রোজকার মত অফিসে অফিসে ঘুরে চাকরি না পাওয়ার ব্যর্থতা নিয়ে ভিড় বাসে বাড়ি ফিরছিলাম হঠাৎ করেই চোখে পড়ল একটা পরিচিত মুখ। “মিতা” না! লেডিস সিটে বসে আছে জানালাটার ধারে , কনডাক্টরকে টিকিট কাটার জন্য টাকা দেবো বলে ঘার ঘোরাতেই নজরে পড়ে মুখটা।কিন্তু ও এখানে কোথায় ! ঠিক দেখলাম তো ! আরো একবার দেখার চেষ্টা করলাম,বেশ ভিড় হয়েছে বাসে ,একটু ঠেলাঠেলি করে মুখটা বাড়াতে দেখি, মেয়েটি মুখটা ঘুরিয়ে রেখেছে জানালার দিকে।বাসের সাথে পাল্লা দিয়ে চলা ট্যাক্সিগুলো দেখছে মনে হয়।ঐ তো ডান নাকের পাশের তিলটা!এবার আর চিনতে অসুবিধা হল না , এটা তো মিতাই। ঠেলাঠেলি করে লেডিস সিটের দিকে ঘুরে দাঁড়ালাম,মেয়ের থেকে ছেলের সংখ্যায় বেশি তাই কেউ তেমন প্রতিবাদ করলো না। আর আজকাল প্রতিবাদ শুনছেই বা কে! সরকার তো কবেই বন্ধ করেছে, ঈশ্বর ও আর শুনছে না।সিটটার সামনে এসে দাঁড়ালাম বটে কিন্তু বলব টা কি ! চিনতে পারবে তো! প্রায় সাত বছর পর দেখা।
ADVERTISEMENT
একটু উশখুশ করছিলাম,আগের জায়গায় ফিরে যাবো কিনা সেটাও ভাবলাম একবার।এমন সময় বাইরের হাওয়ায় চুলটা এলোমেলো হয়ে যাওয়াতে সেটা সামলে নিলো, আর তাতেই মুখটা তুলে দেখতে পেলো আমায়। খুব যে আহামরি সুন্দরী,তা সে কোনোকালেই ছিল না।তামাটে রং ছিলো তার,তবে মুখটা খুব মিষ্টি, হয়তো নিষ্পাপ হাসিটার জন্যই আরো মিষ্টি লাগতো ,হয়তো বা শুধু আমারই মিষ্টি লাগতো।একটা শুকনো হাসি হাসল সে , সেই হাসির কাছে এ কিছুই নয়।যেন হাজার ওয়াটের হ্যালোজিন এর বদলে একটা মোমবাতি, কিন্তু অন্ধকারে এই মোমবাতি ই তো ভরসা।মিতা আর আমার সম্পর্ক অন্ধকারেই তো এখন।আমিও ঘেমো মুখে একটা নিষ্প্রাণ হাসি হাসলাম।আর তো কোনো উত্তর আমার কাছে নেই।
চোখটা এরপর সরিয়েই নিতাম, তখনই বলে উঠল “কোথায় গেছিলে?”, ভিড়ের মধ্যে যতটা সম্ভব মুখটা নামিয়ে বললাম “এই তো কলেজ স্ট্রিট, আর তুমি?” মিতা আঁচল দিয়ে গলার ঘামটা মুছতে মুছতে বলল-“আমি শিয়ালদা গেছিলাম।” এরপর এম জি রোড আসতে মিতার পাশের মহিলাটি নামলেন।এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখেনিলাম কোনো মহিলা আছেন কিনা ,নেই দেখে বসলাম তার পাশে। হাতে শাঁখা পলা, আর একটা সরু চুড়ি,সোনার ই হবে হয়তো ,ইমিটিশানও হতে পারে।পরের কথা কি বলবো তাই ভাবছি ,মিতাই বললো-“আজ একটু বেশিই গরম তাই না!” “হ্যাঁ, তা বটে।” পকেট থেকে রুমাল টা দিয়ে কপালের ঘামটা মুছে জিজ্ঞাসা করলাম ” কিছু দরকারে গেছিলে নাকি !?”
এবার আমার দিকে না তাকিয়েই উত্তর দিল “হুম্”।কত কথা জমে আছে ,কিন্তু তার বহিঃপ্রকাশ এর মাধ্যম খুঁজছে,হয়তো তার ও অনেক কথা আছে কিন্ত বলতে পারছে না।মাথাটা নিচু করেই বসে আছি, দেখলাম মিতার পায়ের কাছে একটা বড় ব্যাগ, কিছু আছে হয়তো, কেনাকাটা করতেই হয়তো গেছিলো শিয়ালদা।সে কখন আমার দিকে তাকিয়েছে খেয়াল করিনি, জিজ্ঞাসা করলো”কবে ফিরলে?” চমকে উঠলাম তার প্রশ্নে । “কি করে জানলাম ভাবছো!?” আমি অবাক হয়ে আবার তাকালাম তার দিকে , এবার তার সেই পুরোনো হাসি ,যা আমার কাছে ঝারবাতির সমান উজ্জল।কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ কনডাক্টারের হাঁক ‘ধর্মতলা’, মিতা আমার দিকে তাকিয়ে আবার জিজ্ঞাসা করলো”তোমার তাড়া আছে নাকি!?”
আমি ঘার নেড়ে উত্তর দিলাম না ।”তাহলে এসো ,একটু কথা বলি” এই বলে একপ্রকার আমার হাতটা ধরে নেমে পড়লো বাস থেকে।আমিও কেমন যেন মন্ত্র মুগ্ধের মত তাকে অনুসরণ করলাম।সেই পুরোনো জোড় , যা হারিয়ে গেছে প্রায় সাত বছর আগে। ধর্মতলা দিয়ে হেঁটে ,বাবুঘাট এর কাছে এলাম।মিতার কাঁধে একটা ভেনিটি ব্যাগ আর হাতে একটা বড় চটের ব্যাগ।আমার হাতে বড় ব্যাগটা ধরিয়ে দিয়ে মাথার চুলটা টাইট করে বাঁধলো।” কি ছিল ব্যাগে?” জিজ্ঞাসা করলাম। ব্যাগটা আমার হাত থেকে নিয়ে বললো “ঐ তো কিছু হাতে বানানো গয়না, অর্ডার পেয়েছিলাম, আজ ডেলিভারি দিয়ে এলাম।”
গ্রীষ্মের পড়ন্ত বিকেলের রোদ টা এসে পড়ছে মুখে, মুখটা আঁচল দিয়ে ঢেকে আমাকে বললো-“কবে ফিরলে বললে না তো !?” আমি চোখটা নামিয়ে বললাম “প্রায় এক বছর হলো, কিন্তু তুমি কি করে জানলে যে আমি বাইরে গেছিলাম?” সেই হাসি টা দিয়ে মিতা বললো “খবর রাখতে হয়।” আসলে আমি খবর রাখিনি, সেই সাত বছর আগের একটা বিকেল ময়দানে বসেই শেষ কথা হয়েছিল দুজনার।সবে তখন গ্র্যাজুয়েশন করেছি, চোখে স্বপ্ন বড় কিছু হওয়ার, আর এই সময় মিতা একদিন জানালো যে তাঁর জন্য বাড়িতে ছেলে দেখছে বিয়ে দেবে বলে।সে আসলে আমার কাছে একটু আশ্বাস চেয়েছিল,চেয়েছিল একটা হাত যা সে শক্ত করে ধরতে পারবে। কিন্তু ঠিক সে সময়ই আমি সরিয়ে নিয়েছিলাম নিজেকে, কি ভেবে জানি না।হয়তো সেই বিকেলে মিতার হাসি আমার কাছে ঝারবাতি লাগেনি, হয়তো নিজের কথা ভাবতে এতটা মগ্ন ছিলাম যে আমাদের কথা আর ভেবে ওঠা হয়নি।
সেই যে দূরত্ব গড়ে উঠল তা আর দূর হয়নি।এরপর বন্ধুদের সাথে ব্যবসা করেছি, সেখানে লস্ খেয়েছি সব ছেড়ে মুম্বাই গেছিলাম কিছু একটা কাজের খোঁজে,সেখানে যত উপার্জন করেছি তার থেকে বেশি বিসর্জন দিয়েছি।তারপর যখন নিজেকে উপলব্ধি করতে পারলাম তখন স্থির করলাম আবার ফিরবো , পড়াশোনা করবো ,একটা চাকরি পেতেই হবে।জানি দেরি হয়েছে অনেক।গত একবছর ঘুরেছি অনেক অফিস ,দিয়েছি অনেক ইন্টারভিউ।কিন্তু ফলাফল সেই একই।ব্যর্থতাকে একান্ত আপন করেছি।হয়তো সব কথা বুঝে গেছে মিতা। কিন্তু তার খবর জানা হয়নি, মনে পড়েছে মাথা খুটেছি কিন্ত কোনোদিন কারো কাছ থেকে জানার চেষ্টা করিনি।
দুটো বাদামের প্যাকেট কিনলো মিতা, আমার হাতে একটা দিয়ে নিজে দাঁতে করে প্যাকেট টা কেটে কটা বাদাম চিবোতে চিবোতে আমার দিকে তাকিয়ে বললো -” তা কি করছ এখন!?চাকরি পেলে?” আকাশের দিকে তাকিয়ে একটু ভাবুক হয়ে বললাম “না, যেখানেই যাই ব্যর্থ হয়ে ফিরি।বাড়ি ঢুকতেও খুব লজ্জা লাগে জানো।কটা প্রাইভেট পড়াই ।তাতে এই হাত খরচা টা আসে যা।”বাবুঘাটের একটা সিড়িতে বসলাম দুজনে। বিকেলের রোদ মেখে গঙ্গায় সাঁতার কাটছে কটা ছেলে, কয়েকজন বয়স্ক লোক ঐ বিহারী হবে হয়তো যারা মুটের কাজ করে তারাও স্নান করছে।আর একটু দূর দিয়ে জোড়ে একটা ভোঁ দিয়ে চলে গেল একটা স্টিমার।আমি এবার তার খবর জানবো বলে কথা বলতে যাবো আর সেই সময় মিতা জিজ্ঞাসা করলো-“আজ কলেজ স্ট্রিটেও কি কোনো অফিসে ইন্টারভিউ দিতে গেছিলে ?”
“হুম্” শান্ত স্বরে উত্তর দিলাম আমি। “আর কবিতা লেখো তুমি!?” একটা বিস্ময় নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো মিতা। এবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম -“লিখি,তবে অনেক কম। কিন্তু সেই পুরোনো লেখা গুলো নিয়ে একটা বই ছাপাবো ভেবেছিলাম।”
“বাহ্ , তাতো খুব ভালো,তা কদ্দুর এগুলো কাজ?”
মলিন মুখে বললাম আমি-“কোনোটাই হচ্ছে না ,চাকরিও জুটছে না আবার প্রকাশকও জুটছে না।নতুন কবির কবিতা কে ছাপাতে চাই! আজকের বাজারে কেউ রিস্ক নিতে চাইছে না।আমার কাছে জমানো টাকাও নেই যে নিজে ব্যবস্থা করবো কিছু,অগত্যা ঠোক্কর খেয়েই যাচ্ছি।আজ তো একটা ইন্টারভিউ দিয়ে এক প্রকাশক কে খসড়া গুলো দেখালাম ,উনি ভালো বললেন বটে কিন্তু রিস্ক নিতে রাজি নন।বলছেন যে ম্যাগাজিনে দাও, একটা একটা করে বের করো।” কথাগুলো শুনে মিতা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।এবার আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম”তোমার কথা বলো,কেমন আছো?” গঙ্গার শান্ত ধারাটার মতো শান্ত চোখে মিতা উত্তর দিলো “ভালোই আছি, সব চলছে ভালোই।” কিছুক্ষন উদাস হয়ে দূরের স্টিমারটার দিকে তাকিয়ে বললো “ওর শরীর টা ক’মাস ধরে খারাপ। কাজে তেমন রেগুলার যেতে পারে না।তার ওপর মেয়েটা বড় হচ্ছে,একটা ভালো স্কুলে ভর্তি করেছি খরচ অনেক।ও একা অসুস্থ শরীরে আর কত করবে ! তাই ঐ একটু আধটু আমিও নামলাম ব্যবসায়।ভালোয় লাভ আছে ।এই শিয়ালদা থেকে সব মেটেরিয়াল নিয়ে যায় ,বাড়িতে বসে বানায় ওসব আবার দিয়ে যায় দোকানে।আর কিছু থাকে আমার কাছে কোনো স্কুলে গিয়ে ম্যাডামদের বিক্রি করি।”
আমি অবাক হয়ে শুনলাম সব, সেই মিতা আর আজকের মিতা কত তফাৎ।অদৃশ্য শত্রুর সাথে একাই লড়ে যাচ্ছে।আমি তার দিকে তাকিয়ে আছি দেখে বললো ” কি দেখছো, বাড়ি যাবে না !?”
ঝেড়েমেড়ে উঠে পড়লাম দুজনায়, হাওড়াগামি একটা বাসে উঠে পড়লাম।মিতা যাবে বালি, সেখানে তার বিয়ে হয়েছিল শুনেছিলাম বটে, আর আমি যাবো বি-গার্ডেন।এবার বিদায় নেওয়ার পালা, আজকের বিদায় টাই আর কোনো কষ্ট নেই বরং একটা আশা লুকিয়ে আছে আবার দেখা হওয়ার।সাবওয়ে দিয়ে নামার আগে মিতা আমাকে বললো-“তোমার কবিতাগুলো আমাকে পড়তে দেবে!?” আমি বিস্মিত হয়েই বললাম”তুমি পড়বে!?” একগাল হেসে সে বললো-“যদি তুমি দাও পড়তে।” আমি ব্যাগ থেকে একটা কাগজের প্যাকেট তাকে দিলাম।বড় ব্যাগটায় ঢুকিয়ে নিয়ে ,একটা ছোটো চিরকূটে আমার ফোন নম্বরটা টুকে নিলো ,আর বললো পড়া হলে ফোন করে জানাবে। এরপর সাবওয়ে দিয়ে হারিয়ে গেল প্রতিদিনের ভিড়ে।
মাঝে দু একবার ফোন করেছিলো সেই,আমি এখনও সেই অপরাধবোধ কাটিয়ে উঠতে পারিনি।এর মাঝেই বড়বাজারে একটা ওষুধের দোকানে কাজ পেয়েছি, ওষুধ মেলানো, এদিক ওদিক ওষুধ দিয়ে আসা এসব করি।আগেরদিন রাতেই বলেছিলো আজ দেখা করবে আমার সাথে ,বলেছিলো মাত্র মিনিট পাঁচেক এর কাজ তাই আমি যে দোকানে থাকি সেই আসবে সেখানে।দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালো মিতা, পড়নে একটা লাল শাড়ি,লাল আমার বরাবরই পছন্দের রং।আমি বেরিয়ে এগিয়ে এলাম তার দিকে, আজ তার মুখে একটা উৎফুল্ল ভাব দেখতে পাচ্ছি,সেই মিতা যে কলেজ কেটে আমার সাথে সিনেমা গেছে, স্টিমার চেপে গঙ্গা পেরিয়েছে বা ময়দানে দুপা ছড়িয়ে বসে বাদাম ভাজা খেয়েছে।একগাল হাসি তার, আমাকে বললো-“মিষ্টি কবে খাওয়াবে?” আমি তো অবাক , হঠাৎ কি এমন হলো যে আমাকে মিষ্টি খাওয়াতে হবে।এবার সে বড় ব্যাগটায় হাত ঢোকালো,সেই শাঁখা পড়া হাতটা কিন্তু তাতে আজ আর চুড়িটা দেখলাম না।ব্যাগটা থেকে একটা বই বের করে আমাকে দিলো, নতুন মলাটের একটা চকচকে বই।আমি হাতে নিয়ে দেখলাম,মলাটে বড় বড় করে লেখা ‘প্রেমিক জনের কবিতা’ আর নিচের দিকে আমার নাম অংশুমান দত্ত।আমি হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলাম,মিতা হেসে বললো-“মাছি ঢুকে যাবে , হাঁ টা বন্ধ করো।আর মিষ্টিটা পড়ে খাইয়ে দিয়ো,আজ তাড়া আছে চললাম।” আমি তাকিয়ে থাকলাম মিতার চলে যাওয়া পথে, বইটা খুলে দুহাতে ধরে দাঁড়িয়ে আছি আমি, আপনা হতেই চোখ থেকে একফোঁটা জল পড়লো পাতার ওপর যেখানে লেখা আছে , প্রকাশক- মিতা সেনগুপ্ত (রায়)।
0 comments