গল্প প্রতিযোগিতা   চিরন্তন প্রেম

গল্প প্রতিযোগিতা চিরন্তন প্রেম

মেঘালয়ের একটি ছোট্ট সুন্দর গ্রাম। সেখানে বাস করে আদিবাসী উপজাতি রা। তাদের জীবিকা চাষবাস আর পশুপালন। সেই গ্রামের গ্রামপ্রধানের ছেলে নাগুরাই। তার মত সুদক্ষ সুদর্শন, বলিষ্ঠ আর সাহসী ছেলে মেঘালয়ে আর কেউ ছিল না। তার সাঁতারে পারদর্শিতা, শিকারে দক্ষতা, মাদোলে র বোল,নাচ -সবই ছিল দেখার মত। গ্রামের অনেক মেয়ে তাকে মনে মনে ভালোবাসত। কিন্তু নাগুরাইএর এসব দিকে কোন মন ছিল না। তার একমাত্র শখ ছিল প্রকৃতির কোলে বসে বাঁশি বাজানো। প্রকৃতির সান্নিধ্য তার বড় প্রিয়। সে ভালোবাসে ঘন্টার পর ঘন্টা নদীর তীরে, জঙ্গলে বসে বাঁশি বাজাতে। জঙ্গলের পশু পাখি রাও চুপ করে শোনে তার সুগন্ধে মৌমৌ করা সুর। তার বাবা মানুষ হিসেবে খুব ভালো ছিলেন। নিজে গ্রামপ্রধান হলেও কাউকে বিনা বিচারে শাস্তি দিতেন না। তার মায়ের মত কাজ খুব কম মহিলা করতে পারত। এছাড়া নানা রকম জড়িবুটি চিকিৎসা জানতেন তিনি।

একদিন নাগুরাই জঙ্গলে নদীর ধারে বসে নিজের মনে বাঁশী বাজাচ্ছিল। হঠাৎই দেখল বহমান নদী তে কিছু একটা ভেসে আসছে।একটু ভালো করে লক্ষ্য করাতে চোখে পড়ল একটা মেয়ে। নদীর কনকনে ঠান্ডা জলে বেচারী কাবু হয়ে গিয়েছে।নাগুরাই সঙ্গে সঙ্গে জলে ঝাঁপিয়ে সুদক্ষ পদ্ধতি তে সাঁতার কেটে তার কাছে পৌঁছে গেল। সে ততক্ষণে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে।কোন ভাবে নদীর তীব্র স্রোতের সাথে লড়াই করে মেয়েটিকে তীরে নিয়ে এল সে ।কিন্তু কোন ভাবেই তার জ্ঞান ফেরাতে পারল না ।কি আর করবে! তাকে কোলে তুলে নিয়ে বাড়ি চলে এল।তার মা কিছু জড়িবুটি রস করে মেয়েটির মুখে ঢেলে দিলেন ।আগুন জ্বেলে তাপসেঁক করতে থাকলেন ।ধীরে ধীরে মেয়ে টির জ্ঞান এল।

ADVERTISEMENT
Tuhu Momo Video Teaser

সে জানালো তার নাম নাখাপিলি ।তার বাবা তাকে ভালোবাসলেও তার সৎমা আর সৎ মায়ের মেয়ে তাকে সহ্য করতে পারত না ।খুব অত্যাচার চালাতো তার ওপর। বাড়ি র সমস্ত কাজ তাকে করতে হত। কোন কাজে না করলেই চলত চরম মারধর। বাবা এসবের কোন কিচ্ছু জানত না।কারন সৎমা তাকে মদের বোতলে নেশাগ্রস্ত করে রাখত ।অবস্থা চরমে ওঠে সেদিন যেদিন তার বিয়ে সৎমা এক আধবুড়ো বদচরিত্র লোকের সাথে অনেক টাকা পাবার জন্য ঠিক করল। নাখাপিলি এর ঘোর প্রতিবাদ করে।তার বাবা কে সবকিছু জানিয়ে দেয়। বাবা সৎমা কে খুব অপমান করে। কিন্তু সে আর তার মেয়ে বাবাকে ঘরে বন্ধ করে নাখাপিলি কে প্রচন্ড রকম মারতে থাকে। বেচারী দৌড়ে গিয়ে নদীতে ঝাঁপ দেয় ।তারপর তার আর কিছু মনে নেই।

এসব কথা শুনে নাগুরাই এর মা আঁচলে চোখ মুছে নাখাপিলি কে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বাবা এসে তার মাথায় হাত রাখলেন। বাড়িতে সবার কেমন যেন মায়া পড়ে গেল মেয়েটি ওপর। খুব মায়া মাখানো বড় বড় চোখ তার। ফুলের মত নিষ্পাপ তার মুখ ।দুদিন পর সুস্থ হয়ে বাড়ির সমস্ত কাজ সে নিজেই একা করতে লাগল ।পাড়া প্রতিবেশী সবার মন সে জয় করে ফেলল খুব তাড়াতাড়ি। আর নাগুরাই? সে শয়নে স্বপনে, নিদ্রা তন্দ্রা তে নাখাপিলি কে ই দেখত।নাখাপিলি র প্রেমে পড়ে গেল সে। একদিন সুযোগ বুঝে সে নাখাপিলি কে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে ফেলল। প্রথম প্রথম নাখাপিলি এড়িয়ে গেলেও পরে সেও ভালোবেসে ফেলল নাগুরাই কে। দুজনের মধ্যে জন্ম নিল এক নিখাদ পরিপূর্ণ ভালোবাসা যা একান্ত ব্যক্তিগত আপন।

প্রথম প্রথম প্রেম টা দুজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কখনো বিকেলে বিকেলে বেড়াতে যাওয়ার কথা বলে, কখনো নদীর তীরে বসে, কখনো বাড়ির পিছনে র বাগানে প্রেমালাপ চলত তাদের। ধীরে ধীরে বিষয় টা নাগুরাই এর মায়ের কাছে ধরা পড়ল। তিনি সেটা তাঁর স্বামী র কাছে বললেন ।বলাবাহুল্য দুজনেই খুব খুশি হলেন ।এক শুভদিন দেখে দুজনের বিয়ে ঠিক হল। সমস্ত গ্রামে র লোকের নিমন্ত্রণ থাকলো ।সবাই ঢোল বাজানো,খাওয়া দাওয়া র দাওয়াত পেয়ে খুব খুশি হল।

দেখতে দেখতে শুভদিন এসে গেল। গ্রামপ্রধানের বাড়ি তে ভীড় করে এল গ্রামের মানুষ ।বেজে উঠল ঢাক ঢোল মাদোল।মেয়ে রা দল বেঁধে নাখাপিলি কে নদীতে স্নান করতে নিয়ে গেল ।তারপর বিয়ে র পোষাক আর ফুলের গহনা দিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে দিল। অপরূপ লাগছিল তাকে ।ঘুরতে ফিরতে নাগুরাই এক নজর দেখে নিচ্ছিল তাকে ।সত্যি ই আজ নাখাপিলি কে অপ্সরী র মতো লাগছিলো।

বাড়িতে ছেলে র বিয়ে উপলক্ষে খবর দেওয়া হয়েছিল নাগুরাই এর কাকা,কাকীমা আর তাদের মেয়ে কে। হৈচৈ করে তারা দুপুরে এসে হাজির হল ।কাকা মেতে গেলেন ছেলে দের সাথে হাসি ঠাট্টা খাওয়া দাওয়া গান বাজনা তে। আর কাকীমা মেয়েদের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে বিয়ে র কাজে সামিল হয়ে গেল ।কাকার মেয়ে টি মনে মনে ভাবল একবার গিয়ে কনে দেখে আসবে ।সে সোজা চলে গেল কনের ঘরে। সে ঘরে কনে কে ঘিরে মেয়ে দের হাসি ঠাট্টা রঙবাহারী গল্প চলছিল।

কাকার মেয়ে সে ঘরে ঢুকে কনে দেখে চমকে গেল। একি! এটা কি করে সম্ভব? এযে তার দিদি যে গতবছর তাদের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিল ! সে এখনো বেঁচে আছে? এখানে ই বা এল কি করে? মেয়েটি সঙ্গে সঙ্গে ছুটলো মাকে খবর দিতে ।বেশি দূর যেতে হল না। মা রান্না ঘরে ই ছিল। মাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে সে সমস্ত কিছু জানিয়ে দিল। নাগুরাই এর কাকীমা একটা ঝামেলা পাকাবার জন্য তৈরি হল।

‘কৈ গো দিদি কোথায় আছো তুমি? দেখ কি ঝামেলা পাকিয়েছ তোমরা! বলি নিজের আপন খুড়তুতো বোনকে যে বিয়ে করছে তোমার ছেলে সেটা জানো কি?না জানলে শোন ঐ মেয়ে তোমার দেওরের প্রথম পক্ষের মেয়ে।’কাকীমা র কথায় যেন বাজ পড়ল বাড়ি তে। সমস্ত মঙ্গল ক্রিয়া অনুষ্ঠান সব কিছু বন্ধ হয়ে গেল ।ছুটে এলেন নাগুরাই এর বাবা আর মা। বাবা চেঁচিয়ে বললেন ‘কি হয়েছে সব কিছু খুলে বল’।কাকীমা সমস্ত গ্রামবাসী র কাছে সব কিছু খুলে বলল ।নাখাপিলি তার সতীনের মেয়ে। বুড়ো বর কে বিয়ে করবে না বলে নদী তে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিল। সে যাত্রায় বেঁচে গিয়ে এদের কাছে আস্তানা গেড়েছে। সম্পর্কে নাগুরাই এর মা বাবা তার জেঠীমাজেঠামশাই।নাগুরাই তার জেঠতুতো দাদা ।তা সবাই বলুক ভাইবোনে কি বিয়ে হয়?

‘নিশ্চয়ই হয় কাকীমা।ওকে আমি ভালোবাসি ।আজ তোমার অত্যাচারে ও বাধ্য হয়ে নদী তে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিল ।তুলে নিয়ে এসে ওর প্রান বাঁচিয়েছি আমরা ।তোমাদের কারো ক্ষমতা থাকলে বন্ধ কর তো আমাদের বিয়ে! দেখি কার ক্ষমতা আছে ওকে আমার থেকে ছিনিয়ে নেয় । ’প্রচন্ড রেগে গিয়ে নাগুরাই কাকীমা কে বলল কথাটা ।কাকা ও এগিয়ে এসে কাকীমা কে চুপ করতে বললেন ।কিন্তু সে থামার লোক নয়। সবার সামনে চিৎকার করে বলতে লাগল ‘তুই থাম।এ বিয়ে হয় না ।সমস্ত গ্রামে ছিছি কার পড়ে যাবে ।’নাগুরাই এর মা এগিয়ে এসে বললেন ‘ঠিক কথাই তো বলছে রে।সত্যি ই তো তোরা ভাই বোন ।তুই বল তো কিভাবে এই বিয়ে সম্ভব? আমাদের যে কোন সম্মান থাকবে না বাবা।’এবার জোর গলায় নাগুরাই বলল ‘তোমরা মানো বা না মানো আমি নাখাপিলি কে ভালোবাসি ।ওকে ছাড়া আমি বাঁচব না মা’।এবারে গ্রামের মানুষ দের মধ্যে একটা গুঞ্জন শুরু হল ।তারা ও সুরে সুর মিলিয়ে বলল’না গ্রামপ্রধান, এ বিয়ে সম্ভব না ।ঈশ্বর রুষ্ট হবেন।’

এতক্ষণ নাখাপিলি ঘরের ভেতরে বসে সব শুনছিল। অপমানের জ্বালায় ফেটে যাচ্ছিল তার বুক। সত্যি সেই জ্বালা মেটাবার একটাই পথ আছে। সেটা হল তার মৃত্যু।সে মরলে নাগুরাই এর নতুন করে জীবন শুরু করতে পারবে। কোন ঝামেলা অশান্তি থাকবে না ।সব অপমান অবমাননা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে ।এই ভেবে সে কাউকে কিছু না বলে ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ।নাগুরাই সেটা দেখতে পেয়ে চিৎকার করে উঠল ‘এই নাখাপিলি কোথায় যাচ্ছ তুমি? আমাকে ছেড়ে চলে যেও না ।দাঁড়াও ‘।এই বলে সে ও তার পিছনে দৌড়াতে শুরু করল।

নাখাপিলি ততক্ষণে ছুটে পৌঁছে গেছে পাহাড়ের খাদের কাছে। তার নীচে দিয়ে তীব্র স্রোতে বয়ে যাচ্ছে নদী ।সে ঝাঁপ দিতে যাবে এমন সময়ে নাগুরাই এসে পিছন থেকে টেনে এনে বুকে জড়িয়ে ধরল।সে মিনতি করে বলল ‘না নাখাপিলি এরকম কোরো না ।তুমি একবার ও ভাবলে না আমার কথা!আমি কিভাবে বাঁচবো তোমাকে ছেড়ে? ‘কান্না ভেজা গলাতে নাখাপিলি বলল’না নাগুরাই তুমি ফিরে যাও ।আমি সরে যাচ্ছি তোমার জীবন থেকে ।নতুন করে জীবন শুরু কর ।’নাগুরাই বলল ‘কখনো ই না।তার চেয়ে বরং এসো দুজনে একসাথে মরি ।তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না আমি ।’এই বলে দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরে পাহাড়ের থেকে নীচে বহমান নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ল ।ততক্ষণে গ্রামের বাসিন্দাদের সাথে নাগুরাই এর মা ,বাবা, কাকা,কাকীমা এসে পৌঁছেছে সেখানে ।কিন্তু শেষ রক্ষা হল না ।প্রেমের জন্য প্রাণ বিসর্জন দিলো দুই প্রেমিক প্রেমিকার।

নাগুরাই এর মা এই মর্মান্তিক ঘটনা সহ্য করতে পারলেন না ।বুকভাঙা আর্তনাদ করে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন ।নিজের মনে বলতে থাকলেন ‘তোরা ফিরে আয় ।মায়ের বুকে ফিরে আয় ।মাকে এত বড় শাস্তি দিয়ে যাস না ।শূন্য করে দিস না রে! ‘অঝোরে কাঁদতে লাগলেন তিনি।

ঠিক তখনই দেখা গেল নাগুরাই আর নাখাপিলি যে নদী তে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুবরণ করেছে সেখান থেকে বিদ্যুতের মত এক উজ্জ্বল আলো উঠে আকাশে মিশে গেল ।সেই সঙ্গে শুরু হল মুষলধারে বৃষ্টি ।বইতে লাগলো ঠান্ডা হাওয়া ।প্রকৃতি যেন ভেঙে পড়েছে এই দুই প্রেমিক যুগলের মৃত্যুতে ।তারা আর ফিরে আসবে না কোনদিন ।তাদের পবিত্র আত্মা অমৃতলোকে যাত্রা করেছে ।সেখানে তারা মিলিত হয়ে একাত্ম হয়ে যাবে।

শোনা যায় আজও নাকি মেঘালয়ের প্রত্যন্ত গ্রামে বিশেষ করে ঝড়বাদলের দিনে আদিবাসী উপজাতি রা স্মরণ করে নাগুরাই আর নাখাপিলি র সে অমর প্রেম কথা ।তারা তাদের প্রেম কে সাফল্যমন্ডিত করার জন্য জীবনের বলিদান দিয়েছিল ।হয়ত তাদের প্রেম জীবদ্দশায় পরিনতি পায় নি ।কিন্তু তারা প্রমাণ করেছে প্রেম এক চিরন্তন সত্য ।কোন চাওয়া পাওয়ার ঊর্ধ্বে ।এ এক এমনি বিষয় যা মানে না কোন বয়স, কোন সম্পর্ক বা সৌন্দর্য ।প্রেম সমস্ত পার্থিব বন্ধনের বাইরে যা স্বর্গীয়, সুবাসিত, পবিত্র, চিরসজীব ও মঙ্গলময়।

  •  

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait