যে পুজো বাঙালির প্রাণের উৎসব এবার সেই দুর্গাপুজোর আমেজেও হারিয়ে গেছে করোনার গ্রাসে। কলকাতায় পুজোর আনন্দের ছবি অনেকটাই ম্লান হয়ে গেছে এ বছর। জাঁকজমকহীন ভাবেই এ বছর দুর্গাপুজো দেখল এ শহর। তবে একটা জিনিস পরিষ্কার, মা দুর্গার আরাধনায় ধনদেবী লক্ষ্মীর যে বাড়বাড়ন্ত থাকে এবং সেখানে তিনি কতটা কৃপাদৃষ্টি বর্ষণ করলেন, এই মন্দা অর্থনীতিতে সেটা হয়ত ক্রমশ প্রকাশ পাবে। তাই প্রয়োজনে পুজোর রূপরেখা আর গতিপথকে বদলে নিয়ে আগামী দিন, বাঙালির পুজোর উদ্দীপনা আর ঐশ্বর্য থাকবে অনির্বাণ - সেই আশায় অতুলপ্রসাদের গান মনে পড়ে যায়, -
“উঠ গো ভারত-লক্ষ্মী, উঠ আদি-জগত-জন-পূজ্যা,
দুঃখ দৈন্য সব নাশি করো দূরিত ভারত-লজ্জা।
ছাড়ো গো ছাড়ো শোকশয্যা, কর সজ্জা
পুনঃ কনক-কমল-ধন-ধান্যে”!
আর এই লক্ষ্মীদেবীকে শিব-পার্বতীর কন্যাসন্তান করে তুলল বাংলার লোকসমাজ। তারা নতুন গল্প তৈরি করে, গান বানিয়ে সাহিত্য তৈরি করল মঙ্গলকাব্যে। বাঙালি জীবনের সঙ্গে শারদ উৎসবের অচ্ছেদ্য বন্ধন তৈরি হল। সপরিবারে মা দুর্গার বাপের বাড়িতে পুত্রকন্যা নিয়ে আগমন হল। মায়ের সঙ্গে কার্তিক-গণেশের পাশাপাশি লক্ষ্মী-সরস্বতীরও আগমন ঘটল। মাইকেল ‘মেঘনাথবধ কাব্যে’ লিখলেন –
“রমার আশার বাস হরির উরসে;-
হেন হরি হারা হয়ে বাঁচিল যে রমা,
সে কেবল বারুণীর স্নেহৌষধগুণে”।
আর রবীন্দ্রনাথ উর্বশী কবিতায় লিখলেন,-
“আদিম বসন্তপ্রাতে উঠেছিলে মন্থিত সাগরে,
ডান হাতে সুধাপাত্র বিষভাণ্ড লয়ে বাম করে”,
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে নারদ নারায়ণকে লক্ষ্মীর উৎপত্তির বিষয়ে জানতে চাইলে নারায়ণ লক্ষ্মীর সৃষ্টির রহস্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছিলেন সৃষ্টির পূর্বে রাসমন্ডলস্থিত পরমযোগী শ্রীকৃষ্ণের বাম দিক দেবী লক্ষ্মীদেবী উৎপন্না হন। অতিশয় সুন্দরী এই নারীর অঙ্গসমূহ শীতকালে সুখদায়ক উষ্ণ ও গ্রীষ্মকালে শীতল। স্থিরযৌবনা দেবীর কটিদেশ ক্ষীণ, স্তনদ্বয় কঠিন ও গুরু নিতম্ব। তাঁর মুখমন্ডলের প্রভা কোটি সংখ্যক পূর্ণচন্দ্রের প্রভার অধিক এবং অক্ষিদ্বয় শরৎকালের মধ্যাহ্নের পূর্ণ প্রস্ফুটিত পদ্মের চেয়েও সুন্দর। শিশুকাব্যে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, -
“লক্ষ্মী আমায় বল্ দেখি মা,
লুকিয়ে ছিলি কোন্ সাগরে।
সহসা আজ কাহার পুণ্যে
উদয় হলি মোদের ঘরে”।
আসলে, লক্ষ্মীর উদ্ভব বৈদিক যুগে। তখন তাঁর নাম ছিল, শ্রী। তখন থেকেই তিনি ঐশ্বর্যের দেবী। বেদে তাঁর জন্ম বৃত্তান্ত নেই। বাবা-মায়ের নামও নেই। পুরাণের যুগে এসে তিনি বাপ-মা পেলেন, নারায়নকে স্বামী হিসেবে পেলেন আর পেলেন নতুন নাম, 'লক্ষ্মী'। তাঁর বাস স্বর্গের বৈকুণ্ঠ লোকে। এদিকে শারদ উত্সবে সপরিবারে মা দুর্গার আগমন বলতে মায়ের সঙ্গে কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতীর আগমনের কথা সবাই জানি। আর সেই দুর্গাপূজা শেষে শুরু হয় ধন বা ঐশ্বর্যের দেবী লক্ষ্মীর আরাধনা৷
দ্বিজেন্দ্রনাথ ‘টঙ্কাদেবী’ নামে পরিহাস করে বাঙলা কবিতা রচনা করেছেন এ ভাবে, -
“টঙ্কাদেবী কর যদি কৃপা না রহে কোন জ্বালা
বিদ্যাবুদ্ধি কিছুই কিছু না, শুধু ভস্মে ঘি ঢালা”
তেমনি রবীন্দ্রনাথও পরিহাস করে ‘পুরস্কার’ কবিতায় লেখেন
“অন্ন জোটে না, কথা জোটে মেলা,
নিশিদিন ধরে এ কী ছেলেখেলা!
ভারতীরে ছাড়ি ধরো এইবেলা
লক্ষ্মীর উপাসনা”
বিষ্ণু পুরাণ, ভাগবত, মহাভারত প্রভৃতি গ্রন্থ অনুসারে লক্ষ্মী দেবীর উৎপত্তি হয়েছে সমুদ্র থেকে। পুরাণে আছে একদিন ভ্রমণ করছিলেন দুর্বাসা। সাক্ষাত্ হল অপ্সরা বিদ্যাধরীর সঙ্গে। অপ্সরার কণ্ঠে এক অপূর্ব পুষ্পহার দেখে মুগ্ধ হলেন দুর্বাসা। স্বর্গীয় সেই কণ্ঠহার তাঁকে দিয়ে দিলেন অপ্সরা। ওটা গলায় পরেই পদব্রজে এগোচ্ছিলেন ঋষি। এ বার দেখা হল ঐরাবতে আসীন দেবরাজ ইন্দ্রর সঙ্গে। তাঁকে ওই কণ্ঠহার উপহার দিলেন দুর্বাসা। কোথায় রাখবেন বুঝে না পেয়ে সেটা ঐরাবতের মাথায় রাখলেন ইন্দ্র। এদিকে ফুলের গন্ধ মোটেও ভাল লাগল না ঐরাবতের। সে মাথা ঝাঁকিয়ে ফেলে দিল পুষ্পহার। পা দিয়ে পিষ্ট করে দিল সেটা। ব্যস! রগচটা স্বভাবের ঋষি অমনি জ্বলে উঠে উচ্চারণ করলেন অভিশাপ। অদ্ভুত সেই অভিশাপ। তিনি বললেন, কী! আমার দেওয়া মালা মাটিতে ফেলে দিলে, তাই তোমার ত্রিলোক এখন লক্ষ্মীছাড়া হবে। অর্থাৎ, লক্ষ্মীর নির্বাসন। দুর্বাসা মুনির অভিশাপে লক্ষ্মীকে হারালেন ইন্দ্র। স্বর্গ লক্ষ্মীছাড়া হল। তখন বিষ্ণুর পরামর্শে স্বর্গের ঐশ্বর্য ফিরে পাবার জন্য দেবগণ অসুরদের সাথে নিয়ে সমুদ্র-মন্থন শুরু করেন। সেই ক্ষীর-সমুদ্র মন্থনের ফলে উঠে আসল নানা রত্ন, মণি-মাণিক্য, অমৃতসুধা আরও কত কি। এসব ছাড়াও সমুদ্র-মন্থনের ফলে উঠে আসলেন লক্ষ্মী দেবী এবং ঠাই পেলেন বিষ্ণুর বক্ষে। সমুদ্র থেকে দেবীর উদ্ভব বলে দেবীকে বলা হয় সমুদ্রোদ্ভবা। সমুদ্র হল অশেষ ধন-রত্নের আধার। বিষ্ণু হলেন জগতের প্রতিপালক। প্রজাদের লালন-পালন করতে ধন-রত্নের প্রয়োজন রয়েছে আর সেজন্যই বিষ্ণু ধন-ঐশ্বর্যের লক্ষ্মী দেবীকে বুকে স্থান দিলেন।
লক্ষ্মীর অভিশাপ ও রাবণ বধ :
উমার তপস্যা হিন্দু পুরাণের একটি জনপ্রিয় কাহিনি। সতী জন্মান্তরে হিমালয়ের ঘরে কন্যারূপে জন্ম নিয়ে শিবকে পতিরূপে পাওয়ার জন্য কঠোর তপস্যা করেছিলেন। স্কন্দপুরাণ থেকে জানা যায়, নারায়ণকে পেতে লক্ষ্মীও একই রকম তপস্যা করেছিলেন।
রামায়ণের গল্প অনুযায়ী শ্রীরামচন্দ্র সীতাহরণের অপরাধে বধ করেছিলেন লঙ্কাপতি রাবণকে। দেবতাদের বিশেষ আশীর্বাদধন্য রাবণকে বধ করতে দেবী মহামায়ার শরণাপন্নও হতে হয় তাঁকে। কিন্তু এই গোটা বিষয়টি কিন্তু রাবণের অদৃষ্টে লেখা হয়ে গিয়েছিল রাবণের যৌবনেই এবং বস্তুত দেবী লক্ষ্মীর অভিশাপই ছিল তাঁর মৃত্যুর মূল কারণ।
অনেকেরই ধারণা যে মর্ত্যে দেবী লক্ষ্মীর প্রথম অবতার জনকদুহিতা সীতা। কিন্তু তা একেবারেই নয়। মর্ত্যে মা লক্ষ্মীর প্রথম অবতার ছিলেন রাজা কুশধ্বজের কন্যা বেদবতী। কুশধ্বজ ছিলেন রাজা রথধ্বজের ছেলে। এক সময় দেবী লক্ষ্মীর আরাধনা করা বন্ধ করে দেওয়ায়, রাজ্য হারিয়ে, ধনসম্পত্তি হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছিলেন রাজা রথধ্বজ। তার পরেই কুশধ্বজ ও তাঁর ভাই ধর্মধ্বজ কঠিন তপস্যায় বসেন।
তপস্যায় সাড়া দিয়ে মা লক্ষ্মী আবির্ভাব হলে রাজপুত্রেরা দু’টি বর চান দেবীর কাছে— রাজ্য পুনরুদ্ধার এবং রাজবংশের কন্যা হিসেবে দেবীর অবতার রূপে জন্মগ্রহণ। দেবী রাজি হন। কুশধ্বজের স্ত্রী মালবতীর গর্ভে প্রবেশ করেন। জন্ম হয় বেদবতীর, ধরাধামে মা লক্ষ্মীর প্রথম অবতারের। বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতেই জন্ম হয় শিশুর। তাই নাকি রাজকন্যার নাম রাখা হয় বেদবতী।
বেদবতী যৌবনে পা দিলে দেবতা থেকে অসুর, সবাই তাঁর পাণিপ্রার্থী হয় কিন্তু তিনি তো দেবী লক্ষ্মীর অবতার, তাই নারায়ণ ছাড়া আর কাউকে স্বামীরূপে বরণ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। নারায়ণকে স্বামী রূপে পাওয়ার কঠিন তপস্যা শুরু করেন বেদবতী। কিন্তু কিছু সময় পরেই আকাশ থেকে ভেসে আসে দৈববাণী— ‘‘ভগবান বিষ্ণুকে স্বামী রূপে পেতে গেলে তোমাক আরও একবার জন্ম নিতে হবে। তোমার পরবর্তী জন্মেই স্বামী রূপে তুমি পাবে নারায়ণকে।’’
দৈববাণী শুনেও তপস্যা চালিয়ে যান বেদবতী। একদিন পুষ্পকে চড়ে ভ্রমণে বেরিয়ে তপস্যারত বেদবতীকে দেখতে পান লঙ্কাপতি রাবণ। তখন তিনিও সদ্যযুবক। বেদবতীকে নানা রকম প্রলোভন দেখান রাবণ কিন্তু তা সত্ত্বেও তপস্যায় অবিচল থাকেন রাজকন্যা। রাবণ ধৈর্য হারিয়ে তাঁর চুল ধরে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। ক্রুদ্ধ বেদবতী তখন অভিশাপ দেন রাবণকে— ‘‘দুরাত্মা, তোর এত বড় সাহস যে তুই আমার শরীরকে অপবিত্র করিস। এবার আমি আমার নশ্বর দেহ পরিত্যাগ করব। আমি আবারও এক ধার্মিক মর্ত্যবাসীর কন্যা হিসেবে জন্মগ্রহণ করব এবং আমিই হব তোর মৃত্যুর কারণ।’’
এই কথা বলেই তিনি আগুনের কাছে নিজেকে সমর্পণ করেন এবং পরে জনকরাজার কন্যা সীতা হিসেবে ধরাধামে ফিরে আসেন। অর্থাৎ সীতা হলেন মর্ত্যে মা লক্ষ্মীর প্রথম অবতার বেদবতীর পুনর্জন্ম। যেহেতু মা লক্ষ্মীরই অবতার ছিলেন বেদবতী তাই বলা যায় যে দেবীর অভিশাপেই রাবণরাজের অদৃষ্ট রচিত হয়েছিল। নাহলে জনকরাজের কন্যা হিসেবে পুনর্জন্মও হতো না এবং রাম-রাবণের যুদ্ধও বাধত না!
বিষ্ণু-পত্নী লক্ষ্মী ঃ
আবার পুরাণের আবন্ত্য খণ্ডে আছে, লক্ষ্মী ঋষি ভৃগু ও তাঁর পত্নী খ্যাতির কন্যা। নরনারায়ণের বর্ণনা শুনে লক্ষ্মী তাঁর প্রেমে পড়ে যান। তাঁকে পতিরূপে পাওয়ার জন্য সাগরসীমায় গিয়ে তপস্যা শুরু করেন। এক হাজার বছর কঠোর তপস্যার পর ইন্দ্র ও অন্যান্য দেবতারা নারায়ণের ছদ্মবেশে এসে তাঁকে বর চাইতে বলেন। লক্ষ্মী বিশ্বরূপ দেখতে চান। দেবতাদের ছলনা ধরা পড়ে যায়। তাঁরা লজ্জিত হয়ে ফিরে যান। এই খবর পেয়ে নারায়ণ নিজে আসেন লক্ষ্মীর কাছে। তিনি লক্ষ্মীকে বর দিতে চাইলে লক্ষ্মী বলেন, “আপনি যদি সত্যিই নারায়ণ হন, তবে বিশ্বরূপ দর্শন করিয়ে আমার বিশ্বাস উৎপাদন করুন।” নারায়ণ তা-ই করে লক্ষ্মীর সংশয় দূর করেন। তারপর নারায়ণ তাঁকে বলেন, “ব্রহ্মচর্যই সব ধর্মের মূল ও সর্বোত্তম তপস্যা। যেহেতু তুমি ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করে এখানে তপস্যা করেছো, সেহেতু আমিও ‘মূল শ্রীপতি’ নামে এখানে অবস্থান করব এবং তুমিও এখানে ব্রহ্মচর্য-স্বরূপা ‘ব্রাহ্মী মূলশ্রী’ নামে পরিচিত হবে।”
আরও একটি আশ্চর্য লক্ষ্মী-উপাখ্যান পাওয়া যায় রামায়ণে। লক্ষ্মী একবার তাঁর সখীদের নিয়ে কৌশিক নামে এক বিষ্ণুভক্ত ব্রাহ্মণের বাড়ি গান শুনতে গিয়েছিলেন। সেখানে ব্রহ্মা ও অন্যান্য দেবতারাও গিয়েছিলেন গান শুনতে। কিন্তু তাঁরা যেতেই লক্ষ্মীর সহচরীরা তর্জন গর্জন করে তাঁদের দূরে সরে যেতে বলেন। দেবতারা লক্ষ্মীকে খুব সম্মান করতেন। তাঁরা কিছু না বলে সরে যান। শুধু নারদ এতে অপমান বোধ করেন। তিনি বুঝতে পারেন, লক্ষ্মীর সহচরীরা লক্ষ্মীর জ্ঞাতসারেই এই কাজ করেছে। তাই তিনি লক্ষ্মী-সহ সবাইকে রাক্ষসযোনিতে জন্মগ্রহণের অভিশাপ দেন। শাপের বর্ণনা শুনে লক্ষ্মী নারদের কাছে এক আশ্চর্য প্রার্থনা করেন। তিনি বলেন, যে রাক্ষসী স্বেচ্ছায় ঋষিদের রক্ত অল্প অল্প করে সঞ্চয় করে কলস পূর্ণ করবে, তিনি যেন তাঁরই গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। নারদ সেই প্রার্থনা মঞ্জুর করেন।
দেবীভাগবত পুরাণেও লক্ষ্মীকে নিয়ে এক আশ্চর্য কাহিনির সন্ধান মেলে। সূর্যের ছেলে রেবন্ত কোনো এক সময় উচ্চৈঃশ্রবা নামক ঘোড়ায় চড়ে বৈকুণ্ঠে বেড়াতে এসেছিলেন। উচ্চৈঃশ্রবা একে অশ্বরাজ, তায় লক্ষ্মীর মতোই সমুদ্রমন্থনের সময় উদ্ভুত। ঘোড়াটিকে লক্ষ্মী নিজের ভাইয়ের মতো দেখতেন। তাই উচ্চৈঃশ্রবা বৈকুণ্ঠে আসতেই তিনি স্বামীকে ছেড়ে ঘোড়ার আদরযত্ন নিয়ে পড়লেন। ঘোড়ার পিঠে বসে থাকা রেবন্তকে দেখে অবাক হলেন নারায়ণও। তিনি লক্ষ্মীকে জিজ্ঞাসা করলেন, “এই ছেলেটি কে?” লক্ষ্মী তখন ঘোড়ার আপ্যায়নে ব্যস্ত। কয়েকবার জিজ্ঞাসা করেও কথার উত্তর না পেয়ে লক্ষ্মীর উপর বেজায় খাপ্পা হয়ে উঠলেন নারায়ণ। স্ত্রীকে অভিশাপ দিয়ে বসলেন, “ঘোড়া নিয়ে এত আদিখ্যেতা যখন, তখন মর্ত্যে মাদীঘোড়া হয়ে জন্মাও গে!” যতই হোক, নারায়ণ লক্ষ্মীর স্বামী; লক্ষ্মীও নারায়ণের স্ত্রী। অভিশাপ শুনে লক্ষ্মীর খুব কষ্ট হল। নারায়ণকে জিজ্ঞাসা করলেন, কিভাবে তিনি শাপমুক্ত হয়ে আবার বৈকুণ্ঠে ফিরতে পারবেন। নারায়ণ বললেন, মর্ত্যে গিয়ে লক্ষ্মীর নারায়ণ-তুল্য এক ছেলে হবে। তারপরই লক্ষ্মী বৈকুণ্ঠে ফিরতে পারবেন। এরপর যথারীতি মর্ত্যে মাদী ঘোড়া হয়ে জন্মালেন লক্ষ্মী। মর্ত্যে গিয়ে তিনি শিবের তপস্যা করলেন। তপস্যায় তুষ্ট হয়ে শিব বর দিতে এলে লক্ষ্মী বললেন, তাঁর সন্তান যেন নারায়ণের ঔরসেই জন্মায়। শিবের পরামর্শে নারায়ণ হয়গ্রীব অবতার গ্রহণ করে ঘোটকীরূপিণী লক্ষ্মীকে বিয়ে করলেন। তাঁদের ছেলে হলে লক্ষ্মী শাপমুক্ত হয়ে বৈকুণ্ঠে ফিরে গেলেন।
এই দেবীভাগবত পুরাণেই লক্ষ্মীর চরিত্র বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে—তিনি পতিব্রতাদের মধ্যে প্রধান, সকল জীবের জীবন, স্বর্গে স্বর্গলক্ষ্মী, রাজগৃহে রাজলক্ষ্মী ও সাধারণ মর্ত্যবাসীর ঘরে গৃহলক্ষ্মী। তিনি বণিকদের কাছে বাণিজ্যলক্ষ্মী। আবার পাপীদের কলহ উৎপাদিনী। আমাদের বাংলার লক্ষ্মী ব্রতকথাগুলি পুরাণকথাকে আশ্রয় না করলেও, সেই সব উপকথার সারবস্তুর সঙ্গে এই পৌরাণিক বর্ণনার কী আশ্চর্য মিল দেখা যায়!
লক্ষ্মী অনার্যদের দেবী :
তবে লক্ষ্মী শুধু পৌরাণিক দেবী নন, অনার্যদের আদি দেবী। আর্য সংস্কৃতিতে লক্ষ্মী যদি সম্পদ সৌন্দর্যের দেবী হন প্রাগার্য কালচারে খিদের অন্নই হলো লক্ষ্মী। তাই তিনি কৃষিলক্ষ্মী। মেয়েলি ব্রতের দেবী, ঘরের লক্ষ্মী, ধান্যলক্ষ্মী। ধান যার আছে সেই ধনবান। বহুব্রীহি মানেই ধনী। রাঢ়-বাংলায় মাঠের ফসল কাটার সময় এলেই লক্ষ্মীর আরাধনা। চৈতি পৌষালি আর ভাদুরে ফসল উঠলেই চৈত্র ভাদ্র ও পৌষসংক্রান্তিতে লক্ষ্মী পুজো ঘরে ঘরে।
কালীপুজোর রাতে অলক্ষ্মীপূজা:
কালীপুজোর রাতে অনেক স্থানে লক্ষ্মী পুজো হয়। তবে লক্ষ্মীপুজোর আগেই অলক্ষ্মীর পুজো। সে এক দেখার জিনিষ। লক্ষ্মী-নারায়ণ-কুবের তিন পুতুল বানানো হয় পিটুলি মানে চাল-বাঁটা দিয়ে। প্রথমটিকে সিঁদূরের প্রলেপ দেওয়া হয়।এটি লক্ষ্মী। দ্বিতীয়টিকে নীল রঙের চূর্ণ দিয়ে নারায়ণ আর কুবের পুতুলকে দেওয়া হয় অপরাজিতাপাতা বাঁটার প্রলেপ। পুতুলগুলি বসানো হয় কলার পেটোতে। শুরু হয় লক্ষ্মীপুজোর আয়োজন। অবশ্যই তার আগে অলক্ষ্মী পুজো করে বিদেয় করতে হবে। একটি গোবরের পুতুলকে কালো রঙে ভুত করে মেয়েদের ঝরে পরা চুলের নুড়ি গোবর আর মোমবাতি জ্বেলে বাঁহাত দিয়ে পুজো। এরপর কুলোর উলটো পিঠে চাপিয়ে কাঁসর বাজিয়ে অলক্ষ্মী বিসর্জন। তারপর লক্ষ্মীপুজোয় বসতে হবে।
এই অলক্ষ্মী পুজোকেই অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনার্যদের পূজিত আদি শষ্যলক্ষ্মী বলেছেন তাঁর বহুল প্রচলিত বাংলার ব্রত গ্রন্থে। তাঁর মতে এই সবুজ হলুদ লাল রঙের তিনটি পুতুল প্রাগার্য লক্ষ্মী পুজোর নিদর্শন। আসলে শষ্যের তিন প্রকার রূপ। সবুজ হলো শষ্যের প্রথম রূপ। তারপর সেই শষ্যের পাক রঙ ধরে। শেষে পরিপূর্ণ পক্ক। লাল রঙের লক্ষ্মীপুতুল সেই ঝুনট পাকা শষ্যের প্রতীক। এই আদিম লক্ষ্মীপুজো শুধু বাংলায় নয়; বাংলার বাইরেও প্রচলিত ছিল।
কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা :
বাংলায় শারদীয়া দুর্গোৎসবের পর আশ্বিন মাসের শেষে পূর্ণিমা তিথিতে কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার আরাধনা করা হয়। বাঙালি হিন্দুর ঘরে ঘরে এক চিরন্তন প্রার্থনা। প্রতি ঘরে ঘরেই দেবী লক্ষ্মীর পূজা হয়ে থাকে। লক্ষ্মী হলেন ধন সম্পত্তির দেবী। ধন সম্পদের আশায় ঘরে ঘরে কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা হয়ে থাকে.নারী পুরুষ উভয়েই এই পূজায় অংশ গ্রহণ করেন। 'কে জেগে আছো'?
'কোজাগরী' শব্দটির উৎপত্তি 'কো জাগতী' অর্থাৎ 'কে জেগে আছ' কথাটি থেকে। বলা হয়, যার কিছু (সম্পত্তি) নেই সে পাওয়ার আশায় জাগে, আর 'যার আছে (সম্পত্তি) যে না হারানোর আশায় জাগে'। আর সারারাত জেগে লক্ষ্মীর আরাধনা করাই এই পূজার বিশেষ আচার। কথিত আছে কোজাগরী লক্ষ্মী পূর্ণিমার দিন দেবী রাত্রে খোঁজ নেন - কে জেগে আছেন? যে জেগে অক্ষক্রীড়া করে, লক্ষ্মী তাকে ধন সম্পদ দান করেন।
অক্ষক্রীড়া শব্দের সাধারণন অর্থ পাশা খেলা। কেউ কেউ এই দিন পরের বাগানের ফলমূল চুরি করে। এই কাজের মাধ্যমে তারা ভাবে যে লক্ষ্মী দেবী তাদের কৃপা করবেন।
“নিশীথে বরদা লক্ষ্মীঃ জাগরত্তীতিভাষিণী।
তস্মৈ বিত্তং প্রযচ্ছামি অক্ষৈঃ ক্রীড়াং করোতি যঃ” ।।
অবনীন্দ্রনাথের মতে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর মধ্যে অনেকখানি টিকে আছে সেই আদিম অনার্যলক্ষ্মীর স্মৃতি। পুজোর উপকরণগুলি দেখলেই বোঝা যায়। কোজাগর মানে কে জাগে। এই মায়াবী পূর্ণিমার রাতে যারা জেগে থাকেন, পাশা অর্থাৎ দ্যূতক্রীড়া করেন দেবী তাঁকে বর দান করেন। বোঝ ঠ্যালা! যে লক্ষ্মীকে নিয়ে এত বড়ো বড়ো কথা সেখানেই জুয়া খেলা!!!! তবে কি ডাল মে কুচ কালা হ্যায়! অনেকেরই সেই গল্পটা জানা আছে। জগৎ শেঠের ধনী হবার গপ্পো।বিদ্যা বুদ্ধির খাতিরে দিল্লীতে ডাক পড়লো শেঠ মশাইএর। সম্রাট তার বুদ্ধি চাতুর্যের খুব প্রশংশা করে বললেন কি চাই আপনার? মায়ের শেখানো বুলি শেঠ আওড়ে গেলেনঃ দিল্লীতে কোজাগরী রাতে কেউ যেন আলো না জ্বালে। সম্রাট বললেন ঠিক আছে। এদিকে কোজাগরী রাতে সারা দিল্লী অন্ধকার হয়ে রইলো শুধু আলো জ্বলছে শেঠের বাড়িতে। দেবী লক্ষ্মী জগৎ ভ্রমণে বেরিয়ে দেখতে পেলেন দিল্লীতে সব অন্ধকার শুধুমাত্র জগৎএর বাড়িতেই আলো জ্বলছে। দেবী বললেন আমাকে একটু আশ্রয় দেবেন? শেঠের মা দেবীর ছলনা বুঝতে পেরে বললেন আপনি বসুন আমি যতক্ষণ না ফিরে আসছি ততক্ষণ থাকুন। দেবী তাতে রাজি হলেন | এবার জগৎ শেঠের মা নদীতে স্নান করতে গিয়ে প্রাণত্যাগ করলেন | ফলে সেদিন থেকে দেবী জগৎ শেঠের ঘরে থেকে গেলেন |
লক্ষ্মী দেবীর বাহন :
লক্ষ্মী দেবীর বাহন পেঁচা কেন? পেঁচা লক্ষ্মী দেবীর সম্পূর্ণ বিপরীত ধর্ম ধারণ করে। পেঁচা কুৎসিত ও দিবান্ধ। যারা সারা জীবন শুধু ধনলাভের চিন্তায় মগ্ন থাকে, তারা ঐ পেঁচার মতই অন্ধ হয়ে যায়। তাই জ্ঞানের আলো তাদের অন্তরে প্রবেশ করতে পারে না। পেঁচা যেমন কালো অন্ধকারে পথ চলে, ধনলোভীরাও তেমনি কালো পথে অর্থাৎ অসৎ পথে ধাবিত হয়। ধনের দেবী তাঁর সঙ্গে পেঁচা রেখে সকলকে জানিয়ে দেন, যিনি ভক্তিধন অন্বেষণ করবে, তিনি আমাকে পাবে আর যিনি পার্থিব-ধন অন্বেষণ করবে তিনি আমাকে নয় আমার পেচাঁকে লাভ করবে।
লক্ষ্মী দেবীর রূপ :
লক্ষ্মী দেবী বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রূপে অধিষ্ঠান করেন। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে আছে এই দেবী বৈকুণ্ঠে পরিপূর্ণতমা শ্রেষ্ঠা মহালক্ষ্মী, স্বর্গে ইন্দ্রের সম্পদরূপা স্বর্গলক্ষ্মী, পাতাল ও মর্ত্যে রাজাদের রাজলক্ষ্মী, গৃহে তিনি গৃহলক্ষ্মী ও অংশরূপে গৃহিনী এবং গৃহিগণের সম্পদরূপিণী মঙ্গলকারিণী মঙ্গলা। তিনি গাভীদের জননী সুরভী, যজ্ঞের পত্নী দক্ষিণা, তিনি ক্ষীরোদ-সমুদ্রকন্যা, পদ্মফুলের সৌন্দর্যরূপিণী, চন্দ্রের শোভারূপা, সূর্যমণ্ডলের শোভারূপা এবং অলঙ্কারে, রত্নে, ফলে, জলে, নৃপপত্নীতে, গৃহে, সকল শস্যে, বস্ত্রে ও পরিষ্কৃত স্থানে বিরাজমানা।
লক্ষ্মী দেবীর বসবাস :
পুরাণ বলছে, তিনি ক্ষীরদ সমুদ্রে মহানাগের উপরে স্থিতির দেবতা বিষ্ণুর সঙ্গে বিরাজ করেন। সেই অবস্থান সময়হীন, তাকে ধ্যানকল্পে স্থান দিয়ে তপস্যা করেন মুনি-ঋষিরা। এছাড়া পাঁচটি বিশেষ স্থানে লক্ষ্মী বাস করেন।
দেবী লক্ষ্মী কমলাসনা। পদ্মফুলকে দেবীর আবাস বলে চিহ্নিত করে সনাতন বিশ্বাস। তাঁর পূজায় পদ্ম অপরিহার্য। সমাজ-নৃতাত্ত্বিকরা জানান, দেবী লক্ষ্মী আদি মাতৃকাশক্তির প্রতিরূপ। পদ্ম একান্ত ভাবেই স্ত্রী-প্রতীক।
দেবীর আর এক আবাস ধরা হয় বিল্বপত্রে। সাধারণত বেল পাতা শিবের অনুষঙ্গ বহন করে। সনাতন বিস্বাস, দেবী লক্ষ্মী বাস করেন বিল্ব পত্রের উলটো পিঠে।
হাতির কপালে লক্ষ্মী বাস করেন। হাতির কপালের মাঝখানের ঈষৎ উঁচু অংশকে ‘গজকুম্ভ’ বলা হয়। অতি প্রাচীন কাল থেকেই ভারতে হাতিকে শুভশক্তির দ্যোতক বলে ধরা হয়। দেবী লক্ষ্মীর একটি রূপকল্পে তাঁর দু’পাশে দু’টি হাতির উপস্থিতি লক্ষণীয়।
গো-পৃষ্ঠে লক্ষ্মী অবস্থান করেন। গরু একদা প্রধানতম সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হতো এ দেশে। সমৃদ্ধির দেবী লক্ষ্মীর অবস্থানকে তাই গো-পৃষ্ঠে কল্পনা করাটা কোনও অস্বাভাবিক ঘটনা নয়।
দেবীর আর এক আবাস প্রতিটি মানুষের হাতের আঙুলের অগ্রভাগে। মানুষের অন্যতম প্রধান কর্মেন্দ্রিয় তার আঙুল। এই অঙ্গই তার অন্ন সংস্থান করে। ফলে লক্ষ্মীর আবাস হিসেবে হাতের আঙ্গুলে অগ্রভাগেকে কল্পনা করাটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়।
Comment 1
Share
খুব ভালো লাগলো। জানা ছিল না অনেক কিছুই
Enter your email address to reset your password.
The very name 'SWADES' denotes the philosophical essence and ideological standpoint of our vision. We envisage serving our 'Swades' by providing news, special stories and literary works of the new generation writers which would cater to the interest of the Nation.
Swades Times © 2020 , All rights Reserved
0 comments