সময় টা সম্ভবত ২০০৫ এর এপ্রিল মাস, একটা পারিবারিক ছুটি কাটানোর কথা মাথায় আসতেই, চারমূর্তি একত্রিত হলাম আমাদের বাড়িতে। চা ও গরম গরম আলুর চপ দিয়ে শুরু হয়ে গেল পরিকল্পনা। সারা সন্ধ্যে তর্ক বিতর্ক, চাপান উতরের পরে রাত এগারোটা নাগাদ আমরা একমত হলাম। ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ী, পরে ঘাটশিলা হয়ে বুরুডি ও স্থানীয় সাইট সিন।
পরের দিন বেরিয়ে পড়তে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল। ঘন সবুজ রঙা টাটা সুমোটা ছুটেচললো দ্রুত গতিতে দুর্গাপুর রোড ধরে। খড়গপুর এর আগে ডাইনে বাঁক নিয়ে জঙ্গলের রাস্তায় পড়তেই অন্ধকার ঘনিয়ে এলো। অথচ আমাদের কোনো অগ্রিম বুকিং করা ছিল না। ভরসা কিছুই নেই দেখে পথের মাঝে জঙ্গল এর ধারে কোনো রিসোর্ট বা বাংলো ধরনের কিছু দেখলেই আমরা গাড়ি থামিয়ে খোঁজ নিচ্ছিলাম। এতে সুবিধা তো কিছু হলোই না বরং বাড়ে বাড়ে গাড়ি দাঁড় করাতে গিয়ে আরো অনেকটা দেরি হয়ে গেল। শেষে রাজবাড়ী পৌঁছতে পৌঁছতে রাত ৯ টা বেজে গেল। ভারপ্রাপ্ত আধিকারিকের সাথে কথা বলে কিছুটা সুরাহা করা গেলেও, কটা ঘর পাওয়া যেতে পারে তার কোনো নির্দিষ্ঠ তথ্য তখনকার মত সংগ্রহ করা গেল না। আরো কিছুক্ষণ সবাইকে অপেক্ষা করতে হবে, রাত এগারোটা নাগাদ আমরা ঘর পাবো। এদিকে দীর্ঘ সময় অভুক্ত থাকার জন্য খিদের কষ্টে টেকা দায় হয়ে পড়েছিল।
ADVERTISEMENT
আমরা তাড়াতাড়ি বেরিয়ে খাবার হোটেলের খোঁজ শুরু করলাম। একমাত্র ভাতের হোটেলটি তখন সেদিনকার মতো বন্ধ হওয়ার উপক্রম করছে। আমরা সাত তাড়াতাড়ি ভাতের অর্ডার দিয়ে হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসলাম। আগে তো খেয়ে নি, তারপরে কপালে যা থাকবে দেখা যাবে। রাতে প্রায় দশটা নাগাদ ঘর পাওয়া গেলো। রাজবাড়ীর দুদিকে গোল গম্বুজ-ওয়ালা ঘরের ডানদিকের একতলা গোল গম্বুজ ঘরটি আমাদের ভাগ্যে জুটলো, এ ছাড়া আরো বড়ো দুটি ঘর এ জায়গা হলো বাকি দলের। গম্বুজ ঘরটি গোলাকৃতি এবং বেশ ছোট, ঘরটির মাঝে একটি দুই বেডের বিছানা, ঘোরানো বড় বড় জানলা গোটা কয়েক, সিলিং অনেক উঁচুতে, তার থেকে লম্বা ডান্ডা-ওয়ালা পুরোনো দিনের ডিসি ফ্যান চলছে। সম্ভবত কোন একজন মানুষের থাকার জন্য বা অন্য কোনো কাজে ঘরটি ব্যবহৃত হতো ।
রাতে শুতে শুতে কিছুটা দেরি হল বটে, তবে শোবার পরে যে ভয়ানক অভিজ্ঞতা হয়েছিল, তা কোনোদিন ভোলার নয়। সে গল্প অন্য কোনোদিন বলবো, কারণ আনন্দময় পারিবারিক ছুটি কাটানোর গল্পের সাথে ওসব অনুভূতি মিশেল খায় না। তবে পরেরদিন সকালে বর্তমান রাজপরিবারের বংশধরদের এক বয়স্ক কেয়ার টেকারের মুখে শুনেছিলাম, ওই গোল গম্বুজ ঘরটিতে কোনো ভাবেই কোনো টুরিস্ট বা অতিথিদের থাকতে দেওয়া হয় না। সেদিন সম্ভবত আর কোনো ঘর না থাকার কারণে ওটিতে আমাদের থাকার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য হয়েছিল।
এক প্যাকেট দামি সিগারেট উপহার দিয়ে অনেক কষ্টে আর একটি কথা জানা গিয়েছিল। ঘরটিতে কোনো এক সময় এক ছোট কুমারের বাস ছিল এবং তিনি একজন চিত্র শিল্পী ছিলেন। তবে এটা কত সালের ঘটনা অথবা কোন ছোট কুমারের কথা এখানে বলা হচ্ছে তা আর জানা যায়নি। অনেক চাপা চাপিতেও কেয়ার টেকারের কাছে থেকে আর একটিও বাড়তি শব্দ বার করা যায় নি।
সে রাতে ঘর পাওয়ার পরে সবার ভিতরেই একটা মানসিক শান্তি ফিরে এসেছিল। আর তখনই বেশি করে মনে হচ্ছিল আমরা ছুটি কাটাতে জঙ্গলে এসেছি। বহুদিনের অভ্যাস অনুযায়ী, রাতে খাবার পরে আমার জঙ্গলের রাস্তায় কিছুক্ষণ পায়চারি করার ইচ্ছা প্রবল হচ্ছিল। ইচ্ছের কথা প্রকাশ করতেই প্রায় সবাইকেই পেলাম, আমার সঙ্গী হিসাবে। প্রথমে রাজবাড়ীর চত্বর পরে আশে-পাশের আরো কিছুটা অঞ্চল জুড়ে আমাদের নৈশ্য ভ্রমণ চলল।
রাতের আবহাওয়া বেশ আরামদায়ক, সারাদিনের কষ্টের উপরে একটা হালকা অলসতার আস্তরণ পড়ছিল। দূরের এক ঝাঁকড়া গাছের মাথা থেকে মাঝে মাঝেই শামুক খোল পাখিদের মৃদু ঝগড়ার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল। এই পাখিটি আকারে বেশ বড়-সর হয়। মাথা, গলা ও ডানার অংশ সাদা হলেও লেজের দিকটা এবং পিঠের শেষ অংশে কালো রং থাকে। ঠ্যাং গুলো লম্বা লম্বা কমলাটে লাল। ডাক অতি কর্কশ, ঝাঁকড়া গাছের অনেকটা উপরের দিকে অনেক পাখি দল বেঁধে থাকে, সকাল হওয়ার আগেই বেরিয়ে যায় খাবারের খোঁজে, আবার সন্ধ্যের আগেই ফিরে আসে চেঁচামেচি করতে করতে। যে গাছে থাকে সে জায়গা খুব নোংরা করে রাখে।
জলা অঞ্চলে শামুকের খোল ভেঙে শাঁস খায় বলেই বোধ হয় এদের এরকম নাম। হাঁটতে হাঁটতে আমরা পৌঁছে গেলাম বেশ বড়ো মাপের একটি মাঠের কাছে। এবড়ো খেবড়ো জমি, বেশিদূর এগোন গেল না। এখন ধান পাঁকার মরশুম, এই সময়ই আশে-পাশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হাতি নেমে আসে পাঁকা ধান খাওয়ার লোভে। এই পরিবেশে জঙ্গলের রাস্তায় তাদের মুখোমুখি হওয়াটা কোনো কাজের কথা নয়।
আকাশে চাঁদ ছিল, মাঠটি চাঁদের আলোতে ঝকঝক করছিল। মাঠের ওপারে হালকা বনভূমির আভাস দেখা যাচ্ছিল। চন্দ্রালোকিত বনভূমির সৌন্দর্য দেখতে দেখতে ফেরার পথ ধরলাম অপেক্ষাকৃত একটু ঘন বনের মধ্যে দিয়ে। চাঁদের আলোটা এখানে অনেকটাই ফিকে। দলে বেশ কয়েকজন লোক থাকলেও একটু যেন গা ছম ছম করছিল।
পাতার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো চুইয়ে পড়া বনপথ আর আগাছার জঙ্গলে একটা বা একপাল হাতি নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে, তা ভেবে সবার ভিতরেই একটা অস্থির ভাব লক্ষ্য করছিলাম। নিস্তব্ধ রাত খান খান করে একটা জঙ্গল আউলের হুম হুম ডাকে সবাই সচকিত হলাম। অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম রাজবাড়ীর হাতায়।
ঘুম ভেঙেছিল একটা হট্টিটি বা টিটি পাখির সুতীক্ষ্ণ ডাকে, ইংরেজিতে পাখিটার নাম রেড ওয়ালেটেড ল্যাপউইং। এরা মাটিতেই বাসা বানিয়ে ডিম পাড়ে। হয়তো এদের নাম করেই কবি লিখেছিলেন -
হাট্টিমা টিম টিম -
তারা মাঠে পাড়ে ডিম।
রাজবাড়ীর কন্টিনেন্টাল ব্রেকফাস্ট সারলাম, বাটার টোস্ট, ডবল ডিমের অমলেট আর চা দিয়ে। গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম উদ্দেশ্য বিহীন ভাবেই। কোথায় যাবো জানি না, তবে আজ আর ঝাড়গ্রামের রাজবাড়ী নয়। অন্য কোথাও, অন্য কোনো খানে। জঙ্গল মহলের ভূপ্রকৃতির একটা আলাদা বৈচিত্র্য আছে। যারা গেছেন, বা থাকেন তারা জানেন। জঙ্গলের ঘনত্ব অধিকাংশই ক্ষেত্রেই পাতলা, পশ্চিমের ঘন অথবা শুকনো পাতলা জঙ্গল থেকে পূর্ব দিকে অনেকগুলি প্রাকৃতিক জলাভূমিতে পরিবর্তিত হয়েছে কালের বিবর্তনে। সে কারণে জঙ্গল মহলের ভিতরের রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে কখনো চোখে পড়বে বড় বড় গাছের পাতলা বনাঞ্চল, কোথাও লম্বা বাবুই ঘাসের তৃণভূমি আবার কোথাও ছোট, বড় বা মাঝারি মাপের জলাশয়।
ক্রমশঃ
আরও পড়ুনঃ ছোটনাগপুরের পাহাড়ে জঙ্গলে (দ্বিতীয় পর্ব)
0 comments