শেষ আলাপ - পন্ডিত নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের শেষ নিবেদনের স্মৃতি

শেষ আলাপ - পন্ডিত নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের শেষ নিবেদনের স্মৃতি

অনুভবের কোনও মাপকাঠি হয় না। ছেলেবেলায় বাবার কেনা একটা খেলনা মোটর গাড়ি পেয়ে ঠিক কতটা আনন্দ হয়েছিল, গণিতের একজন মহান পন্ডিতও তা হিসেব কষে খাতায় লিখে যেতে পারবেন না। যে ছেলেটা ময়দানের সবুজ ঘাসের ওপর দাঁড়ানো একটা বাতিল ঘোড়ার ওপারে অস্ত যাওয়া সূর্য দেখতে দেখতে পাশে বসা বান্ধবীকে প্রথমবার বলেছিল 'তোকে ভালোবাসি', সে বাড়ি ফিরে হাজার চেষ্টা করেও তার খুশি মাপতে পারে নি কাগজে কলমে। দশ বছর আগে বিয়ে হয়ে আসা মেয়েটাকে যখন শ্বশুরবাড়ির সবাই একজোট হয়ে সহবৎ শেখানোর অছিলায় অপমান করেছিলো, সারারাত জানলার ধারে দাঁড়িয়ে অঝোরে কেঁদেও কাউকে পরদিন বলে উঠতে পারে নি, ঠিক কত ঘণ বর্গমিটার পরিমাণ জ্বালা তার বুকে জমে আছে। আসলে গণিতজ্ঞ, বিজ্ঞানীরা যে অনুভূতি পরিমাপের কোনও এককের সন্ধান দিতে পারেন নি।

১৯৮৬ সালের, ২৪ জানুয়ারি। যেদিন আমি বুঝেছিলাম অনুভূতি প্রকাশের কোনো মাপকাঠি হয় না। সাদার্ন এভেনিয়ু'র বিবেকানন্দ পার্কের ওপর মস্ত প্যান্ডেল। সময় প্রায় মধ্যরাত বা তার কিছু আগে। কলকাতার বাতাসে তখনও কড়া শীত লেগে আছে। মঞ্চে বিস্ময় ব্যক্তিত্ব পন্ডিত নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়, আর শ্রোতার আসনে হাজারো মানুষের মাঝে সদ্য তেইশ ছোঁয়া আমি। সেতার-এর তার শেষবারের মতন (সে মুহূর্তে অবশ্যই জানা ছিল না যে তাঁর হাতে সুরের আরাত্রিক থেমে যাবে এর ঠিক তিনদিন পরেই) সুরে মিলিয়ে 'দরবারী'র সামনে ধ্যানমগ্ন হলেন এক সাধক। ধীরে ধীরে তিনি যেন বাইরের সবকিছু থেকে বিযুক্ত হয়ে গেলেন। মনে হলো তাঁর সামনে কোনও এক অজানা সর্বশক্তিমান এসে দাঁড়িয়েছেন আর তিনি তাঁর জীবনের সুরের সমস্ত সঞ্চয় দু হাত ভ'রে উজাড় করে দিচ্ছেন সেই শক্তির পদতলে। আমার শ্রবণে তখন পৃথিবীর বিস্ময়, দু চোখে জল, আর বুকের মধ্যে  ঈশ্বরীয় অনুভূতি। আমার যৌবন, আমার বোধ, আমার চাওয়া, পাওয়া সব যেন ভেসে যেতে লাগলো সুরে। হঠাৎ মনে হলো বন্যায় বাড়তে থাকা জলস্তরের মতন দরবারী'র আলাপ আমার গোড়ালি, কোমর, বুক সবকিছু ছাপিয়ে আমাকে ডুবিয়ে দিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সারা মাঠে। অসংখ্য দর্শক ভরা কাঠের চেয়ার, আর চট দিয়ে ঘেরা দেয়ালের বেড়া টপকে, বাইরে বসা চা'ওয়ালাটি'র গা ছুঁয়ে আধো আলোছায়া মাখা জনশূন্য সাদার্ন এভেনিয়ু'র কালো পিচ রাস্তা ধরে সেই অপার্থিব সুরের স্রোত যেন ভাসিয়ে দিচ্ছে প্রকৃতিকেও। আর আমি, সেই সুরে ডুবতে ডুবতে প্রাণপণ চেষ্টা করছি আমার ভালোলাগাটুকুকে মাপতে ইঞ্চি, ফুট, মিটার, সেন্টিমিটার, বর্গমিটার, ফ্যাদম-এর মতন পার্থিব পরিমাপের একক দিয়ে, আর ব্যর্থ হচ্ছি বারবার। অসহায়ভাবে ভাবছি  'আমি কেমন করিয়া জানাব আমার পরান কী নিধি কুড়ালো – ডুবিয়া নিবিড় নীরব শোভাতে।' সব দ্বিধা দ্বন্দ্ব দূর করে সুরের ঈশ্বর সে রাতে আমাকে সারা জীবনের মতন শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন, জীবনের কোনও অনুভূতিকেই পার্থিব কোনও এককে মাপা যায় না। অনুভব আজীবন অপরিমেয়।

ADVERTISEMENT


(২৭ জানুয়ারি, পন্ডিত নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের চলে যাবার দিন। সম্ভব হলে একবারের জন্যও শুনবেন তাঁর এই শেষ ঐশ্বরিক নিবেদন, আমি নিশ্চিত সকলের সঞ্চয়ের ঝুলি পূর্ণ হবে। তাঁর শেষ অনুষ্ঠানের রেকর্ডিং-এর লিঙ্ক https://youtu.be/5Enhv5ldDls)

চিত্র ঋণ : শ্রদ্ধেয় শিল্পী বিশ্বনাথ দাশগুপ্ত


0 comments

Saurav Chakraborty

Saurav Chakraborty

Shared publicly - 25th Oct, 21 10:20 pm

কাল রাতে ইউটিউব এর লিঙ্ক থেকে ওঁনার সৃষ্টিকে অনুভব করার চেষ্টা করলাম। বেদনায় মন মুচড়ে উঠল।

Saurav Chakraborty

Saurav Chakraborty

Shared publicly - 25th Oct, 21 10:50 am

অদ্ভুত এই অনুভূতি। কলমের জাদুতে ভর করে যেন সেই রাতে পৌঁছে গেলাম।

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait