প্রলাপ

প্রলাপ

সরাসরি প্রসঙ্গে আসি। খুবই জরুরি মনে হলো বলা। আমি একজন শিক্ষক। প্রায় চোদ্দো বছর ধরে শিক্ষকতা করছি। এখন আমি একটি আট বছরের মেয়ের মা-ও। বিভিন্ন বয়সের বাচ্চাদের কাছ থেকে দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। তাই কৃত্তিক| পালের মৃত্যুর প্রসঙ্গে চলতি মতের বাইরে কিছু বলতে চাই।

আমাদের একটা প্রবণতা থাকে, কোনো মানুষের কাজকর্ম ও গতিবিধির সঙ্গে তাঁর পরিবারকে জড়িয়ে ফেলা|কিছু ক্ষেত্রে তা করা যায়, কিন্তু একজন ডিপ্রেশন পেশেন্ট এই সব কিছুর উর্দ্ধে হয়। তাঁর খুবই নিজের ব্যক্তিগত একটা পৃথিবী থাকে|অনেকটা শহরের প্রান্তে থাকা হানা বাড়ির মতন। তার হদিশ শুধুই সে জানে |মাকড়সার জাল দিয়ে ঘেরা সেই জগতে সে একলা বসে জীবনের গল্প লেখে। এটাই তার মনের গড়ন! সেখানে কাউকে সে আলো হাওয়া নিয়ে ঢুকতে দেয় না। কারণ ওই একাকিত্বের সঙ্গে সে নিজের মতন জীবন কাটায়। সেখানে কখনো তার প্রিয়জন বা পরিবারের লোকজন ভালো, আবার কখনো খারাপ। মনের গতি প্রকৃতি তার নিজেরও নিয়ন্ত্রণে থাকে না। তাই তার বাইরের আচরণ বিচিত্র রকম হয়। কেউ তাকে মুডি বলবে, তো কেউ বদমেজাজি। কিন্তু এই mood fluctuations ভালো লক্ষণ নয়। স্কুলে অনেক বাচ্চা খুবই বেশি দুষ্টু। দেখা যায় বাড়িতে সে কথাই বলে না হয়তো। এটা সন্দেহজনক। বড়ো হলেও কেউ কেউ অচেনা মহলে নিজেকে উজাড় করেছে দিচ্ছে, কিন্তু পরিবার জীবনে বিরক্ত হয়ে কোনোমতে সময় কাটাচ্ছে। এটাও সন্দেহজনক। এদের মনে সবসময় পলায়ন প্রবৃত্তি কাজ করে|আমি দেখেছি, কঠিন পরিস্থিতিতে এরা ধৈর্য রাখতে পারে না। এদের কাছে সমাধান মানেই মৃত্যু। কারণ, মৃত্যুর কনসেপ্টটা আমাদের কাছে নির্জনতার। আমাদের চারপাশে এইরকমই ডিপ্রেসেড মানুষ হাসির মুখোশ পরে প্রতিদিন ঘুরছে। এদের অন্তরে প্রতিদিন লালিত হচ্ছে মৃত্যুর ইচ্ছা, যা আসলে পালিয়ে যাওয়া।

ADVERTISEMENT

ডিপ্রেশন জেনেটিক অসুখ। আবার পরিস্থিতিও ডিপ্রেশন তৈরি করে। এই মানুষগুলোর কাছাকাছি যারা বাস করে, তাদেরও যন্ত্রণার জীবন। কারণ, এদের মনের তল পাওয়া অসম্ভব। কখনো এরা ভালোবাসায় ডুবিয়ে দেবে, আবার কখনো তিক্ত করে তুলবে মুহূর্ত। অথচ এরা ভালোবাসার কাঙাল। সামান্য আবেগে এরা সম্পর্ক ভাঙে, গড়ে। কৃত্তিকার মৃত্যু অসম্ভব কষ্টের। কিন্তু, দয়া করে ওর বাবা মাকে দায়ী করবেন না। ওরা কৃত্তিকার ডিপ্রেশন নামের অসুখের শিকার। ওদের যন্ত্রণার কথা আপনারা স্বাভাবিক ভাবে নিত্য জীবন কাটানো মানুষ বুঝতেই পারবেন না।

ডিপ্রেশন রাতের ঘুম উড়িয়ে নিয়ে যায়। জীবনকে উপভোগ করার ইচ্ছা নষ্ট করে। প্রিয়জনকে শত্রু আর দূরের অচেনা মানুষ, পৃথিবী, নেশার বস্তু, নিষিদ্ধ যা কিছু সম্পর্কে আকর্ষণ তৈরি করে। কৃত্তিকার চিঠিতে ড্রাগ খেতে চাওয়ার ইচ্ছা, স্নেহপ্রবন বাবা মার interference পছন্দ না করা, আবার তাদেরই সাথে selfie তোলা, ফাদার্স ডের উপহার, মায়ের সঙ্গে গল্প — সব আচরণ পরস্পর আলাদা। তাই, এই মৃত্যুকে একটি মেয়ের মানসিক অসুস্হতার পরিনাম হিসেবে দেখুন। ওর সবচেয়ে প্রিয়জন দের হিসেব নিতে যাবেন না। সত্যি বলছি, হিসেব মেলাতে পারবেন না।

আমি ডাক্তার নই। আমি শিক্ষক! আমি মা। তাই আমার কথায় বৈজ্ঞানিক ত্রুটি থাকতেই পারে। কিন্তু আমার আবেগ আর পর্যবেক্ষণ অনেকটাই ঠিক বলে আমি মনে করি। আমি অনুরোধ করবো, ছেলেমেয়েদের বয়সন্ধির সময় ওদের একটু professional psychiatrist এর কাছে নিয়ে যান। ওরা অনেক কথা আপনাদের বলতে পারে না। মনোরোগ বাসা বাঁধছে কিনা, নিজেরা বুঝতে পারবেন না। তাই, যান ডাক্তারের কাছে। নাহলে এই ডিপ্রেশন ঘুন পোকার মতন অনেক জীবন শেষ করবে। মৃত্যু না হলেও মৃত্যুর শীতলতার ছোবল থেকে ডিপ্রেশন রোগীর পরিবারের লোকজন, এই সমাজ কেউ বাঁচবে না| এই মানুষগুলো ওই মনের হানা বাড়িতে বসে নিজেই নিজেকে আর তার চারপাশের মানুষগুলোকে হয় মৃত্যু দন্ড দেবে, নাহলে উপহার দেবে মৃত্যুর মতন তিক্ত জীবন !

একটু ভাববেন !

 
 
  •  

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait