সুভাষ চন্দ্র বসু : স্বামী বিবেকানন্দের মানসপুত্র

সুভাষ চন্দ্র বসু : স্বামী বিবেকানন্দের মানসপুত্র

 

মহানির্ব্বাণে প্রবেশ করবার কয়েক ঘণ্টা আগে স্বামীজীকে আপন মনে অনুচ্চ স্বরে বলতে শোনা গিয়েছিল - “If there were another Vivekananda he would have understood what Vivekananda has done. And yethow many Vivekanandas shall be born in time!” যার বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়: “বিবেকানন্দ কি করে গেল তা বোঝবার জন্য আর একজন বিবেকানন্দ চাইতেমন অনেক বিবেকানন্দ সময় হলেই আসবে।অর্থাৎ তিনি কি স্বামী বিবেকানন্দের মানসপুত্র রূপে অলরেডি ভারতবর্ষে জন্মগ্রহণ করে ফেলেছেন কে তিনি? তিনিই কি নেতাজী?

ADVERTISEMENT
Tuhu Momo Video Teaser

 

তাই স্বামীজীকে না বুঝলে নেতাজীকে বোঝা যাবে না; আবার নেতাজীকে না দেখলে স্বামীজীর দর্শনলাভ হবে না। স্বামী বিবেকানন্দ কি জিনিস সেটা স্বামীজীর মানস-কন্যা ভগিনী নিবেদিতা বুঝেছিলেন। তাঁরই মুখে আমরা সে কথা শুনেছি; তিনি বলেছেন বাগুরাবদ্ধ সিংহের মতমুক্তিলাভের জন্য তাঁহার সেই দুরন্ত প্রয়াস, এবং নিরুপায় নিশ্চলতার সেই যে নিদারুণ যন্ত্রণাইহাই ছিল আমার গুরুদেবের ব্যক্তি-চরিত্রের বিশিষ্ট পরিচয়। যেদিন জাহাজঘাটে অবতরণ করিয়া আমি তাঁহাকে এ দেশের মাটিতে প্রথম দেখিয়াছিলাম, সেই প্রথম দেখার দিন হইতেযে আর একদিন গোধুলি-সন্ধ্যায় তিনি তাঁহার দেহটাকে ভাঁজ-করা বসনের মত ত্যাগ করিয়া, এই জগৎ-পল্লীবাস হইতে নিরুদ্দেশ হইয়া গেলেনসেই দিন পর্য্যন্ত, আমি সর্ব্বদা অনুভব করিতাম যে, তাঁহার জীবনে অপর একটির মত এইটিও ওতপ্রোত হইয়াছিল।


স্বামীজীর দেশপ্রেম ও প্রেমের মূল মন্ত্র যে আপন নিয়মে যথাসময়ে নেতাজী সুভাষচন্দ্রের মধ্যে পূর্ণ ও নিঃসংশয়রূপে প্রকাশমান হয়েছে, সেটা বুঝতে হলে স্বামীজীর সেই মন্ত্রটিকে আর একটু ভাল করে অবধারণ করতে হবে।

জাতির উদ্ধারকল্পে, ভক্তি নয়শক্তিকেই তিনি একমাত্র সাধন-পন্থা বলে দৃঢ়-নিশ্চয় করলেন। তত্ত্ব বা সাধনমার্গ হিসাবে ভক্তির মূল্য যেমনই হোক, এটা যে এ যুগের ওই সঙ্কটে শুধুই নিরর্থক নয়বরং ক্ষতিকর, এবং শক্তিই যে একমাত্র সত্য-মন্ত্র, তাই তিনি যে-দৃষ্টির দ্বারা উপলব্ধি করেছিলেন, এবং যেভাবে ও যেরূপে সেই আধ্যাত্মিক শক্তিবাদকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, সেটাও তাঁর প্রতিভারই নিদর্শন। তিনি যে-শক্তিমন্ত্রের সাধক ও প্রচারক ছিলেন তাতে আত্মার জাগরণ আগে, পরে আর সব। তিনি পুনঃ পুনঃ এই কথাই বলতেন যে, ‘man-making’ বা মানুষ-গড়াই তাঁর একমাত্র কাজ; তিনি আর কিছুই করবেন না,অন্ততঃ সেইকালে আর কিছু করবার প্রয়োজন নেই। তিনি বলেনতোমরা কেহই ক্ষুদ্র নও; ওই কু-সংস্কার, ওই কু-বিশ্বাসই সকল ভয় ও সকল দৌর্ব্বল্যের কারণ। Man has never lost his empire. The soul has never been bound. Believe that you are free, and you will be.” 
 


বিবেকানন্দের দেশপ্রেম যে একটা আধ্যাত্মিক কিছু ছিল, তিনি যে দেশকে ভালবেসে শুধুমাত্র তার আত্মার মোক্ষ বা মুক্তির উপায় চিন্তা করেছিলেনএটা তাঁর ওই নব-গঠিত সন্ন্যাসীর দলও যেমন বিশ্বাস করত না, তেমনই, তাঁর সেই বাণী সেকালের তরুণদের প্রাণে কোন্ ভাবের উদ্দীপনা করেছিল তার প্রমাণ বাংলার আধুনিক ইতিহাসের এক অধ্যায়ে চির-উজ্জ্বল হয়ে আছে তথাপি স্বামীজীর এই প্রেম, এবং তজ্জনিত সেই যাতনার সম্বন্ধে একজনের (রোলাঁ) একটি উক্তি স্মরণ করাচ্ছি:

মাতৃভূমি ভারতের সেই সর্ব্বাঙ্গ-নগ্ন মূর্ত্তিতাহার যত-কিছু শোচনীয়তাতাঁহার আর অজ্ঞাত রহিল না; অতিশয় হীন শয্যায় শায়িত, সর্ব্বাভরণরিক্ত সেই রাজেন্দ্রাণীর দেহ তিনি স্বচক্ষে দেখিয়াছিলেন, স্বহস্তে স্পর্শ করিয়াছিলেন।

ভগিনী নিবেদিতার আর একটি কথা এই প্রসঙ্গে স্মরণীয়

 কিন্তু তিনি ছিলেন আজন্ম-প্রেমিকপ্রেম ছিল তাঁহার জন্মগত সংস্কার; সেই প্রেম-পূজার দেবী ছিল তাঁহার মাতৃভূমি। তাহার কোন দোষ যে তিনি ক্ষমা করিতে পারিতেন নাতাহার সংসার-বৈরাগ্যকেও একটা গুরুতর অপরাধ বলিয়াই গণ্য করিতেনতাহার কারণ, তিনি তার (স্বজাতির) সেই সব দোষকে তাঁর নিজের দোষরূপেই দেখতেন।

এতক্ষণ যে স্বামীজীর কথা বলা হচ্ছিল তা যেন অলক্ষ্যে নেতাজীর চরিত-কথাই আলোচনা হচ্ছিল নেতাজীর চরিত্রের একটু ভিতরে দৃষ্টিপাত করলে আমরা কি দেখতে পাই? স্বামীজীর মতই তিনি কি আকুমার ব্রহ্মচারী নন? স্বামীজীকে বিদেশীরাও Warrior-Saint’ আখ্যা দিয়েছে, তাঁর চরিত্রেও ক্ষত্রিয়স্বভাবের প্রাধান্য ছিলএটা সকলেই লক্ষ্য করেছেন। স্বামীজীও ঠিক যে কারণে দেশ-প্রেমিক, নেতাজীও কি ঠিক তাই নন? নেতাজীর দেশপ্রেমে জাতি-ধর্ম্ম-নির্বিশেষে যে এক অপূর্ব্ব ভারতীয়তা-বোধ আমরা দেখেছিদেখে মুগ্ধ হয়েছি, স্বামীজীর মধ্যে ঠিক তাই ছিল, বরং এটা বললে আরও যথার্থ হবে যে, স্বামীজীর সেই দেশপ্রেম-মন্ত্রই নেতাজীর সাধনায় বাস্তবে পরিণত হয়েছে; সে মন্ত্র আর কারও নয়স্বামীজীর। ভগিনী নিবেদিতার গ্রন্থে এর সুস্পষ্ট প্রমাণ আছে। তিনি লিখেছেন, স্বামীজীও মোগলসাম্রাজ্যের গৌরবকে ভারতের গৌরব বলিয়া মনে করিতেন; শেরশাহ, আকবরের নামে তাঁহার বক্ষ যেমন স্ফীত হইত, মুসলমান সাধু ও সাধকের পুণ্যকাহিনীও তেমনই তাঁহার প্রিয় ছিল। যে ভারতকে স্বামীজী ধ্যানে লাভ করিয়াছিলেন, নেতাজী তাহাকেই মূর্ত্তিতে গড়িয়া তুলিয়াছেন। স্বামীজী ভারতীয় সমাজে নারীকে যে গৌরবে পুনঃ প্রতিষ্ঠিত করিতে চাহিয়াছিলেননেতাজীর মনোভাবও কি তাহাই নয়? স্বামীজী বলিতেন

 With five hundred men the conquest of India might take fifty years, with as many women not more than a few weeks.”

এর পর, নেতাজীর ঝান্সীর রাণী-বাহিনী স্বামীজীর কীর্ত্তি বলেই মনে হয় না? নেতাজীর প্রেম নেতাজীর ত্যাগ, নেতাজীর জ্বলন্ত আত্ম-বিশ্বাসএকদিকে অসুরের মত কর্ম্মশক্তি বা রাজসিক উদ্যমশীলতা, অপরদিকে যোগযুক্তের মত সুখদুঃখে সমে কৃত্বা লাভালাভৌ জয়াজয়ৌআত্মার সেই অবিক্ষুব্ধ প্রশান্তি, একদিকে অতি তীক্ষ্ণ বাস্তববোধ ও কার্য্যকুশলতা বা দক্ষতা, অপরদিকে কবির মত উচ্ছাসপ্রবণ হৃদয়-ই দুই চরিত্রের এক লক্ষণ। বোধ হয়, নেতাজীর আকৃতিতেও কোথাও স্বামীজীর সাথে সাদৃশ্য আছেঠিক বলতে পারি না, ্রবীণ রূপদক্ষরাই সেটা স্থির করবেন।
 

 
কিন্তু নেতাজীর জীবন-চরিত, তাঁর শৈশব, বাল্য ও যৌবনের শিক্ষা-দীক্ষা ও কার্য্যকলাপ যাঁরা অবগত আছেন তাঁহারা হয় তএটাও বলবেন যে, নেতাজীর জীবনে স্বামীজীর প্রভাব অতি অল্প বয়সেই পড়েছিল। স্বামীজীর ধর্ম্মের মূলমন্ত্র ছিল“Believe first in yourself then in God”, সেই অদম্য আত্মবিশ্বাস নেতাজীর জীবনে যেন প্রত্যক্ষ-গোচর হয়ে উঠেছে! আবার স্বামীজীর সেই বাণীFight always, fight and fight on, though always in defeatthat's the ideal! (কেবল যুদ্ধ, অবিরাম যুদ্ধ! প্রতিবার পরাজয় হবে জানিয়াও যে যুদ্ধতাহাই ত শ্রেষ্ঠ বীর-ধর্ম্ম!ইহাও কে এমন করে অন্তরে বরণ করে নিতে পেরেছে?  স্বামীজীর সম্বন্ধে শ্রীরামকৃষ্ণ যে ভবিষ্যৎ-বাণী করেছিলেনতাহার নিজের জ্বলন্ত আত্ম-বিশ্বাসই আর সকলের অবসন্ন চিত্তে নষ্ট-বিশ্বাস ও সাহস ফিরাইয়া আনিবেএটাও যেন নেতাজীর সম্বন্ধে আরও সত্য হয়েছে।

তথাপি দুই চরিত্র কি এক? দুইয়ের মধ্যে কি কোন প্রভেদ নেই? প্রভেদ কিছু না থেকে পারে না, কারণ ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব-ভেদ যে থাকবেই। একেবারে ব্রহ্মভূত না হলে দুই আত্মা সম্পূর্ণ এক হয় না। বলতে পারিতামএকই বীজের ফুল, জলমাটিও এক, কিন্তু এমনই যে, ঋতুভেদে তার রঙের পরিবর্ত্তন হয়েছে। যাঁরা আরও ভিতরে দৃষ্টি করবেন, তাঁরা কোন ভেদই মানবেন না। কিন্তু ভেদ একটু মানলে বুঝবার সুবিধা হয়। স্বামীজীর দৃষ্টি যেখানে নিবদ্ধ ছিল নেতাজীকে তাঁর দৃষ্টি সেখান থেকে একটু নিচে নিবদ্ধ করতে হয়েছে, তার কারণ, নেতাজীর লক্ষ্য আরও নিকট। স্বামীজী ছিলেন আদৌ বৈদান্তিক সন্ন্যাসীপরে দেশপ্রেমিক, দেশ-হিতব্রতী; নেতাজী আদৌ দেশ-প্রেমিক, পরে দেশের সেবার জন্যই সন্ন্যাসী। স্বামীজীর প্রতিভা প্রেমের দ্বারা রঞ্জিত হলেও, জ্ঞানই তার প্রধান লক্ষণ; নেতাজীর প্রতিভায় বিশুদ্ধ জ্ঞানের প্রাধান্য নেইতার শক্তি প্রেমের শক্তি; জ্ঞানসেই শক্তির অনুমাত্রিক। নেতাজী মুখ্যত কর্ম্মবীর, তাঁর প্রতিভার চরম নিদর্শন তাঁর সেই আশ্চর্য্য কর্ম্মকুশলতা। স্বামীজীর প্রতিভা মুখ্যতঃ এরকম নয়, সে প্রতিভা মানুষকে জাগাবার প্রতিভা; তাই একজনের নাম স্বামীজী, অপরের নাম নেতাজ,দুটিই সার্থক হয়েছে। স্বামীজী যদি গেরুয়া ত্যাগ করতেন তবে সে আর কিছুর জন্য নয়ওই আজাদ্-হিন্দ ফৌজের নেতাজীহবার জন্য। সেই প্রেম তাঁরও ছিল, কেবল সেজন্য জ্ঞানের তপস্যাকে সংবরণ করে কিছুকাল প্রেমের সমাধিতে সংজ্ঞাহারা হতে হত। অতএব স্বামীজীর মধ্যে আমরা যেমন নেতাজীর ওই প্রেমের মূল দেখতে পাই, তেমনই নেতাজীর মধ্যে স্বামীজীর সেই বাণীকেই মূর্ত্তিমান হতে দেখি সেই এক মন্ত্রBelieve that you are free, and you will be”
 


এই বাণীই নেতাজীকে অনুপ্রাণিত করে তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্ত্তিকে সম্ভব করেছে। স্বামীজী তখন পরিব্রাজকের বেশে সারা ভারত পর্য্যটন করছিলেনকপর্দ্দকহীন সন্ন্যাসী, নাম পর্য্যন্ত ত্যাগ করে তিনি সেই বিশাল জনসমুদ্রে যেন আপনাকে আপনি হারিয়ে গিয়েছিলেন। কলকাতার গুরুভাইগণ কোন সংবাদই জানতেন না, তথাপি এ বিশ্বাস তাঁদের ছিল যে, তিনি হিমালয়ের কোন নিভৃত প্রদেশে আত্মসাধনায় রত আছেন। হঠাৎ, প্রায় দুই বছর পরে, দক্ষিণ ভারতের এক রেল-ষ্টেশনে দুজন গুরুভাই তাঁর দেখা পেয়ে আশ্চর্য্য হয়ে গেলেন। কিন্তু এ মূর্ত্তি তনিবাত-নিষ্কম্প জ্যোতিঃশিখার মত নয়! এর ভিতরে যে ঝড় বইছেদু চোখে রুদ্ধবর্ষণ অশ্রুমেঘ! অতঃপর সেই সন্ন্যাসীর কণ্ঠে উচ্চারিত হলআমি সারা ভারত ভ্রমণ করিয়াছিআমার বুক ভাঙ্গিয়া গিয়াছে। জনগণের কি ভীষণ দারিদ্র্য, কি শোচনীয় দুর্দ্দশা দুই চক্ষে দেখিলাম! আমার কান্না থামিতেছে না। এখন বুঝিয়াছি, ধর্ম্মপ্রচার করিবার সময় এ নহে। এই দারিদ্র্য ও দুর্গতি আগে নিবাবণ করিতে হইবে। ইহার একটা উপায় চিন্তা করিয়া আমি আমেরিকায় যাইতে মনস্থ করিয়াছি।ইহার পর স্বামী তুরীয়ানন্দকে সম্বোধন করিয়া বলে উঠলেন, হরি-ভাই! আমি তোমাদের ঐ ধর্ম্মকর্ম্মের কোন মর্ম্মই বুঝিতেছি না। আমি আমার বুকে মধ্যে একটা বড় জিনিস পাইয়াছিআমি মানুষের দুঃখ অনুভব করিতে শিখিয়াছি।স্বামী তুরীয়ানন্দ বলিয়াছেন, এ যেন ঠিক সেই বুদ্ধের মতসেই ভাব, সেই কথা।

নেতাজীর অন্তরেও কি কেউ প্রবেশ করেছে? যদি করে থাকে তবে বলে দিতে হবে না, তাঁর হৃদয়েও ঠিক এই ঘটনাই ঘটেছিল। সেদিন আজাদ-হিন্দ-ফৌজের ইতিহাসেদুজন পৃথক লেখকের পৃথক কাহিনীতেদুবার দুই উপলক্ষ্যে নেতাজীর যে অদ্ভুত ভাব-সমাধির উল্লেখ করা হয়েছে বর্ত্তমান প্রসঙ্গে তার একটি বড়ই অর্থপূর্ণ। লেখক বলছেন, আজাদ-হিন্দ-গভর্ণমেন্টের সর্ব্বময় কর্ত্তৃত্ব-ভার গ্রহণ করার উপলক্ষ্যে, বিপুল জন-মণ্ডলীর সম্মুখে দণ্ডায়মান হয়ে নেতাজী যখন মাতৃভূমির উদ্ধার সাধনের সংকল্প বা শপথ-বাণী পাঠ করছিলেন, তখন সেই পাঠের মধ্যে যেস্থানে ত্রিশকোটী ভারতবাসীর শৃঙ্খল-মোচন ও অবর্ণনীয় দুর্দ্দশা ও দারিদ্র্য নিবারণের কথা ছিল, সেইখানে এসে তাঁর কন্ঠ সহসা রুদ্ধ হয়ে গেল এবং সারাদেহ পাথরের মত কঠিন ও নিস্পন্দ হয়ে উঠলএকেবারে বাহ্যজ্ঞানহীন অবস্থা! প্রায় আধঘণ্টাকাল তিনি সেই অবস্থায় দাঁড়িয়ে রইলেন! এই যে অলৌকিক অবস্থাএর মূলে ছিল কোন্ অনুভূতি? স্বামীজীর সেই অনুভূতির তীব্রতম রূপ এটাই। আরও প্রমাণ আছে। আমেরিকা থেকে প্রত্যাগমনের পর স্বামীজী মাদ্রাজের বক্তৃতায় দেশবাসীকে সম্বোধন করে যা বলেছিলেন তাতে এই কথাগুলি ছিল

 তোমাদের প্রাণে কি একবারও ইহা জাগে যে, এই দেশের কোটি কোটি নর-নারী কতকাল ধরিয়া, ঘৃণিত পশুর মত চরম দারিদ্র্য ও চরম দুর্দ্দশা ভোগ করিতেছে? সে চিন্তা কি তোমাদিগকে অস্থির করিয়া তোলেআহার-নিদ্রা ত্যাগ করায়? দেশের এই দুর্গতি-মোচনের জন্য তোমরা কেহ কি নাম-ধাম, ধন-জন, পুত্র-পরিবার, এমন কি, নিজের দেহের প্রতিও মমতা ত্যাগ করিতে পার?•••এই জীবন্মৃত অভাগাদিগকে উদ্ধার করিবার কোন উপায়, কোন পন্থা কি তোমরা স্থির করিয়াছ? সেই বজ্র-কঠিন সংকল্প কি তোমাদের আছেযাহার বলে পর্ব্বতপ্রমাণ বাধাও নিমেষে অপসারিত হয়? সমগ্র জগৎ যদি তরবারি হস্তে তোমার পথরোধ করিয়া দাঁড়ায় তথাপি তুমি যাহা সত্য মনে করিয়াছ, তাহা সাধন করিতে কিছুমাত্র ভীত হইবে নামনের এই বল ও প্রাণের সেই প্রেম যদি থাকে, তবে তোমাদের যে-কেহ অতিশয় অলৌকিক ঘটনা ঘটাইতে পারিবে।

 এই বাণী কোন অনাগত পুরুষের উদ্দেশে উচ্চারিত হয়েছিল? সেদিন স্বামীজীর মানস-নেত্রে, তাঁহার তৎকালীন সেই উদ্দীপ্ত হৃদয়ের যজ্ঞানল থেকে, কোন বীরমৃত্তির আবির্ভাব হয়েছিল? তাঁর অন্তরের সেই মূর্তিই কি আজ বাইরে এসে দাঁড়ায়নি? স্বামীজী তাঁর মৃত্যুদিনে এই বলে নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন যে, তখনও আর একটা বিবেকানন্দ দেখা দেয়নি,তথাপি তাঁর দৃঢ়বিশ্বাস ছিল আসবে, সময় হলেই আসবে; না আসলে তাঁকে কে বুঝবেকে তাঁর কাজ সম্পূর্ণ করবে? সেই ভবিষ্যৎ-বাণী যে এত শীঘ্র ফলবে তা কে জানত? আবার সেই সন্ন্যাসী! সেই ত্যাগ, সেই প্রেম! সেই কৌপীনমাত্র সম্বল করে আবার তেমনইদেশের জন্য দেশত্যাগ!

কথিত আছে, নেতাজী মৃত্যুভয়কে সম্পূর্ণ জয় করেছিলেন, শত্রু যখন আকাশ থেকে গুলিবর্ষণ (বোমা) করছে তখন তিনি তারই নিচে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, “আমাকে মারিবে এমন বোমা এখনও তৈয়ারী হয় নাই; ইহাকেই বলে আত্মার অকুতোভয়, এটাও স্বামীজীর একটা বড় মন্ত্র
 “Your country requires heroes. Be heroes! There must be no fear. The true devotees of the Mother are as hard as adamant and as fearless as lions. They are not least upset if the whole universe suddenly crumbles into dust at their feet”.

ঋণ: স্বামী বিবেকানন্দর বাণী রচনা জয়তু নেতাজী: মোহিতলাল মজুমদার

ছবিঋণ : Campus Chronicle

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait