ছোটগল্প : লগ্নভ্রষ্ট

ছোটগল্প : লগ্নভ্রষ্ট

- কিছু না, কিচ্ছু না... এমনিই!
- কী এমনি রে পুঁটি?- পিছনদিক থেকে এসে মাথায় জোরসে একটা চাঁটি মেরে পাশে বসল হাবলুদা।
- আরে পুঁটি এসেছে পোস্তোর বড়া দিতে। তোর কাকিমণি পাঠিয়েছে। তা ওকে আমি তোর বিয়ের কার্ডের ডিজাইনটা দেখালাম। ও মা, মেয়ে দেখেও কেমন চুপ করে বসে আছে। অন্যমনস্ক হয়ে। কেমন হয়েছে জিজ্ঞাসা করলাম, তুতলে তুতলে বললো "ভ-ভালো, ব-বেশ ভালো!" তাই জিজ্ঞাসা করলাম কী হয়েছে রে তোর? বলে কিছু না। এমনিই!- হুড়মুড় করে বলে গেল হাবলুদা'র মা রত্না জ্যেঠি।
- তা পুঁটি তো ছোটবেলা থেকে একটু তোতলাই ছিল মা, এই ক'বছর ধরে দেখছি একটু উন্নতি হয়েছে। ও তুমি চাপ নিও না। আর তাছাড়া বিয়ের কার্ড তো ফাইনাল হয়নি মা, মেয়ে দেখাই শেষ হয়নি এখনও... তুমি ফালতু ওকে কার্ড-ফার্ড এসব দেখাতে যাচ্ছ কেন? আর ও দেখেই বা কি উদ্ধার করবে? বেকার টাইম নষ্ট করো তুমি!
- আরে মেয়েটা এসেছে যখন ভাবলাম দেখিয়েই নিই একবার। এরপর হুড়োহুড়ি লেগে যাবে বিয়ের, তখন সময় পাবো নাকি? বলতো পুঁটি, হাবলু তো চলে যাবে তিন মাস পরে, তার মধ্যে মেয়ে পছন্দ করে, কেনাকাটা করে বিয়েটা দিতে হবে... সময় কোথায় হাতে?
- কো-কো-কোথায় যা-যাবে হাবলুদা?
- একি রে পুঁটাই, তোর তোতলামি'টা বড্ড বেড়েছে তো? এরকম তোতলালে কিন্তু বিয়ে হবে না তোর!
- সেটা তোমাকে ভা-ভাবতে হবেনা হাবলুদা। জ্যেঠি তু-তুমি কী বলছিলে?
- বলছি, ওরে পুঁটি, তোর হাবলুদা তো তিন বছরের জন্য বিদেশে চলে যাবে। কথা চলছিল মাস খানেক ধরে। অফিস থেকে গত পরশু কনফার্ম করেছে। কিন্তু তোর জ্যেঠু বলে দিয়েছে বিয়ে না করে কোথাও যাওয়া যাবে না। কোনোমতেই তাঁকে মানানো যাচ্ছে না। এদিকে অফিসে এরকম হঠাৎ করে বলাটাও চাপ। তবু বেচারা অফিসে গতকাল এটা জানাতে বাধ্য হয়েছে বসকে। বস্ বলেছেন কোনোরকমে একটা বিয়ের কার্ড সামনের মাসের মধ্যে দেখাতে পারলে অফিস থেকে দুজনের যাওয়ার জন্যই ভিসা আর টিকিটের ব্যবস্থা করে দেবে। তাই আমাদের এত তাড়া পড়েছে।
- ওহ, আচ্ছা। আ-আমি তো এসব জা-জানতাম না!
- কেন রে কাকিমণি তো সব জানে, বলেনি কিছু?- জিজ্ঞাসা করল হাবলু।
- আঃ বাবু, ওর মা'কে আমি গতকাল সন্ধেবেলা বলেছি, ও তখনও ওর স্টুডিও থেকে ফেরেনি। টাইম পায়নি বলার আর কী। আর তোর জন্য মেয়ে দেখা তো সেই কবে থেকে চলছে। নেহাৎ তুই সবাইকেই নাকচ করে দিচ্ছিলি তাই...।
- আমি আসি জ্যেঠি। ঝড়ের বেগে উঠে পড়ল পুঁটি।
- চলে যাবি?
- একটু ক-কাজ আছে, ব-বাড়িতে।
- আচ্ছা, যা তাহলে। আর শোন, বিয়ের কেনাকাটার সময় একটু থাকিস কিন্তু আমার সঙ্গে সঙ্গে।
- আ-আমি? আচ্ছা... যদি স-ও-ময় পাই।
- সময় আবার কি রে? ওই তো ঢপের ফটো স্টুডিও তোর... বন্ধ রাখবি ক'দিন!
- শোনো হাবলুদা, ওই ঢপের স্টুডিও চালিয়েই ক'টা ফ্যামিলির পেট চলে। ওটাকে অত ফেলনা ভেবো না বুঝেছো? আর কে বলতে পারে, তোমার বিয়েতেও ওখান থেকেই শেষে ক্যামেরাম্যান পা-পাঠাতে হল?
- এই দেখো মা, ঝগড়ার টপিক দাও শুধু ওকে, সব তোতলামি হাওয়া। বলেছিলাম না?
- হ্যাঁ রে পুঁটি, তুই শ্বশুরবাড়ি গিয়েও এমনভাবে ঝগড়া করবি নাকি?- প্রশ্ন করল হাবলু।
- অদ্ভুত কথা বললে একটা ! হঠাৎ খুব শান্ত গলায় কথাটা বলে, হাবলুর দিকে ততোধিক শীতল একটা দৃষ্টি দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল পুঁটি !
- হাবলু রে, পুঁটি হঠাৎ ওরকম ক্ষেপে গিয়ে চলে গেল কেন বল তো?
- কী জানি মা ! ও তো ওরকমই। ছাড়ো তো!

ADVERTISEMENT

হাবলু আর পুঁটিদের বাড়ি একই পাড়ায়, প্রায় মুখোমুখি। তাই দুজনের পরিচয়টা সেই জন্ম থেকেই! হাবলুর ঠাকুমা আর পুঁটির ঠাকুমার খুব ভাব ছিল এক সময়, দুই বাড়িতে তাই যাতায়াতও ছিল ভালো রকম। কলাটা, মূলোটা না হোক, খাসির মাংস, কচুর লতি, মোচার ঘণ্ট হলে হাবলুর বাড়ি থেকে বাটি আসতো পুঁটিদের বাড়ি আবার পোস্তর বড়া, নারকোল দিয়ে চিংড়ি বাটা বা মালাইকারি হলে এবাড়ি থেকে টিফিন কৌটো যেত হাবলুদের বাড়ি। এর মধ্যে কয়েক বছর আগে পুঁটির ঠাকুমা মারা যান, কিন্তু তাতে দুই বাড়ির মধ্যে যাতায়াত বা আদান-প্রদান কমেনি একটুও। হাবলুর ঠাকুমা এখনও সময় পেলেই চলে আসেন পুঁটির মা'র সঙ্গে গল্পগাছা করতে, অবশ্য আজকাল অনেকটাই কমে গেছে সেটা, বাতের ব্যাথায় বেশি নড়াচড়া করতে না পারার জন্য। পুঁটির মা মাঝেমধ্যে চলে আসে এবাড়িতে, কারণ দুই বাড়ির মধ্যে হাবলুর মা আর পুঁটির মা'র বন্ধুত্বটাও বেশ জোরালো, আর হাবলুর ঠাকুমা তো আছেনই। কিন্তু সংসার সামলে সেই সন্ধে কিংবা বিকেল বেলায়, একটু বাড়ি থেকে বেরোলে তবেই দেখা সাক্ষাৎ হওয়া। হাবলুর মা কে দিদি ডাকার সুবাদে উনি পুঁটির জ্যেঠিমা আর পুঁটির মা হাবলুর কাকিমণি।
সে যাই হোক, এই হাবলু ওরফে তথাগত কিন্তু নামে হাবলু হলেও আসলে বেশ স্মার্ট ঝকঝকে, এম.এস.সি শেষ করে শহরের এক নামী আই.টি কোম্পানিতে কর্মরত, বছর ঊনত্রিশের এক যুবক। কোন ছোটবেলায় গোলগাল নাদুস-নুদুস বাচ্চাটিকে দেখে আদর করে কে যেন হাবলু বলে ডেকেছিল। তারপর থেকে তার ডাকনাম ওটাই হয়ে গেছে। পড়াশোনায় ভালো, স্কুল-কলেজের ফুটবল টিমে অটোমেটিক চয়েস ছিল ছেলেটা। আর সঙ্গে রয়েছে ওর গিটার বাজিয়ে গান করা। পাড়ায়-বেপাড়ায় অনেক মেয়েরই হার্টথ্রব ছিল তথাগত, আর আপাততঃ অফিসেও বেশ ভালো রকমই পাত্তা সে পায় সিনিয়রদের কাছে তার কাজের জন্য। আর মেয়েদের কাছে? তথাগত সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই হল !
এদিকে পুঁটি, যার একটা গালভরা নাম রয়েছে- 'প্রিয়ম্বদা', সে ছোট থেকেই রোগা টিংটিংয়ে, লম্বা, গায়ের রং উজ্বল গমের মতো। পড়াশোনায় মোটামুটি ছিল, আর খুব ভালো ছিল সাঁতারে আর জিমন্যাস্টিকে। কিন্তু ফাঁকিবাজিতে সে সবার সেরা, তাই কমার্স নিয়ে কোনোমতে গ্র্যাজুয়েশনটা কমপ্লিট করেই বাবাকে পটিয়ে-পাটিয়ে ফটোগ্রাফির কোর্স করতে ভর্তি হয়ে গিয়েছিল। তারপর বছর খানেক অন্য ফটোগ্রাফারদের পেছনে ঘুরে ঘুরে কাজ করে অবশেষে বাবাকে একরকম ব্ল্যাকমেল করে নিজের একটা ফটোগ্রাফি স্টুডিও খুলে বসেছে ইদানিং। ছোটোবেলায় ঠাকুমার হাত ধরে তিড়িং-বিড়িং করে লাফাতে লাফাতে পাড়া বেরিয়ে বেড়াতো, আর কিছুতেই এক জায়গায় দাঁড়াতে দিত না ঠাকুমাকে। এই দেখে হাবলুর ঠাকুমা ওকে পুঁটি মাছ বলে ডাকতেন। আর সেই থেকেই ওর ডাকনাম কিভাবে পুঁটিই হয়ে গেল সবার কাছে। পাড়ার অনেকেই পাত্তা দেয় না পুঁটি আর ওর ফটোগ্রাফি স্টুডিওটাকে। কিন্তু পুঁটির তাতে খুব একটা কিছু যায় আসে না। ওর করা প্রি-ওয়েডিং ফটোশ্যুটের প্রোফাইলগুলো এখন অনেকের কাছেই বেশ প্রিয় হয়ে উঠেছে। তাছাড়া পুঁটির স্ট্রিট ফটোগ্রাফির শখ সেই ছোট থেকেই। এখনও প্রায়ই ক্যামেরা কাঁধে বেরিয়ে পড়ে এদিক-ওদিক। আর স্টুডিও? সেটা সামলানোর জন্য দুটো ছেলে আছে মাইনে করা। পুঁটি নিজে ট্রেনিং দিয়ে তৈরি করেছে ওদের। ওরা জন্মদিন থেকে বিয়ে, সব অনুষ্ঠানেরই ফটো, ভিডিও তুলে বেড়ায়। পুঁটি ওসবে আগে যেত, আজকাল নিজে খুব একটা যায় না, ওদেরই পাঠায়। শুধু প্রি-ওয়েডিংগুলো ও নিজের হাতে শ্যুট করে। ওর কথায়- "বিয়ের ছবি একঘেয়ে। প্রি-ওয়েডিংগুলোর তাও একটু কিছু গল্প থাকে, আলাদা আলাদা লোকেশন থাকে!" আর ও রাস্তা-ঘাটে ঘুরে ছবি তুলে বেড়ায়, অনেক কম্পিটিশনেও পাঠায়। তার মধ্যে বেশ কিছু জায়গা থেকে প্রাইজও পেয়েছে সে প্রথম তিন বা পাঁচের মধ্যে থাকার জন্য রিসেন্টলি। এগুলো সে কাউকে বলে না, আসলে কাকেই বা বলবে? বন্ধু কোথায় ওর তেমন? আগে তাও হাবলুদা ছিল। কিন্তু সে-ও পড়াশুনা, চাকরি নিয়ে ব্যস্ত ভীষণ ! আর এখন তো...।

হাবলুদা'কে পুঁটি ভালোবাসে কিনা জানে না, তবে হাবলুদা'র বিয়ে হয়ে যাবে। এটা শোনার পর থেকে কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে ওর। বাড়ি এসে মা'কে জিজ্ঞাসা করল,
- হাবলুদা'র বিয়ে সামনে, মা?
- হ্যাঁ, মেয়ে দেখছে।
- বলোনি তো আমাকে আগে !
- আরে আমাকেই তো কাল বলল রূপা'দি।
- ওহ্।
- তুই দিলি বড়াগুলো? কিছু বলল তোর জ্যেঠি?
- খুশি হল, অ্যাজ ইউজুয়াল। তারপর বিয়ের কার্ডের ডিজাইন দেখাল।
- কার্ড? মেয়ে ঠিক হয়ে গেছে নাকি?
- না, বলল ঠিক করবে মেয়ে একমাসের মধ্যে তাই ডিজাইন ফাইনাল করে রাখছে কার্ডের।
- হ্যাঁ সে তো হবেই, এত বড় বাড়ির একমাত্র ছেলের বিয়ে বলে কথা ! তার উপর এত তাড়াহুড়ো করে করে করতে হবে।
মা বেশ সহজভাবে কথাগুলো বলে যাচ্ছিল, কিন্তু পুঁটিকে কে যেন ভেতর থেকে খোঁচা মেরে যাচ্ছিল। "সেই তো, কত বড় বাড়ির ছেলে, কত পয়সা জ্যেঠুমণির। হাবলুদা'রও তো মাইনে অনেক শুনেছি, তার উপর আবার বিদেশ যাবে ! বিয়ের আয়োজনও তেমনই হবে। আর মেয়েও তেমনই হতে হবে নিশ্চয়ই। সুন্দরী, শিক্ষিতা, ওয়েল ম্যানার্ড।"- এসব ভাবতে ভাবতে নিজের ঘরে গিয়ে বসেছিল পুঁটি, হঠাৎ একটা কথা মনে পড়তে হেসে ফেলল নিজের মনেই।
"আচ্ছা হাবলুদা'রা তো ফটোগ্রাফার, ভিডিওগ্রাফার খুঁজবে। প্রি-ওয়েডিংও করাবে নিশ্চয়ই। ওরা যেমন লোক, পেমেন্ট খুব ভালো করবে নিশ্চয়ই! আচ্ছা, এই অর্ডারটা আমাকে তো দিতে পারে? তাহলে আমার হাতে বেশ ভালো রকমের ক্যাশ আসে। অনেকদিকে একটু হেল্প হয় !" কবে থেকে একটা ভালো ক্যামেরা কেনার টাকা জমাচ্ছে পুঁটি। এই রকম কিছু পার্টি ধরতে পারলে...।
নিজের ঘর থেকে রান্নাঘরে এলো পুঁটি। মা মন দিয়ে কীসব কাটছে। ও বলল,
- মা, তুমি একটা কাজ করতে পারবে? মানে আমার একটু হেল্প হয় তাতে।
- কী রে?
- জ্যেঠি'কে বলবে হাবলুদা'র বিয়ের প্রি-ওয়েডিংটা যদি আমার কাছ থেকে করায় ! ওরা পেমেন্ট ভালোই করবে। আমার ক্যামেরাটার জন্য...।
- এ মা, এসব আমি বলতে পারবো না ওদের পুঁটি। ধুর ! তুই'ই বরং আবদার কর গিয়ে তোর জ্যেঠির কাছে বা হাবলুকেই ডিরেক্টলি বল না?
- হাবলুদা কে? নাঃ ছেড়ে দাও! থাক...।
- কেন রে?
- কিছু না। ছাড়ো। আমাকে ফেকলু ভাববে। ভাববে আমি কাজ পাই না বলে এই সুযোগে কিছু পাওয়ার চেষ্টা করছি।
- আরে না না। হাবলুই তো আমাকে বলেছিল যে কাকিমণি, পুঁটির ছবি তোলার হাত বেশ ভালো। ওর স্টুডিও একদিন অনেক বড় হবে, দেখে নিও!
- সেই। সবজান্তা হাবলু কুমার।
- এ কী কথার ছিরি?
- যাই হোক ছাড়ো, এসব নিয়ে তুমি ওদের কিছু বলতে যেও না! ওর বিয়ের ভিডিও আমার দ্বারা তোলা হবে না। বলে, নিজের ঘরে ফিরে গেল পুঁটি।

এর মধ্যে হাবলুদা'র সঙ্গে খুব একটা দেখা হয়নি পুঁটির। তবে ওদের বাড়ি যেতে হয়েছে বেশ কয়েকবার। ওই মা পাঠায় কিছু না কিছু হাতে দিয়ে। গেলে জ্যেঠি হাবলুদা'র বিয়ে নিয়ে নানা রকম কথা আলোচনা করে পুঁটির সঙ্গে। পুঁটি বলে কম, শোনে বেশি।
একমাস পরে একদিন, পুঁটি তখন স্টুডিওতে একটা কাজে ব্যস্ত। হঠাৎ একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন।
- হ্যালো, এটা কি প্রিয়ম্বদা'র স্টুডিও?
- হ্যাঁ। কে বলছেন?
- আমি শ্রীদর্শিনী বলছি, আপনি আমাকে চিনবেন না। আমার এক বন্ধুর বিয়ের প্রি-ওয়েডিং শ্যুট'টা আপনি করেছিলেন। আমার বেশ ভালো লেগেছে আপনার কাজ। ওর কাছ থেকেই নম্বর নিয়ে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করছি। আমার বিয়ে সামনে, হাতে খুব অল্প সময়... আপনি কি একটা দিন ফিক্স করতে পারবেন?
- উমম্। আচ্ছা আপনার ফেভারেবল ডেটগুলো বলুন আমি দেখছি।
কথা চলতে থাকে দুজনের মধ্যে। সময়, থিম, জায়গা। সব নিয়ে দু'তিনদিন ধরে কথা চলার পর ঠিক হয় এক রবিবারে সারাদিন ধরে ভিক্টোরিয়া, ময়দান ঘুরে শ্যুটিং করে, শেষে প্রিন্সেপঘাটের সূর্যাস্তর ব্যাকগ্রাউন্ডে ফাইনাল কিছু ছবি নিয়ে শেষ হবে পুরো সেশনটা।
শ্যুটিংয়ের দিন সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়েই দেখে উল্টোদিকে হাবলুদা। ওর গাড়ি নিয়ে বেরোচ্ছে। পুঁটি তাড়াতাড়ি বাস স্ট্যান্ডের দিকে হাঁটা লাগায়, ওর দুই অ্যাসিস্ট্যান্ট অপেক্ষা করছে ওখানে। হাবলুদা দেখতে পেলেই এক্ষুনি ডাকবে, তারপর হাজারখানা প্রশ্ন- কী করছিস, কোথায় যাচ্ছিস, কেন যাচ্ছিস? ভুলভাল টাইম ওয়েস্ট! কিন্তু যা ভয় পেয়েছিল ঠিক তাই, হাবলুদা ঠিক পুঁটিকে দেখে ফেলে চেঁচিয়ে ওঠে-
- ওই পুঁটি, কী রে, সামনে দেখেও না দেখার ভান করে চললি কোথায়?
- ওহ তুমি? না, আসলে একটু তাড়ায় আছি তো। খেয়াল করিনি!
- (হাবলুদা কিছুক্ষণ চোখ দিয়ে পুঁটির আপাদমস্তক মেপে নিয়ে বললো) তুমি স্ট্রিট ফটোগ্রাফি করে বেড়াও, আর এই পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চির এত বড় শরীরটা তোমার চোখে পড়েনি? ফাজলামি হচ্ছে? তা ডেটিংয়ে চললি নাকি রে?
- হুহ... মজা করছ?
- কেন তুই যেতে পারিস না কারও সঙ্গে ডেটে?
- ...কাজ আছে, কাজে যাচ্ছি। খুশি? এবার যেতে পারি?
- ওই তো ঢপের কাজ তোর। বলছি যে, আমি পৌঁছে দেবো?
- নাঃ থ্যাঙ্ক ইউ। জগা আর পিন্টু দাঁড়িয়ে আছে বাস স্ট্যান্ডে। আমি আসি।- বলেই একরকম দৌড় লাগালো পুঁটি।
বাস থেকে নেমে একটু হেঁটে ভিক্টরিয়ার গেটের সামনে পৌঁছালো ওরা। ফোন করলো পুঁটি, শ্রীদর্শিনী'র নম্বরে। ফোনটা ধরে ও বলে দিল ভিক্টরিয়ার পেছন দিকে একটা মাঠের মধ্যে ওরা বসে আছে। ডিরেকশন মত গিয়ে ওখানে পৌঁছতেই পুঁটিকে কেউ ৪৪০ ভোল্ট মারলো। সামনে তাকিয়েই নিমেষে পেছন দিকে ঘুরে গেল পুঁটি। সামনে দাঁড়িয়ে হাবলুদা! পাশে মিষ্টি মতো দেখতে একটা মেয়ে, একটা পা-ঢাকা গাউন পরে, চুলটা কোমর অবধি লম্বা। পুঁটির হার্ট বিট'টা অকারণেই খানিক বেড়ে গেছে। কিন্তু উপায় নেই। ওদের ফেস করতেই হবে ওকে। অগত্যা ও সামনে তাকালো অনেকটা দ্বিধা নিয়ে, হাবলুদা মিটিমিটি হাসছে। শ্রীদর্শিনী এগিয়ে এসে হ্যান্ডশেক করল। তারপর আলাপ করিয়ে দিল ওর ফিয়ন্সে তথাগত ওরফে পুঁটির হাবলুদা'র সঙ্গে। পুঁটি অবাক হয়ে দেখলো হাবলু শ্রীদর্শিনী'কে ওদের পরিচয় থাকার কথা কিছুই বলল না। ফলে পুঁটিও চেপে গেল ব্যাপারটা। এরপর শুরু হলো ফটো সেশন। ভিক্টোরিয়ার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে ফটো তুলে ওরা এলো ময়দানে। বেশ ক'টা ফটো তোলার পর যখন শ্রীদর্শিনী মাঠে বসে আলতো করে মাথা রাখলো তথাগত'র কাঁধে, তারপর একটা হাত তুলে দূরের গাড়ি চলার রাস্তাটার দিকে দেখিয়ে পোজ দিল। পুঁটির হঠাৎ করে ছবি তোলার ইচ্ছেটা কেমন চলে গেল! জগা'কে নিজের ক্যামেরাটা ধরিয়ে দিয়ে একটু ছবিগুলো তুলতে বলে ও এক দৌড়ে চলে গেল মাঠের ভীড়ের মধ্যে। ভীড়ে মিশে গিয়ে একটা পান-বিড়িওয়ালার কাছ থেকে এক প্যাকেট বিড়ি কিনল। পকেট থেকে লাইটারটা বার করে একটু অস্থির হাতে একটা বিড়ি ধরাল, লম্বা লম্বা টানে শেষ করতে লাগলো বিড়িটা। মনে মনে পুঁটিকে কে বলল- "পারবি আর ছবি তুলতে? এইভাবে ছবি তোলা যায়? তুই তো মানুষ! ভগবান বা শয়তান, কোনোটাই তো না!" পর মুহূর্তে নিজেই নিজেকে শাসন করলো পুঁটি- "আজ যা-ই হয়ে যাক, আমাকে প্রি-ওয়েডিংয়ের বেস্ট ছবিগুলো তুলতেই হবে। জগা বা পিন্টুকে দিয়ে আর নয়, নিজেই তুলব। বাকি সব কটা ছবি... স-অ-ব ক'টা!" তাড়াতাড়ি বিড়ি'র শেষটুকু ফেলে দিয়ে দৌড়ে ওদের কাছে গেল পুঁটি। জগা হাসিমুখে বললো- "দিদি, এদিকে ছবি তোলা হয়ে গেছে, এবার?"
- "ট্রাম লাইনের দিকে চল। ওখানে ক'টা শট নেব।"-
বলেই ঘাড়ে নিজের ব্যাগটা চাপিয়ে হাঁটা লাগালো পুঁটি। এরমধ্যে অবশ্য একবার শ্রীদর্শিনী'কে সাহায্য করতে হয়েছে, গাউনটা পাল্টে শাড়ি পরতে। ট্রাম লাইনের কাছে গিয়ে পুঁটি নিজের হাতে শ্রীয়ের চুলটা ঠিক করে দিল। আলগা খোঁপা করে, সাইডে একটা হলুদ গোলাপ লাগিয়ে দিল ও ব্যাগ থেকে বের করে। শ্রী অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল।
- হলুদ গোলাপ কোথায় পেলে?
- এসব আমার ব্যাগে টুকটাক থাকে। শ্যুটের সময় লেগে যায়! হালকা হেসে উত্তর দিলো পুঁটি।
ট্রাম লাইন বরাবর হাত ধরে হেঁটে, লাইনের ধারে তথাগতর হাত জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে, পেছন থেকে তথাগত'র পাঞ্জাবীর হাতা টেনে ধরে। এমন নানা পোজে ছবি তুললো ওরা, পুঁটির আইডিয়া মতো। এতক্ষণ ছবি টবি তুলে সবারই ক্ষিদে পেয়েছে মারাত্মক। ময়দানের ওখানেই খাওয়া হলো চাট, ভেলপুরী এসব। শেষে সবাই মিলে চললো প্রিন্সেপ ঘাট। সূর্যাস্ত হবে হবে তখন। শ্রীদর্শিনী'র ইচ্ছেমতো একটা নৌকা ভাড়া করা হল। শ্যুটগুলো ওখানেই হবে। নৌকায় ওঠার সময় একে একে সবাই উঠতে থাকল। শেষে পুঁটি ওঠার সময় হাবলু হাত বাড়াল। একবার মুখ তুলে তাকালো পুঁটি, চোখাচোখি হলো দুজনের। তারপর হাবলুর হাত না ধরে, মাঝিকে হাতটা বাড়াতে বলে উঠে গেল নৌকায়। হাবলু তাকিয়ে রইল কয়েক সেকেন্ড পুঁটির দিকে। ফটোশ্যুটের মাঝেই হঠাৎ গান ধরল শ্রী। তথাগত'র চোখে চোখ রেখে গেয়ে উঠলো- "তাকে খুব কাছে যেই পাই/ আমি অমনি বোবা দু'চোখে হারাই..."।
কী মিষ্টি গলা শ্রীয়ের! ... চোখের ইশারায় জগাকে ফটো তুলতে বলে নিজে নীরবে ভিডিও করতে থাকলো পুঁটি। আর খেয়াল করল, সকালে ভিক্টোরিয়াতে, দুপুরে ময়দানে দেখা ছেলেটা এখানেও কোথা থেকে এসে হাজির হয়েছে। আর অন্য একটা নৌকা থেকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ওদের নৌকোটার দিকে। কেমন অদ্ভুত বিষণ্ণ সেই চাউনি ! ছেলেটা হাবলুদা'র মতোই লম্বা। কিন্তু একটু ছিপছিপে, রিমলেস ফ্রেমের চশমা পরা, গালে বেশ ক'দিনের খোঁচা-খোঁচা না কাটা দাড়ি, একটা জিন্স আর প্রায় রং-চটা একটা টি-শার্ট পরেছে সে। পুঁটি সকাল থেকেই ছেলেটাকে খেয়াল করছে। ঠিক ওদের পেছন পেছন পৌঁছে যাচ্ছে সব জায়গায়। আর এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকছে। ওই বিষণ্ণ চাউনি দিয়ে!
অন্যদিকে মন ফেরালো পুঁটি। শ্রীয়ের গান ততক্ষণে থেমেছে। এবার অন্ধকার হয়ে আসছে, ফিরতে হবে। পুঁটিরা লাস্ট শট'টা নিল যখন শ্রী'কে হাত ধরে নৌকা থেকে নামাচ্ছে তথাগত!
এরপর প্যাক আপ। এবার শ্রী বায়না ধরেছে স্কুপে যাবে। আইসক্রিম ওকে খেতেই হবে ওখানে। তথাগত হালকাভাবে একবার বলল পুঁটিদের নিয়ে যাবার কথা। শ্রী রাজি হলেও পুঁটি বুঝল শ্রী একটু আলাদা সময় চাইছে হাবলুদা'র সঙ্গে। ও স্কুপে যাবার কথা সজোরে উড়িয়ে দিয়ে বাড়ির পথে পা বাড়াল। শ্রীদর্শিনী পেমেন্টের অর্ধেকটা তখনই দিয়ে দিল ওদের হাতে। আর একবার চোখাচোখি হলো পুঁটি আর হাবলু'র। তারপর হনহন করে পুঁটি হাঁটা দিল ওর দুই শাগরেদ'কে নিয়ে। বাড়ি ফিরে বড্ড ক্লান্ত লাগছিল পুঁটির। তবু রাতে ডায়েরিটা খুলে বসল আজ। লিখল-

হাবলুদা যে সত্যি সত্যি জ্যেঠি ছাড়া অন্য কারও সম্পত্তি হয়ে যাবে একদিন... এটা এত বছর ভাবতে পারিনি কেন? আমার ভাবা উচিত ছিল আগে থেকেই! ভিক্টোরিয়ার খিলানগুলো, ময়দান, ট্রাম লাইন, চাট কাউন্টার, প্রিন্সেপ ঘাটের নৌকো, স্কুপ(!)... কেমন স্বপ্নের মতো কেটে গেল দিনটা ! শুধু হাবলুদা'র পাশে... যাক গে, আমার মতো পেত্নীর গলায় কোনও ভূতই নাচছে... হাবলুদা তো... রাজপুত্তুর!
তোমার গল্পে রাজকন্যা, রাজত্ব অর্ধেক,
আমার মত শাকচুন্নীর বট গাছেতে ঠেক!

এই অবধি লিখে নিজের মনেই হেসে নিলো কিছুটা পুঁটি। তারপর ডায়েরি বন্ধ করে শুতে গেল। সারারাত স্বপ্নে দেখল- ও উড়ে যাচ্ছে... দ্বিতীয় হুগলি ব্রিজের উপর দিয়ে, বাবুঘাট পেরিয়ে... এলোমেলো ঘুরছে হাওয়ার সঙ্গে। ওই তো এসপ্ল্যানেডের মোড়, শ্রীরাম মার্কেড, নিউ মার্কেটের উপর দিয়ে সাঁই করে উড়ে গেল ও। এখন নীচে চ্যাটার্জি ইন্টারন্যাশনাল! একটু পরেই ডান দিকে ভিক্টরিয়ার পরিটা ঘুরছে। ও উড়ে গিয়ে পরিটাকে ছুঁলো একবার। খিলখিলিয়ে হেসে উঠল ওই হাওয়া পরি ! নন্দনের উপর দিয়ে যেতে যেতে গান কানে এল, সংগীত মেলা চলছে? কতদিন যাওয়া হয় না ! হঠাৎ চোখে পড়ল এক কোণে দুটো মানুষ দুটো ঠোঁট এক জায়গায়। জামাটা হাবলুদা'র না? মেয়েটা কে? ওই তো মাথার একপাশে দিয়ে একটা হলুদ গোলাপ উঁকি মারছে...।
হঠাৎ ও বুঝল ও আর উড়তে পারছে না। ডানায় ব্যাথা করছে... হে ভগবান, এখানে ফেলো না, আর একটু, একটু দূরে নিয়ে চলো, অন্ততঃ শিশির মঞ্চের সামনেটায়। কিছুতেই না, হাবলুদা'র সামনে কিছুতেই পড়ব না ধপাস ! ঘুমটা ভেঙে গেল পুঁটির। ধড়মড় করে উঠতে যেতেই বুঝল আবার পড়ে গেছে। কোলবালিশটা নিয়েই। গায়ের পাতলা চাদরটা জড়িয়ে-পেঁচিয়ে গিয়ে বাঁ পা-টা মুড়ে গেছে। ব্যাথা লাগছে খুব ! পাশের ঘরে থেকে মা হুড়মুড়িয়ে উঠে এসেছে। দরজা ভেজানোই থাকে। এসেই মা আগে চাদরটা টেনেটুনে সরালো। তারপর হাত ধরে টেনে তুলতে তুলতে বললো- "না, না, এখানে না প্লিজ। এসব বলে ওরকম চেঁচাচ্ছিলি কেন? কোথায় কোথায় ছবি তুলে বেড়াস। খাওয়া-দাওয়া করিস না সারাদিন ঠিকমতো। তারপর দুর্বল শরীরে রাত-বিরেতে উল্টো-পাল্টা স্বপ্ন দেখে চেঁচাস ! সর দেখি, সরে শো, আমি পাশের ঘরে থেকে আমার মাথার বালিশটা নিয়ে আসি!"
মা বালিশ নিয়ে পাশে শুয়ে মাথায় বিলি কাটতে লাগলো। ঘুমে দু'চোখ জুড়িয়ে যেতে থাকল পুঁটির। ও মা'কে বলেনি আজ হাবলুদা'র প্রি-ওয়েডিং শ্যুট করতে গেছিল। এখন বলল,
- মা আজ হাবলুদার প্রি-ওয়েডিং শ্যুট ছিল।
- তাই? তুই কী করে জানলি?
- আমিই তো করে এলাম ! ওর বউ আমাকে ফোন করে সব ঠিক করেছিল তো। তাই জানতাম না এটা হাবলুদা'র জন্য করতে যাচ্ছি। মেয়েটা খুব মিষ্টি জানো মা? খুব ভালো গান করে। আমার মতো না।
কথা জড়িয়ে আসছে পুঁটির ঘুমে। মা আলতো স্বরে বলল,
- আচ্ছা বেশ। তুই এবার ঘুমো তো চুপ করে।
তারপর মেয়ের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ। একটু পরে উঠে পুঁটির টেবিলের কাছে গিয়ে দেখে ডায়েরিটা পড়ে আছে। কী মনে করে আজ অনেক বছর পর ডায়েরিটা খুললো পুঁটির মা। শেষ খুলেছিল পুঁটি যখন কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। কদিন ধরে কলেজ যেতে চাইছিল না মেয়ে, কাউকে কিছু বলছিলও না। জিজ্ঞাসা করলে রেগে যাচ্ছিল। এমনই একটা দিনে ওই পড়ার টেবিল গোছাতে গিয়ে হাতে আসে ডায়েরিটা। পুঁটি তখন স্নানে গেছে। এই ফাঁকে ডায়েরি খুলে শেষের দুটো পাতা পড়তে পড়তে মা'র চক্ষু চড়ক গাছ ! কী বিচ্ছিরি র‍্যাগিংয়ের মুখে পড়েছিল পুঁটি ! পড়তে পড়তে গা শিউরে উঠেছিল। তারপরেই মা মেয়েকে কিছু না জানিয়ে লুকিয়ে দেখা করেছিল ওর কলেজের প্রিন্সিপালের সঙ্গে। সব খুলে বলাতে উনি আশ্বাস দিয়েছিলেন এটার জন্য কিছু একটা করার। আর হ্যাঁ, করেছিলেনও উনি। প্রথমে, পরদিনই কলেজ থেকে বাড়িতে ফোন আসে, প্রিয়ম্বদা কেন কলেজ যাচ্ছে না এক সপ্তাহ ধরে সেটার উত্তর চেয়ে, আর সেদিন থেকেই পুঁটি আবার কলেজ যাওয়া শুরু করে। অবশ্যই প্রিন্সিপাল এর ভয়ে! আর দ্বিতীয়তঃ, কলেজে একটা অ্যান্টি র‍্যাগিং কমিটি বসানো হয় জরুরি ভিত্তিতে।
তারপর থেকে কিছুদিনের মধ্যেই সব নরম্যাল হয়ে যায়। মেয়েও আবার খুশি খুশি কলেজমুখী হয়।
সেই কথা মনে পড়তেই একটু হাসি খেলে যায় পুঁটির মা অর্পিতা দেবীর মুখে। হাসিমুখে ডায়েরিটা খুলে শেষ পাতাটা পড়তে পড়তে সেই হাসি নিমেষে মিলিয়ে যায়। "কী সর্বনাশ ! এবার তো আমি আর কিছু করতে পারবো না ! কিন্তু মেয়েটা এইভাবে কষ্ট পাবে?"... ভাবতে ভাবতে অর্পিতা দাঁড়ায় গিয়ে পুঁটির ঘরের দেওয়ালে ঝোলানো 'ঠাকুর-মা-স্বামীজি'র ছবিটার কাছে। এটা উনিই মেয়ের ঘরে রেখেছিলেন। ওনার সেই ছোটবেলা থেকে ধারণা যে, এই তিনজনের শরণাপন্ন হলে সব বিপদ পার করা যায়! পুঁটি কতটা বিশ্বাস করে? সে তো ঠাকুরই জানেন ! কিন্তু আজও ওই ছবির সামনে গিয়েই দাঁড়ালো অর্পিতা। নিজের অল্প বয়সের কথা মনে করে বলে উঠলো- "মা, পুঁটিকে তুমি শক্তি দিও। আমি বরাবরের মতো আজও বলব না রক্ষা কর। বরং আজ আবার বলবো, আমার মেয়েটাকে শক্তি দিও সত্যিটা মেনে নেবার। নিজের মনের সঙ্গে লড়াই করে নিজেকে আরও বুঝদার করে তোলার।"
নাঃ, আর ঘুম এলো না মায়ের চোখে।

পর দিন রত্নাদি, মানে হাবলুর মা ডাক দিলেন অর্পিতাকে,
- অর্পি, পুঁটি আজ ফ্রি আছে রে?
- কেন গো রত্নাদি?
- আজ দুপুরে থেকেই হাবলুর বিয়ের কেনাকাটাগুলো শুরু করব ভেবেছি। পুঁটিটা থাকলে ভালো হয়। এই আর কী !
- দিদি, বলছি পুঁটির বদলে আমি গেলে হবে? আসলে এই ক'টা দিনে অনেকগুলো কাজ পেয়েছে মেয়েটা। ও তাহলে নিশ্চিন্তে করুক ওগুলো পরপর।
- হ্যাঁ হ্যাঁ, তুই থাকলে তো সবচেয়ে ভালো ! তাহলে আমার আর কাউকে দরকার নেই ! কিন্তু, ঠাকুরপো তোকে ছাড়বে?
- ও আমি ম্যানেজ করে নেব ওকে, চিন্তা করো না।
- ঠিক আছে, তাহলে তিনটের সময় রেডি থাকিস। আমি ডাক দেব।
- আচ্ছা বেশ।

পুঁটি ঘুম থেকে উঠল বেলা সাড়ে দশটার সময়। ব্রেকফাস্টটা দিয়ে মা মেয়েকে বলল-
- এই যে অতি পাকা পুঁটিরানি। একটা কথা বলছি। কোনও তর্ক না করে মন দিয়ে শুনবে।
- হ্যাঁ? হ্যাঁ বলো ! (খুব অবাক হলো পুঁটি, মায়ের কথার টোনটা শুনে...)
- জ্যেঠি যদি তোকে হাবলুর বিয়ের মার্কেটিংয়ে যাবার কথা বলে, তুই বলবি তোর পর পর অনেকগুলো কাজ আছে। এখন যেতে পারবি না।
- মানে? জ্যেঠি কিছু বলেছে তোমাকে?
- অত জেনে তোর কী হবে? যা বললাম সেটা যেন মাথায় থাকে।
- হ্যাঁ, কিন্তু জ্যেঠি আমাকে আগে থেকেই বলে রেখেছিল যাবার কথা !
- এই শোন, খুব ইন্টারেস্ট নাকি রে তোর হাবলুর বিয়ের মার্কেটিং করার?
মায়ের এত অ্যাগ্রেসিভ কথার ধরণে বেশ চমকে গেছে পুঁটি। মায়ের এরকম কথার সঙ্গে ও পরিচিত নয় !
- তুমি কি রেগে আছো কোনও কারণে, মা? ও মা?
- না রেগে নেই। কিন্তু যেটা বললাম সেটাই করবি তুই।
- আচ্ছা বেশ, তাই করব। তুমি শান্ত হও এবার ! কিন্তু জ্যেঠি একা একা পারবে না মা !
- খুব চিন্তা তোর জ্যেঠিকে নিয়ে তাই না? আর আমার কথার দাম নেই?
- কী হয়েছে মা? তুমি এত ডিস্টার্বড্ কেন? (শান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করলো পুঁটি)
- কিছু হয়নি। আমি যাব তোর জেঠিমার সঙ্গে মার্কেটিংয়ে। তোকে যেতে হবে না।
- বাহ্, তাহলে তো আরও ভালো হল। এটা আগে বলতে হয় তো? ঠিক আছে, তুমিই যেও।
দুপুরে হাবলুর মা আর পুঁটির মা বেরোলো মার্কেটিংয়ে। অনেক কিছুই কেনাকাটি হলো। অর্পিতা অনেকদিন পর এইভাবে বাইরে বেরোলো, দোকান-বাজার ঘুরলো। ভালোই লাগছিলো ওর, শুধু মাঝে মাঝে মেয়েটার কথা মনে হচ্ছিল। বাড়ি ফেরার সময় জ্যেঠি পুঁটির ফেবারিট দোকান থেকে একটা ফিস কবিরাজি কিনে জোর করে দিয়ে দিল অর্পিতা'র হাতে।
দু'দিন পর, সেদিন রবিবার। হাবলু আর ওর হবু বউকে নিয়ে বেনারসি এবং আরও কিছু জিনিসপত্র কিনতে বেরোনোর কথা হাবলুর মায়ের। তাই সকাল থেকে তাড়াহুড়ো চলছে। পুঁটির মা দুটো পদ রান্না করে পুঁটির হাত দিয়ে পাঠালো ও বাড়িতে। পুঁটি বেশ ক'টা দিন পরে গেল ও বাড়ি। তাই গিয়ে জ্যেঠিকে খাবারগুলো দেওয়ার পরেই ডাক পড়ল ঠাকুমার ঘরে।
হাবলুদা'র ঠাকুমার সঙ্গে গল্প করতে পুঁটির খুব ভালো লাগে। সাথে ঠাম্মির ঘরে গেলে উপরি পাওনা হিসাবে নারকেল নাড়ু, তিলের নাড়ু, বাদাম তক্তি বা নিদেন পক্ষে লেবু লজেন্স। ছোটবেলার একটা না একটা টুকরো ঠিক জুটে যায় ! আজ ঘরে ঢুকতেই ঠাম্মি বললেন,
- দিদিভাই, তুই আজকাল এই বুড়িকে এড়িয়ে যাস বল?
- এ মা, না না ঠাম্মি, এড়াব কেন?
- এ বাড়ি আসিস, অথচ আমার খোঁজ ও নিস না। নারকেল নাড়ুগুলো পড়ে থেকে থেকে পুরোনো হয়ে যাচ্ছে... কে খাবে?
- কেন, তোমার হাবলুদাদার বিয়ে হচ্ছে। কদিন পর ওর বউই খাবে। তোমার চিন্তা কী?
- হ্যাঁ রে দিদিভাই, একটু কি হিংসে হচ্ছে? হাবলুর বিয়েটা নিয়ে তোর মন খারাপ?
- না না। এ আবার কী সব বলছো? ধুর, আমার কেন...।
- দিদিভাই, নাড়ুর কৌটো'টা নিয়ে আয় তো ! (পুঁটিকে কথা শেষ করতে না দিয়ে বলল ঠাম্মি)
- এই নাও ধর। ইশশ, ধুলো পড়েছে তো কৌটো'টাতে!
- ওই পাশের গামছার টুকরোটা দে, মুছি আগে। ওই জন্যেই তো বলছি, তুই কত্তদিন আসিসনি এই ঘরে !
- আচ্ছা বেশ, এই নাক মুলছি আর এই কান মুলছি। এবার থেকে আসবো এবাড়ি এলেই !
- মনে থাকবে তো?
- হ্যাঁ রে বুড়ি হ্যাঁ। (ঠাম্মি'র গাল দুটো টিপে দিলো পুঁটি। ঠাম্মি দুটো নাড়ু হাতে দিলো ওর)... এই যে কিপটে বুড়ি, দুটোর বেশি নাড়ু হাত দিয়ে গলে না, না?
- এই মুখপুড়ি, তুই আবার আমায় কিপটে বুড়ি বললি? ওই জন্যই দুটো দিলাম। আর দেব না, যাহ্।
- উফফ দাও তো, কৌটোটা দাও। (আগের নাড়ু দুটো মুখে পুরে দিয়ে কৌটোটা এক রকম কেড়েই নিলো পুঁটি। পটাপট আরো দুটো নাড়ু তুলে নিয়ে কৌটোর মুখ আটকে রেখে দিয়ে এল) এই নাও হাঁ করো। একটা তোমার আর একটা আমার!
- আরে আমি খাবো না, মুখে পান আছে... সর, সর!
- নিকুচি করেছে তোমার পানের। হাঁ করো, হাঁ করো।(এক রকম জোর করেই ঠাম্মি'র মুখে নারকেল নাড়ু গুঁজে দিলো পুঁটি। ছোটবেলা থেকে ঠিক এরকমটাই করে আসে ও। ঠাম্মিও মজা পান এতেই!)...
এর মধ্যে জ্যেঠি ঢুকলো ঘরে,
- এই যে পুঁটি রানি, ঠাম্মির আদর খাওয়া শেষ হলে এদিকে আসিস। তোকে হাবলুদা ডাকছে, কী দরকার আছে বলছে !
- আচ্ছা আমি আসছি। এই বুড়ি, টাটা। পরে আসবো আবার। এখন শুনে আসি হেড অফিসের ছোটবাবু কী বলেন। জ্যেঠি, বড়োবাবুর কী খবর? ওনার সঙ্গে তো দেখা সাক্ষাৎই হয় না আজকাল।
- তোর জ্যেঠু? উনি সারাদিন ব্যস্ত কোর্টের কাজ নিয়ে, সারাটা দিন। একদিন শুধু মেয়ে দেখতে গেছিলেন। তারপর কত বলে বলে আজ রাজি করিয়েছি শপিংয়ে যাবার জন্য। ছাড় তোর জ্যেঠুর কথা। সব আমার দায়।
- ওহ, আচ্ছা বেশ। আমি যাবার সময় দেখা করে যাবো একবার জ্যেঠুর সঙ্গে।

জ্যেঠির সঙ্গে কথা বলছিল পুঁটি সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে। ওপরে হাবলুদা'র ঘর। কথা শেষ করে তিন লাফে পৌঁছে গেল ওঘরে! ঘরে ঢুকতেই হাবলু গম্ভীরভাবে তাকালো পুঁটির দিকে, বলল,
- তুই যে আমার প্রি-ওয়েডিং শ্যুট করবি, সেটা আমাকে জানাসনি কেন?
- মানে? তোমার প্রি-ওয়েডিং শ্যুট কে করছে সেটা আমি তোমাকে জানাব? তুমি জানবে না? অদ্ভুত কথা বলছো ! আর আমি নিজেই সেদিন যাবার পর দেখলাম তোমার প্রি-ওয়েডিং শ্যুট করতে গেছি। তার আগে তোমার সঙ্গে তো কথা হয়নি। কথা তো হয়েছে শ্রীদর্শিনী'র সঙ্গে ! ও তোমার নামও করেনি।
- আর তুইও জানতে চাসনি?
- অভিয়াসলি না !
- মাথা মোটা একটা !
- বলছি তুমি কি এটা বলতেই ডেকেছিলে?
- হ্যাঁ?... না... বলছি প্রি-ওয়েডিং নিয়ে তো খুব নাচালি একচোট। এদিক ঘুরে ওদিক ফিরে। কী সব কায়দার ছবি। বিরক্ত করে মেরেছিস সেদিন! যাই হোক, এবার বিয়ের ফটোগুলো তোলার কী ব্যবস্থা হবে?
- সে তুমি জানো, আই মিন তোমরা জানো ! (নির্লিপ্তভাবে জবাব দিলো পুঁটি)
- তোর খুব ভাও হয়ে গেছে তো রে, হ্যাঁ?
- মানে?
- মানে আগেরদিন মায়ের সঙ্গে শপিংয়ে গেলি না, আজও মা বলেছিল কাকিমণি'কে, বলল তুই ব্যস্ত থাকবি আজ। ব্যাপার কী রে তোর? এত কাজ আসছে নাকি? কি এমন ছবি তুলিস তুই?
- তোমার এক্স্যাক্টলি কোনখানে প্রবলেম হচ্ছে বলবে একটু আমাকে? আমার না যাওয়া নিয়ে, নাকি আমার ছবি তোলা নিয়ে, নাকি আমাকে নিয়েই?
- উফফ... তুই ভীষণ ইরিটেটিং জানিস তো? কী করে মা, ঠাম্মি, বাবা এরা তোকে নিয়ে এত আদিখ্যেতা করে কে জানে !
- হ্যাঁ, এখন সুন্দরী বউয়ের পাশে আমাকে ইরিটেটিং লাগবেই তো ! ছোটবেলা থেকে দুনিয়ার অপকম্ম করার সময় আমাকেই সঙ্গে লাগতো তোমার, কদিন আগে পর্যন্ত তুমি নাইট পার্টি করবে তার জন্য আমাকে জ্যেঠুকে মানাতে হয়েছে। তোমার টাকার দরকার তখন ঠাম্মির কাছ থেকে আমার লাগবে বলে টাকা চেয়ে দিয়েছি। জ্যেঠিমার হাত থেকে তোমার সিগারেটের বাক্স, ওল্ড মঙ্কের বোতল কে বাঁচাত গো? তোমার বাকি ওই খুড়তুতো, মাসতুতো, পিসতুতো ভাই-বোনগুলো তো এক একটা জিনিস। তোমাকে কেস খাওয়াতে পারলে ওদের আনন্দের শেষ থাকে না, সেখানে আমি একমাত্র তোমার হয়ে লড়ে গেছি। আর এখন আমি ইরিটেটিং ! বেশ বেশ... তোমার বিয়ের ফটোগ্রাফার তুমি খুঁজে নিও, আমি পারব না।
- এই এই শোন, মেরে মাথা ফাটিয়ে দেব তোর। খুব সাহস তো? আমার মুখের ওপর যা পারছিস বলে যাচ্ছিস ! আমার সুন্দরী বউ তো তোর এত জ্বলুনি কীসের হচ্ছে? আগের দিন ফটো শ্যুটের সময় তো খুব ন্যাকামি করে কথা বলছিলি, গল্প করছিলি ওর সঙ্গে !
- আমার হিংসে করতে বয়ে গেছে ! হুহ...
- শোন, আমার বিয়ের ফটোগ্রাফি তুই ই করবি।
- ...
- কী হল, চুপ কেন তুই?
- ঠিক আছে, জগা আর পিন্টুকে পাঠিয়ে দেব সকাল থেকে।
- না, তুই থাকবি। সারাদিন। সকাল থেকে ! টাকা নিয়ে ভাবতে হবে না তোকে।
- সে আমি জানি, তোমাদের মতো ক্লায়েন্টদের কাছে টাকা নিয়ে সমস্যা হয় না। একটু হেসে বলল পুঁটি। আসছি গো, বিয়ের দিন দেখা হবে। বলে পেছন ফিরে চলে যেতে যাবে পুঁটি, হাবলু আবার ডাকল,
- হ্যাঁ রে পুঁটি, তোর সত্যি আজ কাজ আছে? যেতে পারবি না আমাদের সঙ্গে মার্কেটিংয়ে?
- না গো হাবলুদা, আমার সত্যিই কাজ আছে। আসি...।
আর দাঁড়ালো না পুঁটি। হাবলুর ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা বাড়িতে। দেখলো মা রান্নাঘরের কাজ সেরে স্নানে গেছে। নিজের ঘরে গুম হয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। তারপর মা বেরোতেই ও ঢুকলো স্নানে। শাওয়ার খুলে দিয়ে অনেকদিন পর বাচ্চাদের মত ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদল। অনেকক্ষণ ধরে।

এরমধ্যে একদিনই আর ও বাড়িতে গেছে পুঁটি। জ্যেঠিমা বিয়ের কেনাকাটা দেখতে ডেকেছিল আর দুপুরে ওখানেই খেতে বলেছিল। হাবলুদা এটা ওটা নিয়ে মজা করছিল, কিন্তু পুঁটির সেদিকে মন ছিল না। প্রি-ওয়েডিংয়ের অ্যালবাম'টা কমপ্লিট হয়নি, কিন্তু জ্যেঠি বারবার বলেছিল বলে কয়েকটা ছবি নিয়ে গেছিল ও দেখাতে। দেখে সবার কী আনন্দ। খুব প্রশংসাও হলো পুঁটির ছবি তোলার ! হাবলুদা'র তুতো ভাইবোন কয়েকজনও এসেছিল সেদিন। ঋদ্ধি তার মধ্যে সবচেয়ে ফিচেল। ও হঠাৎ সবার সামনে বললো- "পুঁটিদি তোমার তোলা ছবিগুলোর মধ্যে হাবলুদা'কে সেন্টার করেই তো বেশি ছবি আছে গো ! বৌদি তো সাইড হয়ে গেছে পুরো। কী ব্যাপার হ্যাঁ?"
- "আরে না না, আরও অনেক ছবি আছে। জ্যেঠি দেখতে চেয়েছিল বলে হাবলুদা'র ছবিই বেশি নিয়ে এলাম ! আফটার অল, নিজের ছেলে মেয়ের ছবিই মানুষ বেশি ভালো করে দেখতে চায়। পুরো অ্যালবামে সব ছবি পাবে।"- এই বলে কাটিয়ে তো দিল পুঁটি, কিন্তু ও ও মনে মনে জানে সেদিন ও কী কেস করেছে। সত্যিই হাবলুদার ছবিই ওর ক্যামেরাতে বেশি। ভাগ্যিস জগা আর পিন্টুকে নিয়ে গেছিল। ওরা অন্য ক্যামেরাটাতে শ্রীদর্শিনী'র প্রচুর ছবি তুলেছে, তাই সব মিলিয়ে ম্যানেজ হয়ে যাবে ফাইনাল অ্যালবামে।

বিয়ের আগের দিন, প্রায় রাত ৯টা বাজে। আনন্দ নাড়ু, শ্রী এসব বানানো শেষ হয়েছে সবে। পুঁটির মা-ও এতক্ষণ ওখানেই ছিল। বাড়ি ফেরার সময় হঠাৎ হাবলু এল সামনে।
- কাকিমণি পুঁটি কোথায় গো?
- এই তো একটু আগেই এখানে ছিল, ছবি তুলছিল সবার।
- না আমি খুঁজে এলাম সারা বাড়ি। নেই ও। ফোনেও পাচ্ছি না !
- ওহ, তাহলে বোধহয় স্টুডিওতে বেরিয়ে গেছে।
- এত রাতে?
- হ্যাঁ, বলছিল কালকের জন্যে সব আজ রাতেই গুছিয়ে নিয়ে বাড়ি চলে আসবে।
- কাকিমণি তোমরা রাতে এখানে খাবে তো?
- হ্যাঁ আমি এই বাড়ি গিয়ে তোর কাকুর সঙ্গে আসব। পুঁটির খবর জানি না। ও ক'টায় আসবে।
- পুঁটি গেল কী করে স্টুডিওতে? ফিরবে কী করে?
- আর কী করে, তোর কাকুর স্কুটিটা নিয়ে গেছে!
- ওহ আচ্ছা। আমি পুঁটিকে নিয়ে আসব তাহলে। তোমরা খেয়ে নিও।
এই বলে, হাবলু ওর মা'কে গিয়ে বললো- "মা, আমি একটু ঘুরে আসছি। একটা দরকার পড়েছে খুব। আমাকে খুঁজো না এখন।"
- বিয়ের আগের দিন, এত রাতে কোথায় যাচ্ছিস তুই? সবাই খেতে বসবে এখন?
- আঃ, বললাম তো আসছি। চিন্তা করো না।

বাড়ি থেকে বেরোতেই একটা রিক্সা পেয়ে গেল হাবলু। যখন স্টুডিওতে পৌঁছালো, পুঁটি তখন সব গুছিয়ে নিয়ে বেরোচ্ছে, হাবলুকে দেখে অবাক হলো,
- হাবলুদা, তুমি?
- তোর সব গোছানো হয়েছে?
- হ্যাঁ।
- স্কুটির চাবিটা দে, তুই পিছনে বোস।
- কেন? কিছু...।
- যা বললাম কর চুপচাপ।
এমন কিছু ছিল হাবলুর কথার মধ্যে, পুঁটি আর কথা না বাড়িয়ে বসে পড়ল স্কুটির পিছনে।
- কোথায় যাচ্ছিস হাবলুদা?
- চুপচাপ চল। বড় একটা সমস্যা হয়েছে। তোর সঙ্গে কথা আছে।

প্রায় কুড়ি মিনিট পর গঙ্গার ধারে পৌঁছালো দুজনে। পুঁটি একটা কথাও বলেনি আর এর মধ্যে। হাবলুদা'র গলার আওয়াজেই বুঝতে পেরেছিল সিরিয়াস কিছু একটা ! গঙ্গার এই পাড়ে একটা চায়ের দোকান আছে। দু কাপ চা নিল হাবলু, পুঁটিকে নীচু স্বরে জিজ্ঞাসা করলো- "বিড়ি আছে তোর কাছে?" জিন্সের পকেট হাতড়ে পুঁটি জানালো আছে। তারপর গঙ্গার ঘাটে গিয়ে বসল দু'জনে।
- বলো কী সমস্যা হলো তোমার আবার !
- বিয়েটা কাল না-ও হতে পারে পুঁটি!
- মানে?
- হ্যাঁ রে। একটা সমস্যা হয়েছে।
- উফফ্, সমস্যা সমস্যা...। কী সমস্যা বলবে তো?
- শ্রীয়ের বয়ফ্রেন্ড আছে, সেটা আগে বলেনি।
- ওহ...
- ওহ মানে?
- মানে বিয়ের আগে অনেক সুন্দরী মেয়েদেরই থাকে, তারপর বিয়ে করে অন্য কাউকে, তারপর সব ভুলে যায়। তুমি তো আবার স্টেটস্-এ যাচ্ছ। তোমার ডিমান্ড তো এরকম মেয়েদের কাছে সবচেয়ে বেশি ! আর তুমি কী এক্সপেক্ট করো যে এত সুন্দরী, শিক্ষিতা মেয়ে, সে ভার্জিন হবে? তুমি নিজে ভার্জিন?
- পুঁটি !
- কী হয়েছে?
- ফালতু কথা রাখ ! শোন, শ্রীয়ের বয়ফ্রেন্ড কাল থেকে আমাকে মেসেজ পাঠাচ্ছে, আমি এড়িয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু আজ দুপুরবেলা কিছু ছবি পাঠিয়েছে প্লাস শ্রী কিছু ভয়েস রেকর্ডিং পাঠিয়েছে। কাল বিয়ে করতে গিয়ে লাভ নেই রে। আমি গেলে ওরা পালাবে কাল !
- মানে? ইয়ার্কি নাকি এটা? এতদিন বলেনি কেন? কী বলেছে ভয়েস রেকর্ডিংয়ে? আমাকে শোনাও তো একটু !
- শোনাচ্ছি, আগে বিড়ি বের কর।
- ...এই নে ধর। আর দে, তোর ফোনটা আমাকে দে তো ! শুনি কী হয়েছে। আমার হয়েছে যতো জ্বালা !
প্রায় ছ-সাত'টা ভয়েস রেকর্ডিং। অনেক সরি বলে ক্ষমা চেয়ে মূল যেটা বক্তব্য সেটা হচ্ছে, শ্রীদর্শিনীর বাড়ি থেকে চাপ ছিল খুব যে এন.আর.আই পাত্রের সঙ্গেই বিয়ে দেবে। তাতে ওর ভবিষ্যৎ সিকিওর হবে প্লাস শ্রীদের ফ্যামিলি স্টেটাস বাড়বে। ওর বয়ফ্রেন্ড যেহেতু একটা পাবলিক সেক্টর ব্যাঙ্কে চাকরি করে, মাইনে ভালো পেলেও বিদেশ যাওয়ার কোনও সুযোগ নেই তার। তাই শ্রীয়ের মা আর দিদির ছেলেটাকে পছন্দ নয়। এদিকে হাবলুর সম্বন্ধটা ওদের কাছে সোনার চাঁদ পাওয়ার মতো। ওরা এই সুযোগ আর ছাড়তে চায়নি। শ্রীয়ের বাবার কথা ওনারা পাত্তাই দেন না। তাই বাবাকে বুঝিয়েও কোনও লাভ হয়নি শ্রীয়ের। কিন্তু ওর ফাইনালি মনে হচ্ছে ও পারবে না হাবুলকে বিয়ে করতে। শরীর মন কিছুই দিতে পারবে না ওকে। তাই হাবুল যেন যে কোনোভাবে বিয়ে করতে যাওয়াটা আটকায়। নাহলে শ্রীকে পালাতে হবে বিয়ের দিন।

- শুনলি তো সব ! এবার আমি কী করি বল?
 চুপ করে বসে রইল পুঁটি অন্ধকার গঙ্গার দিকে তাকিয়ে। হাবলুও... বেশ কিছুক্ষণ পর হঠাৎ পুঁটির কাঁধে মাথা রাখল হাবলু, ফুঁপিয়ে উঠল বাচ্চাদের মতো।
 - আমি কী করবো পুঁটি? সবাইকে কী বলবো? এই জন্য বলেছিলাম এত তাড়াহুড়ো করো না বিয়ের জন্য। বাবা শুনলেই না আমার কথা। একজনকে ঠিক মতো চেনার আগেই সারা জীবনের মত জুড়ে যাওয়া। অদ্ভুত নিয়ম আমাদের !
- আচ্ছা চুপ, চুপ ! কাঁদিস না হাবলুদা, প্লিজ। তোকে কাঁদতে দেখলে আমার কান্না পেয়ে যায় তুই জানিস না? ছোটবেলায় তোর ব্যাথা লাগতো, তুই কাঁদতিস, তোকে দেখে আমি কাঁদতাম! তোর ফার্স্ট লাভ রিক্তা যখন তোকে ডিচ করে, মনে আছে স্কুল ফেরত বড় মাঠে গিয়ে রোজ কাঁদতিস তুই? আর আমি তোর পাশে বসে বসে চোখ মুছতাম, তারপর সন্ধে হলে তোকে জোর করে টেনে তুলে নিয়ে বাড়ি ফিরতাম।
 - সব মনে আছে রে, কিচ্ছু ভুলিনি আমি। কিন্তু এখন...।
 - বাড়ি চল হাবলুদা।- উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল পুঁটি।
 - কিন্তু কাল।
 - বাড়ি চলো, জ্যেঠু-জ্যেঠির সঙ্গে কথা বলতে হবে এক্ষুনি।
 - আমি...।
 - আমি থাকব তোমার সঙ্গে ! কিন্তু সত্যিটা বলতেই হবে সবাইকে। দরকার নেই বিয়ে করার, এমনিতেও এই বিয়েটা হবে না, ফালতু সবাইকে বিব্রত করে লাভ নেই। তারচেয়ে জ্যেঠুকে জানাও এক্ষুনি সব, দেখা যাক কী হয়।
 - পুঁটি, তুই থাকবি তো?
 - হ্যাঁ রে বাবা, হাঁদারাম, আছি আমি। চল। আর কান্নাকাটি করেছ, এখন তোমাকে আর স্কুটি চালাতে দেব না আমি। আমি চালাচ্ছি।
 - বেশ, চল।
দু'জন যখন বাড়ি ফিরল। রাত তখন সাড়ে এগারোটা। পুঁটির বাবা-মা'ও অপেক্ষা করছে হাবলুদের বাড়িতেই। আত্মীয়রা যে যার শুতে চলে গেছে তাদের জন্য ঠিক করে রাখা পাশের ফ্ল্যাটটাতে। আর কিছুজন হাবলুদের বাড়ির উপর তলায়। দু'জনে ঢুকে ওদের বসার ঘরে এসে দাঁড়াল। জ্যেঠু তাকালো হাবলুর দিকে, থমথমে পরিবেশ। পুঁটি ওর হাবলুদাকে বাঁচাতে মুখ খুলেছে জাস্ট।
- জ্যেঠু, একটা বড় সমস্যা হয়ে গেছে। একটু শান্ত হয়ে বসো সবাই, বলছি।
- সমস্যাটা কার? তোর না হাবলুর।
- হাবলুদা'র।
- হাবলুর কি মুখ নেই? ও বলতে পারছে না কি হয়েছে? বিয়ের আগের দিন রাতে কীসের প্রবলেম? নাটক হচ্ছে?
- বাবা, আমি এই বিয়েটা করতে পারব না।
- মানে?
- আমি পুঁটিকে বিয়ে করতে চাই!
- হোয়াট ! ঘরের প্রত্যেকে প্রায় এক সঙ্গে বলে উঠল, পুঁটি শুদ্ধু !
- ক-কি ব-অ-লছিস হা-আ-বলু দা... ফিসফিস করে বললো পুঁটি।
- হ্যাঁ বাবা, আমি বিয়ে করলে পুঁটিকেই করব।

সবাই তাকালো পুঁটির দিকে। পুঁটির মুখ হাঁ হয়ে গেছে। মারাত্মক অবাক হয়ে গেছে ও !
- এসব কী উল্টোপাল্টা বলছিস হাবলু? জ্যেঠি বলে উঠলো !

- তা বিয়ের আগের দিন রাতে এমন অদ্ভুত একটা ডিসিশন নেবার কারণটা জানতে পারি?- খুব ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞাসা করলেন হাবলুর বাবা, পুঁটির জ্যেঠু।
- হ্যাঁ বাবা, সবটা বলছি।
- বলছি কী দাদাভাই, সব বল। কিন্তু একটু বসো দুজনে আগে ! দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসব কথা হয় না। আর এই নাও, দুটো করে নাড়ু খাও দুজনে আগে। ধরো, ধরো !
কেউ খেয়াল করেনি, ঠাম্মি কখন এসে দরজার বাইরে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। হাবলুর বাবা একটু বিরক্ত হয়ে বললেন- "তুমি আবার এখানে এলে কেন মা? ফালতু ঝামেলা সব। তোমার ঘুমিয়ে পড়া উচিত। কাল অনেক কাজ আছে।"
- "হ্যাঁ, হ্যাঁ, অনেক কাজ আছে ওসব বৌমারা করবে, তোরা করবি, আমার কী? আমাকে এখানে বেশি দরকার আজ। দাদুভাই, বলো তো কী হয়েছে ! আমিও শুনি সবটা !"
- আমি সবটা বলব, কিন্তু সবার আগে ক'টা ভয়েস রেকর্ডিং শোনাব। সেগুলো শোনানোর পর যা বলার বলব।
- আচ্ছা বেশ, তাই বল তুই। এতক্ষণে মুখ খুললেন পুঁটির বাবা।
পুঁটির তো সারা শরীর, মুখ ঘামে ভিজে জবজব করছে। "ইশ, হাবলুদাকে কী বলতে বললাম, আর কি বলছে এসব? বাবা-মা না জানি কী ভাবছে? আর জ্যেঠি তো কেমন রাগী রাগী মুখ করে তাকাচ্ছে আমার দিকে? জ্যেঠু কেমন করে কথা বললো। উফফ্ আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে এখন!"- ভাবল পুঁটি।
এদিকে হাবলু এক এক করে সব রেকর্ডিংগুলো শোনালো সবাইকে। তারপর বলল- "গতকাল বিকেল থেকে ছেলেটা আমাকে মেসেজ করেছে। আমি এড়িয়ে গেছি, পাত্তা দিইনি। কিন্তু আজ বেলার দিকে, যখন স্নান করতে যাব, তখন শ্রী এই ভয়েস মেসেজগুলো করেছে। আমি যে কী বিষ মনে নিয়ে আইবুড়োভাত খেয়েছি আজ, সে আমিই জানি ! শেষে সন্ধ্যেবেলা শ্রীয়ের লাস্ট ভয়েস মেসেজটা পেয়ে আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি। কাউকে বলার খুব দরকার ছিল। তাই অনুষ্ঠান সব শেষ হতেই আমি পুঁটির খোঁজ করি। কারণ প্রতিবার আমার যে কোনও বিপদে এই মেয়েটাই আমাকে ঠিক পরামর্শ দিয়ে এসেছে। আর ওর কথা শুনে আমার আজ পর্যন্ত কোনও ক্ষতি হয়নি। আজও ওকে নিয়ে গঙ্গার ঘাটে গিয়ে বসেছিলাম। সব শুনে ও-ই বলল বাড়ি এসে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমাদের ঘটনাটা জানাতে। বলল, বাবা, কাকুমণি, ঠাম্মি... এরা ঠিক কিছু একটা ডিসিশন নেবে। এ-ও বলল যে শ্রীয়ের কথা ভেবে আমার লাভ নেই, কারণ এরকম করার আগে শ্রী তো একবারও আমার কথা, আমাদের কথা ভাবেনি ! তাই পারলে তোমরা কাল ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিও।"- এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলো হাবলু। ঘরে পিন পড়লেও শব্দ শোনা যাবে, এমনই নিঃস্তব্ধতা। মাথা নীচু করে বসে আছে সবাই। হঠাৎ ফোঁস ফোঁস আওয়াজে সবার সম্বিৎ ফিরল। দেখলো হাবলুর মা রত্না দেবী কাঁদতে শুরু করেছেন। খুব আস্তে আস্তে বললেন উনি- "আমার ছেলের সঙ্গেই এমনটা হতে হলো?"
- আমি তো তখনই বলেছিলাম মা, যে বাবাকে বোঝাও, এত তাড়াহুড়ো করে আজকালকার দিনে বিয়ে দেওয়া উচিত না। তোমরা কানেই তুললে না আমার কথা! এখন কেঁদে কি হবে?
- সে সব তো বুঝলাম... কিন্তু আজকালকার ছেলেমেয়েরা নিজেদের ছাড়া কারও কথা ভাবে না নাকি? এত স্বার্থপর এরা? ছিঃ ছিঃ। বলে উঠলেন হাবলুর বাবা !
- বাবা, সবাই কিন্তু এক রকম নয়।
- চুপ কর তুমি রাস্কেল ! আমাদের এখন কী করণীয়? মা তুমি কী বল? সন্দীপ তুই কিছু পরামর্শ দে। ঠাম্মি আর পুঁটির বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললেন জ্যেঠু।
- আমি কী বলি বলো তো বিজয়দা? এ এক অদ্ভুত সমস্যা। তবে হ্যাঁ, মেয়ের বাড়িকে সব জানিয়ে কাল বিয়েটা আগে ক্যানসেল করতে হবে। জোর করে বিয়ে দিলে, এ যা মেয়ে দেখছি, হাবলুকে আবার 498 এ না ফাঁসিয়ে দেয় কোনও দিন।
- কিন্তু এত আয়োজন করলাম আমরা। আত্মীয়-স্বজনে বাড়ি ভর্তি। কী বলব সবাইকে? আর ক'ঘন্টা পরেই তো উঠে জল সইতে যাবার কথা? রত্না দেবী বলে উঠলেন।
- মা, আমি বলেছি এই বিয়েটা করতে পারব না। বিয়ে হবেই না একেবারে, সেটা বললাম কি?
- ম-মানে... তুই... পুঁটি?
- হ্যাঁ, পুঁটিকে বিয়ে করতে চাই আমি।
- এসব কী হচ্ছে হাবলু? হঠাৎ করে এরকম হয় নাকি? একটা মেয়ে অন্যায়ভাবে তোমাকে রিজেক্ট করল বলে হাতের সামনে আমার মেয়েটাকে পেয়ে ওকে বিয়ে করতে চাইছ এখন? এ কি ছেলেখেলা নাকি? ও রাজি কিনা জিজ্ঞাসা করেছ একবারও? নাকি ওর মত নেবার প্রয়োজন নেই কারও? ও কি তোমাদের খেলার পুতুল?- একটু রেগেই এবার বলে উঠলেন পুঁটির মা।
- কাকিমণি, তুমি শান্ত হও। রেগে গেলে,মাথা গরম করলে চলবে না আমাদের। দেখছো তো, আমাদের এত আত্মীয়-স্বজন রয়েছে। তবু এসব আলোচনা আমরা শুধু তোমাদের সামনেই নির্দ্বিধায় করতে পারি। কারণ তোমরা বরাবরই আমাদের আত্মীয়র চেয়ে অনেক বেশি। আমি আর পুঁটি ছোটোবেলা থেকে একসঙ্গে বড় হয়েছি। একটা সময় পর্যন্ত আমি ভাবিইনি যে অন্যকোনও মেয়ের কথা আমি ভাববো। বা কারও সাথে প্রেম করব। যখন ভাবলাম, প্রেমে পড়লাম। যথারীতি ল্যাংও খেলাম ক'মাস পর তার কাছে। এই পুঁটিই তখন আমাকে বাঁচিয়েছিলো ডিপ্রেশনে যাবার হাত থেকে। এর পর সব কিছুতে, সে আমার পার্টি করে রাত করে বাড়ি ফেরার পারমিশন হোক বা ঠাম্মির কাছ থেকে আমার জন্য টাকা চাওয়া। এই মেয়েটা নির্দ্বিধায় সব ঝামেলা নিজের ঘাড়ে নিয়েছে। আরও অনেক ঘটনা আছে আমার জীবনে, যা পুঁটি ছাড়া আর কেউ জানে না। জানবেও না। আজও এই ঘটনাটা ঘটার সময় শুধু পুঁটির নামটাই আমার মনে এসেছিল সবার আগে। অথচ কী অদ্ভুতভাবে বাড়িতে আমার বারো-তেরোটা ভাই-বোন রয়েছে আজ ! পুঁটি ছাড়া আমার লাইফের অনেক ডিসিশনই ভুল হয়ে যেত। আজও গঙ্গার ধারে ওর কাঁধে মাথা দিয়েই আমি কেঁদেছি অনেক্ষণ। এই কান্নাটা আমি মায়ের কাছে কেন কাঁদতে পারলাম না? বা অন্য কারও কাছে? এমনকি ঠাম্মির কাছেও পারিনি। ওর কাছে পারলাম, অকাতরে !
তাই বাড়ি ফেরার সময় পুঁটি যখন স্কুটিটা চালিয়ে আমাকে নিয়ে ফিরছে তখন মনে হচ্ছিল এইভাবে ওর পেছনে বসে, হেঁটে, দৌড়ে যদি আমি বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিই। তাতে কার কী ক্ষতি হবে? জানি ব্যাপারটা বুঝতে অনেক লেট হয়ে গেছে। অনেক অনেক লেট। বাবা, তোমার, ঠাম্মির, মায়ের, কাকু-কাকিমণির সামনে দাঁড়িয়ে আমি এইভাবে কথা বলব কোনোদিন ভাবিনি। এটা হয়তো আমার ধৃষ্টতা। তবু, আমার বিয়ের কার্ড দেখে পুঁটির রিয়্যাকশন, কারও সঙ্গে ডেটে যাচ্ছে কিনা জিজ্ঞাসা করাতে ওর রেগে যাওয়া, আমার প্রি-ওয়েডিংয়ের ফটো শ্যুট করাতে ওর নিজের প্রিয় জায়গাগুলোতে নিয়ে যাওয়া, শ্রী'কে ওর মনের মতো করে সাজানো, ময়দানে শ্রী'কে আমার কাঁধে মাথা রাখতে দেখে ওর দৌড়ে পালিয়ে যাওয়া, আমার বিয়ের মার্কেটিংয়ে ওর বদলে কাকিমণির যাওয়া, প্রি-ওয়েডিংয়ের ছবিগুলোর মধ্যে গন্ডা'খানেক আমার সোলো ছবি তোলা। আমি সব লক্ষ্য করেছি, সব। সবশেষে আজ আমার আনন্দনাড়ু তৈরির ছবি তুলতে তুলতে ওর ছল ছল চোখ। আমি কিচ্ছু মিস করিনি। এটা বোধহয় লাইফ আমাকে একটা চান্স দিল, একটা বড় ভুল হওয়া থেকে আটকে গেল। আমি জানি পুঁটি আমার কাছে থাকলে ভালো থাকবে। ও আজ পর্যন্ত কারও প্রেমে পড়েনি কেন জানো কাকিমণি? ও আমাকে সেই ছোটবেলা থেকেই ভালোবাসে। কী রে পুঁটি, ঠিক বললাম তো সব?"

পুঁটি তখন মাথা গোঁজ করে দাঁড়িয়ে বাঁ হাতের নখ খেয়ে যাচ্ছে প্রবলভাবে। সবকিছু ওর মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ জ্যেঠু কথা বলে উঠল-
- মা তুমি কিছু বলবে?
- তুই আমার মত চাইছিস বিজয়?
- হ্যাঁ মা, তোমার মতই চাইছি সবার আগে। আজ আগে তুমি বল, তারপর আমরা সবাই নিজের নিজের মত দেব।
- দেখ বিজু, আমার মত যদি বলিস... তো আমার নারকেল নাড়ুর ভাগ অন্য মেয়েকে দিতে হবে, এটা ভেবে ক'দিন ধরেই আমার মন খারাপ, বাতের ব্যথাটাও বেড়েছে ওই জন্য। এখন মানে মানে নাড়ুর অধিকারিণী পুরো শিশির ওপর নিজের অধিকারটা বজায় রাখলে আমি একটু শরীরে মনে শান্তি পাই।
- উফফ মা, সোজাভাবে কথা বলতে পারো না? সব সময় হেঁয়ালি তোমার!
- হেঁ হেঁ... বুড়ো বয়েসে এই রঙ্গ তামাশা করেই তো জীবনটা কাটবে রে ! তুই ও তো বুড়ো হবি খুব শিগগির, বুঝবি তখন।
- ধুর, ছাড়ো... রত্না, তুমি কিছু বলবে?
- দেখো, হাবলু যাতে ভালো থাকবে, শান্তিতে থাকবে, আমার তাতেই সায় আছে। আমরা ওর জীবনটা সাজাতে গিয়ে বড়-সড়ো গন্ডগোল হয়ে গেল একটা। এবার ও যা ভালো বুঝবে, তাই করুক। বাধা দিও না। আর পুঁটিকে আমিও ভালোবাসি খুব। বরাবরই।
- বেশ, বোঝা গেল যে বাড়ির মহিলা মহলের কোনও সমস্যা নেই এতে। সন্দীপ তুই কিছু বলবি?
- আমি? মানে আমরা তো ঠিক এরকম কোনও ঘটনার জন্য তৈরি ছিলাম না বিজয়দা। আমি অর্পিতা'র সঙ্গে, মানে পুঁটির মা'র সঙ্গে আলোচনা না করে কী করে বলি দুম করে কিছু?
- হ্যাঁ, তো এখানেই আলোচনা কর না ! কে বারণ করেছে তোদের? বৌমা, বল কী বলবে? আচ্ছা তোমাদের একটু একা ছেড়ে দেব?
- না দাদা, ওসব আলোচনা পরে হবে। আমি একটু আগেও বলেছি, এখনও বলছি। বিয়েটা হাবলু করতে চাইছে, ওর মতটা জানা হয়েছে। কিন্তু যাকে বিয়ে করতে চাইছে তার মতটা একবার জানবেন না আপনারা? আমার মেয়েটা ছোটবেলা থেকে মারাত্মক স্বাবলম্বী আর স্বাধীনচেতা। ও চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে কারণ ও বড়দের সম্মান দিতে জানে। কিন্তু তাই বলে ওর কথা না শুনে কেউ কিছু চাপিয়ে দিলে ও বিগড়ে যাবে। তাই আগে ওকে জিজ্ঞাসা করুন দাদা, তারপর আমরা আলোচনা করবো।
- বেশ। তবে তাই হোক। পুঁটি, তোর কি মত? যা ভাবছিস খুলে বল, কোনও দ্বিধা করার কিছু নেই। একটুও যদি কিন্তু থাকে, তবে এ বিয়েতে রাজি হবি না তুই। এটা আমি বললাম তোকে। কিন্তু মনের মধ্যে যা ডাউট আছে, ক্লিয়ার করে নে।
- আমি না ঠিক বুঝতে পারছি না জ্যেঠু, আমার কী বলা উচিত, কী করা উচিত...।
- এই পুঁটি, সারাদিন তো আগে আমার ঘাড়ে চড়ে নৃত্য করতিস। মারতিস আর বলতিস দেখি কে তোমাকে বাঁচায় ! অন্য কাউকে বিয়ে করলে এসব অধিকার তার হয়ে যাবে কিন্তু। তুই চাস সেটা বল?
- আঃ, হাবলু, কী হচ্ছে এসব বাচ্চাদের মতো কথা? ওকে বলতে দে না ওর কথাগুলো? হাবলুকে ধমক দিলেন বিজয়বাবু।
- আমি এই বিয়েটা করলে আমার স্টুডিওটা বন্ধ করে দিতে হবে জ্যেঠু। সবে সবে কাজ আসা শুরু হয়েছিল, বাবা অনেকগুলো টাকা এতে ইনভেস্ট করে ফেলেছে। সেই সব টাকা জলে যাবে। এটা আমি মেনে নিতে পারব না।
- হুম এটা একটা প্র্যাকটিক্যাল সমস্যা বটে ! হাবলুকে বিয়ে করলে তোকে হাবলুর সঙ্গে বাইরে চলে যেতে হবে। সেক্ষেত্রে ব্যবসাটা বন্ধ করতেই হবে ! এটার কী উপায় করা যায় কেউ বল ! জ্যেঠু বললেন।
- দেখ পুঁটি, হাবলুর কথা শুনে আর তোর মুখের হাব-ভাব দেখে আমি যা বোঝার বুঝে গেছি। তোর যদি বর হিসেবে বা লাইফ পার্টনার হিসেবে হাবলুকে মেনে নিতে অসুবিধা না থাকে তাহলে তোর স্টুডিওর ব্যবস্থা আমি করে নেব। ওটা বিক্রি করলেও আমার পয়সা উঠে আসবে। ওটা তোকে ভাবতে হবে না। কী বলো পুঁটির মা?
- কিন্তু বাবা, তোমার অতগুলো টাকা, আমার এতদিনের পরিশ্রম, আমার স্বপ্ন...।
- কাকুমণি এখানে আমি একটা কথা বলি। এই শোন পুঁটি, বিদেশে গিয়ে তুই স্ট্রিট ফটোগ্রাফি করার চান্স আরও বেশি পাবি, সেই ব্যবস্থা আমি করে দেব। এর উপর স্পেশালাইজড কোর্স হয়। তোকে সেখানে ভর্তিও করে দেব। তোর কেরিয়ারের স্কোপ অনেক বেড়ে যাবে। এটা কোনও সমস্যাই নয়। আর বাবা-মা, বউভাতের দিন রাতে বর তো বউকে একটা কিছু গিফট দেয়? আমি যদি পুঁটির জন্য একটু অন্যরকম গিফট কিনি তোমরা কি আপত্তি করবে?
- মানে? জিজ্ঞাসা করলেন বিজয় বাবু।
- মানে আমি জানি যে, পুঁটি গত দেড় বছর ধরে একটু একটু করে টাকা জমাচ্ছে ওর পছন্দের একটা প্রফেশন্যাল ক্যামেরার মডেল কিনবে বলে। সেটাই যদি আমি ওকে বৌভাতে গিফট করি? পুঁটি, তোকে জাস্ট এটুকুই বোঝাতে চাইছি যে, তোর কাজটা, স্বপ্নটা বিয়ের পর শেষ হবে না। নতুন করে যাতে শুরু হয়, আমি সেই ব্যবস্থা করে দেব শুধু। কি রে, এবার তো রাজি হয়ে যা?
- পুঁটি, অমত আছে এখনও? বল তাহলে ! বললেন পুঁটির মা।... কি রে চুপ করে রইলি কেন? বল?
- মা, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না কি বলবো...।
- বেশ, আমি বুঝে গেছি। শোন হাবলু, একজন তোর প্রি-ওয়েডিং-এর ফটো শ্যুট করে এসে প্রচন্ড ডিপ্রেসড হয়ে ডায়েরি লিখেছিল। কী লিখেছিল সেই ডিটেইলস-এ আর যাচ্ছি না। শুধু লাস্ট দুটো লাইন ছিল-
"তোমার গল্পে রাজকন্যা, রাজত্ব অর্ধেক,
আমার মত শাকচুন্নীর বট গাছেতে ঠেক!"
এই অবধি শুনেই ঘরের সবাই হেসে ফেললো। পুঁটির মা অর্পিতা দেবী আবার বলে চললেন,
- এটা পড়েই আমি পুঁটির মনের কথা সবটা বুঝে যাই। মেয়ে আমার ভীষণ সেন্সিটিভ, আর মুখচোরা। প্লাস নিজের চেহারা নিয়ে ওর অদ্ভুত একটা হীনমন্যতা আছে বরাবর, নাকি কনফিডেন্সের অভাব কে জানে! সে যাই হোক, এই জন্যেই আমিই ওকে তোর বিয়ের কেনাকাটা করতে যেতে দিই নি, মিথ্যে মিথ্যে আরো কষ্ট পেতে দিতে চাইনি মেয়েটাকে। তবে আজকে তুই নিজে যখন প্রপোজ করছিস হাবলু, তখন আমরা মা-বাবা হয়ে মত না দিলে বোধহয় বেচারীকে ওর জীবনের সবচেয়ে বড় কষ্টটা দেওয়া হবে। তাই আমি তো রাজি ! শুধু ওর স্বপ্নটা যেন নষ্ট করে দিস না বাবা!
- ব্যাস, হোম মিনিস্টার যখন রাজি, আমার আর আপত্তি নেই দাদা।
- কিন্তু একটা সমস্যা আছে। বলে উঠল হাবলু !
সবাই চমকে তাকালো।
"আবার কী সমস্যা তোমার?"- জিজ্ঞাসা করলেন হাবলুর বাবা।
- না, বলছি যে বিয়ের ফটো তোলার দায়িত্ব তো পুঁটির ছিল, এডভান্সও করে দিয়েছিলাম কিছু টাকা। এবার ছবির কি হবে?
- উফফ, হাবলু, এর মধ্যেও তোর মজা করতে হবে? তুলতে হবে না ছবি, থাক। ছবি ছাড়াই বিয়ে হবে তোদের ! বললেন হাবলুর মা রত্না দেবী।
- আরে মা, রাগ করো না। হ্যাঁ রে পুঁটি, জগা আর পিন্টু মিলে সামলে দিতে পারবে না? দেখাই যাক কেমন ট্রেনিং দিয়েছিস ওদের। এই ছবিগুলো ভালো হলে ওরাই তোর স্টুডিও চালাবে, স্টুডিও বন্ধ করার দরকারই নেই!
- হ্যাঁ পারবে ওরা। স্টুডিওর সব কাজ ওরা পারবে করতে ! এটা দারুণ আইডিয়া দিলে হাবলুদা ! এতক্ষণে হাসি হাসি মুখে মাথা তুলে তাকালো পুঁটি।
- এই তো, হয়ে গেছে। ব্যাস, মিঞা-বিবি রাজি তো ক্যা করেগা কাজি? হাহাহা করে হেসে উঠলো ঠাম্মি, বাচ্চাদের মতো হাততালি দিয়ে।
- তাহলে সন্দীপ তোদের তো কোনও প্রিপারেশন নেই, কী হবে?- জিজ্ঞাসা করলেন বিজয় বাবু।
- কী আর হবে। বৌভাতের বেনারসি পরে বিয়েটা হবে। আর পরের দিন আমি অর্পিতাকে নিয়ে গিয়ে বৌভাতের সব জিনিসপত্র কিনে নেব। ওসব তোমাদের ভাবতে হবে না, তোমরা দুজন মিলে ঠাকুরপোদের বাড়ির দিকের অন্ততঃ খুব নিকট আত্মীয়দের যাতে কয়েকজনকে আনা যায় কাল, সেই ব্যবস্থা করো। আর এখন রাত দেড়'টা বাজল। সবাই একটু রেস্ট নিয়ে নাও। কাল মেয়ের বাড়িতে সকালেই ফোন করে সব কথা জানাবে, গায়ে হলুদের আগেই।- রত্না দেবী বললেন।
- জ্যেঠি, ও জ্যেঠি...।
- তোর আবার কী চাই এখন পাগলি?
- খুব খিদে পেয়েছে ! সেই সন্ধ্যেবেলা চারটে নাড়ু দিয়েছিলে, আর এক কাপ চা খেয়েছিলাম গঙ্গার ধারে বসে। সে তো পেটে ফসিল হয়ে গেছে ! পুঁটি বলল।
- এ মা, সত্যি তো! ছেলেমেয়ে দুটো তো রাতের খাবারই খায়নি! ইশশ, দাঁড়া দাঁড়া আমি খাবার আনছি।- বলে রত্না দেবী দৌড়ে গিয়ে দুটো থালায় খাবার নিয়ে এলেন। একটা থালা পুঁটির মায়ের হাতে দিয়ে বললেন- "নে, মেয়েকে খাইয়ে দে, এটাই ওর আইবুড়োভাত !" আর আরেকটা থালা থেকে ভাত মেখে খাইয়ে দিতে লাগলেন নিজের ছেলেকে।
- দেখো বৌমা, যুগ কেমন পাল্টাচ্ছে ! আমাদের সময় মেয়েদের লগ্নভ্রষ্টা হবার হাত থেকে ছেলেরা বাঁচাতো, আর তোমার ছেলেকে লগ্নভ্রষ্ট হবার হাত থেকে বাঁচাল এই দস্যিটা!
- উফফ মা, তুমি শুতে যাও এবার !... বলে উঠলেন বিজয় বাবু।
- মা, আপনি কথাটা খারাপ বলেননি কিন্তু! মেয়েরা সব পারে, সত্যিই সব পারে। হাসি হাসি মুখে বলে উঠলেন হাবলুর মা।

তারপর আর কি? পরের দিন মেয়ের বাড়িতে জানানো হল। ওদের তরফ থেকে অনেক অনুনয়-বিনয়, হুমকি সব এল। কিন্তু ছেলের বাড়ি বিয়ে ভেঙেই দিল।
এদিকে সকাল হতেই ঠাম্মি চলে গেছে পুঁটিদের বাড়ি। নিয়ম-কানুনগুলো বলে দেবার মতও কেউ তো চাই ওদিকে নাকি? বিজয়বাবু সন্দীপবাবুকে নিয়ে ছুটলেন পুরোহিত ধরতে, জগা আর পিন্টুকে সক্কাল সক্কাল ডেকে পাঠালো পুঁটি। বললো সব খুলে। ওরা তো হেসেই অস্থির। শেষে পুঁটির ধমক খেয়ে থামলো। ফর্দ মিলিয়ে বাজার থেকে শুরু করে যাবতীয় কাজের জন্য পিন্টু রইল। আর জগা একা হাতে সামাল দিতে লাগল ছবি তোলার কাজ। বেলায় গিয়ে যদিও পিন্টুও যোগ দিল ওর সঙ্গে। আর বিয়ে? সে এক মহা তামাশা করে হল। লোকজন যে শুনছে হতবাক হয়ে যাচ্ছে। আর বর-কনে? কনে লুকিয়ে সকাল থেকে গোটা দশেক লুচি, সঙ্গে তরকারি, মিষ্টি, দই, ফল, শরবত সব খেয়ে উপোস করে বিয়ে করতে বসেছে। বর লুকিয়ে মেসেজ করেছিল কনেকে গায়ে হলুদের পর।
- কী রে পুঁটিরানি, পিঁয়াজি কালারের বেনারসি পরতে হবে বিকেলে ! তুই বলেছিলি না তোকে ওই কালারটা মানায় না? আজ দেখবি মানায় কিনা !
- ইশশ, হাবলুদা, এমনিতেই চাপে আছি। ড্রেস মেকআপ নিয়ে খোঁটা দিও না আর ! আজ বুঝলাম, বিয়ে করার চেয়ে বিয়ের ফটো তোলার কাজটা অনেক সহজ !
-  তুই এখনও আমাকে হাবলুদা বলবি?
-  নয়তো কী বলবো? আরে সবকিছুর জন্য একটা মেন্টাল প্রিপারেশন চাই তো নাকি? টাইম দাও একটু?
-  বেশ, ফুলশয্যার রাত অবধি টাইম দিলাম।
-  ইশশ, তোমার সঙ্গে ফুলশয্যা ! ধ্যাৎ, আমার ভাবতেই হাসি পাচ্ছে। পরে কথা হবে।
বিয়ের মণ্ডপে, শুভদৃষ্টির সময় পুঁটির দিকে হাঁ করে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিল হাবলু। ভাবছিল- "পুঁটি... প্রিয়ম্বদা...। এই মেয়েটা এত সুন্দর? আগে কেন ওর দিকে তাকিয়ে দেখিনি এইভাবে? এই দস্যিটার প্রেমে বারবার পড়া যায়!"
পাশ থেকে বন্ধুরা বলে উঠলো- "ওরে হাবলু, এবার চোখ নামা ! সব দেখা কি এখনই দেখে নিবি?" লজ্জা পেল হাবলু।
বাসরে খুব একচোট মজা হল। হাবলুর ভাই-বোনেরা, পুঁটির ভাই-বোনেরা মিলে ধরল যে প্রি-ওয়েডিং যখন হয়নি, পোস্ট ওয়েডিং শ্যুটই হতে হবে একটা ! আর ফটো তোলার দায়িত্বে? পুঁটির দুই চ্যালা আছে না? চিন্তা কিসের?

বৌভাত মিটল মানে মানে। রাতে দু'জন একসাথে ঠাম্মির ঘরে গেল। ঠাম্মি আদর করে জড়িয়ে ধরলেন পুঁটিকে। বললেন-
- দিদিভাই, তোরা যখন খুব ছোট, তখন তোর ঠাকুমা আর আমি ঠিক করেছিলাম তোরা বড় হলে তোদের বিয়ে দেব আমরা। তেমন কথাই হয়েছিল। কিন্তু তোর ঠাকুমা হঠাৎ করে চলে গেল বলে আমি একা বাড়িতে কিছু আর বলতে পারিনি। দাদুভাইয়ের অন্য মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হবে শুনে থেকে বুকটা আমার হুহু করতো। আজ মনে হচ্ছে, ভগবান ঠিক মনের ইচ্ছে পূরণ করেন, যদি সে ইচ্ছের জোর থাকে। ভালো থাক তোরা দুটিতে মিলে। আর, এই যে নাতবৌ, তোমার নাড়ুর কৌটো তোমারই রইল। এতে আর কেউ ভাগ পাবে না। হা হা হা !

তারপর? তারপর সব স্ত্রীআচার শেষ করে ঠাম্মি বাকি ভাই-বোনদের সাথে হাত ধরে বর-কনেকে ঘর পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে এলো, দো'তলায় বাতের ব্যথার তোয়াক্কা না করে।
আর তারপর? ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে গেছিল। বিশ্বাস করুন !


0 comments

Saurav Chakraborty

Saurav Chakraborty

Shared publicly - 18th Feb, 22 09:10 pm

খুব ভালো লাগল

Raja Deb

Raja Deb

Shared publicly - 17th Feb, 22 11:09 am

Darun misti golpo ta

Raja Deb

Raja Deb

Shared publicly - 17th Feb, 22 11:09 am

Darun misti golpo ta

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait