ফিল্ম রিভিউ – ড্রিমগার্ল

ফিল্ম রিভিউ – ড্রিমগার্ল

অভিনয়েঃ আয়ুস্মান খুরানা, নুসরাত ভারুচা, অন্নু কাপুর, বিজয় রাজ এবং আরও অনেকে; পরিচালনা : রাজ শান্ডিল্য 

যেরকম ছবি দেখতে আমরা অভ্যস্ত, মানে নিখাদ প্রেম বা সামাজিক সমস্যা ইত্যাদি, তার থেকে একদম ভিন্ন বিষয় নিয়ে তৈরি এ ছবি। ছবির নায়ক করম সিং(আয়ুস্মান) ছোট থেকে মেয়েদের গলায় কথা বলতে পারে। ছবির পটভূমি উত্তরপ্রদেশের কৃষ্ণ জন্মভূমি মথুরা ও গোকুল। সে কখনো তার কম নম্বর পাওয়া বন্ধু স্মাইলির মা হয়ে স্কুলের প্রিন্সিপল কে ফোন করে তো কখনো যাত্রাপালায় রাধা বা সীতামা সাজে। সেজন্য গোকুলে তাকে সবাই খুব সম্মান করে, পায়ে হাত দিয়ে ছোট ছোট বাচ্ছারা প্রণামও করে।

তার বাবার(অননু কাপুর) একটি দশকর্মা ভাণ্ডারের দোকান আছে। বাবা ঋণে জর্জরিত। ব্যাংক থেকে পাওনাদার এসে শাসিয়ে যায়! করম উচ্চশিক্ষিত হয়েও চাকরি পায় না, যেরকম বাস্তবে হয়। এই অবস্থায় একদিন সে একটি চাকরির বিজ্ঞাপন দেখে এক জায়গায় আসে! সেই দোকান টি তে গৃহস্থালীর টুকিটাকি জিনিস বিক্রি হয় সামনে, আর পিছনে পাতা ‘বন্ধুত্ব করার ফাঁদ’ । কয়েকটি মেয়ে সারাদিন সেখানে বসে ফোনে বন্ধুত্ব করে চলে নানাজনের সাথে। এটাই আসল ব্যবসা। করমের  মেয়েদের গলা শুনে মালিক তাকে দীর্ঘদিন অনুপস্থিত একজনের জায়গায় চাকরি দেন। করম ‘পূজা’ সেজে মিষ্টি মেয়েলি গলায় বন্ধুত্ব করে যেতে থাকে। তার সুমিষ্ট গলায় মোহিত হয় নানা জন। এর মধ্যে প্রধান তার নিজের হবু শ্যালক মহেন্দ্র, ছেলেদের ওপর বীতশ্রদ্ধ এক চাকুরীরত মহিলা যার নাম রোমা, টোটো নামক এক বেয়ারা ছেলে, এক কবিত্ব ফলানো পুলিশ(বিজয় রাজ) এবং আরও একজন। ঘটনাক্রমে করম এদের সবাইকার আসল পরিচয় জানতে পারে। কিন্তু ব্যাপার তখন অনেকদূর গড়িয়ে গেছে। তার সুরেলা গলা শুনে পুলিশবাবু তাঁর স্ত্রীকে ছেড়ে দিতে চান, শ্যালক মহেন্দ্র পূজাকে বিয়ে করতে চায়, টোটো পূজাকে দেখতে চেয়ে না পেয়ে নিজের হাতের শিরা কাটে, রোমাও তাকে ভালবেসে ফেলে। কিন্তু করম বুঝতে পারে বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে যখন জানতে পারে যে  তার বৃদ্ধ বাবা ‘রাহুল’ নাম নিয়ে তাকেই ফোন করে ও বিয়ে করতে চায়। করম বিপদ বুঝে চাকরি ছেড়ে দিতে চায় কিন্তু সেখানেও বাধা। তার মালিক শাসাতে থাকে যে চাকরি ছেড়ে দিলে সে করম কি করে তা সবাইকে বলে দেবে। করম ভালই ফেঁসে যায়। এমতঅবস্থায় সে তার হবু স্ত্রী মাহীকে (নুসরাত) ইনিয়ে বিনিয়ে জিজ্ঞাসা করে এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায়।

ADVERTISEMENT

 

মাহীর পরামর্শ অনুযায়ী সে এবার তার বাবাকে অর্থাত্ ‘রাহুল’কে দেখা করার জন্য ডাকে। বাবা নিষ্ঠাবান হিন্দু। সেই অস্ত্রে শান দিয়ে করম ও স্মাইলি মুসলমান মহিলা সেজে বাবার সাথে দেখা করে। এতে কাজও হয়। বাবা পূজার আসল নাম জূবেদা  জেনে মুষড়ে পড়েন। এদিকে ছেলে এসে বাবার ওই অবস্থা দেখে হিরো সাজার জন্য তাঁকে অনেক জ্ঞান দেয় ও বলে প্রেম সমস্ত ধর্মের ঊর্ধে। সে বাবা ও জুবেদার বিয়েতে রাজি। সম্ভবত এই অংশটি ‘আধুনিক’ ভারতবর্ষের কথা মাথায় রেখে তৈরী। নাহলে বুদ্ধিজীবীদের সমলোচনায় পড়তে হত। সে যাই হোক কিছুদিন পরে করম দেখে বাবা উর্দু শিখছেন, চুল দাড়িতে লাল রং করেছেন, গামছা কাঁধে দিয়েছেন এবং বাড়ি ও দোকানে সবুজ রং করানোর জন্য মিস্ত্রি লাগিয়েছেন। তিনি জুবেদাকে বিয়ে করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এদিকে করম রোমার সাথে দেখা করতে গিয়ে সেখানে মহেন্দ্র, মাহী ও টোটোর সম্মুখীন হয়। সবাই তাকে ভুল বুঝতে থাকে। টোটো দলবল নিয়ে পেটাতে আসে, মাহী রাগ করে চলে যায়। করম মাহীকে সব কথা খুলে বলে। পুলিশবাবু সবকিছু জেনে ওই ব্যবসার মালিককে(রাজেশ শর্মা) ধরেন। সবাই ভুল বুঝতে পেরে ক্ষান্ত হয়।

আরও পড়ুন - মুভি রিভিউ : গুমনামী


পরিচালক মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। প্রত্যেক অভিনেতা তাঁর সেরাটা দিয়েছেন। কিন্তু নুসরাত ভারুচা কে আমরা আগে যে ছবিগুলোতে দেখেছি তার থেকে এখানে সম্পূর্ণ আলাদা তিনি। একদম পাশের বাড়ির মেয়ের মত লেগেছে তাঁকে। রাজেশ শর্মা এবং বিজয় রাজ যথাযথ। অননু কাপুর অনবদ্য। ছোট ছোট চরিত্রগুলো সবাই যথাযথ ফুটিয়েছেন। গানগুলোর মধ্যে ‘দিল কা টেলিফোন’ মনে দাগ কাটে। সিনেমাটোগ্রাফি অসাধারণ। ঝকঝকে। তবে সবাইকে ছাপিয়ে গেছেন আয়ুস্মান! তাঁর সাবলীল অভিনয় ক্ষমতা বহুদিন আগেই প্রমাণিত। এ ছবি তাঁর মুকুটে নতুন পালক জুড়ে দিল। শুধু গোকুল ও মথুরার রাস্তাঘাট বড্ড আধুনিক লাগল। জায়গাটি ঘোরা আছে যাঁর তিনি মেলাতে পারবেন না। এতটাই আধুনিকতায় মোড়া। গোকুল ও মথুরা মন্দির পরিবৃত ও প্রাচীনত্বের ছোঁয়া সর্বত্র। জানিনা সেখানে এখন নতুন শপিং মল হয়েছে কিনা।


এই ছবিটির বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে অভিনব। প্রথমত বলিউড এর প্রথম সারির একজন নায়ককে এই ছবিতে অনেকটা সময় শাড়িতে দেখা গেল! শুধু তাই নয়, চরিত্রের প্রয়োজনে তিনি মেয়েদের গলায় কথা বলেছেন, গান করেছেন এবং মেয়েদের ছলাকলা মেয়েদের চাইতেও ভাল রপ্ত করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, এতটুকু অতি অভিনয় তিনি বা অন্য কোনও অভিনেতা করেন নি। তৃতীয়ত, এই ছবি আমাদের এক গভীর প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়। তা হল, একাকীত্ব। আমাদের একাকীত্ব এতটা বেড়ে গেছে যে এক বাড়ি লোকজন ও এক পাড়া বন্ধু থাকলেও আমাদের ছুটে যেতে হয় ফোন বন্ধুর খোঁজে। আমরা নিজের মনের কথা কোনও অচেনা কাউকে বলি, যাকে হয়ত আমরা দেখি নি কোনদিন। কিন্তু নিজের বাবা মা সন্তান বা বন্ধুকে বলতে ভয় পাই! কতটা আমরা অসহায়। এই ছবি তাই সামগ্রিক ভাবে একটি বার্তা দেয়। তা হল এই স্মার্ট ফোনের যুগে যখন মানুষের বন্ধু বলতে সামাজিক মাধ্যম, যদিও সেখানে সত্যিকার বন্ধুত্ব আশা করা বৃথা, কারণ কেউ তো চেনেই না ভাল করে কাউকে, সেখানে বিশ্বাস করলে ঠকতে ই হবে। মেকি স্বার্থগন্ধী প্রশংসা জুটবে হয়ত, ভালবাসা থাকবে না। তার চাইতে আসুন না পরিবার কে সময় দিই আমরা। সেখানে চমক, স্বার্থ বা তীব্র লালসার ঘনঘটা খুবই কম, কিন্তু ভালবাসার ছোঁয়া টা বড্ড বেশি।

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait