প্রতিজ্ঞা

প্রতিজ্ঞা

“কাকু একটা ক্যাডবেরি সেলিব্রেশনস দাও তো।”  আজ রিয়ার খুড়তোতো বোনের জন্মদিন তাই অফিস ফেরত একটা ছোট গিফট কিনতে পাড়ার দোকানে এসেছে।   

বাড়ি ফিরে রিয়া দেখলো সবাই এসে গেছে- কাকু, কাকিমা, জেঠু, জেঠিমা, ভাইবোনরা সবাই খুব গল্প করছে। মনে মনে প্রস্তুত হয়ে নিলো  রিয়া, একটু পরেই নিশানা তার দিকেই আসবে সে জানে। ঠিক তাই, ৫মিনিটের মধ্যে জেঠিমা হেসে বলে উঠলো ” সেই ছোট্ট থেকে তো কে-এড  স্কুল কলেজ এ পড়ছিস, ৫বছর চাকরি ও করছিস।।।কিন্তু একটা ভালো ছেলে জোগাড় করতে পারলিনা।” সবাই খুব হাহা করে হাসলো যেন খুব মজার কথা হয়েছে।

রিয়া কোনো উত্তর দিলোনা; মুখ টা ঘুরিয়া নিয়ে ভাবলো ‘ দত্ত বাড়ির নাম আমি ডোবাবোনা কথা দিয়েছি যে।’

নিজের মনেই রিয়া পিছিয়ে গেলো ১৩টা বছর; মনে পড়ে গেলো সেই দিন টা ।।।আজ ও পুরোটা ছবির মতো মনে আছে তার। তখন বয়েস মনে হয়ে ১২ কি ১৩ হবে । শৈশবের নিষ্পাপ মন তখন ও জানে পৃথিবী টা সুন্দর এবং স্বপ্নের মতো। 

একদিন রিয়া দেখলো তাদের পাশের বাড়ির নিচের তলাতে একটা নতুন ছেলে থাকতে এসেছে। জানলার ধার থেকে উঁকি দিয়া দেখলো রিয়া; ছেলে তা তার থেকে ১২-১৩ বছরের বড় হবে। সেই প্রথম কোনো ছেলে কে দেখে রিয়া র একদম অন্য রকম এর অনুভূতি হয়েছিল। কেন হলো?এটাকেই কি প্রেম বলে? রিয়া ঠিক জানেনা, কিন্তু সে দেখেছে তার স্কুল এর অনেক বন্ধু  একসাথে হাত ধরে ঘোরে, নিজেদের বয়ফ্রেইন্ড গার্লফ্রেইন্ড বলে। 

ADVERTISEMENT

বেশ কিছুদিন জানলার ধার দিয়া রিয়া দেখতো ছেলেটা কে; দারুন কিছু নয় দেখতে কিন্তু তও রিয়া র কেন এতো ভালো লাগে? উঁকি দিয়া দেখা র বেশি সাহস কোনোদিন তার হয়নি- বাবা মা জানলে খুব বোকা দেবে। এইভাবে দুই মাস কেটে গেলো – একদিন হটাৎ ই ছেলেটা হাত নাড়লো রিয়া র দিকে তাকিয়ে জানলা দিয়ে। ভয়ের চোটে রিয়া এক দৌড় দিয়ে বাথরুম এ লুকিয়ে পড়লো। বুক তা ধড়াস ধড়াস করছে তার; এখন সে কি করবে? কথা বলবে? না কি এখানেই ‘  এন্ড ‘ করা উচিত?

আজ মনে হয়ে সেদিন ‘এন্ড’ করতে পারলে হয়তো এই গল্প টাই অন্য রকম হতো রিয়ার। না, রিয়া পারেনি; তাই পরের দিন সে খুব ভয়ে ভয়ে হাত নেড়েছিলো। এরপর আর কি — একটু  হাত নাড়া , অল্প হাসি চলতে থাকে এরকম।  একদিন রিয়া তাদের বাড়ির ছাদে ঘুরে বেড়াচ্ছে, হটাৎ দেখলো পাশের বাড়ির ঠিকে ঝি মালতি তাকে ডাকছে।

“কিছু বলবি আমায়?” রিয়া জিগ্যেস করে মালতি কে। মালতি রিয়া র থেকে ৫-৬ বছরের বড় হবে।

“তোমাকে অর্ক দা এটা দিতে বলেছে; চাইলে ফোন করতে পারো নইলে চিঠি লিখতে পারো ” বলে একটা ছোট্ট কাগজের টুকরো রিয়া র হাতে দিয়ে দৌড়ে চলে গেলো মালতি। খুব সাবধানে রিয়া ছোট্ট চিরকুট তা দেখলো, তাতে একটা ফোন নম্বর লেখা আছে এবড়োখেবড়ো ভাবে। ‘হাতের লেখা তা কি বাজে’ ভেবে রিয়া একটু মুঝকি হাসলো।

এখন রিয়া খুব বিপদে; ফোন করবে না চিঠি লিখবে? অনেক ভেবে ঠিক করলো প্রথমে এমনি একটা চিঠি এ ভালো। কিন্তু প্রেমের চিঠি কিরম হয়ে? কি লেখে তাতে? অনেক্ষন ভেবে ভেবে রিয়া একটা কাগজে লিখলো ‘আমার নাম রিয়া দত্ত, তোমার নাম তা আজ এ জানলাম। আমি ছবি আঁকতে র গল্প করতে ভালোবাসি খুব।  তোমার কি পছন্দ? আমি সেন্ট পিটার’স স্কুল এ পড়ি, কথা বলতে চাইলে 11 টায় আস্তে পারো স্কুল এর সামনে। ‘

হটাৎ কানে এলো মা ডাকছে ‘ রিয়া খেতে আয়ে, ৯।৩০টা বাজে তো’। তাড়াতাড়ি চিঠি তা একটা বই এর মধ্যে রেখে রিয়া উঠে গেলো খেতে। এমন কপাল সেদিন কেই মা গেছিলো রিয়া র পড়ার ঘোরে বই গুলো একটু গুছিয়ে দিতে, আর পেয়ে গেলো সেই চিঠি। তারপর সে কি মার; এখনো মনে পড়লে চোখের কোনে জল চলে আসে রিয়ার।

বাবা যে কোনোদিন মারেনি সেও ঠাস ঠাস করে কত যে চর মারলো। তারপর ওই চিঠি হাতে চলে গেলো পাশের বাড়ি অর্ক কে জেরা করতে।

রাত তখন ১০।৩০টা। বাবা ফিরে এলো; এসেই কোনো কথা না বলেই আবার ঠাস ঠাস করে মারতে লাগলো। রিয়া বোকার মতো তাকিয়ে আছে বাবা মা র দিকে; চোখ দিয়ে জল পরেই যাচ্ছে। ‘কিছু বোলো বাবা, কি হলো ওখানে? কি বললো অর্ক?’ মনে মনে বললো রিয়া।

মনের কথাটা যেন মা জেনে গেলো; ঠিক এই প্রশ্ন গুলোই করলো বাবা কে। ” বলবে আবার কি, বললো তোমার মেয়ে  লাস্ট ২মাস ধরে ওই ছেলে তা কে উস্কাচ্ছে । ওদের বাড়ির মালতি বললো রিয়া নাকি ওকে বলেছে যে একটা চিঠি দেবো, পৌঁছে দিতে পারবি । ছেলেটা খুব এ ভালো টাই আমায় বললো বেশি বকাবকি করবেন না আঙ্কেল, বাচ্চা মেয়ে; আমি এরম করতেই পারিনা, কত বড় ওর থেকে।

আর কিছু যেন রিয়া র কানে যাচ্ছিলোনা, সবাই মিলে এরম ভাবে কেন মিথ্যে বলছে। মালতী, অর্ক সবাই ওকেই দোষী করে দিচ্ছে; কিন্তু রিয়া তো কিছুই করেনি সেরম। চিঠি ও হয়তো লিখতোনা যদি না মালতি বলতো অর্ক যোগাযোক করতে চাইছে।

“সবাই মিথ্যে বলছে বাবা, বিশ্বাস করো প্লিজ” কোনো মতে আস্তে আস্তে বলেছিলো রিয়া।

ঠাস করে আবার একটা চোর পড়লো তার গালে ” সবাই মিথ্যে বলছে র তুই একদম সব সত্যি বলছিস তাইনা।”

এর ১মাসের মধ্যে অর্ক চলে গেলো অন্য কোথাও। পরে রিয়া অর্ক র দেয়া ফোন নম্বর তা চেক করে জেনেছিলো যে ওটা ভুয়ো।

দিন কেটেছে, অনেক বছর ঘুরে গেছে। আবার সব আগের মতো হয়ে গেছে ; খালি রিয়া র জীবন অনেক টাই পাল্টে গেছে। এখন আর  তার পৃথিবী রঙিন নেই। এক ধাক্কায় কে যেন তাকে অনেক বড় করে দিলো। তার নিজের বাবা মা তাকে বিশ্বাস করলোনা; এই ব্যথা তা আজ ও তাড়িয়ে বেড়ায় রিয়া কে। আজ ও কিছুতেই রিয়া ভুলতে পারেনা কাকিমা র সেই বেঁকা হাসি, ভাই বোন এর অবাক দৃষ্টি তে তাকানো এবং জেঠিমা র আওয়াজ ‘ দত্ত বাড়ির নাম এই মেয়েই ডোবাবে মনে হচ্ছে।’

দাঁতে দাঁত চেপে সেদিন একটা ১৩ বছরের মেয়ে নিজেকে প্রতিজ্ঞা করেছিল ‘ দত্ত বাড়ির নাম আমি ডোবাবোনা; প্রেম এ আমি কোনোদিন পড়বো না’। 

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait