বিনোদিনী

বিনোদিনী

সদ্য বৃষ্টিস্নাত রাত গুলো মহুলের বড্ড প্রিয়। পাশেই বেল গাছ এর পাতা গুলো থেকে টুপটাপ করে ফোঁটা ফোঁটা জল চুঁইয়ে চুঁইয়ে উঠোনে পড়ছে। মেঘ কেটে ধীরে ধীরে আকাশ টা পরিষ্কার হচ্ছে। আর হালকা মিষ্টি জ্যোৎস্নার আলো এসে মহুলের বিছানায় পড়ছে। ঠিক যেনো আকাশ থেকে কোনো পরী এসে রুপোর কাঠি ছুঁয়ে দিয়ে গেছে আর সেই রূপালী আলোয় চারিদিক চিকচিক করছে। ঝিঁ ঝিঁ পোকা আর ব্যাঙের ডাকে চারিদিক গমগম করছে।

 ঘড়িতে তখন প্রায় রাত একটা। যারা রাত জাগে তারাও এতক্ষণে ঘুমিয়ে গেছে, কিন্তু মহুলের চোখে ঘুম নেই। গত মাস তিনেক ধরে মহুলের চোখে ঘুম নেই। কোথাও যেন একটা অপরাধ বোধ সারাক্ষন ওকে তাড়া করে বেড়ায়। রাতের পর রাত কেটে যায়,চোখে ঘুম নামে না, চেয়েও যেন কিছুতেই মহুল নিজেকে সামলাতে পারছে না। 

ADVERTISEMENT
Swades Times Book

আকাশ থেকে ধীরে ধীরে যেমন মেঘ সরে যাচ্ছে মহুলের মন থেকেও ধীরে ধীরে কালো জমাট বাঁধা মেঘ গুলো আসতে আসতে সড়তে শুরু করেছে। আজ মনের এই জমাট বাঁধা কালো মেঘের আড়ালে কোথাও যেন এক টুকরো রামধনুর রেখা দেখতে পেয়েছে মহুল। গত দিন পনেরোর টানা চেষ্টার পরে আজকে ও তার সাথে কথা বলতে পেরেছে। এই বৃষ্টি মাখা রাতে তার সাথে নিজের মনের কথা শেয়ার করতে পেরে সত্যিই অনেকটা হালকা লাগছে মহুলের। সেই কণ্ঠ, সেই গলার দৃঢ়তা, সেই ব্যক্তিত্ব মাখানো কথা,সেসব ই তো ওকে গত কয়েক মাস ধরে বেঁচে থাকতে শিখিয়েছে। মাস তিনেক আগের সেই রাতের স্মৃতি আজও ওর স্মৃতিতে সতেজ। হাজার চেষ্টাতেও যেনো সেই স্মৃতি ও ভুলতে পারবে না।

পার্থ, মহুলের ছোটবেলার বন্ধু।ওর মন খারাপের ঠিকানা। ওর মন ভালো করার ওষুধ। যাকে নিয়েই ও ওর ছোট্ট স্বপ্নময় জগৎ টাকে নিজের মতো করে সাজিয়েছিলো। পার্থ আর মহুলের বাবা ছিলেন ছেলেবেলার বন্ধু। ছিল গলায় গলায় হৃদ্যতা। মহুল ছিলো পার্থর থেকে মাস তিনেকের ছোটো ।মহুল হতেই নাকি পার্থর বাবা বলে দিয়েছিলেন তার ছেলের সাথে মহুলের বিয়ে দেবে।  সেই সূত্রেই দুই পরিবারের কাছে আসা। তারপর পার্থর যখন বছর ছয়েক বয়স,হঠাৎ হার্ট এটাকে পার্থর বাবা মারা যাওয়ার পর মহুলের বাবা পার্থ আর পার্থর মা কে নিজেদের বাড়ির কাছাকাছি একটা বাড়িতে নিয়ে এনে রাখেন। তারপর ধীরে ধীরে দুই মায়ের সান্নিধ্যে আর মহুলের বাবার পরম স্নেহে মহুল আর পার্থ বড়ো হতে থাকে, ধীরে ধীরে একে অন্যের বেস্ট ফ্রেন্ড থেকে একে অপরের পরিপূরক হয়ে ওঠে। ভালোলাগা ধীরে ধীরে গভীর থেকে গভীরতর গভীরতম ভালোবাসায় পরিণত হয়, যার হদিশ হয়তো দুজনের কারও কাছেই ছিলো না। তারপর বছর খানেক আগে দুই পরিবারের সম্মতিতে দুজনের চার হাত এক করে দেওয়া হয়। 

