ছোটগল্প - দুমপটাশের জয়জয়কার

ছোটগল্প - দুমপটাশের জয়জয়কার

নিস্তারিনীপিসির খিরকি দোরের পাশের ঝোপটা থেকে আস্তে আস্তে একটু মাথা তুললো কানাই। কানাইকে তো আপনারা চেনেনই। আরে! আমাদের কানাই… ওই যে জয়হরিবাবুর বাড়ির ছুটকো কাজের কানাই। ছেলেটা এমনিতে তো ভালোই কিন্তু জয়হরিবাবুর পাল্লায় পড়ে ওরও মাথাটা বোধহয় একটু একটু বিগড়োচ্ছে। যাকগে! সে কথা ভেবে আর কি হবে। খুব সাবধানে এদিক ওদিক দেখে ঝোপটা থেকে বেরিয়ে ও একটু গা হাত-পা চুলকে নিলো। মনে মনে বললো, 'একবার দুমপটাশটা রেডি হয়ে যাক। সবার আগে ওকে দিয়ে এই নচ্ছার মশাগুলোর ব্যবস্থা করবো।'

একটু এগিয়ে গিয়ে নিস্তারিনীপিসির বাগানের পাঁচিলটা ধরে খুব ভয়ে ভয়ে উঁকি দিলো কানাই। কোথাও কেউ নেই। বাগানের পশ্চিম কোনে একটা  সজনে গাছ। ওইদিকের পাঁচিল ঘেঁষে একটা উচ্ছে আর একটা লাউ গাছ। এদিকটায় একটা পেয়ারা গাছ। কলাগাছ আর কিছু শাকপাতা। বেশি বড় নয় বাগানটা। কিন্তু নিস্তারিনীপিসি কৈ। এতোক্ষণে তো তার রান্না করার সময় হয়েছে। চল্লিশ মিনিট আগে পুকুরে ডুব দিয়ে এসেছে, নিজে চোখে দেখেছে কানাই। আজ জেনে যেতেই হবে পিসি কি খায়‌। দুমপটাসের মধ্যে তার বিজ্ঞান সম্মত এক্সট্র্যাক্ট ভরে….

ADVERTISEMENT

ওহহো! দুমপটাশের কথা তো আপনাদের বলাই হয়নি। ব্যাপারটা কি হয়েছে বুঝলেন, জয়হরিবাবু গত চারমাস ধরে একটা রোবট বানাচ্ছেন। ওনাকে তো আপনারা জানেনই। যতসব উদ্ভট কাজের উদ্ভবে তার জুড়ি মেলা ভার। যেমন ওনার বৈঠকখানার বড় ঘড়িটা উল্টোদিকে চলে। কি করে যে সময় বোঝেন ভগবানও বোধহয় জানেননা। ওই যেমন, ওনার বাড়িতে কাক বসলে এলার্ম বাজে। ওই যেমন ওনার ল্যাবরেটরির দরজা খোলে ওনার গলার চিচিং ফাঁক ডাকে… কত আর বলবো। আপনারা তো জানেন সবই। তা তিনি ঠিক করেছেন তার গিন্নির কাজে সহায়তা করতে একটা রোবট বানিয়ে ফেলবেন। তাহলে আর গৌরীদেবী তাকে রোজ বাজারে পাঠাবেন না। কিছু এটা সেটা কাজে ল্যাবরেটরি থেকে ডেকে পাঠাবেন না। যদিও দুমপটাশকে দেখে গৌরীদেবী "মরণ" ছাড়া আর কিছুই বলেননি। কিন্তু তাতে কি জয়হরিবাবু দমে যাবেন! তবে একটু অসুবিধা আছে বটে। সেটা তো সবকিছু আবিষ্কারের আগে হয়ই। আর ওনার মা সুখবালাদেবীও যে খুশি হয়েছেন, এককথাও বলা যায়না। চোখে আঁচল দিয়ে বললেন, "বাবার কষ্টের রোজগারের টাকা এভাবে নষ্ট করছিস খোকা! মানছি মানুষটা তোকে কিছু বলে না। তবু তোর তো ভাবা উচিত।"

সত্যিই তো। বাবার জন্য এখনো পর্যন্ত কিছুই আবিষ্কার করেননি তিনি। দুমপটাশের কাজটা হয়ে গেলেই…

কিন্তু দুমপটাশকে নিয়ে একটু মুশকিলেই পড়েছেন জয়হরিবাবু, সেটা ঠিক কথা। হয়েছে কি, বাবার পুরোনো ছাতার শিক, তিনটি বালতি, খাটের দুটো ভাঙা পায়া, আর একটা প্যাকিং বাক্স ভেঙে, কেটেকুটে, জুড়েতোড়ে রোবটটা খাড়া তো হয়েছে। মেসিন, কলকব্জা লাগিয়ে নড়াচড়াও করছে তাও ঠিক। একটু ট্রেনিং দিলে কাজও করবে প্রবল বিশ্বাস জয়হরিবাবুর, কিন্তু পেটের বালতিটাতে সব কলকবজ্বা, মেসিন রাখার ফলে রোবটটা ব্যালেন্স রাখতে পারছে না। একটু হাঁটাচলা করলেই পেছন ঠুকে পড়ে যাচ্ছে। রোবটের হাল দেখে জয়হরিবাবুর তিনবছরের কন্যা জয়ী খিলখিল করে হেসে বলেছে, "এ বাবা দুমপটাস!"সেই থেকে জয়হরিবাবু রোবটটার নাম রেখেছেন দুমপটাস। 

হলো কি, তিনদিন আগে সকালে যথারীতি জয়হরিবাবু রোজকার মতো বাজারে গেছেন। বিশুর কাছে জ্যান্ত কৈ মাছ দেখে লোভও হয়েছিল খুব। কিন্তু উনি কিছু বলার আগেই সব কৈ মাছগুলো নিস্তিরিনীপিসি কিনে ফেললো। এক কেজি তিনশো পঞ্চাশ গ্ৰাম মাছ। খুব রাগ হয়েছিল জয়হরিবাবুর। তো তিনি বলেই ফেললেন, "কী পিসি? আজকাল লুকিয়ে মাছ খাচ্ছো নাকি! চেহারাটা তো বেশ খোলতাই হয়েছে।"

ব্যাস আর যায় কোথায়! জয়হরিবাবুর দিকে ফিরে বাঁজখাই গলায় বললো পিসি, "কে রে তুই ছোকরা! রামহরি উকিলের ছেলে না তুই? এতো বড় সাহস তোর?!"

সঙ্গে সঙ্গে একটা বিড়াশি সিক্কারের চড় এসে পড়েছিল তার গালে। এত্তটুকু মিথ্যে বলছিনা, পুরো সারে সাত মিনিট ধরে মাথাটা বনবন করে ঘুরছিল জয়হরিবাবুর। সেই অবস্থায় শুনলেন পিসি বলছে, "বিধবা হয়ে ইস্তক মাছ কেন আঁশ অব্দি দাঁতে কাটিনি, আর কালকের ছোঁড়া আমাকে এতোবড় কতা শোনায়! এ্যাঁ!! শুনে রাখ অলপ্পেয়ে ড্যাকরা.. মেয়ে জামাই আসবে আমার। সোনার চাঁদ নাতিটাকে নিয়ে। ফের যদি এমন কথা মুক দিয়ে বের করেছিস…!"

সঙ্গে কি ভাগ্যিস কানাই ছিল তাড়াতাড়ি পিসির সামনে এসে বললো, "রাগ কোরো না কো পিসি। দাদাবাবুর ওই গাদাগাদা বিজ্ঞানের বই পড়ে মাতাটা একদমই খারাপ হয়ে গেচে গো। তোমাকে আর কি বলি!"

পিসি একটু ঠাণ্ডা হয়ে বললো, "সেটা ঠিক। বেশি পড়লে মাতাটা একটু গোলমাল করে বটে। যাক। সে আর কিচু মনে কল্লাম না আমি।"

কানাই এক গাল হেসে বললো, "তুমি তো বুজবে পিসি। তোমার মতো ক'জন আচে!"

সেদিনের গোলমালটা কোনোরকমে মিটেছিলো বটে। বাড়ি ফিরে পুরো একবেলা ভেবে জয়হরিবাবু ঠিক করলেন, এমন চড়ের জোর যার সে তো আর যে সে মহিলা নয়। সুতরাং পিসি ঠিক কি কি খায় তাকে জানতেই হবে। সেই খাবারের বৈজ্ঞানিক নির্যাস তিনি পুরে দেবেন দুমপটাশের ভেতরে। ব্যাস। তারপর আর দুমপটাশকে ঠেকায় কে! প্রথমে অবশ্য ভেবেছিলেন দুমপটাশকে ট্রেনিং নিতে পিসির কাছে পাঠাবেন। তারপর ভাবলেন, পিসির মতো অবৈজ্ঞানিক মানুষের হাতে কি দুমপটাশকে ছাড়া ঠিক হবে! তাই দুনম্বর ব্যবস্থা। সেই জন্যই বেচারা কানাইয়ের দুদিন ধরে এই হেনস্তা। 

যাক সে কথা। কিন্তু এই দুদিনের অনুসন্ধানে যা ফলাফল বেরিয়েছে, তাই মোটেও সুখকর নয়। পিসি সকালে খায় বাসি তরকারি দিয়ে গোলারুটি। দুপুরে কলমি কি ঢেঁকি শাকভাজা, শুক্ত, ডাল, কাঁচকলার বড়া, সব্জিপাতির ছ্যাঁচড়া আর চাটনি। বিকেলে ফলপাকুর আর রাতে একসের দুধকে ফুটিয়ে অর্ধেক করে তা দিয়ে চারটি রুটি। 

জয়হরিবাবু ভীষণ ভাবনায় পড়েছেন। গোলারুটি কি ঢেঁকি শাকের মধ্যে কি বিজ্ঞান আছে তার মাথায় তো আসছে না। কাঁচকলার বড়াটাই বা কি জিনিস ভেবে পাচ্ছেন না। চিন্তায় চিন্তায় নাওয়া খাওয়া মাথায় উঠলো। সারাদিন বিড়বিড় করছেন, 'গোলারুটি, ঢেঁকি শাক, শুক্ত, কাঁচকলার বড়া।'

সুখবালা বড় চিন্তায় পড়েছেন। তিনি সেদিন দুকথা শোনালেন বলে কি ছেলেটা এমন নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দিল! তারওপর রাতে তার স্বামী রামহরি গম্ভীর মুখে মাথা নেড়ে বললেন, "একটা মাত্র ছেলে আমার। বংশের প্রদীপ। মানছি পড়াশোনা করে আর বিজ্ঞান বিজ্ঞান করে তার মাথাটা একটু বিগড়েছে, কিন্তু কারোর কখনো কোনো ক্ষতি তো সে করেনি। নিজের মনে থাকে। তাকে অমন চারটি কথা শোনানো কেন বুঝি না। আমি যা রোজগার করে রেখে যাবো, তিনপুরুষ বসে খাবে। তোমার চিন্তাটা কিসের।"

মরমে মরে গেলেন সুখবালা। বললেন, সে কথা নয় গো। বিয়ে দিয়েছো ছেলের। তার তো কিছু দায়িত্ব আছে। বৌয়ের তো কিছু সখ আল্হাদ থাকে। সব কথা শ্বশুর শাশুড়িকে বলা যায়? তোমার নাতনিটারও তো ভবিষ্যত আছে। তাই তো বলি। না হলে কি আর মায়ের প্রাণ চায়, বলো।"

"এসব নিয়ে ভেবোনা। নাতনির জন্য যা রেখে যাবো আমি তার কিছু অভাব থাকবে না। আর বৌমার হাতে মাঝে-সাঝে কিছু দিও। সত্যিই তো মেয়েটারও তো কিছু সখ-আল্হাদ আছে।"

সুখবালা হেসে বললেন, "তা কি দিইনি গো! কিন্তু মেয়েটা বড্ড ভালো। কিছু নিতে চায় না। বললে বলে, সবই তো আছে মা। তোমরা তো কিছুই অভাব রাখোনি, আলাদা করে আর কি লাগবে বলো! এমন মেয়েকে খোকা বোঝেনা।"

"বোঝে গো বোঝে। এতো বছরেও পুরুষ মানুষের হৃদয় বুঝলে না তুমি…"

ওদিকে অন্য একটি ঘরে অন্যরকম সাধ্যসাধনা চলছিলো। জয়হরি স্ত্রীর হাতটি মুঠোয় নিয়ে বললেন, "তুমি যদি বলো, এসব বিজ্ঞান সাধনা ছেড়ে দেবো আমি। কলেজের চাকরিটাও নেবো। শুধু রাগ করে বাপের বাড়ি যেওনা।"

গৌরী হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন, "এবার আর এসব কথায় হবে না।"

"তবে কি করতে হবে বলো। যা বলবে, সব শুনবো।"

"তবে খাওয়া ফেলে উঠলে কেন?"

"মনটা একদম ভালো নেই গো!"

গৌরী স্বামীর বুকে হাত রেখে নরম গলায় বললেন, "কি হয়েছে? বলোনি কেন আমাকে?"

"বললে আবার তুমি রাগ করবে।"

"এই চিনলে আমায়।"

গৌরীর হাতটা টেনে নিয়ে জড়িয়ে নিয়ে জয়হরি বলেন, "দুমপটাশকে বোধহয় আর ঠিক মতো বানাতে পারলাম না। আসলে কি বলতো! এখানে আর কি আয়োজন! আর আমার আর টাকাই বা কোথায় লাখ লাখ… এ যদি বিদেশ হতো… চাকরিটা বোধহয় আমার করাই উচিত। বাবার কাছে আর কতদিন.. তোমারও বোধহয় খারাপ লাগে! ভেবোনা আমি বুঝিনা। কিন্তু ইচ্ছা করে না জানো… বিজ্ঞানের নেশা ছেড়ে বেরোতেই পারিনা.."

গৌরী স্বামীর বুকের কাছে সরে এসে তার ঠোঁটের ওপর হাত রাখেন। বলেন, "এসব নিয়ে ভাবতে হবে না তোমায়। তোমার যা ভালো লাগে তাই নিয়ে থাকো।"

তবে বাপের বাড়ি চলে যাবে না বলো!"

"যাবো না। তোমাদের ছেড়ে যাওয়া কি সহজ গো!"

হঠাৎ করে কানাইয়ের চিৎকার চেঁচামেচিতে একদম লাফিয়ে উঠলেন জয়হরি। বাইরে কি যেন গোলমাল হচ্ছে। জয়হরি তাড়াতাড়ি করে বেরোতে গিয়ে হোঁচট খেলেন। কোনো রকমে সামলালেন বটে, কিন্তু পায়ে ভালো রকম ব্যাথা পেলেন। তাও গৌরী যদি শেষ মুহূর্তে ধরে না ফেলতেন, বোধহয় পড়েই যেতেন। দরজার খিলটা স্বামীর হাতে তুলে দিয়ে গৌরী বললেন, "সাবধানে।"

ওদিকে হয়েছে কি.. তিনটি চোর রাতের অন্ধকারে চুপিচুপি জয়হরিবাবুর ল্যাবের পেছন দিককার পাঁচিল টপকে ভেতরে ঢুকে পড়ে পা টিপে টিপে বাগান পেরিয়ে মিশিরজির ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালো। দারোয়ান মিশিরজি তখন এক বাটি ডাল আর এগারোটা রুটি খেয়ে গেটের গায়ে খাটিয়া পেতে বাদশাহী গোঁফের গালপাট্টা কাঁপিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে হত সৈনিকের মতো ঘুমাচ্ছিলো। চোর তিনটি বিনাবাক্যেব্যায়ে তাকে বেবাক বেঁধে ফেলে তার বন্দুকটা হাতে তুলে নিল। মিশিরজি একটাও শব্দ করতে পারলোনা। এই অব্দি প্ল্যান মাফিকই হয়েছিল। তারপর তারা আবার বাগান পেরিয়ে বসতবাড়ির সামনে এলো। এখানেই ঘটলো বিপত্তিটা। নিয়ম মতো ওখানে তখন কারোর থাকার কথা নয়। বাড়ির সবারও ঘুমিয়ে পড়ার কথা। কিন্তু সেদিন গরমটা পড়েছিল জব্বর। বুধাই আর কানাইও শুয়ে পড়েছিল। বুধাই বুড়ো হয়েছে, সারাদিনের ক্লান্তিতে শোয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়েছে। মাথার ওপর যদিও পাখা ঘুরছে তবু ছোট ঘরটির মধ্যে যেন আগুন বইছে। কানাই আর ঘরের মধ্যে থাকতে পারলোনা। একটু খোলা হাওয়ার খোঁজে বাইরে বেরিয়ে বারান্দায় এসে বসলো। ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছিল। দেয়ালে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে চোখটাও বুজে এসেছিল কানাইয়ের। এমন সময় অন্ধকারে একটা চোরের পা সটান কানাইয়ের পায়ের ওপর পড়লো। চমকে কানাই "বাবারে!" বলে চেঁচিয়ে উঠলো। তারপর ওদের দিকে তাকিয়ে একটু ভয় পেয়ে বললো, "একি! কে তোমরা!"

একটা চোর বললো, "ধর ওকে। বেঁধে ফেল।"

ওদের মাথা মুখ গামছায় ঢাকা। শুধু চোখ দুটো দেখা যায়। ভয় পেলেও কানাই বুদ্ধি হারালো না। লাফ দিয়ে উঠে একটা চোরকে ঠেলে দিয়ে একলাফে উঠোনে এসে পড়লো। বাকি দুজন ওকে ধরতে যেতেই কানাই সারা উঠোন বাগান ছোটাছুটি করতে করতে চেঁচাতে লাগলো, "বড়বাবু, ছোটবাবু, মা-ঠান, বৌদিমনি শিগগির এসো, বাড়িতে ডাকাত পড়েছে…"

ধরতে না পেরে একজন চোর বন্দুকটা তুলে ওর দিকে তাক করে বললো, "চুপ কর। নাহলে মাথা ফুটো করে দেবো। চোরটা কি করে জানবে, বন্দুকটা মিশিরজির জীবদ্দশায় কোনো দিন চলেনি। সুতরাং সে বন্দুক চালানো আর কারোর পক্ষে সম্ভব নয়। ততক্ষণে ওদিক থেকে রামহরি আর এদিক থেকে জয়হরি বেরিয়ে এসেছেন। কিন্তু কি করবেন বুঝতে পারছেন না। অবস্থা গতিক দেখে গৌরী ঘরের ভেতর থেকে পুলিশকে চুপিচুপি ফোন করে দেন। কিন্তু কাউকেই কিছু করতে হলোনা। হঠাৎ করে ঘটাং ঘ্যাঁচ, ঘটাং ঘ্যাঁচ আওয়াজে সবাই চমকে চেয়ে দেখে ল্যাবটেটারির দরজা দিয়ে দুমপটাশ বেরিয়ে আসছে। জয়হরি অবাক হন। ল্যাবের দরজায় তো চাবি দেওয়া ছিল। দুমপটাশ বেরোলো কি করে! তার চেয়েও অবাক কান্ড এমন দৃঢ় পদক্ষেপে সে যে এগিয়ে আসছে, একবারও তো নড়বড় করে পড়ে যাচ্ছে না! বেশি ভাববার সময় পেলেন না জয়হরি। ওদিকে একটা হুলুস্থুল কাণ্ড শুরু হয়ে গেছে। চোর তিনজন কয়েক মুহূর্ত থমকে থেকে দুমপটাশকে দেখলো। একজন বললো, "এই! এটা কে রে!"

আর একজন বললো, "দুর! ছাড় তো! এই বন্দুকটার কুঁদো দিয়ে একটা বারি দে।"

যার হাতে বন্দুকটা ছিল সে ছুটে গিয়ে বন্দুকটা মাথার ওপর তুলতেই কি হলো বোঝার আগেই জয়হরি দেখলেন সে ছিটিয়ে দুরে গিয়ে পড়লো আর উঠলো না। বাকি দুজন "কি হলো রে" বলে ছুটে যেতে যেতেই ওদের মাঝখানে এসে পড়লো দুমপটাশ। জয়হরি স্পষ্ট দেখলেন, দুমপটাশ তার হাত দুটো সোজা টানটান করে ওদের দিকে বাড়িয়ে দিল আর তার থেকে একটা স্পার্ক বেরিয়ে গিয়ে লাগলো ওদের গায়ে। ওরাও ছিটকে পড়তেই খোঁড়াতে খোঁড়াতেই ছুটে গেলেন তিনি। পেছনে রামহরি আর কানাই। মনে মনে বললেন, "মেরে ফেললো নাকি!"

কাছে গিয়ে দেখলেন, নাহ্! শুধু অজ্ঞান হয়ে গেছে। তিনি দুমপটাশের দিকে এগিয়ে গেলেন। ভালো করে দেখলেন। সব ঠিক আছে। দুমপটাশ যেমন বেরিয়েছিল, তেমনিই ঘটাং ঘ্যাঁচ আওয়াজ তুলে ল্যাবের দিকে চলে গেল। সে ঢুকে যেতেই দরজা আপনার থেকেই বন্ধ হয়ে গেল। পুলিশ এসে সহজেই তিনজন অজ্ঞান আসামীকে গ্ৰেফতার করে নিয়ে গেল। সাব-ইন্সপেক্টর সকালে এসে জবানবন্দি নিয়ে যাবেন বলে গেলেন। মিশিরজীর বন্দুকটাও থানায় জমা পড়লো। উপযুক্ত প্রমাণ সহকারে সকালে ফেরত নিয়ে যেতে বললেন। বলাই বাহুল্য মিশিরজীকে খুলে দেওয়া হয়েছিল। এই আধঘন্টায়ই মিশিরজীর গোঁফ ঝুলে পড়েছিল। সে সুবোধ বালকের মতো মাথা নেড়ে বললো, "জী।"

জয়হরি ভাবলেন, দুমপটাশের ব্যাপারটা সকালে ঠান্ডা মাথায় ভাববেন। কিন্তু বাড়ির সবার উত্তেজিত নানা কথার ভীড় ঠেলে শুতে যেতে বেশ দেরি হয়েই গেল। দুমপটাশকে নিয়ে কারোর কোনো প্রশ্নের উত্তরই তিনি দিলেন না। সুখবালা বললেন, "রাগ করিস না বাবা! আমি কি বুঝতে পেরেছিলাম যে এমন একটা জিনিস তুই বানিয়েছিস! আহা! আহা! বেচারা রে! কত কটুকথা বললাম গো ছেলেটাকে!"

ক্লান্তস্বরে জয়হরি বললেন, "আজ থাক মা। বড্ড ক্লান্ত লাগছে। এইসব ঝামেলা মিটুক। তারপর দুমপটাশকে নিয়ে কথা বলবো‌‌।"

ঘরে এসে শুতে গৌরী বললেন, "রাগ করেছো?".

জয়হরি হেসে বললেন, "তোমার ওপর? কখনো পারি? সত্যিই ক্লান্ত লাগছে।"

গৌরী বললেন, "তবে ঘুমাও। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দি।"

সকালে উঠতে একটু দেরিই হলো। একটা চাপা গোলমাল শুনে ঘুম চোখে বারান্দায় এসে দেখলেন, উঠোনে বিস্তর লোক জড়ো হয়েছে। দুমপটাশকে ল্যাবের বাইরে এনে রাখা হয়েছে। ধুপধুনো ফুল মালা দিয়ে তার পুজো চলছে। আর থেকে থেকে জয়ধ্বনি উঠেছে, "জয়.. দুমপটাশের জয়! জয়.. দুমপটাশের জয়!"

পায়ে পায়ে তিনি দুমপটাশের দিকে এগিয়ে গেলেন। দুমপটাশের মুখে যে ওই স্মিত হাসিটা.. সেটা তো ওনার দেওয়া নয়! তবে কি!

নিস্তারিনীপিসি কোথা থেকে এসে জয়হরির মুখে একটা নাড়ু গুঁজে দিয়ে বললেন, "সেদিনের চড়টার জন্য রাগ কোরোনা বাবা। তোমার মতো হিরের টুকরো ছেলেকে মারা আমার উচিত হয়নি। কিছু মনে রেখোনা। আমি নিজে হাতে তেল কৈ রেঁধে খাইয়ে যাবো তোমাকে।"

একটু মাথা নাড়া ছাড়া আর কিছুই বলতে পারলেন না জয়হরি। দুমপটাশের দিকে তাকাতে দেখলেন, দুমপটাশ তার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে মুচকি হাসলো। ভুল দেখলেন কি!!

 

সমাপ্ত

ছবি সৌজন্যঃ গুগুল 


0 comments

Mandira Dey

Mandira Dey

জন্মসূত্রে বড় হওয়া উত্তরপাড়াতে। শিক্ষাও তার আশেপাশে আবর্তিত। বিবাহের পর দীর্ঘ কুড়ি বছর ব্যাঙ্গালোর প্রবাসী। সংসার সন্তানের দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত লেখালেখি থেকে বহুদূরে হারিয়ে যাওয়া। অবসরে বই আঁকড়ে কেটে যেত সময়। কোলকাতায় ফেরার পর নিয়মিত লেখালেখিতে ফেরা। মূলত সোশাল মিডিয়ায় লেখা শুরু। তারপর থেকে বিভিন্ন পত্রপত্রিকাতে নিয়মিত লিখে চলা। কবিতা সংগ্ৰহে কিছু কবিতার স্থানপ্রাপ্তি। বাংলা সাহিত্যের প্রতি চিরকালীন ভালোবাসায় পাঠকের পরিচয়েই সাবলীল ও গর্বিত।

FOLLOW

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait