ঘরবন্দী জীবন ছাদের কার্নিশে

ঘরবন্দী জীবন ছাদের কার্নিশে

আজ বিকেলে ছাদে উঠে দেখলাম সারা পাড়ার লোক প্রায় ছাদে। এ দেখে হাত নাড়ে তো,ও বলে কী রে খবর কী! আমিও খানিক হেসে, খানিক দুখী মুখ করে নিজের আর সমাজের দুর্গতির কথা বলতে শুরু করলাম। দেখো না, কাজের মাসির তো ছুটি, বাসন মেজে আর ঘর মুছে শরীর কাহিল, কিংবা কী রোগ এলো বলো দেখি, কী করে চলবে গো এভাবে! ওপাশেরও একই হাল। পাশের ফ্ল্যাটের ছাদে দেখি জোর কদমে ব্যাডমিন্টন খেলা চলছে। বেশ টিম বানিয়ে বাবা ছেলের জুটি সিরিয়াস মুখে খেলে যাচ্ছে । সুগার পেশেন্ট আমার শ্বশুরমশাই তো গোটা চল্লিশ পাক খেয়ে ফেলেন ছাদেই। জল ফড়িংয়ের মত বাচ্চাগুলো নেচে বেড়ায় ছাদময় ।

ছোটবেলা জুড়ে আমাদের একটা ছাদ ছিল, বিকেল হলে টুক করে ছাদে উঠে যেতাম। ছাদের কার্নিশে হাত দিলে মনে হতো এটাই আমার একলা পৃথিবী। ছাদ জুড়ে আচারের দুপুর, ঘুড়ির দুপুর, শীতের রোদ মাখা দুপুর, বৃষ্টি ভেজা বর্ষা, লোডশেডিং এর রাত, তারাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব , প্রেমের চিঠির ঘ্রাণ সব নিয়ে জীবন জুড়ে ছিল বাড়ির ছাদ। ফ্ল্যাট বাড়ি গড়ে ওঠার আগে আমরা বড়ো বেশি ভালোবাসতাম ছাদকে। ছোটবেলায় মাঝরাতে ঘুম ভেঙে অনেক সময় দেখেছি, বাবা আর মা ছাদে বসে নিজেদের গল্পে মশগুল। সারাদিনের কাজ, সংসার আর চাকরির পর ওদেরও একান্ত জায়গা ছিল ওই ছাদ টুকুই। আমার বিয়ের পরও ছুটির বিকেলগুলো ছাদে বসে নিজেদের ছোটবেলার গল্প একে অন্যকে শোনাতে কেটে যেত। সংসার থেকে আড়াল হতে চাইলে আমরা তখন ছাদকেই আশ্রয় করতাম। বাড়ির কর্তারা বেরিয়ে গেলে দুপুর থেকে ছাদেই কাটত আমাদের,এটাও শুনেছি আমার দিদি শাশুড়ির মুখে। একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে যাওয়ার আগে পর্যন্ত বাড়ির বউদের হাসি রাগ অভিমানের একমাত্র ভরসার জায়গা ছিল ছাদ।

ADVERTISEMENT

সময় বদলের সঙ্গে বাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাট উঠেছে। যারা বাড়িতে থেকে গেছেন তাদের হাঁটু ছাদে ওঠার জন্য আর মজবুত থাকেনি। বিকেল হলে ছেলে মেয়েরা ব্যাগ নিয়ে টিউশনে চলে গেছে। পাড়ার পার্ক বাচ্চাদের কোলাহলে মুখর হয়ে উঠতো। নাচের ক্লাস, গানের ক্লাস, কবিতা, আঁকা, সাঁতার ক্যারাটে টেবিল টেনিসের ক্লাস শুরু ওই বিকেল থেকে। তাদের সঙ্গে গেছেন মায়েরা। বাড়ির বা ফ্ল্যাটের দরজায় তালা ঝুলিয়ে। কেউ ওই বিকেলে ভীড় বাসে গলদ ঘর্ম হয়ে ফিরেছেন সংসারে। কর্তাদের কথা বাদ দিলাম । অফিস, মিটিং করে কেটে যাচ্ছিল সোম থেকে শুক্র, ছুটির দিন গুলো আরামে আয়েশে , সপরিবারে রেস্টুরেন্ট বা মলে ঘুরে আবার সোমবার থেকে টাই ঝুলিয়ে অফিস ছোটা। কর্তা গিন্নীর একান্ত সময় এখন আর ছাদের নির্জনতা নয়, মাল্টিপ্লেক্সে বা বাড়িতে বসে সিনেমা দেখা কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে পানীয় বা বার্বি কিউ দিয়ে জমাটি আড্ডা।
এদিকে ছাদের কার্নিশে শ্যাওলা জমেছে দিনের পর দিন। বুক চাপা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে একসময় বুড়ো হয়ে গেছে। ফ্ল্যাটের ছাদ জমে উঠেছে কখনো দোলের দিন, দিওয়ালির দিন বা ঘুড়ির ওড়ানোর দিন। কচিৎ কদাচিৎ গরমের সন্ধ্যে হলে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু সেই দাঁড়ানো ফোনের ওপাশের মানুষটার সঙ্গে একা হবার জন্য। ছাদের কাছে আসার জন্য নয়। কিংবা কখনো যখন ছাদের গাছে জল দিতে এসেছে মানুষগুলো,তাদের দিকে কৃতজ্ঞ চোখে তাকিয়েছে ছাদের কার্নিশ, ছাদের কোন। আরো ফুল ফুটুক, বেল জুই জবা আর তোমরা আমার সঙ্গে থাকো, আবার এসো সকাল বিকেল, এভাবে একা করে দিও না , পাঠাও না তোমাদের ছেলে মেয়েগুলোকে, দাপিয়ে বেড়াক আমার ওপর তোমাদের ছোটবেলার মতন।।আমরা কান দিই নি, আমরা শুনতে পাইনি। নিজেদের ব্যস্ত করে এই তুচ্ছ আর্জিকে মুচকি হেসে এড়িয়ে গেছি।

এরপর পৃথিবীর এই দারুন অসুখে আমরা বন্দী করলাম নিজেদের বাড়িতে বা ফ্ল্যাটে। আস্তে আস্তে বাইরে বেরুনো বন্ধ হয়ে গেল, নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া আমরা আর বারমুখো হচ্ছি না। সারাদিন যেমন তেমন রান্না গৃহস্থালী বা অনলাইন ক্লাস বা ওয়ার্ক ফ্রম হোম করে কেটে গেলেও বিকেল টা আমাদের ছাদে ওঠা ছাড়া উপায় রইলো না। ১৮দিন ধরে ঘরে থেকে থেকে মানুষের অভ্যেস বদল হলো। মানুষ নিজেকে সময় দিলো। আর বিকেল গুলো ভিড় করে এলো ছাদে।
পাশের বিল্ডিং এর অচেনা দম্পতিও মেসোমশাই মাসিমা হয়ে উঠলেন অচিরেই। সামনের ফ্ল্যাটের সারাক্ষণ সাজগোছ করে পরিপাটি থাকা মিসেস রায় বিনা মেকআপেই ছাদে হেঁটে বেড়াতে লাগলেন। রং না করা চুলে সাদা রঙের ঝিলিক, সেটা উপেক্ষা করেই এসে দাঁড়াচ্ছেন কার্নিশের পাশে। আমাদের পাশের বাড়ির চক্রবর্তী কাকু কাকিমা ঝগড়াঝাঁটি কমিয়ে বিরস মুখে ছাদে চায়ের কাপ নিয়ে ঘোরেন, আজকাল কথাও হয় আমার সঙ্গে। ওনাদের মেয়ে আসে একটু সন্ধ্যে করে ছাদে, ফোনে কথা বলতে বলতে দেখি মুখ রাঙা হয়ে উঠেছে। ছাদে ঘুরতে ঘুরতে যে কনফারেন্স কলে অফিসে মিটিং সেরে নেওয়া যায় তাও আমি আজকাল জানছি। ছাদে দাঁড়িয়ে যে ব্যস্ত রাস্তা দেখতাম সেই রাস্তায় জীবন যেন থমকে গেছে। আর হঠাৎ করে পাড়া জুড়ে উঠে এসেছে ছাদ।

আমার সেই কবেকার স্কিপিং রোপ আবার বেরিয়েছে। মেয়ে সেটা নিয়ে সারা ছাদ ছুটে বেড়ায়, আমরা পাড়ায় ছুটতাম, ওর তো সে উপায় নেই। লুডো আর দাবার বোর্ড নিয়ে বাড়ির সবাই একযোগে বসে পড়ছি ওর সঙ্গে।
সময় কাটানো বেজায় মুশকিল এখন, আর একটা সময় আমরা এই সময়গুলোকে কত সহজে উপেক্ষা করেছি।

ঘরবন্দী জীবন আমাদের অনেক কিছু শিখিয়ে যাবে আশাকরি। ছাদ একটা রূপক মাত্র, এমন অনেক কিছু আমরা অবলীলায় অবহেলা করে সরিয়ে রেখেছি আমাদের জীবনে।
যে ভালোবাসে না সে অবহেলা করে, যে ভালোবাসে সেও হেলায় এড়িয়ে যায় কখনো। ভালোবাসার মানুষ হোক বা ছাদ অবহেলা বড় সহজে করা যায়। মুহুর্তের অবহেলা কোথায় গিয়ে ভাইরাসের মত হৃদয়ে গর্ত করে দেয় তা কেউ বোঝে বা বোঝে না। মানুষের থেকে শারীরিক ভাবে দূরে থাকার সময়ে , আজ আমরা আরো কাছে আসতে পারছি বোধহয় মানুষের , ভালোলাগা জিনিসের। এই দুর্দিনে তাই বা কম কী!


0 comments

Illora Chattopadhyay

Illora Chattopadhyay

জন্মসূত্রে বড় হওয়া উত্তরপাড়ায়। সংস্কৃত সাহিত্যে এম.এ পাশ করার পর ১৫ বছর হুগলী জেলার একটি গ্রামীন আধাসরকারি স্কুলে শিক্ষকতা । সংস্কৃত নিয়ে পড়াশোনা করলেও প্রিয় বিষয় বাংলা। বাংলা সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা চিরকালীন। মাঝে কিছুদিন পত্র পত্রিকায় বইয়ের রিভিউ লেখা। তারপর দীর্ঘদিনের বিরতি। প্রাণের টানে আবারও ফিরে আসা সাহিত্যের প্রাঙ্গণে। তবে এবারে শুধু আর পুস্তক আলোচনা নয়, তার সঙ্গে মৌলিক লেখালেখির শুরু। মূলত সোশাল মিডিয়ায়। তারপর থেকে বিভিন্ন ওয়েবম্যাগ, কাগজের পত্রপত্রিকাতে নিয়মিত লিখে চলা।যদিও নিজেকে লেখক নয়, পাঠক মনে করতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করি।

FOLLOW

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait