গল্প প্রতিযোগিতা একটি অন্যরকম ভালোবাসার গল্প

গল্প প্রতিযোগিতা একটি অন্যরকম ভালোবাসার গল্প

“টিকিটটা দেবেন”, কন্ডাক্টরের ডাকে নন্দনা পার্স থেকে টাকা বার করে পেছন ফিরল। 
এই অফিস টাইমে এসি বাসে সিট না পেলেও সুস্থভাবে দাঁড়িয়ে যাওয়াটাও নন্দনার কাছে যেন একরকম লটারির টিকিটে জেতা।

কন্ডাক্টরের থেকে ব্যালেন্সটা ফেরত নিতে গিয়ে নন্দনা আমূল কেঁপে গেল। 
চোখ আটকে গেল ডানদিকের কোনার সিটে – ওটা আদিত্য না? ও এখানে কি করছে? এতদিন পর ! এইভাবে, এইখানে! হাজারটা প্রশ্ন এক ঝটকায় নন্দনার মাথায় ভিড় করে। 
চোখ সরাতে গিয়ে হঠাৎই খেয়াল করে চেনা চোখদুটো ওর দিকেই তাকিয়ে  – তাতে লেগে একটুকরো হাসি। যা নন্দনাকে এক সময় উত্তাল করে তুলেছিল। দীর্ঘ শরীরটা সিট ছেড়ে উঠে আসে।
ভরাট গলায় প্রশ্ন ভেসে আসে, “ কি রে, তুইও কি ডি এল এফ- এ নামবি?”

নন্দনা কোনমতে মাথা নাড়ে। 

ডি.এল. এফ. বিল্ডিং-এর সামনে দুজনকে নামিয়ে বাসটা বেড়িয়ে যেতেই নন্দনা রোদচশমার আড়ালে জরিপ করতে থাকে বিগত পনেরো বছরে কত কিছু বদলেছে আদিত্যর।
 
“কতদিন বাদে দেখা।” আদিত্য স্বভাবসিদ্ধ সপ্রতিভ ভঙ্গিতে বলে।

ADVERTISEMENT
Swades Times Book

“হ্যাঁ, সেটাই। ভালো আছিস?” নন্দনা এখনো আড়ষ্ট বোধ করে।

আদিত্য গভীর চোখে দেখে।

“একটা কাজে এখানে এসেছি। তোর তাড়া না থাকলে লাঞ্চ-চলে আয় না। অনেক কথা হবে।”

“আচ্ছা। আমার কিন্তু দুপুর একটা-য় লাঞ্চ।“ নন্দনা বলে ওঠে।

“ওকে,ডান”। আদিত্য ঝকঝকে হাসে।

অফিসে এসে নন্দনা আগে ওয়াশরুম ছোটে  ঘাড়ে-মুখে জল দিতে। আয়নায় মুখ দেখতে দেখতে একধাক্কায় পিছিয়ে যায় ২০০৫-এ।

ক্লাস টুয়েলভদের সেদিন শেষ দিন। সব বিভাগের ছেলে-মেয়েরাই আনন্দে আত্মহারা। শুধু জানালার একধারে একটা স্প্রাইটের গ্লাস হাতে  নন্দনা আনমনে বসে নীল আকাশে উড়ে বেড়ানো চিলটাকে দেখছিল। আর কদিন পরে আদিত্য অসাধারণ রেজাল্টের জোরে এরকমই উড়ে যাবে স্টেটসে। আলাদা বিভাগ হওয়া সত্ত্বেও আদিত্যকে অসম্ভব ভালো লাগে। কিন্তু তা হলেও লাজুক নন্দনা কিছু বলে উঠতে পারেনি কোনদিন। মধ্যবিত্ত মূল্যবোধে মানুষ হওয়া নন্দনা পড়াশোনাতে খুব ভালো হলেও ক্লাসের আর পাঁচটা উচ্চবিত্ত মেয়েদের মতন অতটা সপ্রতিভ নয়।  ইংরাজির কমন ক্লাসগুলোতে চোরাটান অনুভব করলেও অলরাউন্ডার আদিত্যর থেকে দুরেই থেকেছে বরাবর।আর নন্দনার এই ক্রাশ খাওয়ার ব্যাপারটা আদিত্য ভালোই উপভোগ করতো। সেই সুবাদে সব প্রোজেক্টগুলো নন্দনার থেকে নির্দ্বিধায় আদায় করে নিতে আদিত্যর কোনদিন একটুও অসুবিধা হয়নি।


দিয়া-রৌনকদের টানাটানিতেও আজ নন্দনা গান গাওয়া এড়িয়ে গেল গলা ভেঙ্গে গেছে বলে। শরীরটা ভালো নেই। নন্দনা টানাপোড়েনের মধ্যে গতকাল সারাটা রাত কাটিয়েছে।
 
আজ কি একবার আদিত্য-কে বলতে চেষ্টা করবে? বলবে যে, “আদি, একবার আমার দিকে তাকিয়ে দেখ। কখনো কি তোর কিচ্ছু মনে হয়নি? জ্বর নিয়েও মা-র বকুনি সহ্য করে রাত জেগে নোটস্ তৈরি করেছি, দিনের পর দিন অপেক্ষা করে থেকেছি শুধু একবার তুই কাছে এসে দাঁড়িয়ে বলবি যে আমি তোর, শুধু তোর।”

হঠাৎ দিয়ার খোঁচা খেয়ে সম্বিত ফিরল- হল পুরো নিস্তব্ধ। স্টেজে আদিত্য গিটার হাতে- দৃষ্টি সোজা হিউম্যানিটিস-এর অদ্রিজার দিকে,গলায় নন্দনার সবথেকে প্রিয় এড শিরানের গান –

“All I know is, darling, I was made for loving you.
Hold me close,
through the night,
Don’t let me go,
We’ll be alright,
Touch my soul 
and hold it tight.
I’ve waiting all my life”……

আদিত্য নেমে এসে অদ্রিজার নদীর মতন উচ্ছল শরীরটাকে জড়িয়ে ধরল – “পাগলী, তোর জন্য সারা জীবন অপেক্ষায় থাকব।” সারা হলে তখন পায়রা ওড়ার শব্দ।
নন্দনা-র চোখ পাথর। বরফের চাঁই ভাঙার শব্দ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে ভেতরে। গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ভেঙে যাচ্ছে নন্দনার শরীরের সবকটা হাড়। ভেতরের কথাগুলো কেমন দলা পাকিয়ে উঠছে গলার কাছে। মাথাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে যন্ত্রণায়।
কোনমতে টেবিলটা ধরে উঠল।
টলতে টলতে একে ওকে ধাক্কা দিয়ে বেরনোর সময় কানে আসলো বৃন্দার গলা।
“কি রে, কোথায় চললি? খাবি না?” 
নন্দনা মাথা নাড়ল, “না রে, মা কল করেছিল। একটু তাড়াতাড়ি যেতে বলল। ম্যাম-কে বলে দিস, প্লিজ।”

“ওকে, নো প্রবলেম। ” বৃন্দা হাত নাড়ায়।

দুপুর একটা পাঁচ। অফিসের পাশে এই সিসিডি-টাতে নন্দনা অফিসের কলিগদের সাথে মাঝেমাঝেই আসে। দরজা ঠেলে ঢুকে দেখে আদিত্য এরমধ্যেই এসে গেছে। নন্দনার বুকের ভেতর কি যেন একটা চলকে উঠল। সাদা শার্ট, নীল জিন্স আর হালকা ট্রিম করা দাড়িতে ভীষণরকম আকর্ষণীয় লাগছে আদিত্যকে। এই কয়েক বছরে নন্দনাও ফিনফিনে টিনএজার থেকে রূপসী। বছর তেত্রিশের নন্দনাকে দেখে যে কেউ ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট বলে ভুল করবে। স্লেট রঙা শাড়ি আর লাল ব্লাউজে নন্দনার ফর্সা চেহারাটা আরো তীক্ষ্ম লাগছে।

ঠান্ডা কফির গ্লাসের উল্টোদিকে দুজোড়া চোখ পরস্পরের দিকে অপলক দৃষ্টিতে স্থির। নন্দনার তীক্ষ্ম সৌন্দর্যের সাথে অভিজ্ঞতার মিশে একটা আলাদা বলয় যেন তৈরি হয়েছে -যে কেউ চট করে তা ভেদ করতে পারে না।

“অদ্রিজার কি খবর?”
নিস্তব্ধতা ভেঙে বলে ওঠে নন্দনা। 

আদিত্য মাথা নামায়।

“আমার পি এইচ ডি অবধি ও অপেক্ষা করতে রাজি ছিল না।অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু আমার কেরিয়ারের সাথে আপোস করাটা আমার যুক্তিসঙ্গত মনে হয়নি। আর ওর-ও মনে হচ্ছিল ব্যাপারটা বড্ড বেশি লম্বা হয়ে যাচ্ছে। তাই…..”

কোল্ড কফির গ্লাসের গায়ে জলের বিন্দু গড়িয়ে পড়া দেখতে থাকে নন্দনা।  ঠিক এইভাবেই এই দীর্ঘ পনেরোটা বছরে নন্দনার একটা একটা মুহূর্ত গড়িয়ে গেছে কালের গর্ভে।

“তারপর, তুই কি করছিস? “ আদিত্য কথা ঘোরাতে চেষ্টা করে।

“আমি এম সি এ করে একটা আইটি কোম্পানিতেই আপাতত….”

“আর আঙ্কল-আন্টি?”
আদিত্য এবার কৌতূহলী হয়।
নন্দনা বাইরে ট্রাফিক জ্যামে আটকে থাকা গাড়ি দেখতে দেখতে অন্যমনস্ক।
“বাবা রিটায়ার করার আগেই হার্ট অ্যাটাকে চলে গেলেন ২০১৫-তে।  এখন মা আর আমি।”

আদিত্য বলে ওঠে, “আই অ্যাম রিয়েলি সরি।”
খানিকক্ষণ নিস্তব্ধতা। 
ইতস্ততঃ করে আদিত্য বলে, “বলছি যে, এই শনিবার তোর সময় হবে? একটা সেমিনার আছে। সেটা সেরে একটু আড্ডা দিতাম।“

চারদিকে যেন পিন পড়ার শব্দ।  ক্যাফের এত গুঞ্জন, মিউজিক- কোন কিছুই নন্দনার কানে ঢোকে না। এত ক’টা বছর শুধু এই সামনের মানুষটার সাথে প্রতিটা মুহূর্ত কাটাতে চেয়েছে। আর আজ যেন মেঘ না চাইতেই জল।

নন্দনার ঠোঁটে এক চিলতে হাসি খেলে যায়। 

“দ্বৈপায়নের ওইদিন ছুটি থাকে। আমরা ওইদিনটা নিয়মিত ওর মায়ের সাথে দেখা করতে বর্ধমান যাই। উইকএন্ডের ঘোরাও হয়, আর লং ড্রাইভ-এর আনন্দটাও হয়। আজ উঠি রে। লাঞ্চটাইম ওভার হয়ে গেছে। বসের ক্যাটক্যাট শুনতে হবে। পরে আরেকদিন আড্ডা মারা যাবে।“
 
কাঁচের বাইরে থেকে আদিত্যকে স্থির হয়ে বসে থাকতে দেখতে দেখতে নন্দনা মোবাইলের স্ক্রিন অন করে।

“হ্যালো তীর্থা? তুই তোর পারুলিয়ার বাড়িতে যেতে বলছিলি না? এই সপ্তাহে তোর সময় হবে? তাহলেচল্, এই শুক্রবার রওনা দিই। রবিবার ফিরে আসবো। হ্যাঁ রে বাবা, পাক্কা। টিকিটটা তুই করে নে। আর, বাকি ব্যবস্থাও। হ্যাঁ রে, জানি বাবা, তোর খুব আনন্দ হচ্ছে। আমারও খুব আনন্দ হচ্ছে।  এই প্রথমবার বর্ধমান যাবো। শুক্রবার আমি ব্যাগ প্যাক করে সোজা অফিস চলে আসবো।”

মনের মধ্যে ওঠা তুফানটা চাপা দিতে এটা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। ইচ্ছে করেই আদিত্যর ফোন নম্বরটা নেয়নি। জীবনের কিছু জিনিস হারিয়ে গেলে ফিরে না পাওয়াই ভালো। থাকনা এই ভালোবাসা, যেমন করে বুকের ভেতর আগলে গত পনেরোটা বছর ছিল। আদিত্যর প্রতি নন্দনার ভালোবাসা চিরকালই অমলিন থাকবে – থাকবে একটা অন্যরকম রূপকথা হয়ে। খুব মনখারাপী দিনগুলোতে এই আজকের দিনটা একটা অন্যরকম উজ্জ্বল আলো নিয়ে জেগে থাকবে মনের ভেতর – ভাবতে ভাবতে নন্দনা বাসস্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ায়।  এখনি গড়িয়ার সাতটা পঁচিশের বাসটা এসে পড়বে। ইলশেগুড়ি বৃষ্টি শুরু হলো। নন্দনা চোখ বুঁজে গুনগুন করে ওঠে -” তুমি রবে নিরবেহৃদয়ে মম-"

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait