ভৌতিক ছোট গল্প – তুমি আছো

ভৌতিক ছোট গল্প – তুমি আছো

আজ স্মৃতিকণা দেবীর প্রথম মৃত্যু বাষির্কী। সেই উপলক্ষ্যে স্মৃতিকানার দুই মেয়ে,এক ছেলে, জামাই,বৌমা, নাতি,নাতনিরা সবাই এসেছে।

স্মৃতিকণা আর সমরেশের তিন ছেলে মেয়েই কলকাতার বাইরে থাকে। দুই মেয়ে ব্যাঙ্গালোর আর চেন্নাইতে আর ছেলে আমেরিকাতে থাকে। এই বাড়ীতে স্মৃতিকণা আর সমরেশ থাকে।

আজ থেকে একবছর আগে যখন স্মৃতিকণা মারা যায়, তখন তারা ব্যাঙ্গালোরে বড় মেয়ের বাড়ীতে বেড়াতে গিয়েছিলো। এই বাড়ীর প্রতি স্মৃতিকণার অসম্ভব ভালোবাসা ছিলো। তাই সে বাড়ী ছেড়ে খুব একটা ঠাঁই নাড়া হতে চাইতো না। এ বাড়ীর বাগান, ঠাকুরঘর, পাড়া প্রতিবেশী সব নিয়েই ছিলো তার জগৎ। এই নিয়ে ছেলে মেয়েদেরও অভিযোগ কম ছিলোনা। গত বছরই প্রথম ছেলের ওখান যায় ওরা। ওখান থেকে প্রথমে ছোট মেয়ের বাড়ী তারপর বড় মেয়ের বাড়ী যায়। সেখানেই একরাতে কার্ডিও অ্যারেস্টে মারা যায় স্মৃতিকণা। ছেলে আসতে পারে নি বলে মেয়েরা ওখানেই স্মৃতিকণার পরলৌকিক কাজ করে। কিন্তু সমরেশের ব্যাপারটা ভালো লাগেনি। তাই স্মৃতিকণার বার্ষিক কাজটা এবার তাদের কলকাতার বাড়ীতেই হবে। এরপরেই এই বাড়ী বিক্রি করে দেওয়া হবে। কারণ সমরেশকে একা এতো দূরে ফেলে রাখতে তার ছেলেমেয়েরা কেউই রাজি নয়। সমরেশকে এই বাড়ীঘর পাড়া প্রতিবেশী সব ছেড়ে নতুন জায়গায় থাকতে হবে। কথাগুলো ভেবে অকারণেই মনটা ভারী হয়ে যায় সমরেশের।

ADVERTISEMENT

আজ সকালে একটা কান্ড ঘটে। শ্রাদ্ধে দানে দেবে বলে একটা লাল রংয়ের চওড়া ভেলভেট পাড়ের শাড়ী কেনা হয়েছিলো। শ্রাদ্ধের সব কিছু ছেলে মেয়েরাই কিনেছ। সমরেশ এসবের কিছুই দেখে নি। আজ সকালে সমরেশের বৌমা শ্রাদ্ধের সব জিনিষপত্রের সাথে শাড়ীটাও ওদের ড্রয়িংরুমে রাখে। সমরেশ শাড়ীটা দেখে কৌতুহলি হয়ে হাতে তুলে নিলেন। শাড়ীটা দেখতে দেখতে তার মনটা ত্রিশ বছর পিছিয়ে গেলো।

সেবার পূজার কাপড় কিনতে সমরেশ তার দুই বোন আর স্ত্রীকে নিয়ে দোকানে গিয়েছিলো। সমরেশের দুইবোনের কাপড় কেনা হয়ে যাওয়ার পর স্মৃতিকণাকে সমরেশ শাড়ী পছন্দ করতে বলে। উনিশ বছরের সদ্য যুবতী স্মৃতিকণা সেদিন এই রকমেরই একটা শাড়ী পছন্দ করেছিলো। সরকারী অপিসের সামান্য কেরানী সমরেশের সেদিন ভেলভেট পাড়ের শাড়ী কিনে দেবার ক্ষমতা ছিলো না। বলেছিলো পরে কিনে দেবে। তারপর যখন সংসারে স্বাচ্ছন্দ্য এলো, তখন স্মৃতিকণা প্রায় বিগতযৌবনা নারী। ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে গেছে। মধ্যবিত্ত বাড়ীর আটপৌরে জীবনে অভ্যস্থ স্মৃতিকণার শাড়ীর রং হালকা হয়েছে। তাই গাঢ় লাল রংয়ের ভেলভেট পাড় শাড়ী স্মৃতিকণার আর পরা হয় নি।কাপড়টা হাতে নিয়ে, সেই কথাই ভাবছিলো সমরেশ। খুব অনুতাপ হচ্ছিলো তার। যে মানুষটা সারা জীবন ধরে এতো কিছু করলো, তাকে একটা লাল ভেলভেট পাড় শাড়ী কি কিনে দিতে পারতো না সে? স্ত্রীর প্রতি তার উদাসিনতার কথা ভেবে চোখে জল চলে আসে তার। এমন সময় দেখে কাপড়টার এক জায়গায় ছেঁড়া। এ বাবা! এতো সুন্দর শাড়ীটা ছেঁড়া?সমরেশ তার পুত্র বধুকে ব্যাপারটা দেখানোর পর সে ওই শাড়ীটা সমরেশকে নিজের কাছে রাখতে বলে। বলে বিকেল বেলায় ওটা দোকান থেকে পাল্টে আনবে। এরপর সারা দুপুর ধরে অতিথিরা এসেছে। স্মৃতিকণার নানা স্মৃতি চারণ করেছে। তারপর আস্তে আস্তে সবাই বিদায় নিয়েছে।

এখন প্রায় সন্ধ্যা। শ্রদ্ধের কাজ শেষ হয়ে গেছে। এখন ছেলেমেয়েরা, স্মৃতিকণা যা, যা খেতে ভালোবাসতো সব খাবার গুছিয়ে নিয়ে নদীর ঘাটে গেছে। সেখানেই তার উদ্দেশ্যে সব খাবার দেওয়া হবে। বাড়ীতে এখন কেবল সমরেশ একা।

সবাই চলে যাওয়ার পর সমরেশ বিশ্রাম নেওয়ার জন্য নিজের ঘরে এলো। তার প্রিয় ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে বসে চোখটা একটু লেগে আসছিলো। হঠাৎ করেই শোনে,হাওয়ায় জানালা দামাদম পিটাচ্ছে। কারেন্টও চলে গেলো। সমরেশ চোখ খুলে দেখে ঝড় উঠেছে। সে তাড়াতাড়ি জানালাগুলো বন্ধ করে দেয়। এমন সময় দেখে জানালার পাশের টেবিলে সকালের লাল শাড়ীর প্যাকেটটা পরে রয়েছে। সমরেশ প্যাকেটটা তুলে দেখে প্যাকেটটা হালকা লাগছে। প্যাকেটের মধ্যে হাত দিয়ে দেখে কাপড়টা নেই। কাপড়টা কোথায় গেলো? একটু ঘাবরে যায় সমরেশ। তারপর ভাবে হয়তো বৌমা কাপড়টা সরিয়ে রেখেছে। এমন সময় নীচে ভারী কিছু একটা পরার শব্দ পায়।

তাড়াতাড়ি মোবাইলের টর্চটা জ্বালিয়ে নীচে আসে সমরেশ। চারিদিকে মোবাইলের ক্ষীণ আলোয় দেখে, স্মৃতিকণার যে ছবিটা বড় করে, লেমিনেশন করে এনে ড্রইং রুমে রাখা হয়েছিলো, সবাই মালা দিয়েছিলো। সেই ছবিটা উল্টে পরে রয়েছে। সমরেশ টর্চটা এক জায়গায় রেখে ছবিটা তুলে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দেয়। এরপর সমরেশের চোখ ছবিটার দিকে গেলে চমকে উঠলো সে। এ কি! এটা তো সেই লাল শাড়ীটা। ফোটোটাতে এই শাড়ীটা পরালো কে? টর্চের আলোয় সমরেশ ভালো করে দেখলো। হ্যাঁ সত্যিই তো ফটোটার গায়ে লাল শাড়ী জড়ানো। আর তার পাশে ওটা কি? ছবির পাশের টেবিলের উপর হাত বাড়িয়ে দেখে, এতো সকালের ব্লাড প্রেশারের ওষুধটা! সমরেশের মনে পরলো, সত্যিই তো! আজ তো, সে সকালে ব্লাড প্রেসারের ওষুধ খায়নি ! সমরেশের সারা শরীর কাঁপতে লাগলো।

এমন সময় দরজার কলিংবেল বেজে উঠলো। সমরেশ আবাক হয়ে গেলো। কারেন্ট নেই, কিন্তু বেল বাজছে কি করে? বার কয়েক বেল বাজানোর পর নাতিদের গলার আওয়াজ পেলো সমরেশ। তারাতাড়ি গিয়ে দরজা খুলে দিলো। এমন সময় আলোও জ্বলে উঠলো। সমরেশের ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে সবাই জিজ্ঞাসা করলো, তার কি হয়েছে?সমরেশ কোন উত্তর না দিয়ে ড্রয়িং রুমে চলে এলো। সেখানে এসে দেখলো কোথায় সেই কাপড়? ছবিটা তো এমনিই মালা পরানো অবস্থায় রয়েছে। সমরেশের বৌমা বললো,”বাবা, সকালের ওই কাপড়টা দিন, ওটা দোকান থেকে পাল্টে আনি।” সমরেশ বললো, “না বৌমা। ওই কাপড়টা পাল্টাবে না। ওই কাপড়টা এই ছবির গায়ে জড়িয়ে দেও।” তারপর ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে বললো, “আমি এই বাড়ী বিক্রি করবো না রে। আমি একাই এখানে থাকতে পারবো। তোরা আমার জন্য ভাবিস না।” তারপর মনে মনে বললো, “তুমি আছো স্মৃতিকনা। সশরীরে হয়তো নেই। তবে অশরীরী হয়ে আছো। চিন্তা করো না। আমি তোমাকে ছেড়ে যাবো না।”

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait