দুহাজার চার সালের ডিসেম্বর মাস। খুব ভালোভাবে মনে আছে কারণ ওই সময় সুনামি হয়েছিল ভারতে। আমি, আমার হাসব্যান্ড অনির্বান ও তার ছোট বোন অনিন্দিতা এবং অনিন্দিতার দুই বন্ধু মিলে আমরা ঘাটশিলা বেড়াতে গিয়েছিলাম, মাত্র দুদিনের ট্যুর। তখন আমার সদ্য বিয়ে হয়েছে।
আমরা একটি ছোট্ট বাড়ী তে উঠলাম যেটি আমরা কলকাতা থেকেই বুকিং করে গিয়েছিলাম। গল্প শুরু করার আগে বাড়ীটির একটু ছোট্ট করে বর্ণনা দে জরুরি। ছোট্ট একতলা বাড়ী, মেন গেট দিয়ে ঢুকেই সামনে সিঁড়ি যেটা পৌঁছে দেবে ছাতে, আর সামনে দুদিকে দুটি ঘর। বাঁদিকের ঘরটি আমরা দখল করলাম মানে আমি, অনির্বান আর অনিন্দিতা। সুতরাং ডানদিকের ঘরটি পড়ে রইলো অনিন্দিতার দুই বন্ধু প্রসেনজিৎ আর শুভদীপ এর জন্য। দুটি ঘর এর আয়তন প্রায় সমান। দুটি তেই অ্যাটাচড বাথরুম আর একটা ছোট্ট কিচেন। আমরা ঠিক করলাম, বাজার থেকে চিকেন কিনে এনে নিজেরাই রান্না করবো। প্রসেনজিৎ খুব ভালো রান্না করে তাই রান্নার দায়িত্ব টা ওই নিয়ে নিলো। আমরা মেয়েরা খুশিই হলাম তার জন্য।
ADVERTISEMENT
গরম গরম চিকেন আর হাতে গড়া রুটি দিয়ে ডিনার সারা হলো। অনির্বান কোথা থেকে খুঁজে নতুন গুড়ের রসগোল্লা এনেছিল, জাস্ট জমে গেলো খাওয়াটা। খানিক্ষণ গল্প টল্প করে আমরা তিন জন বাঁদিকের ঘরে শুতে চলে গেলাম। বাকি দুজন রয়ে গেলো ডানদিকের ঘরে। তখনো কেউ জানিনা কী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।
বিছানায় অনির্বান শুয়ে ছিল একেবারে দেয়ালের দিকে। আমি মাঝে আর বোন খাটের ধারে। রাত দুটো নাগাদ ঘুমের মধ্যে আমার মনে হলো কেউ যেন আমাকে পিঠে মৃদু করাঘাত করে ডাকছে। একবার.. দুবার.. তিন তিন বার.. একই অনুভূতি হলো। ধড়মড় করে উঠে বসতেই দেখি বোন আমার পাশে নেই। আমি কিন্তু পিঠে অনুভূতি টা আমার ডানদিক থেকেই পেয়েছিলাম, তাও অতটা গুরুত্ব দিলাম না..ভাবলাম হয়তো অনির্বান ই ডেকেছে। ওর দিকে ফিরে দেখি.. ওতো অঘোরে ঘুমিয়ে আছে।
এইবার আমার একটু একটু ভয় করতে শুরু করল। দেখলাম বাথরুম এর আলো জ্বলছে। একটু পরে বোন বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো। ওকে দেখে বেশ বুঝলাম ও বেশ ভয় পেয়েছে। গোটা মুখে জলের ঝাপ্টা দিয়েছে.. আমি বললাম.. কীরে.. ঘুমোসনি? ও বলল.. ঘুমিয়েছিলাম.. কিন্তু একটা আওয়াজ এ ঘুমটা ভেঙে গেলো।
কিরকম আওয়াজ? কৈ.. আমি তো কিছু শুনি নি। আমি প্রশ্ন করলাম। ও বলল.. জানি না.. মনে হলো ঘরের মধ্যে খাটের খুব পাশ দিয়ে কেউ একটা হাঁটছে.. মাঝে মাঝে তার নিশ্বাস টাও আমার গায়ে পড়ছিলো।
