিকুকে কিছু জানান যাবে না। পরশুই তো ১৭ই জুলাই।
পরদিন সকালে ভজহরির আকস্মিক মৃত্যুতে সারা চৌধুরি বাড়ী স্তম্ভিত। পিকুই সবথেকে বেশি বিচলিত। "কাকা তো সুস্থই ছিল বল রাই..তাহলে " আর ভাবতে পারে না পিকু।একটা বুদ্ধি খেলে যায় পিকুর মাথায়।
-"কিরে প্ল্যানচেট করবি?" পিকুর কথায় মনে মনে খুশিই হয় রাই।  

- "করতে পারি যদি আদিত্য নারায়ণকে আহ্বান করা হয় তো!"
-"কিন্তু ভজহরি কাকাকে যে কিছু প্রশ্ন করার ছিল।"খানিক বিমর্ষ হয়েই বলে পিকু।
-"সে তো আদিত্য নারায়ণকেও করতে পারবি। উনিও তো উত্তর দিতে পারবেন। "

রাইএর সঙ্গে কোনদিনও পারেনি পিকু তাই এবারেও রাইয়ের যুক্তি মেনে নিল বাধ্য হয়েই। চিলেকোঠার ঘরটাকে প্ল্যানচেটের স্থান হিসেবে বেছে নিয়েছে ওরা। আজ রাত ১২টায় পিকু আর রাই প্ল্যানচেটের আসর বসাবে এই ঘরে। ঘরটাকে রাই পরিষ্কার করে দুটো আসন বিছিয়ে দিয়েছে। ধূলোর ভ্যাপসা গন্ধ এড়ানোর জন্য দুটো ধূপও জ্বালিয়েছে। আজ তার স্বপ্নপূরণের দিন।
 

ঠিক ১২টা। রাই আর পিকু একটা বৃত্তের মধ্যে বসেছে। দুটো মোমবাতি জ্বলছে মাঝে। আর আছে আদিত্যনারায়ণের ডায়েরিটা। দুজনে একে অপরের হাত ধরে রেখেছে। একাগ্র মনে স্মরণ করছে আদিত্যনারায়ণকে। দুজনেই ধ্যানস্থ। ঘরের আবছা আলো-আঁধারিতে যেন সময় স্থির হয়ে আছে.. কোথাও একটা টিকটিকি ডেকে উঠল - টিক টিক টিক.. সেই মুহূর্তে পিকুর মনে হল তার শরীর যেন ভারী হয়ে আসছে.. চোখের পাতা খুলতে চেয়েও যেন পারছে না.. তার শরীর অন্য কার নিয়ন্ত্রণাধীন। সে কি সংজ্ঞা হারাচ্ছে.. চেতন অবচেতনের সন্ধিলগ্নে হঠাত্‌ কানে এল এক পরিচিত কণ্ঠস্বর -"দাদাবাবু চোখ খোলো।"

কথাটা শোনার পরই পিকুর শরীরটা যেন নিমেষে অস্বাভাবিক হয়ে গেল। চোখ খুলে সামনের দৃশ্য দেখার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না সে-রাইয়ের দৃষ্টি বিস্ফোরিত কিন্তু সেই চোখ কিছুই দেখছে না, এলোমেলো চুল, ঠোট নড়ছে কিন্তু কণ্ঠস্বর ভজহরির। 

রাই ভজহরির গলায় বলে চলল - "দাদাবাবু.. সময় কম..রাই...ইরা..রাই..তুমি পালাও.. নাহলে আদিত্যনারায়ণ তোমার শরীর কেড়ে নেবে.. ঠিক যেমন সাবিত্রী ইরার সঙ্গে করেছিল। ইরাই রাই। আমাকেও রাই...।" কথাটা সম্পূর্ণ হবার আগে একটা প্রবল ঝড় উঠল বাইরে। ঘরের জানলাটা দড়াম করে খুলে যেতেই একটা দমকা বাতাস ঘরে প্রবেশ করে মোমবাতি দুটো নিভিয়ে দিল আর সেই মূহূর্তে রাই সংজ্ঞা হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। ঘরে নেমে এল নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। পিকুর সমস্ত শক্তি তখন দুপায়ে কেন্দ্রীভূত। আগের সাহস এখন আর নেই..কিভাবে দরজা খুঁজে সিঁড়ি বেয়ে নিজের ঘরে সে ঢুকল সেই জানে। বাকি রাতের কথা আর তার মনে নেই।

পরদিন সকালে একটা শোরগোলের শব্দে ঘুম ভাঙল পিকুর। সারারাত ছেঁড়াছেঁড়া স্বপ্নে বারবার ইরা না রাই বা দুজনকেই দেখেছে। সেটা বাস্তব না কল্পনা সেটা বোঝার মত ক্ষমতা এই মুহূর্তে তার নেই। কিন্তু নিচের শব্দের কারণটা জানা প্রয়োজন। মাথার তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে যখন সে নিচে নামল তখন বাড়ীর লোকজন একটা সাদা কাপড়ে ঢাকা মৃতদেহ ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। সামনে দাদাকেই জিজ্ঞেস করল পিকু।

-"কি হয়েছে রে দাদা?"
অপ্রত্যাশিত উত্তরে হতবাক হয়ে গেল সে।  

"রাই মারা গেছে রে কাল রাতে.. খুব অদ্ভুত ব্যাপার বুঝলি পিকু। চিলেকোঠার ঘরে লাশ পাওয়া যায়। কি করতে ওখানে গেল সেটা রহস্য। ডাক্তার বলছে হার্ট আট্যাক, একদম ভজহরির মত।"


0 comments

Saurav Chakraborty

Saurav Chakraborty

Shared publicly - 25th Oct, 21 06:24 am

ভীষণ ভালো লাগলো

Arijit Banerjee

Arijit Banerjee

Shared publicly - 27th Jun, 21 11:53 pm

দেহান্তর ও পরপারের সম্পর্ক-- দুটো আলাদা বিষয় নিয়ে অনেক গল্প পড়েছি। কিন্তু দুয়ের মেলবন্ধনে এই সুন্দর সৃষ্টি পাঠ্যসুখ দেয়। পরলোক ও প্রেতচর্চা বিষয়ে লেখিকার আরো কয়েকটি লেখা পড়েছি। কিন্তু এটি স্বতন্ত্র। আশা করি,আগামী দিনে এরকম লেখা আরো পাবো।

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait