দেবাদিদেব মহাদেব— তাঁর নামে শান্তি! শক্তি! মুক্তি! তিনি অপার, অরূপ, অনন্ত। তাঁর অপরূপ দেহকান্তি মনন করা মাত্র মনে আসে অসীম শ্রদ্ধা, অনির্বচনীয় আনন্দ। তিনি সংহার, তিনি সৃজন, তিনিই পুরুষ, তিনিই প্রেম, তিনিই প্রকৃতি। তাঁর চক্ষুদ্বয়ে ধ্বংসের নীরবতা, তাঁর ত্রিনয়নে বিনাশের আগুন, তাঁর তান্ডবে মৃত্যুর পদধ্বনি আবার তাঁরই নির্মল মুখমণ্ডলে সৃষ্টির উল্লাস, তাঁরই রুদ্রবীনায় ঝংকৃত হয় নবনির্মাণের নূতন সুর। তাঁর সৃষ্ট প্রচন্ড তান্ডবের 'তা' ও পার্বতীর সুললিত লাস্যের 'ল' যুক্ত হয়ে নির্মিত হয় নৃত্যগীতবাদ্যের 'তাল'। তিনি রাগ, তিনিই রাগিণী, নৃত্যসংগীতের সৃজন তাঁরই ইচ্ছার ফল্গুধারা। তিনি জ্ঞানস্বরূপ, ব্রহ্মস্বরূপ, আনন্দস্বরূপ।তিনি ভক্তি-মুক্তি-কাম-মোক্ষদায়ী, ভয়-বাধা-বিপত্তি-শত্রুবিনাশকারী, স্বাস্থ্য-সম্পদ-মঙ্গলপ্রদানকারী। তাই শিবলিঙ্গব্রতধারণকারী ভক্তের অযুত অশ্বমেধযজ্ঞের ফল লাভ হয়। আজও ত্রিভুবনে পাশুপতব্রত সকল দান অপেক্ষা শ্রেয় ও মঙ্গলদায়ী।
ADVERTISEMENT
আজ ফাল্গুনমাসের কৃষ্ণচতুর্দশী, আজ মহাশিবরাত্রি। আজ শিব ও শক্তির মিলনক্ষণ, আজ পুরুষ ও পরাপ্রকৃতির সংযোগের পুণ্যতিথি, আজ সৃষ্টির সূচনা। ‘লিঙ্গপুরাণ’ অনুযায়ী মহাশিবরাত্রি ছাড়াও বিভিন্ন মাস, ঋতুভেদে শিবলিঙ্গব্রত ভিন্ন ভিন্ন ও তার পূজাবিধিও ভিন্ন। আজ আমার প্রচেষ্টা সেগুলিকে একটু তুলে ধরা।
চৈত্রমাসে অনুষ্ঠিত ব্রততে শিবলিঙ্গকে চন্দনযুক্ত সুগন্ধীজলে স্নান করিয়ে ব্রতের সূচনা করা হয়। স্বর্ণনির্মিত, নবরত্নখচিত কর্ণিকাযুক্ত( পদ্মের বীজকোষ ) অষ্টদল পদ্ম নির্মাণ করে, সেই কর্ণিকা মাঝে স্ফটিকের লিঙ্গ স্থাপন করতে হয়। তারপর সেই লিঙ্গে বেলপাতা ( এতে স্বয়ং লক্ষ্মীদেবী অধিষ্ঠা করেন ), সাদা পদ্ম (স্বয়ং মহাদেব বাস করেন এই ফুলে), শালুক ( অধিষ্ঠাতা দেবসেনাপতি কার্তিক ), রক্তপদ্ম, নীল পদ্ম( অধিষ্ঠাত্রী দেবী অম্বিকা ), শ্বেতঅর্কপুষ্প( আকন্দ— ব্রহ্মা বাস করেন ), কর্ণিকার কুসুম( মেধা বাস করেন ) , করবী( অধিষ্ঠাতা গণেশ ), বকফুল( নারায়ণ বাস করেন ) এবং সকলপ্রকার সুগন্ধি কুসুম( যার অধিষ্ঠাত্রী দেবী পার্বতী )— এর মধ্যে যে যে ফুল উপলব্ধ হবে তা ব্যবহার করতে হবে। ধুপ ও দীপসহযোগে( এতে রোগনাশ হয় মানুষ নির্বাণপ্রাপ্ত হয় ) মহেশ্বরকে তাঁর মন্ত্র দ্বারা পূজা করা বিধেয়।
পূজাকালীন মহাদেবের দক্ষিণে অঘোর মন্ত্র দ্বারা অগুরু নিবেদন, পশ্চিমে সদ্য মন্ত্র দ্বারা মনঃশিলা ( এক ধরণের খনিজ পদার্থ, red arsenic), উত্তরে বামদেবমন্ত্র আবাহন করে চন্দন ও পূর্বে পুরুষমন্ত্র দ্বারা হরিতাল( এটিও এক ধরণের খনিজ পদার্থ ) অর্পণ করা নিয়ম। এর সঙ্গে সাদা অগুরু ও লাল অগুরু, গুলগুল নির্মিত ধূপ, মহাচরু ( যজ্ঞের পায়েস ) ও ঘি দ্বারা প্রস্তুত আঢ়ক পরিমাণ ( বা তার অর্ধেক ) অন্ন প্রসাদ হিসেবে প্রদান করা কর্তব্য। শিবপূজাতে চামর, তালবৃন্ত ব্যবহৃত হয় ও শূলপানিকে বিবিধ উপহার ( অবশ্যই তা ন্যায় ও পরিশ্রমদ্বারা উপার্জিত ) জলে শুদ্ধ করে ভক্তিযুক্ত মনে নিবেদন করা বিধেয়।
উপরোক্ত নিয়ম সব শিবমহাব্রতের জন্য প্রযোজ্য শুধু মাসের প্রভেদে লিঙ্গ নির্মাণ হেতু প্রয়োজনীয় পদার্থের রকমফের হয়। যেমন— বৈশাখ মাসে হীরাযুক্ত লিঙ্গ প্রস্তুত করা বাঞ্ছনীয়, জ্যৈষ্ঠে মরকতযুক্ত (পান্না) , আষাঢ়ে মুক্তোখচিত, শ্রাবণে নীলাযুক্ত, ভাদ্রে পদ্মরাগযুক্ত (চুনি) , আশ্বিনে গোমেদ, কার্তিকে প্রবাল, অঘ্রাণে বৈদূর্য্যমণি খচিত , পৌষমাসে পুষ্পরাগযুক্ত (পোখরাজ), মাঘে সূর্য্যকান্তমণি( আতস কাঁচের মত ) এবং ফাল্গুন
ও চৈত্রে স্ফটিক দ্বারা লিঙ্গ নির্মাণ বিধেয়। তবে সব মাসেই একটি সোনার পদ্ম তৈরী করে তার মধ্যে লিঙ্গ স্থাপন করতে হবে, সোনা অনাদায়ে রুপোর পদ্ম তৈরি করতে হবে। মণিমুক্তো শোভিত পদ্ম যদি তৈরী করা না যায় তাহলে সোনা বা রুপোর দ্বারা প্রস্তুত করা উচিত আর রুপো যদি সম্ভব না হয় তাহলে তামা, লোহা দ্বারাও পদ্ম নির্মাণ করা যেতে পারে। কিন্তু যদি সেটাও অসম্ভব হয় তাহলে কাঠ, পাথর, মাটি, গন্ধময় পদার্থ যা হোক না কেন বেদীযুক্ত লিঙ্গ নির্মাণ করে (ক্ষণস্থায়ী হলেও চলবে) পূজাবিধি সম্পন্ন করতে হবে।
প্রত্যেক মাসেই একটি করে সোনা বা রুপোর পদ্ম দ্বারা মহাদেবের পুজো করা উচিত, কিন্তু যদি সোনা বা রুপো না পাওয়া যায় তাহলে বেলপাতা দিয়েও পুজো করা সম্ভব। শিব অর্চনায় সহস্র পদ্ম প্রয়োজন হয়, তবে অনাদায়ে তার অর্ধেক কিংবা তারও অর্ধেক পদ্ম পুজোয় অর্পণ করা যায় , আবার তাও যদি না পাওয়া যায় তাহলে একশো আটটি পদ্ম দিয়ে পুজো করা যাবে।
বছরের প্রত্যেকমাসে শিবলিঙ্গব্রত করা উচিত, এই ব্রতে পূর্ণিমা ও অমাবস্যায় উপবাস ও সাধ্যমত দানধ্যান করা অবশ্য কর্তব্য। বছরশেষে গোদান ও বৃষ উৎসর্গ করে ব্রাহ্মণদের ভোজন করাতে হবে। আর পূর্বোক্ত নিয়মানুযায়ী লিঙ্গ নির্মাণ করে পুজো শেষে শিবালয়ে স্থাপন করতে হবে বা ব্রাহ্মণকে দান করতে হবে। এইভাবে ভক্তিযুক্তমনে ও নিষ্টাভাবে ব্রত পালন করলে ভক্ত মৃত্যুর পর শিবালয়ে গমন করেন এবং শিবচরণাশ্রয় লাভ করে থাকেন।
পিনাকপাণি মহাদেব স্বয়ং নির্গুণ ব্রহ্ম। তিনি অলিঙ্গ। সৃষ্টির প্রয়োজনে তিনি লিঙ্গধারণ করেন, এই শিবলিঙ্গ থেকে ত্রিদেবের সৃষ্টি। অব্যক্তময়ী পরাপ্রকৃতি তাঁর দ্বারাই ব্যক্ত হয়ে পুরুষ সহযোগে সৃজনেচ্ছায় উন্মুখ হন, আবার জগৎসংসার সংহার শেষে ব্রহ্মান্ড যখন প্রকৃতিতে বিলীন হলে পরমাপ্রকৃতি ব্যক্তরূপ থেকে আবার পরমব্রহ্মমাঝে অব্যক্তরূপে বিরাজমানা হন। সৃষ্টির ধ্বংসশেষে শুধু ব্রহ্মই অবস্থান করেন, তাই শিবই একমাত্র সত্য, এ জগৎ তাই শিবময়।
তিনি আশুতোষ— তিনি অল্পেই সন্তুষ্ট। তাই সোনা, রূপো, তামা, লোহা, কাঠ, মাটি যার দ্বারাই তাঁকে নির্মাণ করা হোক না কেন তিনি তাতেই কৃপাদান করেন। সামান্য বেলপাতা দ্বারাই তাঁকে অর্চন করা যায়। কোনপ্রকার আড়ম্বর তাঁর পুজোয় নিষ্প্রয়োজন। তিনি ভক্তি ছাড়া আর কিছুই চান না,এ সমারোহ আমাদের দ্বারাই তাঁর ওপর আরোপিত, তাই নৃপতিনিষাদনির্বিশেষে তিনি সবার ওপর অনুগ্রহ করে থাকেন।
তিনি সত্যস্বরূপ, মঙ্গলস্বরূপ, প্রেমস্বরূপ, ত্যাগস্বরূপ, পবিত্রস্বরূপ তাই যদি সত্যিই তাঁর পুজো করতে হয় তাহলে আমাদের হৃদমাঝে তিনি যে বিবেকরূপে আমাদের মনবেদীতে সদা স্থাপিত তাঁর অর্ঘ্য শুধু সত্য, নিষ্টা, কর্ম, প্রেম, ত্যাগ ও তিতিক্ষা— এ ভিন্ন আর কিছুই না।
সত্যম শিবম সুন্দরম!!
তথ্যসূত্র : লিঙ্গপুরাণ, শিবপুরাণ ও অন্যান্য।
ছবি:Pinterest
0 comments