আমি বুঝলাম আমরা তিন জন ছাড়াও আর একজন চতুর্থ ব্যক্তি এই ঘরের মধ্যে রয়েছে.. সে হয়তো কোনো কালে মানুষ ছিল.. এই মুহূর্তে হয়তো শুধুই ছায়া।
বোন অলরেডি ভয় পেয়েছিলো তাই আমার অভিজ্ঞতা র কথা ওকে আর কিছু বললাম না। বললাম.. ও কিছু না.. তুই শুয়ে পড়।
দুজনে শুয়ে পড়লাম, কিন্ত ঘুম আসছিলো না। এই ঘটনার প্রায় ঘন্টা খানেক কেটে যাওয়ার পর দুজনেরই বোধহয় চোখ বুজে আসছিলো.. এমন সময় দুজনেই দেখলাম হটাৎ করে বাথরুম এর আলো টা জ্বলে উঠলো.. আর দরজা টা সজোরে বন্ধ হয়ে গেলো।
দুজনেই একসাথে চিৎকার করে উঠলাম। অনির্বান চমকে ঘুম থেকে উঠে পড়লো। বলল কী হয়েছে? আমরা দুজনেই তখন বাকরুদ্ধ।
অনির্বান বাকি দুজন কে ডাকবার জন্য দরজা খুলতে গিয়ে দেখে দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। অনেক ঠেলা ঠেলি করেও দরজা খুললো না।
আমরা দুজন তখন শক্ত কাঠ হয়ে বসে আছি। কোনো মতে সেই রাত টা কাটলো। বিনিদ্র রজনী কাটিয়ে আমরা রীতিমতো ক্লান্ত। পাশের ঘর থেকে ওরা এসে ডাকাডাকি করছে. অনির্বান এবার কিন্তু দরজা খুলতে পারলো।
ওদের রাতের অভিজ্ঞাতার কথা বললাম। ওরা দুজনেই হেসেই খুন। বলল ঠিক আছে.. আজ রাতে আমরা এঘরে শোবো.. তোমরা ওঘরে শুয়ো। আমি আর বোন আপত্তি করলাম.. বললাম হয় অন্য হোটেল নেয়া হোক অথবা ফিরে চলো। কিন্তু আমাদের আপত্তি ধোপে টিঁকলো না। ঘর বুকিং এর টাকা সব মেটানো ছিল আর ট্রেন এর টিকিট ছিল তার পরের দিনের। সুতরাং আরো একটা দিন যে ওই বাড়িতেই থাকতে হবে বুঝতে পারলাম। যাহোক ইতিমধ্যে বাড়ীর কেয়ার টেকার এসে হাজির। আমাদের কোনো অসুবিধে হচ্ছে কিনা জানতে। তাকে অনেকবার জিজ্ঞাসা করার পরেও সে কিছুই বলল না। হাব ভাব দেখে মনেহল কিছু যেন লুকোতে চাইছে।
যাই হোক সেদিন সারাদিন আমরা ঘুরে বেড়ালাম.. ঝর্ণা, ফুলডুঙরি পাহাড়.. রণখিনি মন্দির ইত্যাদি জায়গায়.. মনটা বেশ ভালো হয়েগেলো.. গত রাতের কথা ভুলেই গেছিলাম প্রায়.. বিকেল বিকেল ফিরে এলাম আবার সেই অভিশপ্ত বাড়িটাতে।
খাওয়া দাওয়া সেরে কথা মতো ঘর পাল্টানোর পর শুয়ে পড়লাম সবাই। আজ আমি দেয়াল ধারে. মাঝে বোন.. আর খাটের ধারে অনির্বান।
রাত দেড়টা বা দুটো হবে.. ফীল করলাম কেউ আমার পায়ে হাত দিয়ে ডাকছে. ধড়মড় করে উঠে বসে দেখি বোন শক্ত কাঠ হয়ে বসে আছে..গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে না.. শুধুই আঙুলের ইশারা করছে পায়ের দিকে.. দেখলাম যেন সাদা ধোঁয়ায় মোড়া কিছু একটা বাথরুম এর দিকে সরে যাচ্ছে। আবার সেই আলো জ্বলে ওঠা আর দড়াম করে দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ।
স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম কিছুক্ষন। কোনো সাড়াশব্দ নেই আর। বোনের অবস্থা বেশ সঙ্গিন |মনে হয় ওই দৃশ্য দেখে অজ্ঞান হয়ে গেছে। আমি সাহসে ভর করে অনির্বান কে ডাকবার চেষ্টা করতে গেলাম। কিন্তু বুঝলাম নড়বার ক্ষমতা নেই আমার, হাত পা গুলো যেন লোহার মতো ভারী হয়ে রয়েছে। সব কিছু বুঝতে পারছি, অথচ কিছুই করতে পারছি না। বেশ কিছুক্ষন এই ভাবে কাটার পর অবস্থা একটু একটু স্বাভাবিক হতে লাগলো৷ ভাবলাম আজকের মতো বিপদ কাটলো। আস্তে আস্তে চোখে ঘুম জড়িয়ে এলো। কতক্ষন এভাবে কাটল জানি না।
ঘুমের মধ্যে মনে হল কেউ যেন একদম আমার মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আর একটা ছোট্ট হাত আমার চুলে বিলি কাটছে। চমকে উঠে চোখ খুললাম। আমার মুখের কাছে একটা ছোট্ট শিশুর মুখ। খুব স্পষ্ট… কিন্তু খুব করুন। বোধহয় সেই ছায়া.. আমাকে কিছু বলতে চাইছে। কিন্তু না সে আমাকে বোঝাতে পারছে.. না আমার তার কথা বোঝার মতো অবস্থা আছে। সেই শিশু আস্তে আস্তে তার ছোট্ট হাত দিয়ে আমার মুখ টা ঘুরিয়ে দিলো আমার বাঁ পাশে.. যেখানে বোন অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল .. কিন্তু একী? বোন তো সেখানে নেই.. তার জায়গায় বসে আছে একটি স্পষ্ট নারী মূর্তি।
সত্যি বলছি, আর কিছুই মনে নেই।
জ্ঞান ফিরতে দেখি ডাক্তার এসেছেন। পাশে শোয়া বোন তখনো অজ্ঞান। ডাক্তার বললেন.. ভালো করে খোঁজ খবর নিয়ে তবেই তো বাড়ী বুকিং করবেন। এ বাড়িতে এক মা তার একটি বাচ্চা সমেত আত্মহত্যা করেছিল। সেই থেকেই বাড়ী ফাঁকা। বাড়িওয়ালা পার্মানেন্ট ভাড়াটে পায় না তাই টুরিস্ট দের ভাড়া দেয়।
এরকম ঘটনা এখানে নতুন নয়।
সব কিছুর মধ্যে আমার একটা ব্যাপারে খটকা লাগছিলো – যা কিছু ঘটলো তা আমাদের সঙ্গে মানে দুই মহিলার সঙ্গেই কেন হল? সঙ্গে আরো তিন জন পুরুষ সদস্য ছিল তাদের সঙ্গে কেন কিছু হল না? এমন কী একজন তো আমাদের সঙ্গে এক ই ঘরে ঘুমিয়ে ছিল অথচ সে কোনো কিছুই জানলো না কেন? সেই শিশুটির করুন মুখটা বার বার ভেসে উঠছিলো। হয়তো সেই মা কোনো মহিলা কেই তাদের কথা জানাতে চেয়েছিল।
26শে ডিসেম্বর 2004, আমরা ট্রেন এ উঠে বাড়ী ফিরছি। খবরে শুনলাম ভয়ঙ্কর সুনামি হচ্ছে।
আমাদের বুকে তখন অন্য সুনামি।
0 comments