সেবার সিকিম ভ্রমণের মূল উদ্দেশ্যই ছিল অজানার সন্ধান ও সাথে গুরাসের (রোডোডেন্ড্রন) রসাস্বাদন। এই মনোবাঞ্ছা নিয়েই আমরা ২০১৭ মার্চ মাসের শেষে একরাতে দার্জিলিং মেল-এ চেপে বসলাম। ভ্রমণের প্রথমভাগে ছিল বহুল আলোচিত ওখরে এবং হিলে-বার্সে ট্রেক, রোডোডেন্ড্রন স্যাংচুয়ারীর মধ্য দিয়ে। এটা এখন অনেকের কাছেই পরিচিত রুট- তাই এ সম্বন্ধে আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। এবার আসি দ্বিতীয় ভাগে।
অপরিচিত জায়গা বা এখনকার Gen-Y –এর ভাষায় “Offbeat Location” এর সন্ধানে বেরিয়ে পড়ার নেশা, অনেকের মতই আমার মধ্যেও জাগায় Adrenalin rush. নেট ঘাঁটতে ঘাঁটতে এরকমই এক অরূপরতনের সন্ধান পেলাম এবার- ৫৬০০ ফুট উচ্চতায় পশিম সিকিমের ছোট্ট জেলা শহর গেজিং (Geysing)। যদি মেঘের উপত্যকা চোখের সামনে দেখতে দেখতে দুটো দিন পাহাড়ি নিস্তব্ধতায় কাটাতে মন চায় তাহলে যে কোন প্রকৃতিপ্রেমীর মন জয় করবে এই পাহাড়ি জনপদ। তিন কিলোমিটার উপরে পেলিং এর জনপ্রিয়তার পাশে গেজিং এখনও নিতান্তই অনাঘ্রাত। তবে প্রথমেই বলে রাখা প্রয়োজন যারা শুধু সিকিমে আসা মানেই ঘরে বসে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে চান, তাদের জন্য এই স্থান নয়। বরং যারা মেঘের মিহি পর্দার নীচে শিশিরে সিক্ত হতে চান বা লনে বসে চা খেতে খেতে সূর্যাস্তের লাল আভা চোখে মেখে সন্ধ্যেবেলা সামনের পাহাড়কে আলোর তারকাশোভিত রূপে প্রস্ফুটিত হতে দেখতে পছন্দ করবেন, তাদের এই জনপদ স্বাগত জানায়।
ADVERTISEMENT
হিলে-বার্সের ট্রেক করে ওখরেতে দুরাত্রি কাটিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু হল গেজিং-এর দিকে। পথে আমাদের ড্রাইভার তোপদীন শেরপাজীর নেতৃত্বে আমরা ছুঁয়ে গেলাম হি, বার্মিওক, রিনচেংপঙ ও কালুক। রিনচেংপঙ থেকে শেরপাজী আমাদের বহু আকাঙ্ক্ষিত কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখালেন। সেই মনমোহিনী দৃশ্য ভোলার নয়।
দুপুর গড়িয়ে গোধূলির লালিমা যখন ছড়িয়ে পড়েছে পাহাড়-উপত্যকায়, আমাদের বোলেরো গাড়ি এসে পৌঁছালো গেজিং-এর একটি দারুণ সুন্দর আস্তানা সানি গুরুঙ- এর “ওক ভ্যালি রিট্রিট ভিলেজ হোমস্টে”-র সামনে। হাসিমুখে আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন গুরুঙজী। পিছনে একটি লাল আগুন-রঙা ফুলে ঢাকা রোডোডেন্ড্রন গাছ। সামনে সুগভীর খাদের ভিতর থেকে সদর্পে দণ্ডায়মান পাইন গাছের সারি, আর বহুদূরে পাহাড়- চুড়ায় সূর্যাস্তের আল্পনা--- সব মিলিয়ে এক ঘোরলাগা পরিবেশ। গেজিং- এ অন্য থাকার জায়গা থাকলেও Tripadvisor এর দৌলতে “ওক ভ্যালি রিট্রিট” বেশ জনপ্রিয়।
বিকেলে পকোড়া সহযোগে চা-পান হোল । ইতিমধ্যেই সামনের পাহাড় সেজে উঠেছে আলোর বর্ণমালায়। বেশ কিছুক্ষণ বসে আড্ডা হোল। রাতে হাল্কা বৃষ্টির সাথে মুরগীর মাংস সহযোগে গরম ভাত অমৃত মনে হোল। প্রথম দিনের অবসান।
পরের দিন আমরা খুব সকালে প্রাতঃরাশ সেরে পেলিং হেলিপ্যাড (আমাদের ভাগ্য এখানে রিনচেংপঙ-এর মত সুপ্রসন্ন ছিল না-কাঞ্চন দেখা দেয় নি) হয়ে গেলাম পশ্চিম সিকিমের আর এক অনিন্দ্যসুন্দর জনপদ “ছায়াতালে”। আকাশ পরিষ্কার। চারিদিক সবুজ পাহাড়ে ঘেরা একটি জলাশয়। তারমধ্যে আবার পাহাড়ের প্রতিবিম্ব। অপূর্ব প্রাকৃতিক শোভা। এই জায়গাটিও এখনও অতটা জনপ্রিয়তা পায় নি। তাই বেশী ভিড় নেই। ট্রাউট মাছসহ বিভিন্ন রঙিন মাছ জলাশয়ে ঘোরাঘুরি করছে।
আমাদের ছোট্ট ছেলে টিনটিন তো তার বন্ধুদের জলের মধ্যে দেখে আনন্দে দিশেহারা। এখানে লেকের ঠিক পাশে একটি সুন্দর বাংলো আছে থাকার জন্য। সেখান থেকে যে নয়নাভিরাম প্রকৃতি চোখের সামনে প্রতিভাত হতে দেখা যায় ভেবেই শিহরিত হলাম। শুনলাম পরিষ্কার আকাশে এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘারও দেখা মেলে। এখান থেকে আমরা পাড়ি দিলাম রঙ্গিত নদীর ধারে অপূর্ব ছায়াঘন কমলালেবুর বাগান, অতঃপর পথে দেখলাম রিম্বি জলপ্রপাত, কাঞ্চনজঙ্ঘা জলপ্রপাত। কাঞ্চনজঙ্ঘা জলপ্রপাতে সূর্যালোকে রামধনু দেখা যায়। এরপর দুপুরের খাওয়া সেরে যাওয়া হল পেমিয়াংসি মনাস্ট্রি। সিকিমের অন্যতম সুন্দর বৌদ্ধ গুম্ফা। এখানকার মনোরম পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মন কাড়ল সহজেই। তিনতলা এই গুম্ফার প্রতিটি তলায় বিভিন্ন রকমের পৃথক পৃথক বৌদ্ধ উপাচারের সমাহার যা দেশী এবং বিদেশী সকল পর্যটকদের বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে। প্রায় বিকেলবেলায় পায়ে পায়ে পৌঁছলাম সিকিমের প্রাচীন রাজধানীর ধ্বংসাবশেষ “ র্যাবডান্টসে”-তে। এই জায়গাটিই এইদিনের সবকটি জায়গার মধ্যে আমার মন ছুঁয়েছে সব থেকে বেশী। প্রায় দুই কিলোমিটার একটি ট্রেক, পাহাড়ি পথে চেসনাট গাছ সমৃদ্ধ এক মায়াবী পরিবেশের মধ্যে দিয়ে, যার শেষে র্যাবডানসে-র ধ্বংসাবশেষ। ইতিহাস অনুসারে সিকিমের দ্বিতীয় রাজধানী ছিল র্যাবডান্টসে, ১৬৭০ সাল থেকে ১৮১৪ সাল পর্যন্ত।
সিকিমের প্রথম রাজা ফুনটসোগ নামগিয়ালের রাজধানী ছিল ইয়াকসাম। তিনি তাঁর রাজধানী পবিত্র উদ্দেশ্যে ব্যাবহারের জন্য পৃথক করে রাখেন। তাঁর পুত্র তেনস্থং নামগিয়াল ১৬৭০ সালে রাজধানী র্যাবডান্টসেতে প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে নেপালী সৈন্য এই রাজধানী দখল নিয়ে ধ্বংস করে। রাজপ্রাসাদ ও চোর্ত্তেনের ধ্বংসাবশেষ বর্তমানে পরিলক্ষিত হয়।ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ (Archeological Survey of India) এই ভগ্নাবশেষকে জাতীয় সৌধরূপে স্বীকৃতি দিয়েছে।
এখনকার প্রতিটি দেওয়ালে যেন ইতিহাস ফিসফিস করে কথা বলে। আমরা এই পড়ন্ত বিকেলে সেই কথোপকথনের সাক্ষী রইলাম। গোধুলিবেলায় প্রায় অন্ধকার চারিদিক...অচেনা পাখিদের দিনাবসানে বাড়ি ফেরার কলকাকলি... দীর্ঘাঙ্গী পর্ণমোচীদল --- সব মিলিয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলি। ফেরার পথে দেখে নিলাম ওক ভ্যালি রিট্রিট-এর আশেপাশে কয়েকটি ভিউপয়েন্ট যেখান থেকে পুরো গেজিং শহরটির একটি ল্যান্ডস্কেপ পাওয়া গেল।
দ্বিতীয় দিনের গন্তব্য হল এশিয়ার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উচ্চতায় অবস্থিত ঝুলন্ত (Suspension) ব্রিজ –“সিংসোর ব্রিজ”(১৯৮ মি লম্বা) এবং রোডোডেন্ড্রন-ছাওয়া গ্রাম উত্তরে (Uttarey) (সিংসোর ব্রিজ থেকে ৩ কি মি)।
এত জায়গা ঘোরার পরেও আমার মন উতলা করে ওক ভ্যালির লনে বসে রাতে মাথার ওপর অসীম আকাশে নক্ষত্রমালা, ভাসমান মেঘপুঞ্জ, নীচে ঝাপসা উপত্যকা ও গাছপালার অনির্বচনীয় অনুভূতি- তথাকথিত একঘেয়ে কর্মময় জীবন থেকে দূরে সমস্ত কিছু জুড়ে এক অলৌকিক নিস্তব্ধতা।
এই প্রাকৃতিক নিসর্গের সাথে সানি গুরুং ও তাঁর পত্নীর হাতের সুস্বাদু রান্না ও আন্তরিক অতিথি আপ্যায়ন এবং পরের দিন গেজিং ছাড়ার আগে সিকিমের বিশেষ উত্তরীয় (খাদা) সহযোগে গুরুঙজীর বিদায় অভ্যর্থনা এ জন্মে ভোলার নয়... চোখের কোণে জল চিকচিক করে ওঠে। এ এমনই এক অনুভূতি যা মনের মণিকোঠায় সযত্নে পরম আদরে লালন করে অনাঘ্রাত অনামী গেজিংকে।
শহরের কোলাহল থেকে দূরে, নিরবিচ্ছিন্ন শান্তিতে, পাখিদের নৈকট্যে কাটানো এই দুটি দিন মনে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। NJP –তে নামার সময়ে আমাদের গাড়ি যখন পাহাড়ের পাকদণ্ডী বেয়ে তিস্তা-রঙ্গিতের হাত ধরে ধীরে ধীরে পথ চলতে থাকে, তখন উপরে তাকিয়ে দেখি দূরে পাহাড়চূড়ায় ততক্ষণে জমতে শুরু করেছে মন খারাপের মেঘ। বিদায় গেজিং।
0 comments