শিয়ালদার স্টেশনে থাকে লালন। এখানই তার জন্ম। মা, বাবা কাউকেই সে জানে না। বুড়ো বাউলদাদা তাকে মানুষ করেছে। আগে এই বাউলদাদার সঙ্গে গান গাইত ট্রেনের কামরায়। এখন বাউলদাদা বড়ো একটা যায় না, লালন যায়। লালন খুব ভালো গাইতে পারে না। তাই সে কার্তিকদাদার কাছে শেখা দু-চারটে ম্যাজিক শিখে সেগুলিও দেখায়। পুলিশদের সঙ্গে ভাব করে ট্রেনের কিছু মালপত্তর বয়ে দেয়। পেট চলে যায়। লালন খুব ভালো মুড়ি মাখে। একদিন মুড়ি মাখা খাচ্ছিল, তখন একজন যাত্রী এসে বলল , ‘তুমি তো মুড়ি বেচতে পারো’!
লালন অবাক হয়ে তাকালেও,খুশি হয় এইকথায়। তবে লালন কিছু বলার আগেই বুড়ো বাউল বলে ওঠে, ‘বাবু এতো খুব ভালো পস্তাব(প্রস্তাব), কিন্তু সব জিনিসপত্র কিনতে তো অনেক পয়সা লাগবে। আমি চাই মুটে না বয়ে লালন এমন কিছু করুক। মনে রাখব’।
ভদ্রলোক তখনই বললেন, ‘কী কী লাগে বলবি, আমি আছি তো’!
লালন আরও অবাক। মিষ্টি হেসে আরেকটু মুড়ি মাখা দিতে গেল। বাউল দাদা রে রে করে উঠল। ‘তোর থালা থেকে খাবে কীরে বাবু? বড়ো হলি কিছুই বুঝিস না। জাত ধর্ম কিছুই মানিস না দেখছি’।
কী করে বুঝবে? আজ সে শুধু বোঝে গরিব বড়লোক, ফুটপাতের মানুষ, স্টেশনে থাকা মানুষ অন্য মানুষদের মধ্যে তফাত, কিন্তু মনে মনে মানে না। এই সবই সে ভাবছে হাসপাতালের বেডে শুয়ে শুয়ে। লালনের পা অপারেশন হয়েছে। নীলরতনের বেডে শুয়ে আছে এখন সে। এখানে নিয়ে এসেছে এক মাসিমা। নীলরতন হাসপাতালেই কাজ করেন তিনি। তারপর কিছু দিদি দাদারা এসেছিল, যাদের সঙ্গে ট্রেনে মুড়ি বিক্রি করতে করতে পরিচয়।
মনে পড়ছে বিপদের দিনটির কথা। একদিন এক কামরা থেকে অন্য কামরায় যেতেই বিপত্তি ঘটল। ট্রেনের এই মাসিমা দেখতে পান। ট্রেনের চেন টেনে ট্রেন থামিয়ে লালনকে নিয়ে আসেন এই হাসপাতালে। স্পাইনেও বেজায় চোট। তাই বেশ ক’দিন আছে। বাউলদাদা আসে মাঝে মাঝে। লালন খুব চিন্তা করে কী করে চলছে বাউলদাদার। বাউলদাদা অবশ্য বলে, ‘চিন্তা করিস না বাপ, ভিখারিদের খাওয়া জুটে যায় ঠিক’।
বেড থেকে আকাশ দেখা যায়। পাশের ছেলেটি কাল ছুটি পেয়েছে। তাই বেডটা খালি। লালন দেখেছিল ছেলেটিকে নিতে বাবা ,দাদা মামা সবাই এসেছিল।যাওয়ার সময় ওনারা লালনকে এক শিশি নাড়ু দিয়ে গেলেন। লালন শুনল এটা বন্ধুর মায়ের হাতের।বন্ধুর নাম নীলেশ। লালনকে নীলেশ বলেছে দেখা হবে ভাই, ভালো থেকো।
নীলেশের কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ দেখল ওর পাশের বেডে অচেতন একটি ছেলেকে শুইয়ে দেওয়া হচ্ছে। বাড়ির লোকদেরকে বলা হল, ‘একটু পড়েই জ্ঞান ফিরবে’।
লালন বুঝল ট্রেন থেকে পড়ে ও বোধহয় এমন ধারার কেৎরে গিয়েছিল। ভিমরি খেতে দেখেছে লালন, কিন্তু আজ প্রথম অচেতন কোন মানুষকে দেখল । একটু মায়া হল।মনে আছে ট্রেনে গরমকালে অনেকেই এই ঠাসাঠাসিতে ভিমরি খায়।
পাশের ছেলেটি জ্ঞান ফিরল ভিজিটিং আওয়ারসের আগেই। বাড়ির লোক এল। একজন মহিলাকে দেখে মনে হল মা হবেন। অনেকক্ষণ পাশে বসে রইলেন কোন কথা না বলে, ঘন্টা বাজার পর যখন চলে যাচ্ছেন লালনের দিকে তাকালেন , একটু হাসলেন। জ্ঞান ফেরার পর শুনল ছেলেটির নাম আনন্দ। এসেছিল কলেজ স্ট্রীট এ বই কিনতে। হঠাৎ পেটে ব্যথা। তাড়তাড়ি করে ইমার্জেনসি। ব্যাস অপরেশন। অ্যাপেনন্ডিক্স অপারেশন হল।দুই দিন কেটে গেছে, একটু একটু ভাব হয়েছে আনন্দের সঙ্গে।ভালোই লাগে লালনের।
দিন দুই হল মাঝে মাঝে কানে ভেসে আসে দেশাত্মবোধক গান। ১৫ই অগস্ট এর প্রস্তুতি। আজ সেই বিশেষদিন বলে সব রোগীর জন্য এল লাড্ডু আর একটা ফল। কোনো একটা স্কুলের ছেলেমেয়েরা এসে দিল। লালনের নতুন বন্ধু আ্নন্দ বলে উঠল ,‘ইশ ! আমার এবার স্কুলে নাটক করা হল না। মিস হল’।
লালন বলল, ‘আমারও মিস হল’।
‘তুমি বুঝি স্কুলে কিছু করছিলে’ আনন্দ প্রশ্ন করল লালনকে।
লালন মুচকি হেসে বলল, ‘না ভাই, স্কুলে যাই না।তবে আজ শরীর ঠিক থাকলে আমার কত লাভ হত।পতাকা বিক্রি করে পয়সা হয় যে অনেক। আর খাওয়াও জোটে বেশ ভালো। স্টেশনে পুলিশকাকুরা খাবারের প্যাকেট দেয়। আর এইসব দিনে আমার মুড়ি বিক্রিও হয় বেশ। তারপর জমপেশ করে স্টেশনের পাশ থেকে রঙিন সরবত খাই। কত মজা’।
আনন্দ বলল ,’তুমি স্কুলে পড় না? ট্রেনে মুড়ি বিক্রি কর বুঝি’?
লালন বলল, ‘না আমি স্কুলে ভর্তিই হইনি কোনদিন। যাক তোমাদের এই দিনের মজার কথা বলো।'
‘আমরাও মজা করি বটে, তবে মাঝেমাঝে যখন ভাবি দেশের সংগ্রামীদের কথা,স্বদেশীদের কথা, খুব কষ্ট হয়। এই আন্দোলন না হলে, সংগ্রাম না হলে আমরা তো স্বাধীন হতাম না। ক্ষুদিরাম বোমার আঘাতে সাহেবদের মারতে গিয়ে ধরা পড়ে যায়। ফাঁসি হয়।শ্রী অরবিন্দ আলিপুর বোমা মামলায় ধরা পড়েন। আমাদের সংগ্রামীরা কত কষ্ট সহ্য করেছেন বলো’? আনন্দ একটানা বলে যায়।
লালন হেসে ঘুমোনোর ভান করল। চোখ বুঝে বোঝার চেষ্টা করল কাদের কথা বলছে এই ছেলেটি। ওইতো সেদিন বাবুলরা পেটো বাঁধছিল, তাহলে তারা কী স্বদেশী? লোকেরা যে বলে অ্যান্টিসোশাল। আগেও লোকেরা আন্দোলন করত, এখনও তো করে। মাঝে মাঝেই তো মিছিল যায় এই ফ্লাইওভার দিয়ে। তবে এই মিছল কিসে আলাদা? পুলিশদাদারা বাউলদাদাকে পচ্ছন্দ করে বলে শোবার জন্য অল্প পয়সা নেয়,তাই জগ্গুমস্তানদের দিতে হয় না। কিন্তু বাউলদাদাকে অকারণ অনেকে খুব বকাবকি করে। তাহলে এটা অত্যাচার? কাল জিজ্ঞাসা করলে কেমন হয় তাই ভাবে। তারপর ভাবে আর মনে মনে বলে, ‘বইতে নিশ্চয়ই লেখা আছে। না হলে লালনের বয়সি ছেলেটি জানবে কী করে? আমি যদি পড়তে পারি আমি কী জানতে পারব? আমি পড়ব’? পিঠের ব্যথা অনেকটাই কমেছে। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলে লালন যাবে একবার দমদম স্টেশনের দিদিমণির কাছে।বা খবরের কাগজ বিক্রি করে দামু কাকুর কাছে। ভাবতে ভাবতে চোখবুজে এল। দেখল রাশি রাশি বই, বই গুলি উড়ছে উড়ছে উড়ছে, আর লালন ধরার জন্য ছুটছে আর ছুটছে। কানে আসছে কদম কদম বাড়ায় যা।
ADVERTISEMENT
0 comments