প্রতিযোগিতার গল্প – বাড়ি ফেরা

প্রতিযোগিতার গল্প – বাড়ি ফেরা

এক)
হাইস্পিডে ছুটতে থাকা গাড়িটা একটা আওয়াজ করে থেমে গেল নির্জন অন্ধকারের মাঝে। হয়তো ইঞ্জিনের কোনো সমস্যা। বনেটের মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসা কালো ধোঁয়া ভিতরটাকে গ্রাস করছে। অর্ককে বাধ্য হয়ে নেমে আসতে হল। বীরভূম থেকে বন্ধুর বিয়ে খেয়ে কলকাতায় ফিরছিল সে। অত রাতে কেউ তাকে ছাড়তে চায়নি। তবে পরেরদিন খুব জরুরি কিছু কাজ থাকায় বেরিয়ে পরতে হয়েছে। গাড়ি থেকে নেমে চারিদিকটা দেখল সে। জ্যোৎস্না রাতের শীতল হাওয়ায় আশেপাশের পরিবেশটা অপার্থিব সুন্দর লাগছে। যেদিকেই তাকায় সেদিকেই শুধু রূপালি ধান জমি আর প্রান্তর । মোবাইলে সময় দেখল – রাত ১ টা ৩৩। এই রাস্তায় গাড়ি খুব কম চলে। এমন এঁড়ে পরিস্থিতিতে গাড়িটা ঠিক করবে কি করে, তা ভাবতে ভাবতে নিজেই বনেটে দু’বার জোরে চাপ দিল। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হল না, ক্রমাগত কালো ধোঁয়া বেরতে থাকল । এত রাতে অজানা পরিবেশে সে একা। কিছুক্ষণ আগে মাইলফলক দেখে এসেছে। বোলপুর থেকে আনুমানিক ছয় কিলোমিটার দূরে আছে। এখানে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো উপায়‌ও নেই ! বাড়িতে এত রাতে ফোন করলে সবাই খামকা চিন্তা করবে। তবে ভোর হতে আর ঘণ্টা দুয়েক ; তারপর এলাকার লোকজনের সাহায্যে ঠিক একটা ব্যবস্থা করে ফেলবে গাড়িটার । এসব ভাবতে ভাবতে কিছু দূরে রাস্তার ধারে একটা উঁচু ঢিপির উপর বসলো সে। একটু ভয়ও হল। এইসব এলাকায় তো আবার ডাকাতের উৎপাত! অবশ্য তাকে আক্রমন করলে ওই গাড়ি আর টাকা ছাড়া কিছুই পাবে না.. আনমনে কতক্ষণ সময় কেটেছে হিসেব নেই। হঠাৎ কিছুটা দূর থেকে একতারার আওয়াজ শুনে খানিকটা চমকে উঠল সে। এখন বাউল গাইছে কে !

“আমার প্রানের মানুষ আছে প্রানে,
তাই হেরে তায় সকল খানে।
আছে সে নয়ন তারায়, 
আলোক ধারায়ে তাই না হারায়।
ওগো তাই দেখি তায়ে যেথায় সেথায়
তাকাই আমি যেদিক পানে ।”

ADVERTISEMENT

-বাবু বুঝি পথ হারালেন ?
পাশ ফিরে তাকাল অর্ক। গানের মোহতে এতক্ষণ বোঝেনি, একজন গেরুয়া বসনে একতারা হাতে তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। চাঁদের আলোয় লোকটার মুখ দেখা যাচ্ছে, বয়সের ছাপ স্পষ্ট।
খানিক থতমত খেয়ে অর্ক জবাব দিল, -নাহ.. ওই গাড়িটা খারাপ হয়ে গেছে। আপনি কে ?
-আমি নিত্যানন্দ, বাবু। লোকে আমায় বাউল বলেই চেনে।
-তা আপনি এত রাতে এখানে কি করছেন ? খানিক সন্দেহে জিজ্ঞেস করল অর্ক। সে শুনেছে ডাকাত অনেকসময় ছদ্মবেশে থাকে!
-এই তো সময় বাবু। আমাদের গানের, সাধনার.. এই সময়! আপনি ভয় পাবেন না, আমি ডাকাত নই!
লোকটা ঠিক ধরে ফেলল মনের কথা। 
-না না তা ঠিক নয়। আসলে এত রাত, তাই আর কি! আপনি বসুন না এই আমার পাশে ।
-ধন্যবাদ বাবু! তা বাবু কি কলকাতার ?
-হ্যাঁ, আসলে নলহাটি থেকে ফিরছিলাম। পথে গাড়িটা গেলো বিগড়ে! তাই অগত্যা এখানে বসে। তোমার বাড়ি কোথায়, বাউল ?
-এই বোলপুরে বাবু ! আপনাদের কলকাতায় অনেকবার গিয়েছি দল এর সাথে।হেসে উত্তর দিল নিত্যানন্দ ।


-তোমার গান বেশ ভালো লাগল! এমনি‌ও একা বসেছিলাম। তুমি আসায় ভালোই হল। আরও একটা শোনাতে পারবে আমায় ? 
– আমরা তো গানেই বেঁচে আছি বাবু.. এই বলে শুরু করল সে, 

 

“এক ফুলে চার রঙ ধরেছে
সে ফুলে ভাব নগরে কি শোভা করেছে।।
কারণবারির মধ্যে সে ফুল
ভেসে বেড়ায় একুল ওকূল।
শ্বেতবরণ এক ভ্রমর ব্যাকুল
সে ফুলের মধুর আশে ঘুরতেছে।।
মূল ছাড়া সে ফুলের লতা
ডাল ছাড়া তার আছে পাতা।
এ বড় অকৈতব কথা
ফুলের ভাব কই কার কাছে।।
ডুবে দেখ মন দেল-দরিয়ায়
যে ফুলে নবীর জন্ম হয়
সে ফুল তো সামান্য ফুল নয়,
লালন কয় যার মূল নাই দেশে।।”

– আহ্, মন ভরে যাচ্ছে !
-বাউল মানে বোঝেন বাবু ?
-নাহ্ গো। আমরা তো শহুরে মানুষ ; তাই অত চর্চা নেই। তা তুমিই বুঝিয়ে দাও !
– পাগল বোঝেন ? বাউল মানে পাগল! আমরা পাগল – গানের নেশায়। লোকে তো আমাদের অর্ধেক সন্ন্যাসীও বলে! রক্ত মুখে নিয়েও আমরা গাইতে পারি বাবু ! এই গান আমাদের সুখ-দুঃখ সব !
-তা বুঝলাম ! তোমার বাড়িতে কে কে আছে ?
-আমার এক মেয়ে আছে বাবু !
অর্ক বাউলের মুখের দিকে তাকাল। চোখের কোনে জলবিন্দু স্পষ্ট!
-একি তুমি কাঁদছ কেন ?
-ওহ্ কিছু না !
-না বলতেই হবে ! বল আমাকে ! 
একটু খুকখুক আওয়াজ করে কেশে নিত্যানন্দ মুখ খুলল,
-সেই রাতে আমি আর আমার মেয়ে এই পথেই ফিরছিলাম বাবু। ওই শয়তান ডাকাতের দল আমার মেয়েটাকে ছিঁড়ে খেয়েছে.. ছিঁড়ে খেয়েছে। আর আমি! আমি কিছুই করতে পারিনি।
ব্যাপারটা পরিষ্কার হল। 
-তা তোমার মেয়ে এখন কোথায় ?
-গ্রামেই আছে বাবু। প্রতিদিন কত অত্যাচার যে ওকে সইতে হয়! গ্রামের মানুষ আমাদের এক ঘরে করে দিয়েছে। মোড়ল বাবুও এসে বলে গেছেন ঘর যেন ছেড়ে দিই ! এখন কি যে করি কিছুই বুঝতে পারি নে!
লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে গেলো অর্ক-র। একবিংশ শতকেও এরকম মানসিকতা! ছিঃ! 


-আমি কাল তোমাদের গ্রামে যাব বাউল। সেখান থেকে তোমাকে আর তোমার মেয়েকে কলকাতায় নিয়ে যাব। থাকার একটা বন্দোবস্ত ঠিক হয়ে যাবে !
-বাবু আমার জন্য এত করবেন ?
-মানুষ মানুষের জন্য‌ই তো করে ! আর আমিও তো মানুষ।
বাউলের ঠোঁটের কোণে একটা ম্লান হাসি ফুটে উঠল। কথা আর গানের মাঝে সময় যে কখন পেরিয়ে গেছে, তার খবর ওরা রাখেনি ! 
-ভোর হতে চলল। শুনতে পাচ্ছেন পাখির ডাক ?
-হ্যাঁ, পাচ্ছি গো ! তা তোমার গ্রামের নাম কি ?
– আদিত্যপুর ! এই রাস্তা ধরে সোজা আট মাইল গেলেই পাবেন। ওখানে আমার নাম বলবেন। লোকে দেখিয়ে দেবে বাড়িটা !
-বুঝলাম। তুমি যাবে তো সাথে ?
-আপনার সাথে যেতে পারব না বাবু। আপনি যান, আমি ঠিক সময়ে পৌঁছে যাব। আমার একটা ছোটো কাজ আছে, সামনে একটু যেতে হবে.. আচ্ছা বাবু আমি চলি তাহলে। আপনি পৌঁছানর পরই আমি পৌঁছে যাব ।
-আচ্ছা। চলে এস কিন্তু তাড়াতাড়ি !
ভোরের আবছা আলোয় একতারার সুরে বাউল হাঁটতে শুরু করল ,
“খাঁচার ভিতর অচিন পাখি
কেমনে আসে যায়,
তারে ধরতে পারলে মন বেড়ি –
দিতাম পাখির পায়ে।
আট কুঠুরী নয়
দরজা আঁটা মধ্যে মধ্যে,
ঝরকা কাঁটা – 
তার উপরে সদর কোঠা
আয়না মহল তায়।
কপালের ফের নইলে কি আর
পাখিটির এমন ব্যবহার,
খাঁচা ভেঙ্গে পাখিয়ামার কোন খানে পালায়।
মন তুই রইলি খাঁচার আশে
খাঁচা যে তোর কাঁচা বাঁশের।
কোন দিন খাঁচা পড়বে খসে
ফকির লালন কেঁদে কয়।

 

“লোকটা দূরে কোথায় মিলিয়ে গেল!

দুই)
অর্ক পিছন ফিরে গাড়িতে উঠে অজান্তেই স্টার্ট দিল। গাড়ি স্টার্ট নিতেই চমকে উঠল ! একি গাড়ি স্টার্ট নিল কি করে ! গাড়ি যে খারাপ ছিল। অনেকটাই আশ্চর্য হতে হল তাকে। তবে আর সময় নষ্ট নয়। বাউল কে দেওয়া কথা রাখতেই হবে !
আদিত্যপুরে পৌঁছে বাউলের বাড়ি খুঁজে পেতে সকাল হয়ে গেল। আশেপাশের পরিস্থিতি ততক্ষণে উত্তপ্ত হতে শুরু করেছে। একদল লোককে সাথে নিয়ে গ্রামের মোড়ল পুরো বাড়িটা ঘিরে ফেলেছে। ভিড় সরিয়ে ভিতরে ঢুকে এল অর্ক। সবাই তাকে অবাক হয়ে দেখছে।
-থামুন আপনারা দয়া করে! আমি আজ ওদের নিয়ে গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে যাব।
-যত তাড়াতাড়ি পারেন করুন। নাহলে এ ঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেব আমরা!
-শান্ত হন আপনারা! আমাকে ভিতরে যেতে দিন !
দর্মার দরজা ধাক্কা দিয়ে ভিতরে ঢুকল সে। ঘরে তেমন কিছুই নেই : একটা তক্তাপোষ, এক কলসি জল, কিছু জামাকাপড় আর কালি ঠাকুরের ছবি। ঘরের কোণে এক শীর্ণকায় মেয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে বসে আছে। চোখে মুখে কালশিটে স্পষ্ট। দু’হাত জোর করে অর্ককে বলল ,
-আমাকে মারবেন না বাবু, আমাকে মারবেন না !
-কে বলল আমি তোমাকে মারব। আমি তো তোমাকে আর তোমার বাবাকে এখান থেকে নিয়ে যেতে এসেছি !
-আমার বাবাকে! 
খানিকটা বিষ্ময় ফুটে উঠল মেয়েটার চোখে। 
-হ্যাঁ তোমার বাবার থেকে সবটা শুনেই তো আমি এলাম এখানে !
এবার হাউহাউ করে কাঁদতে শুরু করল মেয়েটা ।
-বাবা তো সেই রাতেই খুন হয়েছে বাবু!
নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না অর্ক !
-মানে ! উনি তো কালই আমার সাথে………
-ওই যে বাবার অস্থি!
একটা কাঠের পাটাতনের উপরে রাখা আছে ছোটো পিতলের ঘটটা। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মাঝখানে সব যেন গুলিয়ে উঠছিল। 
-তাড়াতাড়ি তৈরি হ‌ও। সাথে যা নেওয়ার নিয়ে নাও। আর বাবার অস্থি টাও.. 
-আমি আপনাকে চিনি না! কি করে যাই আপনার সাথে !
এদিকে বাইরের অবস্থা আরও জটিল হতে শুরু করেছে।
-এই নষ্ট মেয়ে ছেলে দেখে আবার নষ্ট হলি নাকি ! বের.. বেরিয়ে আয়ে বলছি !
নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না অর্ক । মেয়েটার হাত ধরে বাইরে নিয়ে এল। সকলের সামনে চিৎকার করে বলল ,
-ওকে আমি নিয়ে যেতে এসেছি। এরপর যদি আপনারা কেউ একটুও বাড়াবাড়ি করেন আমি প্রশাসন ডাকতে বাধ্য হব, এই বলে দিলাম ! মোড়ল মশাই, শেষ বারের মতো বলছি – এদের সবাইকে নিয়ে এক্ষুনি এখান থেকে চলে যান ।
পুলিশের নাম শুনে মোড়লও আর সাহস পেল না। আসতে আসতে সামনেটা ফাঁকা হয়ে গেলো !

তিন)
গাড়ি চালাতে চালাতে মেয়েটার দিকে চোখ পড়ল অর্ক-র। ঘুমিয়ে পড়েছে ! অত্যাচারের নিষ্ঠুর চিহ্নগুলো ভেদ করে ওর সুন্দর মুখশ্রীটা ক্রমশ ফুটে উঠছে। কিছুই নেই মেয়েটার জীবনে.. সে যাই হোক, ওকে সমাজে প্রতিষ্ঠা দেওয়া‌ই এখন মূল লক্ষ্য। পাশেই রাখা আছে অস্থি। নিত্যানন্দের ব্যাপারে সে আর কিছু বলেনি মেয়েটাকে। একজন কতটা অভাগী হলে নিজের বাবার অস্থিটুকুও বিসর্জন দিতে পারে না! 
ফোন বেজে উঠল ,
-বাবা তুই কোথায় ?
-ফিরছি মা.. 
বাতাসের সাথে ভেসে আসছিল একতারার সুর আর সেই কণ্ঠ যা অর্ক-র চেনা।
” বাদল বাউল বাজায় রে একতারা
সারা বেলা ধরে ঝরোঝরো ঝরো ধারা ।।
জামের বনে ধানের ক্ষেতে আপন তানে আপনি মেতে,
নেচে নেচে হল সারা ।।”

(সমাপ্ত)

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait