ক্যান্সার জয়ী ছোট্ট মেয়ের কাহিনী – ‘অমৃতা’

ক্যান্সার জয়ী ছোট্ট মেয়ের কাহিনী – ‘অমৃতা’

“ম্যাডাম,আমার খুব নাটকটা করার ইচ্ছে ছিল। আমি কাল ইচ্ছে করে অ্যাবসেন্ট করিনি গো।” কলকলিয়ে বলে উঠলো মেয়েটা। ক্লাস নাইন বি, রোল নাম্বার সেভেন। ছদ্ম গাম্ভীর্যে চুপ করে আছেন লিপিকাদি। দুদিন  পরে স্কুলে রবীন্দ্র-জয়ন্তী। “তাসের দেশ” নাটক হবে। যারা নাটক করছে তাদের গতকাল স্কুলে আসতেই হতো। মিউজিকের সঙ্গে প্র্যাকটিস ছিল। অথচ, ঐ দিনটাতেই দিব্যি ডুব মেরে দিল কয়েকজন। তাদের মধ্যে একটি প্রাণী হল এই মেয়েটি, সুপর্ণা। যারা আসেনি তাদের নাটক থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। সবাই নির্বিবাদে সিদ্ধান্তটা মেনে নিয়েছে, কিন্তু এই মেয়েটি সকাল থেকে লড়ে যাচ্ছে। লিপিকাদি মুখ উঠিয়ে মেয়েটির দিকে তাকালেন। চাঁপা ফুলের মতো গায়ের রঙ মেয়েটির। মাথা সোজা করে দাঁড়িয়ে আছে। স্কুলের মধ্যে ওর চেহারাটা নজর কাড়ে। গত মাসে ইন্টারস্কুল কাবাডি প্রতিযোগিতায় মেডেল নিয়ে এসেছে। ক্লাসে কাজ দিলে সবার আগে খাতা নিয়ে আসে। হাতের লেখাটা একটু ভালো করলে মাধ্যমিকে ফার্স্ট ডিভিশন বাঁধা। ওকেই “তাসের দেশে”র রাণী করা হয়েছিল। রাণী হওয়ার খুব সাধ ওর। কাজেই হঠাৎ  করে বাদ দিয়ে দেওয়ার ঘটনাটা ও মোটেও ভালো চোখে দেখেনি। লিপিকাদি এবার একটু নরম হয়ে বললেন,-“এবার আর কিছু করার নেই। অন্য জনকে একদিনের মধ্যে পার্ট মুখস্থ করানো হয়ে গেছে। পরের বার করিস। আর এবার তুই তাহলে সঞ্চালনা কর। ইচ্ছে মতো সেজেগুজে আসিস। এবার যা। “যুদ্ধে আংশিক জয়লাভ করার মতো মুখ নিয়ে সূপর্ণা বীরাঙ্গনার মতো চলে গেল। পরের দিন কমলা রঙের শাড়ি সামলে দিব্যি সঞ্চালনা করল। শুধু নাটকের সময় মুখটা একটু ম্লান করে ছিল। লিপিকাদি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন-“পরেরবার নাটক করতেই হবে।” একটুও হাসেনি মেয়েটা। অভিমান হয়েছিল খুব। 
তারপর গরমের ছুটি, ইউনিট টেস্ট, খাতা দেখার চাপে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছিল স্কুলের দিদিমনি এবং পড়ুয়ারা। তখনই খবরটা এল। নাইনেরই একটি মেয়ে এসে বলল যে সুপর্ণা খুব অসুস্থ। হসপিটলে ভর্তি। স্টাফরুমেও মৃদু আলোচনা হল এই নিয়ে। তারপর সব চুপচাপ! পনেরো দিনের মাথায় সুপর্ণা নিজেই স্কুলে এল। গালটা একটু ফুলে রয়েছে। লিপিকাদিকে এসে বলল,-“ম্যাডাম,আমার অপারেশন হবে। ডাক্তারবাবু বলেছেন অনেকদিন লাগবে সেরে উঠতে। তবে যতদিন পারব স্কুলে আসবো। পরের বছর যে আমার মাধ্যমিক!” সেদিনই স্কুলে এসে দেখা করলেন ওর বাবা। যা বললেন তা শুনে তো স্কুলের কেউ বিশ্বাসই করতে পারলেন না। সুপর্ণার অসুখটার নাম ‘ক্যানসার’| অমন ফুলের মতো একটা মেয়ে, ওর লড়াই কিনা এই ভয়ঙ্কর অসুখের সঙ্গে? চোখ ঝাপসা হয়ে আসে লিপিকাদির। ক্লাসে গিয়ে চোখ মেলাতে পারেন না মেয়েটার সঙ্গে। নাটকের আগের দিন তাহলে এই কারণেই অসুস্থ হয়েছিল ও। মনে মনে প্রার্থনা করেন, পরের বছর যেন এই মেয়েটা হাসিমুখে নাটক করতে পারে। তবে, যাকে নিয়ে এত ভাবনা সে কিন্তু বন্ধুদের সঙ্গে ফার্স্ট বেঞ্চে বসা নিয়ে লড়াই করছে, ক্লাসে যারা কথা বলছে তাদের নাম লিখে নালিশ ঠুকে আসছে স্টাফরুমে, মেডিকেল কলেজ যাওয়ার পথে কত্ত ঝলমলে বই দেখেছে—সে গল্পও করে ফেলছে। ওর ঝকঝকে চোখ দুটোয় অসুখটা এতটুকু কালো ছায়া ফেলতে পারছে না। ওদের ক্লাসটিচার লিপিকাদি মনে মনে বলছেন,-“তোকে জিততেই হবে।” মুখে বলছেন,-“সুপর্ণা, ‘অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড’ পড়বি? আজ আমার থেকে নিয়ে যাস।” সুপর্ণা গর্বিতভাবে মাথা নাড়ছে। ভাবছে, কী বেশ একটা অসুখ করেছে, তার জন্য সবাই কত্ত ভালোবাসছে। অসুখটাও যেন থমকে যাচ্ছে। কিশোরী মেয়েটার মুখের হাসি কেড়ে নিতে তারও তো লজ্জা হওয়া উচিত। 

ADVERTISEMENT


হেডদিদিমণি  চন্দ্রিমাদি  চিন্তিত মুখে বললেন,-“সুপর্ণার বাবা এসেছিলেন। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার। কেমো শুরু হবে আগামীকাল থেকে। আমাদের কিছু সাহায্য করা উচিত।” স্কুলের ছাত্র , শিক্ষক সকলে সাধ্যমতো চেষ্টা করলেন। ওকে দেখতে গেলেন অরুণিমাদি আর লিপিকাদি, নিজের বাবাকে এই অসুখে হারিয়েছেন লিপিকা ম্যাডাম। তাই অসুখটার প্রতি অনেকটা রাগ, ঘৃণা জমে আছে। অসুখটাকে মেয়েটার শরীর থেকে আলাদা করে দিতে পারতো যদি তবে মনের জ্বালাটা মিটতো। হসপিটলে ঢুকে লিপিকাদির মনে হল সুখ আর অসুখের মাঝখানে একটাই ভাঙা সাঁকো! এপারে ওপারে আমরা কজন। মেয়েটা ছুটে এল ওদের দেখে। অসুখটা কি ও বোঝে না। তাই হসপিটলের বেডে খেলাঘর সাজিয়ে বসেছে। অরুণিমাদির হাত থেকে গল্পের বইয়ের প্যাকেটটা নিতে নিতে হাসার চেষ্টা করল। লিপিকাদিকে বলল,-“বাংলা পরীক্ষায় কত পেয়েছি ম্যাডাম?” লিপিকাদি না হেসে পারলেন না। বললেন,-“গোল্লা।”সুপর্ণাকে আদর করে বললেন ,-“তুই স্কুলে আয় । তারপর লেখাপড়া করবি।” ওর মা কান্না লুকিয়ে বললেন-“কবে যে যাবে?” সুপর্ণা হাত মুঠো করে বলল,-“স্কুলের জাম গাছটায় জাম পেকেছে গো ম্যাডাম?” মেডিকেল কলেজের ক্যানসার ওয়ার্ডের বাইরে দখিনা বাতাস বইছে। অনেকগুলো বন্দিনী মেয়ের উদাস দৃষ্টিতে দখিন হাওয়ায় বর্ষার মেঘ দেখতে পেলেন লিপিকাদি।  আর বসতে পারলেন না। 


টানা একটা বছর ওষুধ, কেমো, ইনজেকশন, অপারেশনে বিপর্যস্ত হল একফোঁটা মেয়েটা।স্কুল চলল নিজের নিয়মে। শুধু ফার্স্ট বেঞ্চের ধারের দিকটা দেখে মনটা হু হু করত লিপিকাদির। মাধ্যমিক পরীক্ষাও এগিয়ে এল। ঘরে বসে লেখাপড়া করছে সুপর্ণা। সবাই জানে পরীক্ষাটা ও দিতে পারবে না। ওর যা শরীরের অবস্থা ,হসপিটলের বেডে বসেও পরীক্ষা দিতে পারবে না। অসুখটা বুঝি এবার হারিয়েই দিল ওকে। বাংলা পরীক্ষার দিন বিকেলবেলা স্কুল থেকে বেরিয়ে বাসস্ট্যান্ডের দিকে হাঁটছিলেন লিপিকা দিদিমনি। হঠাৎ চেনা গলার ডাক—“ওওও ম্যাডাম!” ঘুরে তাকিয়ে দেখে সুপর্ণা। অসুখটা ঝড়ের চিহ্ন রেখে গেছে ওর শরীরে। তবু শীর্ণ দুহাতে কার্ডবোর্ড আঁকড়ে বাড়ি ফিরছে। হাত নেড়ে আশ্বাস দিল পরীক্ষা ভালো হয়েছে। ইশারায় বলল কত কী। সব বুঝলেন না। শুধু এইটুকু বুঝলেন, ক্যানসার নামের অসুখটা এবার হারতে চলেছে। আর ঠিক করলেন মেয়েটা সেরে উঠলে পরের অনুষ্ঠানে ওকে রাণী নয় রাজার পার্ট দেবেন। সেরা পার্টটা ওকে ছাড়া কাউকে মানাবে না। সুপর্ণাকে হাত নেড়ে মনে মনে অনেক আদর পাঠালেন। সবার আদর বর্ম হয়ে ঘিরে থাকুক ওকে। ও রাজার মতো যুদ্ধ জয় করে আসুক। সুপর্ণা ততক্ষণে কাছে চলে এসেছে। প্রণাম করে বলল,- “শরীর যখন খুব খারাপ করে তখন মনে মনে সেই মন্ত্রটা বলি আর অসুখ সেরে যায়।” লিপিকাদি অবাক হয়ে বললেন,-“কোন মন্ত্রটা রে?” সুপর্ণা গম্ভীর হয়ে বলল,-“সেদিন ক্লাসে বলেছিলেন না—‘মৃত্যোর্মা অমৃতং গময়োঃ।” এক মুহূর্তের জন্য চরাচর স্তব্ধ হয়ে গেল লিপিকাদির কাছে। সুপর্ণার হাতদুটো মুঠিতে ধরে থাকলেন কিছুক্ষণ। একটু শক্তি নিলেন ছোট্ট মেয়েটার কাছ থেকে আর মনে মনে ওর নাম দিলেন ‘অমৃতা’। বিকেলের এলোমেলো হাওয়ায় মেয়েটার চলে যাওয়ার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে দেখলেন একটা কালো অন্ধকার পিছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে জ্যোতির বলয়, পৃথিবীর কোনো অসুখ যাকে ছুঁতেই পারবে না!!

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait