ছোটনাগপুরের পাহাড়ে জঙ্গলে (দ্বিতীয় পর্ব)

ছোটনাগপুরের পাহাড়ে জঙ্গলে (দ্বিতীয় পর্ব)

ভ্রমণকাহিনীঃ ছোটনাগপুরের পাহাড়ে জঙ্গলে (প্রথম পর্বের লিঙ্ক)

 

দ্বিতীয় পর্বঃ

প্রাথমিক গন্তব্য কনকদুর্গা মন্দির, 16-17 কিলোমিটার বনভূমির মধ্যে দিয়ে সতর্ক ভাবে এগিয়ে চললো আমাদের গাঢ় সবুজ সুমো গাড়িটি। জঙ্গলের পথ, বাঁক নিয়েছে অজস্রবার, 5-6 কিলোমিটার পর থেকেই জঙ্গল ক্রমশ ঘন হতে শুরু করলো। প্রায় 40-45 মিনিট গাড়ি চালিয়ে অবশেষে জঙ্গলের মধ্যে একটা গোলাকৃতি পরিষ্কার অঞ্চল দেখতে পেলাম। তারই মাঝে শতাব্দী প্রাচীন পোড়ো মন্দিরের কঙ্কালটি এখনো রয়েছে।


এখান থেকেই শুরু চিল্কিগড়ের জঙ্গল। এই মন্দিরের পশ্চিমে, জঙ্গল গভীরতা পেয়েছে। প্রায় লোকালয় বিহীন এই গড়ের জঙ্গলে আছে চারশোর উপরে বৃক্ষ লতাগুল্মের প্রজাতি। মন্দিরের পূর্ব প্রান্তে রয়েছে শতাব্দী প্রাচীন পাহাড়ি নদী ডুলুং। এই কনক দুর্গা মন্দির ডুলুং নদী নিয়ে অনেক ইতিহাসের কথা শোনা যায়। আর আছে কিছু মিথ, স্থানীয়রা এখনো তার অনেক কথাই বিশ্বাস করেন। পারিবারিক ছুটি কাটানোর গল্প লিখতে বসে এই ঐতিহাসিক ঘটনা বা মিথ গুলি পরিবেশন করা কতটা সমীচীন জানিনা। তবে সেসব কথা না বললে, এই স্থান মাহত্বের পূর্ণ প্রকাশ পাবে না। শুনতে থাকুন খারাপ লাগবেনা, এটুকু বলতে পারি। পাঁচশো বছরেরও পুরনো কাহিনী আজও চিত্রিত আছে স্হানীয় দের মধ্যে। ইতিহাস বলে, এই মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন ব্রাহ্মণ রাজা গোপীনাথ সিংহ রায়।

ADVERTISEMENT
Tuhu Momo Video Teaser

রাজা গোপীনাথ সপরিবারে সুসজ্জিত নৌকাবিহারে ডুলুং নদী দিয়ে চিল্কিগড় প্রাসাদ থেকে মন্দিরে আসতেন এবং কনক দুর্গার আরাধনা করতেন। কাজেই ওই সময় ডুলুং নদীর অববাহিকা গভীরতা সম্পর্কে একটা নির্দিস্ট ধারণা করা যায়, হয়তো সে সময় রাজপরিবারের বজরা বা পানসি চলত ডুলুং নদীতে।

চিল্কিগড় রাজারা তন্ত্রমতে এই দেবীর আরাধনা করতেন। প্রতি অমাবস্যা তিথিতে মায়ের কাছে নরবলি হতো। রাজার আদেশে রাজ শত্রু বন্দীদের নিয়ে আসা হত মায়ের সামনে এবং খাঁড়ার আঘাতে অপরাধের শাস্তি স্বরূপ দেওয়া হতো নরবলি। অনেক মন্দিরেই সেকালে নরবলির প্রথা চালু ছিল।

এক অর্থে নরবলি অন্য অর্থে রাজ শত্রু নিধনের একটা প্রথাগত সামাজিক রূপ দেওয়ার চেষ্টা। আজও অন্ধকারে মন্দির প্রাঙ্গনে একাকী দাঁড়িয়ে থাকলে, যেন কোনো অতৃপ্তির বাতাস আকুল হয়ে কেঁদে ফেরে। শোনা যায় যে এই মন্দিরে নরবলির ইতিহাস বহু বছর স্থায়ী ছিল। পরবর্তীকালে ইংরেজরা চিল্কিগড় দখল করলে এই নরবলি প্রথা বন্ধ হয়ে যায়। তবে এখনও নাকি নবমীর রাতে দুর্গা ঠাকুরের অষ্টধাতুর বিগ্রহের সামনে মোষ অথবা ছাগ বলি চালু আছে। অষ্টধাতুর দুর্গা মূর্তি এখানে অশ্বারোহিনী চতুর্ভূজা। উড়িষ্যা অনার্য মন্দির শৈলীতে নির্মিত প্রাচীন এই মন্দির প্রকৃতপক্ষে একটি বিষ্ণুমন্দির।

 

ভালোভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, এই প্রাচীন ভগ্ন মন্দিরের মাথায় বিষ্ণুর সুদর্শন চক্র ধ্বজ বর্তমান। এই শিল্পরীতি শুধুমাত্র ভগবান বিষ্ণু বা শ্রীকৃষ্ণের মন্দির দেখা যায়।তবুও যে কেন এই মন্দিরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী কনক-দুর্গা মনে সোনার তৈরি দুর্গা মূর্তি, তা এক রহস্য।
কথিত আছে প্রাচীনকালে কোন এক সময় এই মন্দিরের উপরে একটি প্রবল বজ্রপাতে মন্দিরটি সম্পূর্ণভাবে দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায় । তখন তার পাশেই নবনির্মিত কনক-দুর্গা মন্দির স্থাপিত হয়। এই মন্দিরটিও শতাধিক বছরের পুরোনো।

চিল্কিগড় ঝাড়গ্রামের এই অরণ্যাঞ্চল সাধারণত শাল পলাশের অরণ্যে ঘেরা। কিন্তু অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় ডুলুং-এর এপারে কনক-দুর্গা মন্দির সংলগ্ন প্রায় ৬৮ একর বনভূমি সম্পূর্ণ ঔষধি গাছ দিয়ে ঘেরা। তাই সমগ্র ভারতের উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা ঔষধ গবেষণার কাজে এই বনভূমি তে আসেন। এই মন্দিরের একটু দূরেই বহু প্রাচীন একটি কুচিলা (যা দিয়ে নাক্সভম ওষুধ তৈরি হয়) বৃক্ষের সন্ধান পাওয়া যায়। রাজা গোপীনাথ এর পরবর্তী উত্তরসূরীরা আয়ুর্বেদিক স্বাস্থ্য চর্চায় বিশেষভাবে পারদর্শী ছিলেন। তাই এই রাজারা ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থান থেকে এমনকি বিদেশ থেকে ঔষধি বৃক্ষ সংগ্রহ করে এই ঔষধি বনভূমি তৈরি করেছিলেন। উদ্ভিদ গবেষকদের মতে, প্রায় ৪৩০ টি প্রজাতির ঔষধি বৃক্ষ এই বনভূমিতে পাওয়া যায়।

সাড়ে চারশো বছরের মিথ। রহস্যে ঘেরা ঝাড়গ্রামের চিলকিগড় রাজবাড়ি লাগোয়া কনক দুর্গা মন্দিরের দুর্গাপুজো। আজও নাকি অষ্টমীর রাতে গভীর জঙ্গলের মধ্যে নিজেই নিজের ভোগ রাঁধেন স্বয়ং দুর্গা।
ডুলুং নদীর তীরে ছবির মত চিলকিগড়। গা ছমছমে গভীর জঙ্গলের মধ্যে কনক দুর্গার মন্দির।একসময়ে এটা ছিল ওড়িশার ব্রাহ্মণ রাজার রাজত্ব। আগেই বলেছি মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা রাজা ছিলেন গোপীনাথ সিংহ রায়। এই সিংহ রায় পরিবারের শেষ রাজার ছেলে ছিল না। তাঁর মৃত্যুর পর রাজত্ব যায় সামন্তদের দখলে। সামন্তরা ছিল সেনাপতি। পরে তারাই রাজা হয়।

দশমীতে কলাগাছরূপে রাবণ-পুজো হয়। সন্ধেবেলা ডুলুং-এর তীরে মশাল জ্বালিয়ে সেই কলাগাছকে তীর মারার প্রতিযোগিতা চলে। চারবার সোনার মূর্তি চুরি যাওয়ার পর এখন অষ্টধাতুর মূর্তিতেই জমজমাট পুজো হয় চিলকিগড়ে।
এমন গা ছমছমে পরিবেশে মন্দির প্রাঙ্গণে বসে পুরোনো দিনের রাজতন্ত্র, নরবলির বিভীষিকার কথা ভাবতে ভাবতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

আমার সর্বাঙ্গ ভেজা, পরনে একখানি নতুন গামছা। সম্ভবত ডুলুং নদীর জলে স্নান করিয়ে বলি দেওয়ার উদ্দেশ্যেই আনা হয়েছে আমাকে। বাইরে অন্ধকার থাকলেও মন্দিরের ভেতরটা অনেক মশালের আলোয় আলোকিত দেখাচ্ছিলো। কাপালিক দর্শন একজন পুরোহিত দেবীর মূর্তির সামনে বিরাট খাড়া নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। চারিদিকে ধুপ ধুনোর গন্ধে নিঃশাস নিতে অসুবিধা হচ্ছিল।

এমন সময় একসঙ্গে অনেক ঢাক আর কাসর ঘন্টা বেঁজে উঠতেই আমি বুঝলাম এবারে আমাকে বলি দেওয়া হবে। হঠাৎ নজর গেল বিগ্রহের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লম্বা চওড়া একজন সুপুরুষ প্রৌঢ়র দিকে। তার কপালে রাজ তিলক আঁকা আর তার ঠিক পাশটিতে ভীত সন্ত্রস্ত ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা একটি অষ্টাদশী তরুণী। সেই অপূর্ব সুন্দর্যের স্নিগ্ধতা আমার সব মৃত্যু ভয়কে হরণ করলো। মেয়েটির দুই চোখে সিক্ত ছিল, এই মেয়েটিকে আমি চিনি, আমার ভীষণ চেনা মানুষ।

সহসা মেয়েটির সুতীব্র চিৎকারে মন্দির চত্বর খান খান হয়ে গেল। তার সুতীব্র বাঁধাদানে মন্দিরের মধ্যে যেন লন্ড ভন্ড বেঁধে গেল। আমি সেই সুযোগে প্রহরীদের হাত ছাড়িয়ে পালাতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু আমার দুই হাত পিছমোড়া করে বাঁধা ছিল, তাই টাল সামলাতে না পেরে মন্দিরের সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়ে গেলাম। উঠে দেখি আমার হাতে কোনো বাঁধন নেই, ঘুমের ঘোরে মন্দিরের চাতাল থেকে গড়িয়ে সিঁড়িতে পড়েছি, তবে কোথাও বিশেষ চোট লাগেনি।

প্রকৃতিস্ত হতে কয়েক মিনিট সময় লাগলো। মন্দির চত্বর খাঁ খাঁ করছে। অল্প দূরেই আমার সহযাত্রীদের কথা বলার কলকাকলি কানকে সস্থি দিলো। ওরা সম্ভাবত ডুলুং নদীর দিকে চলেছে। চট জলদি উঠেই ওদের পিছু ধাওয়া করলাম আর অল্পক্ষণের মধ্যেই সুন্দরী ডুলুং কে দেখতে পেলাম।


ক্রমশঃ

আরও পড়ুনঃ ছোটনাগপুরের পাহাড়ে জঙ্গলে (তৃতীয় পর্ব)

 

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait