দ্বিতীয় পর্বের শেষাংশ - আমার সর্বাঙ্গ ভেজা, পরনে একখানি নতুন গামছা। সম্ভবত ডুলুং নদীর জলে স্নান করিয়ে বলি দেওয়ার উদ্দেশ্যেই আনা হয়েছে আমাকে। বাইরে অন্ধকার থাকলেও মন্দিরের ভেতরটা অনেক মশালের আলোয় আলোকিত দেখাচ্ছিল। কাপালিক দর্শন একজন পুরোহিত দেবীর মূর্তির সামনে বিরাট খাড়া নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। চারিদিকে ধুপ ধুনোর গন্ধে নিঃশাস নিতে অসুবিধা হচ্ছিল।
ADVERTISEMENT
এমন সময় একসঙ্গে অনেক ঢাক আর কাসর ঘন্টা বেঁজে উঠতেই আমি বুঝলাম এবারে আমাকে বলি দেওয়া হবে। হঠাৎ নজর গেল বিগ্রহের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লম্বা চওড়া একজন সুপুরুষ প্রৌঢ়র দিকে। তার কপালে রাজ তিলক আঁকা আর তার ঠিক পাশটিতে ভীত সন্ত্রস্ত ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা একটি অষ্টাদশী তরুণী। সেই অপূর্ব সুন্দর্যের স্নিগ্ধতা আমার সব মৃত্যু ভয়কে হরণ করলো। মেয়েটির দুই চোখে সিক্ত ছিল, এই মেয়েটিকে আমি চিনি, আমার ভীষণ চেনা মানুষ। মেয়েটির সুতীব্র চিৎকারে রক্ষা পেলাম সে যাত্রা। প্রকৃতিস্ত হতে কয়েক মিনিট সময় লাগলো। মন্দির চত্বর খাঁ খাঁ করছে। অল্প দূরেই আমার সহযাত্রীদের কথা বলার কলকাকলি কানকে সস্তি দিলো।
আরও পড়ুনঃ ছোটনাগপুরের পাহাড়ে জঙ্গলে (দ্বিতীয় পর্ব)
তৃতীয় পর্ব
রক্তিমা (আমার স্ত্রী ) প্রশ্ন করলো - কোথায় ছিলে তুমি এতক্ষন ?
আমি বললাম - কেন আমি তো পুরোনো মন্দিরের চত্বরে বসে ছিলাম, তোমরা আমাকে না ডেকেই চলে এলে ডুলুং
দেখতে?
রক্তিমা অবাক হয়ে বললো - আমরা তো মন্দিরের ওদিক থেকেই এলাম, তোমাকে বসে থাকতে দেখলাম না তো !
এবারে আমার আশ্চর্য হওয়ার পালা, মুখে কিছু বললাম না কিন্তু একটা জটিল চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগলো।
আমি যেখানে বসে ছিলাম, পুরোনো মন্দিরের চাতাল, সেটা কোনো গুপ্ত স্থান নয়, বলতে গেলে একেবারেই প্রকাশ্য দিবালোকের মধ্যেই।
তাই আমাদের এগারো দলের সদস্যদের আমি ছাড়া বাকি দশজনের আমাকে না দেখতে পাওয়াটা স্বাভাবিক নয় !!
আমি কি তবে সময়ের সরণি ধরে কিছুটা পিছনে চলে গিয়েছিলাম?
এ প্রশ্ন আজও আমাকে ভাবায়, ব্যাপারটা যেহেতু হাস্যকর এবং অতিমাত্রায় অবিশ্বাস্য তাই এই ঘটনা কখনো কাউকে বলার কথা মনে হয়নি। আজ বহুদিন বাদে এই বিষয় লিখতে গিয়ে ওই ঘটনার স্মৃতিচারণ করলাম।
নদীটি কোথাও উচ্ছল আবার কোথাও বা নিস্তরঙ্গ, ভাব তার অনেকটা সদ্য কিশোরীর মতো, যে নদীর নামটাই এতো মিষ্টি, তাকে দেখতে তো মিষ্টি হবেই। নদীর পারে বসে পড়লাম বড়োসড়ো একটা পাথরের উপরে। পাথরটার পিছনেই একটা ঝাঁকড়া আমলকি গাছ কোনাকুনি ভাবে ডুলুং নদীর দিকে ঝুকে পড়েছিল, আমার মাথার উপরে তার শীতল ছায়া অনুভব করছিলাম। সামনেই নদীর ওপারে একদল গ্রাম্য কিশোরের দুরন্ত স্নান দেখতে দেখতে অনেকটা সময় কাটলো। তার দুই একটা ছবিও তুললাম বসে বসে। ওদিকটা একটা ভাঙা ঘাটের মতো মনে হলো। জানি না কত যুগের সাক্ষী বহন করছে সেই ঘাট।
সব নদীরই যেমন একটা গল্প থাকে, তেমন ডুলুং নদীরও আছে ....
বেলপাহাড়ি অঞ্চলের ডুলুংডিহা পাহাড় থেকেই ডুলুং নদীর উৎপত্তি, তাই এই পাহাড়ি নাম। কিছুদূর যাওয়ার পরেই নদীটি সুবর্ণরেখায় গিয়ে মিশেছে । ডুলুং এর এই কিশোরী রূপ ভরা বর্ষায় যৌবনবতী যুবতীর রূপ ধারণ করে। পাথরের উপরে বসেই একমাত্র শ্রোতা সহধর্মিণীকে আবৃত্তি করে শোনাচ্ছিলাম কবি শিবাশিস দণ্ড-র লেখা বিখ্যাত ছড়া ‘ছোট্ট ডুলুং, মিষ্টি ডুলুং, মারাংবুরুর মেয়ে।
বড়ো মিষ্টি লাগছিল সেই সকাল, সেই আমলকির স্নিগ্ধ নিবিড় ছাওয়া, সামনে সদ্য কিশোরী ডুলুং এর এলোমেলো বয়ে চলা।
বর্ষাকাল ছাড়া অন্য সময়টা হাঁটুজলে পার হয়ে পৌঁছে যাওয়া যায় কাছেই চিল্কিগড় রাজবাড়ীতে। বর্ষাকালে অবশ্য দু’কুল জলে টইটম্বুর হয়ে যায়। এক নাগাড়ে ভারী বৃষ্টি হলে প্রবল বেগে ধাবমান হয়ে বিপুল জলরাশি দুইকূল ছাপিয়ে পৌঁছে যায় আশে-পাশের গ্রামের কাছাকাছি।
এই রাজবাড়িটি মল্লদেব রাজাদের স্মৃতি-বিজড়িত। জঙ্গলাকীর্ণ পথের দুই ধারে শাল, সেগুন, মহুয়া, কেঁদ, কুসুম, অর্জুন ও গামার গাছের ছড়াছড়ি, এ ছাড়াও রয়েছে বেল, বহেরা, হরিতকি, পিয়াল, বড় বড় চালতা গাছ, তাতে গাছ ভর্তি হলুদ সবুজ কাঁচা পাকা চালতা ফলে আছে। মা চালতা দিয়ে মুসুর ডাল বানাতো আর বানাতো কালো সর্ষে ও চালতা দিয়ে এক ধরণের টক। কি ভালোই যে লাগতো সেই রান্নার স্বাদ, তা বলে বোঝাতে পারব না। আমড়া গাছ ও দেখলাম দুই একটা, এগুলো সম্ভবত ছোট টক আমড়া, আমাদের ছোট বেলায় একধরণের মিষ্টি আমড়া খাওয়ার প্রচলন ছিল, চলতি ভাষায় তাকে বিলিতি আমড়া বলা হতো । টক মিষ্টি অপূর্ব স্বাদের এই খাবার টি বোধ হয়ে আজকাল এলিট খাদ্যতালিকার অন্তর্ভুক্ত হতে পারেনি।
ধূসর অতিকায় এক বিশাল প্রাচীরের ঘেরাটোপে অতীতের স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা প্রায় ভগ্ন এক রাজবাড়ীর ধ্বংসাবশেষ তখন পাইক এবং চুয়াড় সম্প্রদায়ের বাস ছিল এই জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চলে, সাধারণত দস্যুবৃত্তিই ছিল তাদের অন্যতম জীবিকা।
রাজবাড়ির সিংহদুয়ার পেরোতেই সামনে সুন্দর ফুলের বাগান। বাঁদিকে রয়েছে বিরাট অতিথিশালা ।
এই বংশের শেষ রাজা নরসিংহ মল্লদেবের নামেই সামনের রাস্তার নামকরণ। এই রাজবাড়িতে এখনও থাকেন তাঁর উত্তরসূরীরা । প্রায় তিনশো বছর আগে জামবনীর রাজা ছিলেন ভূমিপুত্র সামন্ত রাজা গোপীনাথ সিংহ এবং চিল্কিগড় ছিল তার রাজধানী। চিল্কিগড়ের প্রাচীন কনকদূর্গা মন্দির এবং এই রাজবাড়ীটি রাজা গোপীনাথ সিংহের আমলেই তৈরি। পুত্রহীন রাজার একমাত্র কন্যা সুবর্ণমণির সাথে পরবর্তীকালে বিবাহ হয় পার্শ্ববর্তী ধলভূমগড়ের রাজা জগন্নাথ (সিংহ) দেও ধবলদেবের সাথে। ১৭৬৫ সালে রাজা গোপীনাথ সিংহের মৃত্যুর পর চিল্কিগড়ের রাজা হন জগন্নাথ সিংহ। ওনাদের পুত্র কমলাকান্ত দেও ধবলদেবের সময়কে চিল্কিগড়ের স্বর্নযুগ বলে মনে করা হয়।
এই রাজবাড়ীর সাথে আরো একটি গৌরবজনক অধ্যায় জড়িয়ে আছে। ঐতিহাসিক চুয়াড় বিদ্রোহ চলাকালীন রাজা জগন্নাথ সিংহ এই চিল্কিগড় রাজবাড়ী থেকেই ১৭৬৯ সালে ধল বিদ্রোহের ঘোষণা করেন। সে কথা মাথায় রেখেও স্বাধীন ভারতের সরকার এবং আর্কিওলজিকাল ডিপার্টমেন্ট এই রাজবাড়িটি এবং তার আসে পাশের স্থপতির সংস্কারের কথা ভাবতে পারতেন।
ডুলুং কে আর বেশিক্ষন সঙ্গে দেওয়া গেল না, গন্তব্য স্থির না থাকলেও গ্রীস্মর দুপুরে যে অনেকটা পথ অতিক্রম করতে হতে পারে, এমন একটা সম্ভবনা আগে থেকেই ছিল।
সবুজ সুমো গাড়ি আবার গর্জন করে উঠেই দুই পাশের ছায়াময় বনভূমিকে পিছনে ফেলে দ্রুত এগিয়ে চললো ঝাড়গ্রাম জঙ্গলের দিকে। জামবনি - বাহিরগ্রাম - চিঁচিঁরা হয়েও হাতিবাড়ির মূল রাস্তায় পরা যেত কিন্তু সে রাস্তায় জঙ্গল তত গভীর নয় তাই আমরা ঝাড়গ্রাম হয়ে লোধাশুলির জঙ্গলের রাস্তা ধরলাম। এখন লোধাশুলিতে পর্যটকদের থাকার জন্য দুই একটা বনবাংলো হয়েছে বটে তবে যখনকার কথা বলছি সেই সময় ওসব কিছুই ছিল না, গোটা লোধাশুলির জঙ্গলটা কুখ্যাত ছিল বুনো হাতি আর মাওবাদীদের আক্রমণের জন্য।প্রতি সপ্তাহেই বুনো হাতির হানার খবর আসতো, আসতো কেন - এখনো আসে।আর হাতিকে দোষ দিয়েই বা কি লাভ ? যেভাবে প্রতিদিন প্রতিনিয়ত জঙ্গল ধ্বংস হয়ে চলেছে তাতে হাতির খাদ্যের অভাব তো ঘটছেই তার সঙ্গে সঙ্গে ছোট হয়ে অবলুপ্তির পথে চলে যাচ্ছে হাতির চারণ ক্ষেত্র এবং চলাচলের পথ, যাকে এলিফেন্ট করিডোর বলে।
এই এলিফেন্ট করিডোর হালকা পাতলা এমন এক জঙ্গল যা এক জঙ্গল থেকে অন্য জঙ্গলে হাতি চলাচলের সাহায্য করে এবং যা হাতিদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হাতি যে পরিমানে খাদ্য গ্রহণ করে তাতে একই জঙ্গলে খুব বেশিদিন থাকলে তাদের খাদ্যাভাব হয় তাই মরসুন অনুযায়ী তারা একাধিক জঙ্গল কে সনাক্ত করে রাখে যাতে সারা বছর তাদের খাবারের অভাব না ঘটে। একটি হাতি সারা দিনে প্রায় ৪০০ থেকে ৫০০ কেজি খাবার খেতে পারে।
ধান পাকলে হাতি তার গন্ধ পায় অনেক দুর থেকে, হাতির ঘ্রান শক্তি খুব প্রবল। গ্রামের ক্ষেতে হাতি পড়লে ফসলের অনেক ক্ষতি হয় তাই ধান পাকার সময় বড়ো বড়ো গাছে বা খুঁটির উপরে মাঁচা বেঁধে চাষীরা পালা করে পাহারা দেয়, হাতি খেদানোর জন্য। কানেস্তারা বা টিন পিটিয়ে হৈ হল্লা করতে করতে গ্রামবাসীরা কখনো কখনো মশাল বা পটকা নিয়ে হাতি তাড়াতে গিয়ে হাতিদের জখম করে ফেলে। হাতির রোষে প্রানও যায় দু চারজন গ্রামবাসীর। এভাবেই চলতে থাকে হাতি মানুষে দ্বৈরথে।
ক্রমশঃ...
আরও পড়ুন - ছোটনাগপুরের পাহাড়ে জঙ্গলে (চতুর্থ পর্ব)
0 comments