পার্থ ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ায় ভীষণ ভালো ,কিন্তু কোনোদিনই ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার ইঁদুর দৌড়ে যেতে চায়নি। পার্থ ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতো দেশের জন্য কিছু করবে, আর সেই জেদই একদিন পাগলামিতে পরিণত হয়। পার্থ র মায়ের পার্থর এই পাগলামিতে সায় না থাকলেও মহুল এ ব্যাপারে পার্থ কে চিরকাল ভীষণ সাপোর্ট করতো। আর তার জন্যই আজ মহুল অনুতপ্ত। ঠিক বিয়ের এক মাসের মাথায় পার্থর জয়েনিং আসে। তার আগে পার্থ একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে জব করতো। অফার লেটার হাতে পাওয়া মাত্র পার্থ মহুলকে কোলে তুলে নিয়ে ওর কপালে চুমু এঁকে দিয়ে বলেছিলো-“মহুল, তোমার পার্থ আজ পেরেছে নিজেকে দেশের কাজে উৎসর্গ করতে, তুমি খুশি তো?”

মহুল পার্থর খুশিতে জ্বলজ্বল করতে থাকা নিষ্পাপ মুখের দিকে চেয়ে নিজের চাওয়া পাওয়ার হিসেবে ভুলে গিয়ে এক গাল হাসি নিয়ে জানিয়েছিলো সেও ভীষণ খুশি। সেদিন যদি মহুল একবার স্বার্থপরের মতো পার্থকে মুখের ওপর বলে দিতো, সে চায় না পার্থ মিলিটারি তে যাক, তাহলে হয়তো আজ এই বৃষ্টি ভেজা রাতে পার্থর বুকে মাথা রেখে মহুল শান্তিতে ঘুমোতে পারতো।

আজ থেকে ঠিক তিন মাস আগের সেই ভয়ঙ্কর দিন, বাড়িতে সবাই মহুলের জন্মদিন নিয়ে আনন্দ করছে, সেদিনই রাতের ফ্লাইটে পার্থরও বর্ডার থেকে ফেরার কথা ছিলো, মহুলকে জন্মদিনের উপহার দিতে। বাড়ি ভর্তি লোকের মাঝে হঠাৎ করেই ল্যান্ডফোন টা বেজে উঠেছিলো। দিল্লী থেকে ফোন করে বলা হয়েছিলো একটি বাক্য। “আতঙ্ক বাদী হামলায় লেফটেন্যান্ট জেনারেল পার্থ সেন নিহত”। বাক্যটা হয়তো তখনও পুরোটা শেষ হয়নি, তার আগেই জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে যায় মহুল,কারণ ফোন টা রিসিভ করেছিলো মহুল নিজেই। তারপর জ্ঞান ফিরে নিজেকে নিজের ঘরের বিছানায় আবিষ্কার করে প্রথম বারের জন্য ওর মনে হয়েছিলো ওর জীবন বৃথা। ওর জীবনে বেঁচে থাকার কোনোই মানে নেই। তখনও ওর কপালের সিঁদুর, হাতের শাঁখা পলা অক্ষয় ছিলো। ও চেয়েছিলো এই বেশেই নিজেকে শেষ করে দিতে। আর একটু অপেক্ষা করলেই কাল ভোরে পার্থর দেহ হয়তো চলে আসতো, আর তারপরেই ওকে সধবার বেশ ছেড়ে বিধবার বেশ ধারণ করতে হতো। নিজের জীবদ্দশায় সজ্ঞানে পার্থর দেওয়া যে সিঁদুর ও পরে ছিলো সেটাকে মুছে ফেলতে ও পারতো না, সেই জন্যই বাড়ি থেকে চুপি সাড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলো গঙ্গায় নিজেকে ভাসিয়ে দেওয়ার উদ্যেশ্যে। নিজের জন্মদিনের রাত টাকেই নিজের মৃত্যু দিন হিসেবে বেছে নিয়েছিল। 

রাত তখন প্রায় একটা । বাগবাজারে বাড়ি হওয়ার সুবাদে পাশেই ছিল গঙ্গা। চেয়েছিলো নিজেকে গঙ্গার বুকেই উৎসর্গ করতে। জোছনা মাখা রাতের শহরের বুক দিয়ে অলি গলি পেড়িয়ে ও হেঁটে গিয়েছিলো। নিজেকে শেষ করে দিতে মরিয়া হয়ে যখন ঝাঁপ দিতে গিয়েছিলো ঠিক তখনই কেউ যেনো ওকে টেনে নিজের বুকে আছড়ে এনে ফেলেছিলো। অজানা অচেনা কেউ। মহুলের মনে হয়েছিলো পার্থই হয়তো এই অজানা অচেনা মানুষ টিকে পাঠিয়েছে মহুলের প্রাণ বাঁচাতে। সেদিনের প্রত্যেকটি শব্দ, প্রত্যেক টি বাক্য আজও মহুলের মনের মধ্যে সমান ভাবে জ্বলজ্বল করছে।

-আপনি কি পাগল? এভাবে কেউ মরে? আপনার দুটো হাত আছে, দুটো পা আছে, দিব্যি হেঁটে চলে বেড়াচ্ছেন, তাও আপনার জীবনে এতো দুঃখ? কিসের? কিসের জন্য আপনি এভাবে নিজেকে শেষ করে দিতে যাচ্ছিলেন? আজ ভাগ্যিস আমার কাজ সেড়ে ফিরতে লেট হয়েছিলো, আর শর্টকাট হয় বলে এই রাস্তা দিয়ে ফিরছিলাম, নয়তো আপনার কি হতো? এতক্ষনে তো বানে ভাসতে ভাসতে মোহনায় পৌঁছে যেতেন? কি হলো? চুপ কেন? কিছু বলবেন?

সেদিন সত্যিই কিছু বলার মতো অবস্থায় ছিলো না মহুল, চোখ দিয়ে জল ও বেরোচ্ছিলো না, শুধু ফ্যালফ্যাল করে সেই অনাহুত ব্যক্তিটির মুখের দিকে তাকিয়ে বসেছিলো। 

-দেখুন, নিজের চোখেই দেখুন ঐ যে, পাড়ে শুয়ে আছে ঐ ভদ্রলোক? দেখুন ও ভালো করে হাটঁতেও পারে না, ওর জীবনের দুঃখ কি আপনার থেকে কিছু কম? ওর মাথার ওপর ছাদ টুকুও নেই, তাও বাঁচার কথা কিন্তু ভোলেনি? ওর তো সবচেয়ে সুবিধা,গঙ্গায় টুক করে ঝাঁপিয়ে পড়ে জীবন এ দাঁড়ি টেনে দেওয়ার, কৈ ও তো সেটা করছে না, বরং দেখুন হাতের স্ক্র্যাচটাকে  আঁকড়ে ধরে ও শুয়ে আছে।প্রতিনিয়ত বাঁচার জন্য যুদ্ধ করছে, আর আপনি? 

মহুল আর চুপ থাকতে পারেনি। একেই বোধহয় বলে ধাক্কা দিয়ে কাঁদানো। সেদিন ইচ্ছা করে মহুলকে অপমানে অপমানে জর্জরিত করে তুলেছিলেন ভদ্রলোক। যাতে মনের দুঃখ মনে চেপে না রেখে বাইরে আনতে পারে।

এরপর মহুল হাউহাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়ে। ও বলে ওর জীবনের মানে ও হারিয়ে ফেলেছে। ভদ্রলোক সবটা জেনে বলে, 

-পার্থ মরেনি, পার্থ কে বাঁচিয়ে রাখার দায় আপনার। আপনার কাজের মধ্যে দিয়ে আপনার ভালোবাসা বেঁচে থাকবে। আপনি ভাবছেন কেন পার্থর জীবন এখানেই শেষ? আপনি আজ থেকে নতুন করে বাঁচুন, নিজের জন্য না, সমাজে অনেক কিছু আছে, করার জন্য, তাদের নিয়ে ভাবুন, তাদের জন্য কিছু করুন। আপনিই তো বললেন, পার্থ চাইতো দেশের জন্য কিছু করতে, মানুষের জন্য কিছু করতে, তাহলে আপনি কি ভাবছেন মরে গেলেই ওর প্রতি ভালোবাসা দেখাতে পারবেন? আপনি পার্থর শেষ না করে যাওয়া কাজ টা শুরু করুন, নতুন উদ্যমে মনের জোড় আনুন, নিজের কথা ভুলে অন্যের জন্য বাঁচুন, দেখবেন এতেই পার্থর আত্মা শান্তি পাবে। এভাবে জীবনের কাছে হার মেনে নিলে পার্থ বোধহয় কোনোদিন ও খুশি হতে পারবে না। 

সেদিন ভদ্রলোকের কথা মোহমুগ্ধের মতো করে শুনেছিল মহুল। কি সাবলীল সেই কথা বলার ভঙ্গি। কি দৃঢ় সেই কণ্ঠ, কি প্রচন্ড ব্যক্তিত্ব সেই কথায়, মহুল যেন চেয়েও অস্বীকার করতে পারছিল না ভদ্রলোকের কথাগুলো। 

সেই অনাহুত ভদ্রলোক নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে সেদিন বলেছিলেন উনি মানুষের মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা গোপন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন।  নিজের পরিচয় সেদিন তিনি পুরোপুরি গোপণ করেননি ঠিকই কিন্তু কোনোও সুস্পষ্ট ভাবে জবাব ও দেননি। শুধু কথায় কথায় নিজের নাম টি বলে ফেলেছিলেন। সেদিন তিনি নিজে দায়িত্ব নিয়ে মহুলকে ভোর হওয়ার আগে বাড়ির গেট অবধি ছেড়ে দিয়ে যান। বিনিময়ে শুধু কথা আদায় করে নেন যে এরপর যেন মহুল কক্ষনো এরকম সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে এই রাতের কথা একবার হলেও ভাবে। 

মহুল সেদিন রাতে প্রাণে বেঁচে গেলেও ওর মনের মধ্যেকার ক্ষত রয়েই যায়। তখন সবে সবে মহুল সধবার পোশাক ছেড়ে সাধারণ সাদা কাপড় গায়ে চরিয়েছে, মাথার সিঁদুর ধুয়েছে, হাতের শাঁখা পলা ভেঙে নতুন সাজে সেজেছে, তখন একদিন হঠাৎ ই রাতের বেলায়  রেডিও তে গান শুনতে শুনতে একটা চ্যানেলে এসে ও থমকে যায়। সেই কণ্ঠ, সেই দৃঢ়তা একদম অবিকল সেই গলা। মহুল শোনে রেডিও ৯২.৩ এফ.এম থেকে ভেসে আসছে- “ব্রেকের পর আপনাদের প্রিয় আর.জে অভিষেক আপনাদের মনের গোপন অন্ধকার দূর করতে চলে এসেছে। বলুন আপনাদের মনের যাবতীয় দুঃখ, ক্ষোভ, মান অভিমান যা আছে সব কিছু শেয়ার করুন আমার সাথে, আমি আপনাদের সব কথা শুনবো, আর আপনারা চাইলে আমি সেসবের সমাধান দেওয়ার ও চেষ্টা করবো। আসুন, নিজেকে উজাড় করে দিন, কোনোও দুঃখ চেপে রাখবেন না….”

মহুলের মনে পড়ে সেদিন রাতের সেই ভদ্রলোক ও তো বলেছিলেন ওনার নাম অভিষেক, এও তো বলেছিলেন যে উনি মানুষের গোপন প্রশ্নের উত্তর খুঁজে দেন। তারমানে ইনিই তিনি। একই রকম সুস্পষ্ট উচ্চারণ, সেই কণ্ঠ। এরপর প্রতিদিন মহুল রাত ১০টা থেকে ১২টা পর্যন্ত আর.যে অভিষেকের অনুষ্ঠান শুনতে থাকে। সকলের নানা রকম দুঃখের কথা শুনে মহুল বুঝতে পারে, থেমে থাকার নাম জীবন না, জীবনে চলতে থাকাই আসল। 

মহুল নিজেকে আস্তে আস্তে এরপর গুছিয়ে নিতে থাকে। ওর পরিবারের সকলেই ওর এরকম ব্যবহারে বেশ অবাক হলেও মনে মনে খুশি হয় এই ভেবে যে মেয়েটা নিজের জীবনটাকে শেষ করে না দিয়ে বরং নিজের কাজের মধ্যে দিয়ে পার্থ কে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। পার্থর কাজ মিটে যাওয়ার মাস খানেক পরেই মহুল চাকরি তে জয়েন করে। তারপর পথ শিশুদের নিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান শুরু করে, এখন তো রেড লাইট এরিয়াতেও গিয়েও বাচ্চাদের পড়ায়, আর এসব করার জন্যই ও চাকরি টা চেয়েও ছাড়তে পারেনি। কারণ চ্যারিটি করার জন্য টাকার প্রয়োজন, আর মহুল চেয়েছিলো ও নিজের টাকাতেই এসব করে। তাই ও এখন অনেক গুলো এন.জি.ও তে নিয়মিত ডোনেশন দেয়, এমনকি নিজেও অনেক জামা কাপড় বই খাতা কিনে নিয়ে গিয়ে বাচ্চাদের হাতেহাতে দিয়ে আসে। ও এখন অনেক টা স্বাভাবিক হলেও, ওর মনের ভিতরে সেই জমাট বাঁধা কালো মেঘ এখনো পুরোপুরি সরে যায়নি। আজও প্রতি রাত ওর বিনিদ্র রজনী হয়েই কাটে। শুধু সারাদিনের কাজের ব্যস্ততার মাঝে ও পার্থ কে ভুলে থাকার চেষ্টা করে যায়, আর রাত ১০টা থেকে ১২টা অভিষেকের গলার আওয়াজ শুনে পরের দিন বেঁচে থাকার রসদ যোগায়। 

আসতে আসতে মহুলের ক্রমশ মনে হচ্ছে, মহুল যেন ঐ দু ঘন্টার জন্য বেঁচে থাকতে শুরু করেছে। ও সারাদিন ঘড়ির কাঁটার সাথে ছুটতে থাকে আর ভাবে কখন ঘড়িতে ১০টা বাজবে,আর ও সেই কণ্ঠ শুনতে পাবে। সেদিন সেই অনাহুত দৃঢ় কণ্ঠের ভদ্রলোক ওর প্রাণ বাঁচিয়ে আগে থেকেই ঋণী করে দিয়েছিলেন,কিন্তু এখন নিজের অজান্তেই মহুলের সেই ঋণের বোঝা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। যেটা শোধ করার ক্ষমতা হয়তো ওর এ জন্মে হবে না, অথবা এমন টা বলা যেতে পারে সব ঋণের কখনও শোধ হয় না। তাই সেই বৃথা চেষ্টা মহুল করেওনা। শুধু একবার ও ওনাকে পার্সোনালি মিট করে ধন্যবাদ জানাতে চায়। আর সেই জন্যই গত পনের দিন ধরে রেডিও স্টেশন এ ফোন করার চেষ্টা করছিলো।কিন্তু কিছুতেই ফোন পাচ্ছিলো না, যখনই ফোন করে তখনই লাইন বিজি বলে। 

অবশেষে আজকে ওর দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবশান হয়েছে। তখন বাজে ঠিক রাত সাড়ে দশটা। অন্যন্যদিনের মতো আজকেও ও বারবার ট্রাই করছিলো, হঠাৎ ই রিং হলো, কিছুক্ষনের মধ্যেই ফোনের ওপাশ থেকে ভেসে এলো সেই কণ্ঠ-

-“হ্যালো, ফোনের ওপারে আমার সাথে কে তার মনের গোপন কথা শেয়ার করছে, আমরা কি তার নাম জানতে পারি?”

 -আমি মহুল। মহুল সেন। গলার আওয়াজ টা যেন হঠাৎ করেই থেমে গেলো, শুধু কিছু গভীর নিঃশ্বাস কিম্বা দীর্ঘনিঃশ্বাস শুনতে পাচ্ছিলো মহুল।

-হ্যালো? আমি কি আমার মনের কথা বলতে পারি?

ফোনের ওপাশ থেকে আবার সেই কণ্ঠ ভেসে এলো!

-নিশ্চই, আপনি বলুন আপনি কি বলতে চান?

-আমি মাস তিনেক আগে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলাম, হঠাৎ আমাকে একজন ভদ্রলোক বাঁচান, আমি আজও তাকে খুঁজে চলেছি। ভগবানকে সামনে থেকে কখনও দেখিনি। ওনাকে দেখেছিলাম। যদি আর একটি বারের জন্য ওনাকে সামনে দেখতে পেতাম তাহলে শেষ বারের জন্য ওনাকে একটি বার ছুঁয়ে দেখতাম,আর আমাকে নতুন জীবন উপহার দেওয়ার জন্য একটি বার ধন্যবাদ জানাতাম।

মহুল বেশ ভালোভাবেই টের পেলো, ফোনের ওপাশে দীর্ঘনিঃশ্বাস এর পরিমাণ বেড়ে গেছে, ভদ্রলোক যেন অনেক কিছু বলতে চেয়েও পারছেন না।

-কি হলো? আপনি কি তাকে একটু বলে দেবেন, যদি সে সত্যিই আমার কথা শুনে থাকে, বুঝে থাকে, তাহলে একটি বারের জন্য যেন সে সেখানে চলে যায়?

-হু? কোথায়?

নিঃশ্বাসের তীব্রতা যেন আরও বেড়েছে।

-যেখানে আমি তাকে প্রথম বারের জন্য দেখেছিলাম, যেখানে সে আমাকে নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছিল, যেখানে আমি সব হারিয়ে নতুন করে অনেক কিছু ফিরে পেয়েছিলাম, সেই স্থানে, সে জানে..তাকে বলতে হবে না! 

-হুম। আচ্ছা, তাহলে সত্যিই যদি তুমি শুনতে পাও মহুলের কথা, চলে যেও তোমাদের সেই প্রথম দেখা হওয়ার জায়গায়। 

কিন্তু ম্যাডাম কখন?

-ঐ যে, একই সময়, একই স্থানে। সে জানে। সে সবটা জানে। আপনি বলে দিন কাল আমি তার জন্য সেই একই সময়ে একই জায়গায় অপেক্ষা করবো। সে যদি আমার কথা শুনে থাকে, তাহলে যেন একবারের জন্য হলেও আসে। 

-নিশ্চই। আপনি যদি সত্যিই বুঝে থাকেন মহুল আপনাকে কোথায় যেতে বলছে তাহলে চলে যাবেন। ধন্যবাদ। সঙ্গে থাকুন। মহুল?

-হু?
-আপনার জন্য আমার তরফ থেকে একটি গান উপহার রইলো।

ওমনি ফোন টা কেটে গিয়ে গান আরম্ভ হলো-
ওরা মনের গোপন চেনে না..
ওরা হৃদয়ের রং জানে না..
প্রজাপতি ডানা ছুলো বিবাহ বাসরে
কেন সারারাত জেগে বাড়ি ফিরি ভোরে
ওরা মনের গোপন চেনে না
ওরা হৃদয়ের রং জানে না..

গান টা শুনতে শুনতে আর বাইরে বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে মহুল যেন কোথায় হারিয়ে ফেললো নিজেকে। বাইরে অঝোর ধারায় বৃষ্টির ফোঁটা গুলো ঝরছে, আর ওর মনে তখন মেঘ কেটে হালকা রামধনুর রেখা ফুটছে। অজানা এক ভালোলাগায় মহুল নিজের অজান্তেই খুশি হয়ে উঠছে। না এটা পার্থ কে ভুলতে পাড়ার আনন্দ নয়, অথবা নতুন করে কিছু স্বপ্ন দেখার আনন্দ ও নয়, এই আনন্দ বড্ড অচেনা মহুলের। যেন সারা পৃথিবীতে সব কিছু হারিয়ে অনেক কিছু পাওয়ার এক নির্মল আনন্দ। ঠিক যেমন রবি ঠাকুর তার গানে লিখে গেছেন, “আনন্দ ধারা বহিছে ভুবনে..” এ যেন ঠিক তেমনই কোনো আনন্দের বারি ধারায় ভিজছে মহুল। এক নির্মল নিষ্পাপ ভাব আসছে ওর সারা হৃদয় জুড়ে..বাইরে থেকে অন্যেরা দেখে হয়তো এটাকে প্রেম বলে ভ্রমিবে, কিন্তু এ এক অজানা অনুভূতি। যাতে কোনকিছু হারাবার ভয় থাকে না, যাতে কোনকিছু পাওয়ার লোভ থাকে না, যাতে উজাড় করে শুধু দু হাতে ভালোবাসা

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait