স্বামী বিবেকানন্দের মাতা-ঠাকুরাণী

স্বামী বিবেকানন্দের মাতা-ঠাকুরাণী

 

বৈকুণ্ঠ হতে লক্ষ্মী এল পৃথিবীর এই মাটিতে

জয়রামবাটিতে
গ্রামখানি যে ধন্য হলো মায়ের চরণ ধুলিতে
জয়রামবাটীতে

স্বামী শিবানন্দকে স্বামী বিবেকানন্দ লিখছেন, রামকৃষ্ণ পরমহংস বরং যান, আমি ভীত নই মা-ঠাকরাণী গেলে সর্বনাশ! শক্তির কৃপা না হলে কি ঘোড়ার ডিম হবে! আমেরিকা ইওরোপে কি দেখছি?—শক্তির পূজা, শক্তির পূজাআমার চোখ খুলে যাচ্ছে, দিন দিন সব বুঝতে পারছি সেইজন্য আগে মায়ের জন্য মঠ করতে হবে আগে মা আর মায়ের মেয়েরা, তারপর বাবা আর বাপের ছেলেরা, এই কথা বুঝতে পার কি”?

ADVERTISEMENT
Swades Times Book

শ্রীরামকৃষ্ণ সম্পর্কে স্বামীজী যেমন বলতেন, আমি তাঁর জন্মজন্মান্তরের দাস, এটা আমার পরম ভাগ্যতস্য দাস-দাস-দাসোহহং শ্রীমাকে স্বামীজী শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে অভিন্ন জ্ঞান করতেনতাঁর দৃষ্টিতে এক অখণ্ড সত্তাই দুই দেহাধারে আপনাকে প্রকাশ করেছেনগুরুভ্রাতা শ্রীরামকৃষ্ণানন্দকে এক চিঠিতে লিখেছেন,

‘মা-ঠাকুরাণীকে তাঁহার জন্মজন্মান্তরের দাসের পুনঃপুনঃ ধূল্যবলুণ্ঠিত সাষ্টাঙ্গ দিবেতাঁহার আশীর্বাদ আমার সর্বতোমঙ্গল অর্থাৎ তিনি যেমন নিজেকে শ্রীরামকৃষ্ণেরজন্মজন্মান্তরের দাসবলে মনে করতেন সেইরকম তিনি নিজেকে সারদাদেবীরওজন্মজন্মান্তরের দাসবলে গণ্য করতেনশ্রীরামকৃষ্ণের উদ্দেশে রচিত তাঁর বিখ্যাত কবিতাগাই গীত শুনাতে তোমায়এই সাক্ষ্যই বহন করেছেএই কবিতার প্রথম স্তবকেই তিনি লিখেছেন, -

“দাস তোমা দোঁহাকার,
সশক্তিক নমি তব পদে
আছ তুমি পিছে দাঁড়াইয়ে,
তাই ফিরে দেখি তব হাসিমুখ

১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে স্বামীজি লিখেছেন: শাকচুন্নি যে ঠাকুরের পুঁথি পাঠাইয়াছে, তাহা পরম-সুন্দর কিন্তু প্রথমে শক্তির বর্ণনা নাই, এই মহাদোষ দ্বিতীয় edition- শুদ্ধ করতে বলিবে

এই প্রসঙ্গে স্বামী সারদেশানন্দ লিখেছেনঃ শ্রী রামকৃষ্ণ- পুঁথি- লেখককে স্বামীজি ব্যগ্রভাবে নির্দেশ দেন, পুঁথিতে ঠাকুরের সঙ্গে মায়ের স্তব [অন্তর্ভুক্ত] করিবার জন্যঃ "সশক্তিক ছাড়া ভগবানের উপাসনা হয় না তাই পরে সংযুক্ত হইল,

"জয় মাতা শ্যামা সুতা জগতজননী

রামকৃষ্ণ - ভক্তিদাত্রী চৈতন্য দায়িনী"

স্বামীজী স্বয়ং স্বরচিত ঠাকুরের আরাত্রিক স্তবে মায়ের বীজ মন্ত্র " হ্রীং" সংযুক্ত করিয়া দেন' [স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ]

স্বামী বিবেকানন্দ বলতেন, ‘শ্রীশ্রী মার উপরে মহাশান্তভাব, কিন্তু ভিতরে সংহারমূর্তি  ১৯১৪ সালে প্রথম মহাযুদ্ধের সময় জয়রামবাটিতে একজন শ্রীশ্রী মাকে খবরের কাগজ থেকে যুদ্ধের সংবাদ পড়ে শোনাচ্ছিলেনমিনিট দশেক শোনার পর এবং বহু লোকক্ষয়ের কথা শুনে মায়ের হঠাৎ ভাবান্তর হলপ্রথমে মৃদু গলায় হোঃ হোঃ শব্দে আরম্ভ করে উচ্চশ্বরে হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ অট্টহাস্য করতে লাগলেনসেই বিকট হাসিতে সমস্ত বাড়িখানি যেন কেঁপে উঠলগোলাপ-মা যোগিন-মা কাছে বসে সব শুনছিলেন, তারপর গলবস্ত্র হয়ে জোড়হাতে সম্বর সম্বর বলে প্রার্থনা করতে লাগলেনমা- ক্রমশ প্রকৃতিস্থ হয়ে কোমল মাতৃভাবে ফিরে গেলেনসৃষ্টি স্থিতি যেমন জগৎ প্রপঞ্চের অঙ্গ, ধ্বংসও তেমনিএই গভীর সত্য ভাবতে আমরা ভয় পাই

একবার কোনও কারণে হরিশের [ঠাকুরের গৃহী ভক্ত] মাথা খারাপ হয়ে যায়ঠাকুরের তিরোভাবের পর সেইসময় মা কামারপুকুরে এসে বেশ কিছুদিন ছিলেন| তার ধারণা হয় মা সারদামণি তার প্রকৃতি, এমনকি ধৃষ্টতাবশত,  মার জন্য পাতে প্রসাদ রেখে দিতএকদিন কেউ নেইশ্রীমা যখন পাশের বাড়ি থেকে বাড়ির ভিতরে যেই ঢুকেছে, ওমনি হরিশ মায়ের পিছু পিছু ধাওয়া করল | হরিশ তখন খেপা| মা তখন কোথায় যায়? তাড়াতাড়ি ধানের মরাইয়ের চারদিকে ঘুরতে লাগলেন| আর কিছুতেই ছাড়ে না| সাতবার ঘোরার পর মা আর তখন পারছেন না| মা বললেন, তখন আমার নিজ মূর্তি [বগলা-মূর্তি] মনে এসে পড়ল | তারপর অর বুকে হাঁটু দিয়ে জিভ টেনে ধরে এমন চড় মারতে লাগলুম যে, হাঁপাতে লাগলো | আমার হাতের আঙ্গুল লাল হয়ে গেছিল |"  নরেশচন্দ্র চক্রবর্তীকে মা একবার তাঁর পায়ে হলুদ ফুল অঞ্জলি দিতে বলেনশাস্ত্রে আছে পীতপুস্প ছাড়া বগলা পূজা হয় না

শ্রীরামকৃষ্ণের মহিমা উপলব্ধির জন্যে স্বামীজীকে দীর্ঘকাল বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষা বিচার-বিতর্কের আশ্রয় গ্রহণ করতে হয়েছিল, কিন্তু মায়ের মহিমা উপলব্ধির জন্য তাঁর কোনও কিছুরই প্রয়োজন হয়নিমায়ের মহিমা সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন বা সংশয় স্বামীজীর কোনওদিন ছিল নাশ্রীমা শ্রীরামকৃষ্ণের ত্যাগী ভক্ত-ছাড়া অন্যান্য সকলের মতো নরেন্দ্রের কাছেও অন্তরালবর্তিনী ছিলেনপরবর্তীকালেও শ্রীশ্রী মা যখন স্বামীজীর সঙ্গে কথা বলতেন তখন সোজাসুজি কথা বলতেন নামায়ের মুখে অনুচ্চস্বরে উচ্চারিত কথাগুলি গোলাপ-মা বা অন্য কেউ স্পষ্ট করে শুনিয়ে দিতেনশুধু স্বামীজী নন, অন্যান্য ত্যাগী-সন্তানদের সঙ্গেও [দু-তিনজন ছাড়া] শ্রীমা ঐভাবেই কথা বলতেন

শ্রীরামকৃষ্ণ শ্রীমাকে স্বামীজী যে অভেদ জ্ঞান করতেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় আমেরিকা যাত্রার প্রাক্কালে তাঁর শ্রীমায়ের আশীর্বাদ প্রার্থনা করবার ব্যাকুল সঙ্কল্পেঘটনাটি এই: স্বামীজীর মনে আমেরিকা যাওয়ার সঙ্কল্প স্থির হয়ে গেলেও এই বিষয়ে পূর্ণ সন্দেহমুক্ত হবার জন্য তিনি ভাবলেন: আচ্ছা, শ্রীশ্রীমা তো ঠাকুরের অংশস্বরূপিণী; তাঁকে একখানা পত্র লিখলে হয় না? তিনি যেরূপ বলবেন, সে রূপই করবস্বামীজী তারপর শ্রীমায়ের নির্দেশ চেয়ে যে পত্র লিখলেন তাতে শ্রীমা স্বামীজীকে আশীর্বাদ করে পাশ্চাত্যদেশে গমনের অনুমতি দিলেনএটি পেয়ে স্বামীজীর সকল দ্বিধার অবসান হল, তিনি বললেন; ‘আঃ, এতক্ষণে সব ঠিক হল; মারও ইচ্ছা আমি যাই।  শ্রীশ্রীমায়ের আশীর্বাদকেই স্বামীজী তার পাশ্চাত্যদেশে ঐতিহাসিক সাফল্যের পশ্চাতে ক্রিয়াশীল প্রধান শক্তিরূপে গণ্য করতেনপাশ্চাত্য থেকে ফিরে আসার পর, একদিন তিনি শ্রীমাকে বলেছিলেন, মা আপনার আশীর্বাদে যুগে লাফিয়ে না গিয়ে তাদের তৈরি জাহাজে চড়ে সে মুল্লুকে গিয়েছি

আবার স্বামী সারদেশানন্দ বলছেন. ‘তিনি ছোটমামীর [শ্রীমায়ের কনিষ্ট ভাতৃবধূ] মুখে শুনেছেন যে, বিশ্বজয় করে ফেরবার পর স্বামীজী যেদিন প্রথম শ্রীশ্রীমায়ের চরণ বন্দনা করলেন, সেদিন ছোটমামীর ভাষায়, “রাজার মত চেহারা, ঠাকুরঝির পায়ে লম্বা হয়ে ড়লো; জোড়হাতে বলল, - “মা, সাহেবের ছেলেকে ঘোড়া করেছি, তোমার কৃপায়

এই দর্শনের আর একটি প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ পাই কুমুদবন্ধু সেনের স্মৃতি কথায়মা তাঁর ঘরের দরজায় সম্পুর্ণ চাদরে ঢেকে নীরবে দাঁড়িয়ে ছিলেনস্বামীজী তাঁর সামনে এসেই সোজা মাটিতে শুয়ে তাঁকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলেন  … কিন্তু সাধারণ রীতি অনুযায়ী তাঁর পাদস্পর্শ করলেন নাতারপর তিনি উঠে দাঁড়িয়ে উপস্থিত আমরা যারা স্বামীজীর পিছনে দাঁড়িয়েছিলাম তাদের কোমল কন্ঠে বললেন, যাও, মাকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম কর কিন্তু কেউ তাঁর চরণ স্পর্শ কোরো না তাঁর এতই করুণা, এতই কোমল তাঁর প্রকৃতি, এতই তিনি স্নেহময়ী যে যখন কেউ তাঁর পাদস্পর্শ করে তিনি তাঁর সর্বগ্রাসী করুণা, সীমাহীন ভালোবাসা এবং সমবেদনা দ্বারা তৎক্ষনাৎ তার যাবতীয় দুঃখকষ্ট নিজের মধ্যে আকর্ষণ করে নেন তার ফলে তাঁকে নীরবে অপরের জন্য কষ্ট ভোগ করতে হয় ধীরে ধীরে একে একে তাঁর সম্মুখে সাষ্টাঙ্গে প্রণত হও মুখে কেউ কিছু না বলে তোমাদের অন্তরের অন্তস্তল থেকে নীরবে তাঁর কাছে সর্বান্তকরণে প্রার্থনা কর তাঁর আশীর্বাদ ভিক্ষা কর তিনি সর্বদাই অতিলৌকিক স্তরে অবস্থান করেন এবং সকলের মনের কথা জানেনতিনি অন্তর্যামিনী

‘আমাদের সকলের প্রনাম শেষ হলে গোলাপ-মা নীরবতা ভঙ্গ করে স্বামীজীকে অত্যন্ত স্নেহপূর্ণ স্বরে বললেন, “মা জানতে চাইছেন, দার্জিলিং- তোমার শরীর কেমন ছিল? বিশেষ উপকার হয়েছে কি?”

স্বামীজী: “হ্যাঁ, সেখানে অনেকটা ভালো ছিলাম

গোলাপ-মা: “মা বলেছেন, ঠাকুর সর্বদাই তোমার সঙ্গে আছেনআর জগতের কল্যাণের জন্য তোমাকে আরও অনেক কাজ করতে হবে

স্বামীজী: “আমি প্রত্যক্ষভাবে দেখতে পাই, অনুভব করি এবং উপলব্ধি করি যে, ঠাকুরের আমি যন্ত্র মাত্রযেভাবে যেসব অসাধারণ বিরাট সব ব্যাপার ঘটছে আর যেভাবে ওদেশের মেয়ে-পুরুষ ঠাকুরের জীবন উৎসর্গ করতে এবং ঠাকুরের বাণী প্রচার করতে আমাকে নিঃস্বার্থভাবে সাহায্য করার আগ্রহ দেখিয়েছে, তাতে আমি নিজেই কখনও কখনও অবাক হয়ে যাইআমি মায়ের আশীর্বাদ নিয়ে আমেরিকায় গিয়েছিলাম; সেখানে আমার বক্তৃতার মাধ্যমে মানুষের মনে যে সাড়া জাগাতে সমর্থ হয়েছিলাম এবং তাদের কাছে যে অভাবনীয় সম্মাণ লাভ করেছিলাম তাতে আমি তৎক্ষণাৎ বুঝেছিলাম যে, মায়ের আশীর্বাদের শক্তিতেই অসম্ভব সম্ভব হয়েছিল

এই কথাই স্বামীজী এক পত্রে স্বামী শিবানন্দকে লিখেছিলেন, তারক ভায়া, আমেরিকা আসবার আগে মাকে আশীর্বাদ করতে চিঠি লিখেছিলুম, তিনি এক আশীর্বাদ দিলেন, অমনি হুপ্ করে পগার পার, এই বুঝ

স্বামীজী মায়ের সম্বন্ধে বলতেন, ‘জ্যান্ত দুর্গাস্বামী শিবানন্দকে লিখেছিলেন, বাবুরামের মার বুড়োবয়সে বুদ্ধির হানি হয়েছে জ্যান্ত দুর্গা ছেড়ে মাটির দুর্গা পূজা করতে বসেছে দাদা, বিশ্বাস বড় ধন; দাদা, জ্যান্ত দুর্গার পূজা দেখাব, তবে আমার নাম তুমি জমি কিনে জ্যান্ত দুর্গা মাকে যে দিন বসিয়া দেবে, সেই দিন আমি একবার হাঁফ ছাড়ব তার আগে আমি দেশে যাচ্ছি না যত শীঘ্র পারবে টাকা পাঠাতে পারলে আমি হাঁফ ছাড়ে বাঁচি; তোমরা যোগাড় করে এই আমার দুর্গোৎসবটি করে দাও দেখি গিরিশ ঘোষ মায়ের পূজা খুব করছে, ধন্য সে, তার কুল ধন্য

শ্রীরামকৃষ্ণের অন্যান্য সন্তানেরা সম্ভবত শ্রীমায়ের ঐশী স্বরূপ সম্পর্কে প্রথমে সম্পুর্ণ অবহিত ছিলেন নাতাই স্বামীজী শিবানন্দকে লিখেছিলেন, মা-ঠাকরুন কি বস্তু বুঝতে পারনি, এখনও কেহই পার না, ক্রমে পারবে ভায়া, শক্তি বিনা জগতের উদ্ধার হবে না আমাদের দেশ সকলের অধম কেন, শক্তিহীন কেন?—শক্তির অবমাননা সেখানে বলে মা-ঠাকুরাণী ভারতে পুনরায় সেই মহাশক্তি জাগাতে এসেছেন, তাঁকে অবলম্বন করে আবার সব গার্গী মৈত্রেয়ী জগতে জন্মাবে দেখছ কি ভায়া, ক্রমে সব বুঝবে এইজন্য তাঁর মঠ প্রথমে চাই

পরবর্তীকালে শ্রীরামকৃষ্ণের অন্তরঙ্গ ত্যাগী-পার্ষদগণের শ্রীমা সম্পর্কে দৃষ্টির যে বিবরণ পাওয়া যায় তাতে দেখা যায় যে, তাদের সকলেরই কাছে শ্রীমায়ের প্রকৃত স্বরূপটি ধরা পড়েছিলতাঁরা বুঝেছিলেন পরমা প্রকৃতিই শ্রীমায়ের মধ্যে মানবীরূপ গ্রহণ করেছিলেনবলা বাহুল্য, তাঁদের এই দৃষ্টি উন্মোচন করে দিয়েছিলেন স্বামীজী

শ্রীমায়ের সম্পর্কে তাঁর বিশেষপক্ষপাতিত্বকে স্বামীজী গোপন করতে পারতেন নাবরং বলা যেতে পারে, তা উচ্চকন্ঠে ঘোষণা করতে পারলেই যেন তিনি পরম উল্লসিত হতেন, গভীর তৃপ্তি পেতেনতাই স্পষ্টভাবে স্বামী শিবানন্দকে লিখেছিলেন, দাদা, রাগ করো না, তোমরা এখনও কেউ মাকে বোঝনি মায়ের কৃপা আমার উপর বাপের কৃপার চেয়ে লক্ষ গুণ বড় মায়ের দিকে আমিও একটু গোঁড়া মার হুকুম হলেই বীরভদ্র ভূতপ্রেত সব করতে পারেএই দারুণ শীতে গাঁয়ে গাঁয়ে লেকচার করে লড়াই করে টাকার যোগাড় করছিমায়ের মঠ হবেদাদা, মায়ের কথা মনে পড়লে সময় সময় বলি, ‘কো রামঃ?’ দাদা, যে বলছি, ওইখানটায় আমার গোঁড়ামি

শ্রীমায়ের সঙ্গে স্বামীজীর সাক্ষাতের সময় গোলাপ-মা অনুচ্চস্বরে শ্রীমায়ের নিম্নোক্ত কথাগুলি স্বামীজীকে শুনিয়ে বলেছিলেন, ঠাকুর তোমার মাধ্যমে এইসব মহৎ বৃহৎ কাজগুলি করাচ্ছেন তুমি তাঁর চিহ্নিত শিষ্য সন্তান স্বামীজী সে কথা শুনে গভীর আবেগের সঙ্গে বলেছিলেন, মা, আমি তাঁরই বাণী প্রচার করতে চাই এবং সেজন্য যত সত্বর সম্ভব একটি স্থায়ী সংঘ স্থাপন করতে চাই কিন্তু আমার দুঃখ হচ্ছে এইজন্যে, যত দ্রুত আমি করতে চাই তা পেরে উঠছি না শ্রীমা তখন নিজেই স্নেহকোমল কন্ঠে আশ্বাস দিয়ে বললেন, তার জন্য তুমি কোনো ভাবনা কোরো না তুমি যা করেছ আর যা করবে তা চিরকাল টিকে থাকবে এই কাজের জন্যেই তোমার জন্ম জগতের মানুষ তোমাকে লোকগুরু হিসাবে মানবে তুমি নিশ্চিত জেনো, ঠাকুর তোমার আকাঙ্খা অচিরেই পূর্ণ করবেন অল্পদিনের মধ্যেই দেখতে পাবে তোমার চিন্তা, তোমার স্বপ্ন বাসতবে রূপ নিচ্ছে সেকথা শুনে স্বামীজী ভক্তি বিনত কন্ঠে শ্রীমাকে বললেন, আশীর্বাদ করুন মা, তাই যেন হয়আমার পরিকল্পনা যেন সত্বর ফলপ্রসূ হয়

শ্রীমায়ের আশীর্বাদ সত্য হয়েছিলশ্রীমায়ের সঙ্গে সাক্ষাতের মাসখানেক পরেই ১৮৯৭ খৃষ্টাব্দের ১লা মে স্বামীজী আনুষ্ঠানিক ভাবেরামকৃষ্ণ মিশনতথা রামকৃষ্ণসংঘের প্রতিষ্ঠা করেছিলেনপ্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য শ্রীমা, শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে কাতরভাবে প্রার্থনা করেছিলেনশ্রীমায়ের প্রেরণা আশীর্বাদ এবং শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে তাঁর প্রার্থনার ফলশ্রুতি রামকৃষ্ণসংঘ

স্বামীজী বেলুড় মঠে প্রথম দুর্গোৎসব করার ইচ্ছা করলে অনেকের অমত হয়, তখন বিষয়ে স্বামীজী মাকে জিজ্ঞাসা করেনশ্রীশ্রীমা তৎক্ষণাৎ উত্তর দেন, হ্যাঁ বাবা, মঠে দূর্গাপূজা করে শক্তির আরাধনা করবে বইকি শক্তির আরাধনা না করলে জগতে কোনও কাজ কি সিদ্ধ হয়? তবে বাবা, বলি দিও না, প্রাণী হত্যা কোরও না তোমরা হলে সন্ন্যাসী, সর্বভূতে অভয়দানই তোমাদের ব্রত মঠের প্রথম দূর্গাপূজায় স্বামীজীর নির্দেশে শ্রীমায়ের নামেই সঙ্কল্প করা হয় এবং শ্রীমায়ের হাত দিয়ে পুরোহিতকে পঁচিশটাকা দক্ষিণা দেওয়ান স্বামীজীসর্বত্যাগী সন্ন্যাসীদের আনুষ্ঠানিক বৈদিক পূজাদিতে অধিকার না থাকায় তদবধি মঠের সমস্ত পূজা অনুষ্টানাদিতে শ্রীশ্রীমায়ের নামে সংকল্প করতে স্বামীজী নির্দেশ দেনআর এই বেলুড় মঠের দুর্গাপুজায় স্বামীজী মাকেও দুর্গামূর্তির পাশে বসিয়ে শ্রীচরণে অঞ্জলি দেনতাঁরজ্যান্ত দুর্গাপুজোর অভীপ্সা সে দিন সার্থক হয়েছিল

স্বামী সারদানন্দ বলেছেন, “শ্রীশ্রীমা স্বামীজীর কাজের উদ্দাম আবেগ যেন অনেক সময় রাস টেনে ধরে নিয়ন্ত্রণ করতেনকলকাতার প্লেগ-মহামারীর সময় স্বামীজী নিবেদিতা প্রভৃতিকে নিয়ে সেবাকার্য আরম্ভ করলেন, কিন্তু কার্যের ব্যাপকতা দিন দিন বাড়তে থাকায় এবং সে পরিমাণ অর্থের সংস্থান না থাকায় স্বামীজী বিচলিত হয়ে পড়লেন, শেষ পর্যন্ত তিনি সেবা কাজ অক্ষুণ্ণ রাখবার জন্য বেলুড় মঠ বিক্রি করবার ইচ্ছা করলেনএই কথা শ্রীশ্রী মায়ের কাছে উথ্থাপন করায় তিনি তৎক্ষণাৎ বললেন, সে কি বাবা, বেলুড় মঠ বিক্রি করবে কি? মঠ-স্থাপনায় আমার নামে সংকল্প করেছ এবং ঠাকুরের নামে উৎসর্গ করেছ, তোমার -সব বিক্রি করবার অধিকারই বা কোথায়? … বেলুড় মঠ কি একটা সেবাকাজেই নিঃশেষ হয়ে যাবে? তার কত কাজ ঠাকুরের অনন্ত ভাব সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে যুগ যুগ ধরে এইভাবে চলবে তখন স্বামীজী একটু সলজ্জ ভাবে বললেন, তাইতো, আবেগভরে আমি কি করতে যাচ্ছিলাম, সত্যি তো মঠ বিক্রি করতে আমি পারি না, সে অধিকার আমার নেই রাজাকে [স্বামী ব্রহ্মানন্দ] মঠের অধ্যক্ষ এবং শরতকে [স্বামী সারদানন্দ] যে আমার খেয়ালই ছিল না

‘প্রবাসীপত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় শ্রীমার তিরোধানের পরে এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন যে, নেপথ্যে শ্রীমা সারদা না-থাকলে শ্রীরামকৃষ্ণরামকৃষ্ণ পরমহংসহতেন নাজীবন-সাধনায় শ্রীরামকৃষ্ণের সাধনসঙ্গী রূপে ত্যাগে-তিতিক্ষায়, দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে, উত্তরজীবনে কঠিন দারিদ্রে, বারেবারে ঠাঁই-নাড়া জীবনে অপরিসীম সহনশীলতায়, কঠিন তপশ্চর্যায় আবর্তিত হয়েছেনতাই রম্যা রঁল্যাত্যাগে মহত্তমায় তাঁকে প্রতিষ্ঠা দিতে পারেন, আর সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণন বলতে পারেন হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবী তাঁর (শ্রীমায়ের) জীবন আদর্শ থেকে জেনে নিতে পারে শান্তির শিল্পকলা আত্মীকরণের কথা

১৯০০ খ্রিস্টাব্দে ক্যালিফোর্নিয়ার প্যাসাডেনা শেক্সপিয়র ক্লাবে প্রদত্ত বক্তৃতায় স্বামীজি শ্রীরামকৃষ্ণের মহাসমাধির পরে ঘরবাড়ি-পরিজন ছেড়ে আসা বারো জন তরুণের অসহায়তার কথা জানিয়ে তাঁদের একমাত্র ভরসাস্থল যে শ্রীমা, সে কথা মেলে ধরেছেনসে কী হৃদয়যন্ত্রণা, সেই যন্ত্রণার তীব্রতা ছিল অসহনীয়... সে দিন আমাকে সহানুভূতি দেখানোর কেউ ছিল না... শুধু এক জন ছাড়া... আমাদের গুরুদেবের সহধর্মিণীকিন্তু তিনি ছিলেন নিঃসহায়আমাদের চেয়েও তিনি ছিলেন দরিদ্র

সেই মা শাক বুনে খাচ্ছেন, ভক্তের এঁটো কুড়োচ্ছেন, কাঙালিনী সেজে ছেঁড়া কাপড় তালি দিয়ে পরছেনরামকৃষ্ণ সঙ্ঘের সর্বোচ্চ স্থানে আসীন থেকেও কখনও কোথাও কোনও অধিকার কায়েম করতে চাননি তিনিনেননি কোনও বাড়তি সুযোগ-সুবিধাসুদক্ষ প্রশাসক হিসাবেও ইতিহাসে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গিয়েছেন তিনি


ঋণ: বাণী রচনা: স্বামী বিবেকানন্দশতরূপে সারদা: স্বামী লোকেশ্বরানন্দশ্রী মা সারদা দেবীস্বামী গম্ভীরানন্দ

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait