পুরাণে বর্ণিত  দেব দেবীর পরিচয় ও বৈদিক দেবদেবী

পুরাণে বর্ণিত দেব দেবীর পরিচয় ও বৈদিক দেবদেবী


ঈশ্বর নিরাকার হলেও তিনি যে কোন রূপ ধারণ করতে পারেন। ঈশ্বরের ক্ষমতা সীমাহীন। সীমাহীন তার গুণ। ঈশ্বর যখন নিজের গুণ বা ক্ষমতাকে আকার দান করেন,তখন তাকে দেবতা বলা হয়। যেমন ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব, দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী প্রভৃতি দেবদেবী। দেবতারা স্তুত বা প্রশংসিত হয়ে অভিষ্ঠ পূরণ করেন তাই তারা দাতা। আবার নিজে দীপ্তি পান এবং অন্যকে সেই দীপ্তি দ্বারা প্রকাশ করেন বলেও তিনি দেবতা। বিভিন্ন নামে বিভিন্ন রূপে পূজিত হলেও দেবতারা এক অবিভক্ত অদৃশ্য পরমব্রহ্ম যা ঈশ্বরের ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ। ঋকবেদের একটি মন্ত্রে  বলা হয়েছে, "এক অখণ্ড ও চিরন্তন ব্রহ্মকে বিপ্রগণ বা জ্ঞানীরা বিভিন্ন নামে অভিহিত করেছেন। দেবতাদের করুনা লাভের জন্য পূজা করা হয়। পূজা করলে দেবতারা খুশি হন। মানুষ দেবতাদের কৃপা লাভ করে অন্তরে সুখ ও শান্তি পায়।  দেব-দেবীর পূজা বিভিন্ন সময় করা হয়। কোনো কোনো দেব দেবীর পূজা প্রতিদিনই করা হয়। যেমন ব্রহ্মা, কার্তিক, সরস্বতী প্রভৃতি।

ADVERTISEMENT


 আমাদের আদি ধর্ম গ্রন্থ বেদের ওপর ভিত্তি করে পুরাণ নামক ধর্মগ্রন্থসমূহ রচিত হয়েছে। বেদ ও পুরাণে বিভিন্ন দেবদেবীর রূপ, শক্তি, প্রভাব, সামাজিক গুরুত্ব এবং পূজা প্রণালী বর্ণনা করা হয়েছে। এছাড়া আরও কিছু দেবতা রয়েছেন যাদের কথা বেদ ও পুরাণে নেই। কিন্তু ভক্তগণ যুগ যুগ ধরে পূজা করে আসছেন। এভাবে আমরা তিন প্রকার দেবতার পরিচয় পাই যথা বৈদিক দেবতা, পৌরাণিক দেবতা ও লৌকিক দেবতা।


বৈদিক দেবদেবী
বেদে যে সমস্ত দেবতার কথা বলা হয়েছে তাকে বৈদিক দেবতা বলে। যেমন অগ্নি, ইন্দ্র, মিত্র, রুদ্র, বরুণ, বায়ু, সোম প্রভৃতি। বৈদিক দেবী হিসাবে সরস্বতী ঊষা অদিতি রাত্রি প্রভৃতি।  বৈদিক দেবতাদের কোন মূর্তি ছিল না। দেবতাদের শরীর ছিল মন্ত্রময় । হোমানল প্রজ্বলিত করে বা অগ্নির মাধ্যমে দেবতাদের আহ্বান করা হত। প্রজ্বলিত যজ্ঞাগ্নিতে বিভিন্ন দেবতার উদ্দেশ্যে ঘৃত, পিঠা-পায়েস,মাংস প্রভৃতি অর্পণ করা হত। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কার্যাবলীকে এক বৃহৎ যজ্ঞ বলে মনে করতেন বৈদিক ঋষিরা। তাই তাদের যাগকর্ম বিশ্বযজ্ঞের প্রতীক হয়ে উঠত। অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করে বেদের মন্ত্র উচ্চারণ করে শ্রদ্ধা জানানো হত। তাদের কাছে মঙ্গল প্রার্থনা করাকেই যজ্ঞ বলে। বৈদিক যুগের উপাসনা ছিল যজ্ঞ ভিত্তিক। বৈদিক মন্ত্রে দেবতাদের রূপ ও ক্ষমতার বর্ণনা করা হত। বেদে দেবতাদের তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে যথা স্বর্গের দেবতা, অন্তরীক্ষ লোকের দেবতা ও মর্ত্য লোকের দেবতা।


স্বর্গের দেবতা

যে দেবতারা স্বর্গলোকে অবস্থান করেন তারা স্বর্গের দেবতা বলা হয় ।যেমন সূর্য, যম,বরুণ প্রভৃতি।  স্বর্গের দেবতাদের ক্ষমতা অসীম ।তারা মর্তলোকে বা পৃথিবীতে আসেন না।


অন্তরীক্ষ লোকের দেবতা
স্বর্গ,মর্ত্যে এর মাঝামাঝি যে দেবতারা অবস্থান করেন তারা অন্তরীক্ষ লোকের দেবতা ।অন্তরীক্ষ লোকের দেবতারা মর্ত্যে আসেন কিন্তু থাকেন না। যেমন ইন্দ্র,বায়ু প্রভৃতি।


মর্ত্যলোকের দেবতা
মর্ত্যলোকে বা পৃথিবীতে যে দেবতারা অবস্থান করেন তারা মর্ত্যলোকের দেবতা।  মর্ত্যলোক বা  পৃথিবীর দেবতারা পৃথিবীতে আসেন,থাকেন।  আমরা তাদের দেখতে পাই যেমন অগ্নি।  অগ্নিকে আমরা দেখতে পাই । তিনি পৃথিবীতে অবস্থান করেন।  অগ্নিদেব পৃথিবীতে অবস্থান করেন বলে অগ্নি প্রজ্বলিত করে সেই অগ্নিতে ঘৃত, পিঠা-পায়েস, মাংস প্রভৃতি ভালো ভালো জিনিস অগ্নির মাধ্যমে উৎসর্গ করে তাকে আহ্বান জানানো হয়। অগ্নির মাধ্যমে আহুত দেওয়া দ্রব্যাদি দেবতাদের কাছে পৌঁছে যায়। বৈদিক দেবতাদের বর্ণনা খুবই চিত্তাকর্ষক। আমরা এখানে সংক্ষেপে অগ্নিদেব এবং উষাদেবী বর্ণনা দিচ্ছি।


অগ্নি
 ঋকবেদের প্রধান দেবতাদের অন্যতম অগ্নি।  অগ্নিদেব তাদের মুখ।  অগ্নি মুখে দেবতাগণ ভোজন করেন।  এর অর্থ হলো অগ্নির মাধ্যমে দেবতাদের কাছে দ্রব্যাদি উৎসর্গ করা হয়।  অগ্নিকে অন্যান্য বৈদিক দেবতাদের দূতও বলা হয়েছে। কারণ তিনি দেবতাদের কাছে যজ্ঞকারীর প্রদত্ত দ্রব্য পৌঁছে দেন।  অগ্নি যজ্ঞের অবলম্বন ।সেজন্য অগ্নিকে বলা হয়েছে ঋত্বিক,পুরোহিত ও হোতা।  বৈদিক দেবতাদের কোন বিগ্রহ ছিল না তবে বেদে শরীরধারীর মতো করে অগ্নির বর্ণনা করা হয়েছে।  তার মুখমণ্ডল ও পৃষ্ঠদেশ ঘৃতবর্ণ,  কেশরাশি স্ফুলিঙ্গ বর্ণ,  দন্ত সুবর্ণ ভাস্বর,  চিবুক সুগঠিত ও উন্নত। বৈদিক আর যজ্ঞগৃহে মঙ্গল কার্যাবলী সর্বদা অগ্নি কর্তৃক রক্ষিত হত। সেজন্য অগ্নিকে গৃহপতিও বলা হয়।


ঊষা
ঋকবেদে দেবতাদের চেয়ে দেবীদের সংখ্যা কম।  এই কম সংখ্যক দেবীর মধ্যে ঊষা অতুলনীয় হয়ে বিরাজ করছেন।  সূর্যোদয়ের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে পূর্ব আকাশের কোণে যে মনমুগ্ধকর অরুণ বর্ণ দেখা যায় তাকেই বলা হয়েছে ঊষা।  সেই কোণটিকে বলা হয়েছে ঊষাকাল আর ঊষা কালের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন ঊষা।  ঊষা দেবী রাতের অন্ধকার দূর করে আলোকোজ্জ্বল জগতের সন্ধান দেন।  তার আগমনে জীবজগৎ কর্মচঞ্চল হয়ে ওঠে।  মায়ের মতো তিনি সবাইকে লালন পালন করেন।  ঊষাকালে আমরা ঘুম থেকে উঠে সারাদিন ভালোভাবে চলার পণ করি।

 

তথ্যসূত্র
Monier-Williams, Monier। A Sanskrit-English Dictionary। Delhi: Motilal Banarsidass Publishers।.Sri Satguru Publications.Delhi
Pargiter, F.E. 1922.
Ancient Indian Historical Tradition. London. Oxford University Press.
Shulman, David Dean. Tamil Temple Myths - Sacrifice and Divine Marriage in the South Indian Saiva Tradition. আইএসবিএন ০-৬৯১-০৬৪১৫-৬
Thapan, Anita Raina (১৯৯৭)। Understanding Gaņapati: Insights into the Dynamics of a Cult। New Delhi: Manohar Publishers। আইএসবিএন 81-7304-195-4।
Thurston Edgar. Castes and Tribes of Southern India (Vols I-V). Cosmo Publication, Delhi.

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait