অন্যান্য দেবতাদের থেকে মহাদেব স্বতন্ত্র কেন!

অন্যান্য দেবতাদের থেকে মহাদেব স্বতন্ত্র কেন!

শিবোহম 

শিব! এক অনন্ত সত্ত্বা। এক অখণ্ড মনোযোগ। এক নিঃস্বার্থ ব্যক্তিত্ব। এক অলৌকিক পুরুষ।

তাঁর জন্ম সম্বন্ধে বিষ্ণুপুরাণ বলছেন, নারায়ণ নিজে নিজেকে তিনভাগে বিভক্ত করে থাকেন। তাঁর মধ্যে একভাগ হলেন আদিদেব শিব।তিনি জন্মমৃত্যু রহিত, তাই 'অজাত'।  ইনি সকলের ঈশ্বর বা প্রভু বলে 'সর্বেশ'। যেহেতু তিনি পুরে বা শরীরে বাস করেন, তাই তিনি 'পুরুষ'। অনুৎপন্ন এবং পূর্বতন হওয়ার জন্য তিনি 'স্বয়ম্ভু'। শত বৎসর ধরে চেষ্টা করলেও সেই স্বয়ম্ভুর আদিকালের সংখ্যা নির্ণয় করা সম্ভব নয়।

ধ্যানযোগ। যাঁর মূর্তি বা ছবির মাধ্যমে সমধিক প্রকাশিত। চক্ষু দুটি ইষৎ উন্মিলিত। সর্বাঙ্গে বিভূতি। কৈলাশের প্রচন্ড ঠান্ডায় বসে ধ্যান করছেন।মস্তকে চন্দ্র, জটায় মা গঙ্গাকে ধারণ করেছেন জীবের কল্যাণের জন্য।পেশীবহুল চেহারা। অত্যন্ত গৌরবর্ণ। ললাটের তৃতীয় নেত্রখানি বন্ধ। সে নেত্র খুলে গেলে প্রলয় হয়। প্রলয়কালে নটরাজ মূর্তি ধারণ করে মহাকাল নৃত্য করেন মহাকালীর সঙ্গে। কাঁধে শেষনাগ বাসুকি, পদতলে নন্দী মহারাজ, যিনি আদতে ষাঁড়, কিন্তু মহা শক্তিশালী। এক হাতে ডমরু, অন্য হাতে ত্রিশূল। বলা হয় সেই ডমরুর নিনাদই হলো বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের আদি শব্দ 'ওম'। সেই ত্রিশূলের তিনটি ফলা থেকে বের হয় শক্তিস্রোত। নিজ গবেষণায় তৈরী করেছেন ভীষণ অস্ত্র 'পাশুপত'। তাঁর নাম পশুপতি, সেই থেকে অস্ত্রের নাম। সমস্ত বিশ্বকে ধ্বংস করে দিতে পারে এই ভীষণ অস্ত্র। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে এই অস্ত্র দরকার হবে তৃতীয় পান্ডব অর্জুনের। মহাদেব রীতিমত পরীক্ষা করে তবেই অর্জুনকে সে অস্ত্র দেবেন, নারায়ণের অনুরোধে। এই হলেন মহাদেব, পুরাণ এঁর বর্ণনা এভাবেই দেয়।

ADVERTISEMENT

 

আরও পড়ুন : পুরাণে বর্ণিত দেব দেবীর পরিচয় ও বৈদিক দেবদেবী

 

সমুদ্রমন্থন পর্ব চলছে। দেবাসুর দুই দল মিলে অমৃত মন্থনের কাজে লিপ্ত। শেষনাগ বাসুকি মন্থনের রজ্জু হয়েছেন, শ্রী ভগবানের কূর্ম অবতারের পিঠে মন্দার পর্বত কে বসিয়ে মন্থন শুরু হলো। সেই মন্থনের প্রাবল্য সহ্য করতে না পেরে বাসুকি নাগের মুখ দিয়ে জগৎ বিধ্বংসকারী হলাহল বিষ নির্গত হতে থাকলো। দেবতারা এই ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তাঁরা মন্থন থেকে প্রাপ্ত অমৃতের ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে তখন চিন্তিত। এদিকে সৃষ্টি তো লয় পেতে বসেছে! নারায়ণ চিন্তিত হলেন। এই বিপদ থেকে একজনই এখন উদ্ধার করতে পারেন। দেবাদিদেব মহাদেব। নারায়ণের কথা শুনে মহাদেব সেই তীব্র বিষ নিজ কণ্ঠে ধারণ করলেন। কিন্তু ওই বিষ তাঁর শরীরে গেলে তাঁর অস্তিত্ব বিপন্ন হতে পারে। এবারে স্বয়ং মহাকালী নিজের ক্রোড়ে মহাদেব কে আশ্রয় দিলেন, মাতৃরূপিণী হয়ে। মহাদেব সুস্থ হলেন। এবং নিজ যোগবলে ওই বিষকে নিজের শরীরে ঢুকতে দিলেন না, এবং বাইরেও বের করে দিলেন না। নিজ কণ্ঠে ওই বিষ ধারণ করে হলেন 'নীলকণ্ঠ'। এই ত্যাগই শিবের আদর্শ। সবাই অমৃতপানে ব্যাস্ত, কিন্তু তিনি ধারণ করলেন কালকূট বিষ।

 

আরও পড়ুন : প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য পুরাণে সূর্য দেবতার পূজার এই ব্যাখ্যা পাওয়া যায়

 

প্রলয়ের কর্তা তিনি কিন্তু বারে বারে জগৎ রক্ষা হেতু নিজেকে নিঃশেষ করে শিবত্বে উন্নীত হয়েছেন। দক্ষিনেশ্বরে ঠাকুরের গলরোগ হয়েছে, দেহত্যাগের দেরি নেই বিশেষ। নরেনকে একদিন নিভৃতে ডাকলেন। নরেনের কথায়, এক তীব্র শক্তি ঠাকুরের শরীর থেকে তাঁর শরীরে ঢুকে যেতে লাগল। তিনি বাহ্যজ্ঞান হারালেন। ঠাকুর বললেন, নরেনকে সব দিয়ে তিনি ফকির হলেন। স্বামী বিবেকানন্দ উত্তরকালে বলবেন, ঠাকুর যাকে 'কালী' বলতেন, সেই শক্তি তাঁর শরীরে সেদিন ঢুকে গেছিল। ঠাকুরও তো ফকির হলেন, বিলিয়ে দিলেন নিজেকে নরেনের মধ্যে, জীবের কল্যাণের স্বার্থে। লক্ষ লক্ষ মানুষের পাপ নিজ দিব্য শরীরে গ্রহণ করে, জীবের কল্যাণার্থে ষোলোজন সন্ন্যাসী সন্তানকে ঐক্যবদ্ধ করে, মাতৃত্বের আদর্শ হিসাবে শ্রীমা কে তুলে ধরে তিনি নিজ কণ্ঠে কালকূট রোহিনীরোগ (ক্যান্সার) ধারণ করলেন। এই ঠাকুরই তো নরদেহে স্বয়ং সেই স্বয়ম্ভু, যিনি 'নান্তম না মধ্যম না পুনস্তবাদিম'। আর শ্রীমা ই তো মহাদেবী, যিনি ঠাকুরের রোগের সময় আবারও মাতৃরূপিণী হয়ে তাঁর দায়িত্ব তুলে নিলেন আবার।

তিনিই শিব, যিনি একাধারে শক্তির সাথে মিলিত হয়ে জগৎপ্রপঞ্চের বিলয় ঘটান। সেই অর্ধনারীশ্বর রূপের পূজা আজ। মহা শিবরাত্রি। যে পূজা করলে মানুষ মৃত্যুভয়রহিত হয়। জন্মমৃত্যুর চক্র থেকে মুক্ত হয়।

শিব হলেন শক্তি, শিব হলেন তেজ। শিব হলেন ত্যাগ, যিনি জীবের কল্যাণার্থে নিজেকে অকাতরে বিলিয়ে দেন। বারবার। প্রতিবার।

সেই আদিদেব মহাদেব এবং মহাদেবীকে মহা শিবরাত্রির পুণ্যলগ্নে অন্তরের প্রণতি জানাই।

 

ছবি : ইন্টারনেট

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait