গল্প প্রতিযোগিতা   অপরাধ

গল্প প্রতিযোগিতা অপরাধ

সেই তার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল সুমন্ত স্যরের বাড়িতে। তখন আমি বাংলা সাহিত্যের ছাত্র। সাহিত্য পড়ে ভেসে গিয়েছিলাম। হাল্কা গোঁফ গজিয়েছে। কাঁধে ঝোলা ব্যাগ। খেস বা খদ্দরের পাঞ্জাবিতে কী যে ব্যাপার ছিল জানি না, মেয়েরা ঝপাঝপ আমার প্রেমে পড়তে শুরু করল। কচি বয়স। তেমন সাহস ছিল না। তবু প্রেমকে ঠেকাতে পারেনি কেউ। কিন্তু প্রেম যেন আমার জীবনে অভিশাপ হয়ে নেমে এল। সপ্তাহে দু’দিন পড়তে যেতাম। সোম আর শুক্র। এক শুক্রবার পড়ে স্যরের ঘর থেকে বেরিয়েছি। দেখি সাইকেলটা পাংচার হয়ে গেছে। হেমন্তের বিকেল। সাড়ে পাঁচটাতেই আকাশের আলো নিভে এসেছে। সাইকেল নিয়ে হেঁটেই রওনা দিলাম। হঠাৎ খেয়াল করলাম পাশে পাশে সাইকেল নিয়ে শাল্মলীও হেঁটে চলেছে। বললাম,
-“তুইও হেঁটে যাচ্ছিস  যে?”
ও বলল,
-“এমনি।” 
এখানে বলি, ক’দিন ধরে শাল্মলীর আচরণে অন্য কিছু লক্ষ করছি। স্যরের কাছে আগে আগে এসে নিজের পাশে আমার জায়গা রেখে দিচ্ছে। খাতা নেওয়ার ছলে হাতটা একটু ছুঁয়ে দিচ্ছে। স্যরের ঘর থেকে হৈ হৈ করে বেরোনোর সময় শাল্মলী আমার খুব কাছে ঘেঁষে আসছে। গায়ে গা ঠেকে যাচ্ছে। এ সবই আমি বুঝতে পারছি। সেদিন আমি আর শাল্মলী নিঃশব্দে পাশাপাশি হাঁটছিলাম। শাল্মলী ফিসফিস করে বলল,
-“মৈনাক, এখনি বাড়ি যেতে হবে না। চল না রে কফি শপে গিয়ে একটু বসি।” 

ADVERTISEMENT

আটকাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কারণটা তেমন জোরদার হল না। কফি শপের কাছে এসে শাল্মলী রীতিমতো জোর করতে লাগল।
-“প্লিজ মৈনাক, এমন দিন আবার কবে আসবে! না বলিস না।”
এড়াতে পারলাম না। ঢুকলাম কফি শপে। মুখোমুখি না বসে শাল্মলী আমার পাশের চেয়ারে বসল। সাধারণত দুটো চেয়ারের মাঝখানে যতখানি ব্যবধান থাকে তা আমাদের চেয়ারের মাঝে রইল না। শাল্মলী হেসে হেসে ঢলে পড়তে লাগল আমার গায়ে। বারবার কপট আঘাত করতে লাগল। সেই ছলে ছুঁয়ে যেতে লাগল আমার কাঁধ, পিঠ, হাত। জানতে চাইল,
-“তুই কখনো কারুর প্রেমে পড়েছিস?” 
ছোট্টো করে বললাম,
-“না।” 
সে বলল,
-“সেকী রে? এত সুন্দর চেহারা তোর। কেউ তোর প্রেমে পড়েনি?
-“জানি না।
-“আমি কিন্তু একজনের প্রেমে পড়েছি।”
অপাঙ্গে দেখে নিল আমাকে। চুপ করে আছি দেখে বলল,
-“জানতে চাইবি না, কে?”
গলা খাঁকরে ভাবলেশহীন গলায় জিজ্ঞেস করলাম
-“কে?”
শাল্মলী বলল,
“থাক। আজ আর শুনতে হবে না। অন্য আরেক দিন বলব তার কথা।”
সে কী বলতে চেয়েছিল, আমি তা বুঝেছিলাম। শাল্মলী এত ইঙ্গিত দেওয়ার পরেও আমি এতটুকু এগোতে পারিনি। তারপরেও শাল্মলী বোঝানোর চেষ্টা করেছে বহু বার। আমি বুঝেও বুঝিনি। আমি তখন নিজের মন বোঝার প্রাণপণ চেষ্টা করছিলাম। শাল্মলী একদিন সৌরভকে আশ্রয় করল। আমি তার সাক্ষী হয়ে থাকলাম।


শাল্মলীর পরেও অনেকে এসেছে। এসেছে মধুলিকা। তার সঙ্গেও আলাপ সেই পড়ার ব্যাচেই। একদিন পড়তে গিয়ে দেখি মধুলিকা আসেনি। তার পরদিন মধুলিকার ফোন এল।
-“হ্যালো, মৈনাক?”
-“হ্যাঁ, কাল পড়তে এলি না কেন?”
-“আমার জ্বর হয়েছে রে।”
-“ও।”
কয়েক সেকেণ্ডের পজ। মধুলিকা বলল,
-“তুই একবার নোটসের খাতাটা নিয়ে আসবি রে আমার বাড়িতে?”
-“এখন?”
-“আয় না! তাহলে কালকের উত্তরটা লিখে নিতাম।”
ভরদুপুরে সাইকেল নিয়ে নোটসের খাতা নিয়ে বেরোলাম। ওদের বাড়িতে আগেও গেছি। মধুলিকার জন্মদিনে। বন্ধুদের সঙ্গে। তাই বাড়িটা আগে থেকেই চিনতাম। মধুলিকাদের বাড়িতে পৌঁছে বেল বাজানো মাত্র মধুলিকা এসে দরজা খুলে দিল। ভেতরে ঢুকলাম। বিশাল বাড়িটা খাঁ খাঁ করছে। মধুলিকা বলল,
-“বাড়িতে কেউ নেই।” 
কথাটা আমার ভালো লাগল না। মধুলিকা আমার হাত ধরে এনে সোফায় বসাল। বললাম,
-“চটপট লিখে নে। আমাকে ফিরতে হবে।”
-“এত তাড়া কীসের? তুই যেন কী!”
-“তুই তো নোটস লিখবি বলেই আমাকে ডাকলি?”
-“তা তো লিখবই। তার আগে আমার কপালে উত্তাপ দেখবি না? বললাম যে আমার জ্বর হয়েছে!”
আমি ঘামতে লাগলাম। তার মধ্যে লেখার কোনো লক্ষণই দেখলাম না। মধুলিকা আমার ডানহাতটা টেনে নিয়ে নিজের কপালে রেখে বলল,
-“বল তো আমার এখন কত জ্বর?”
তারপর কোথা থেকে কী হয়ে গেল। হঠাৎই উপলব্ধি করলাম আমার ঠোঁটে এক সুগভীর চুম্বন এঁকে দিয়েছে মধুলিকা। আমি এলোমেলো হয়ে সোফায় এলিয়ে পড়েছি। কোনো রকমে নিজেকে টেনে তুললাম। পেছন থেকে মধুলিকা ক্রমাগত থামাতে চাইছিল আমাকে। প্রচণ্ড চেষ্টায় বেরিয়ে এসেছিলাম সেখান থেকে। নোটসের খাতা সেখানেই পড়ে ছিল। আমি দিশেহারা ভাবে সাইকেল চালিয়ে বাড়ি এসেছিলাম। বাথরুমে ঢুকে হড়হড় করে বমি করেছিলাম। বার বার সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলেছিলাম ঠোঁট। সেদিনের পর থেকে মধুলিকা আমার সঙ্গে আর কথা বলেনি।
আমার কাছে শেষ এসেছিল ঋতাভরী। তখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। সাহিত্য মজ্জায় বসে গেছে। তখনো সুমন্ত স্যারের বাড়িতে পড়তে যাই। স্নাতকোত্তরে স্যারের কাছে ঋতাভরী নতুন পড়তে এসেছে। একদিন ও জোর করে আমাকে ভিক্টোরিয়ায় নিয়ে গেল। একটা গাছের আড়াল খুঁজে বসেছি দু’জনে। মানে ঋতাভরীই নিরালা খুঁজে বসার ব্যবস্থা করেছে। আমার আপত্তির কথা পরিষ্কার করে বলতে পারিনি। ঋতাভরী বাঁপাশে বসে আলতো করে আমার হাতটা ধরল। আমি কাঠ হয়ে গেলাম। ঋতাভরী আমার চোখে চোখ রাখল। বলল,
-“মৈনাক, আমাকে তুই কতখানি ভালোবাসিস?” 
তার গলাটা আবেগে বুজে এল। আমি কোনো উত্তর খুঁজে না পেয়ে চুপ করে রইলাম। ঋতাভরী ভাবল এটাই আমার ভালোবাসার প্রকাশ। সে আস্তে করে আমাকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটের কাছে মুখটা নিয়ে এল। আমি ছিটকে উঠে দাঁড়ালাম। মধুলিকার স্মৃতি মনে পড়ে গেল মুহূর্তে। তীব্র বিবমিষা আমাকে গ্রাস করে নিল। ঋতাভরী এর জন্য প্রস্তুত ছিল না। প্রথমটা হতভম্ব হয়ে গেল। তারপর বলল,
-“এটা কী হল?”
-“কী?”
-“তুই কি ন্যাকা?”
আমি কোনো কথা বলতে পারলাম না। সে আবার বলল,
-“তুই একটা কাপুরুষ। ক্লীব একটা। একজন মেয়ের সান্নিধ্যে এসেও…”
এর বিরুদ্ধেও আমি একটাও কথা বলতে পারলাম না। তাতে ঋতাভরী আরো রেগে উঠল। বলল,
-“আমাকে তুই অপমান করেছিস মৈনাক।”
এতক্ষণে আমার কথা ফুটল।
-“আ-আমি!”
-“ইয়েস। ইউ। ইউ।”
-“কীভাবে?”
-“কীভাবে! জিজ্ঞেস করতে লজ্জা করছে না তোর? আমাকে পছন্দ না হলে কেন ভিক্টোরিয়ায় এসে আমার সঙ্গে একান্তে বসলি?”
-“আমি কোথায় একান্তে বসলাম?”
-“তুই না তো কে? উত্তর দে। কে আমার সঙ্গে বসেছিল?”
আমি কিছুতেই ঋতাভরীকে বোঝাতে পারলাম না, মন না চাইলেও আমি তাকে এড়াতে পারিনি। এটাই আমার সঙ্গে বারবার হয়ে এসেছে। সে আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। বলল,-“আমার মধ্যে কী নেই তোকে বলতেই হবে। বল? কী নেই আমার মধ্যে?” 
সে আমাকে দু’হাত দিয়ে ধরে জোরে জোরে ঝাঁকাতে লাগল। আমি অস্ফুটে কিছু বলতে গেলাম। সে আমাকে সজোরে জাপটে ধরল। আঁচড়ে কামড়ে আমাকে ক্ষত-বিক্ষত করে দিল। আমি কাঠের অধিক কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম ঠায়।


শাল্মলী, মধুলিকা, ঋতাভরী এরা সকলেই খুব ভালো। স্মার্ট, প্রগতিশীল, আধুনিকা, সুশ্রী। তবু আমি বুঝে উঠতে পারিনি কেন এদের কারুর গভীরে আমি ডুব দিতে পারলাম না!কারুর সঙ্গেই প্রেম হল না আমার।
যাই হোক আবার একদিন সুমন্ত স্যরের বাড়িতে পড়তে গেছি। দরজার পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকল এক যুবক। শুনলাম এম.ফিল. করছে। কী বলিষ্ঠ গঠন। পরনে নীল পাঞ্জাবি, মাখন রঙের জিন্স। মুখে যত্ন লালিত দাড়ি-গোঁফ। এক কথায় যে-আমাকে দেখে মেয়েরা প্রেমে পড়ত, এই ছেলেটির চেহারা তার চেয়েও সুন্দর, মোহময়। তার সঙ্গে স্যার পরিচয় করিয়ে দিলেন। ও হল জিষ্ণু। চোখাচোখি হতেই  যেন শিহরণ জাগল। মেয়েরা তার জন্য পাগল হল। মধুলিকাকেও দেখতাম জিষ্ণুর প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েছে। আমি সাহস করে তার কোনো দিন কথা বলে উঠতে পারিনি। অথচ কথা বলতে ইচ্ছে করত খুব। তবে সে সুযোগ ঘটে গেল সহজে। 
একদিন স্যরের ব্যাচ থেকে সবাই পিকনিকে গেলাম। সেখানে সবার চোখ এড়িয়ে নদীর ধারে দেখা করলাম জিষ্ণুর সঙ্গে। জিষ্ণু একা দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিল। কিছু কথা ছিল। না বললেই নয়। সংকোচ যে হচ্ছিল না তা নয়। তবু যা অবস্থা তাতে না বলেও উপায় ছিল না। দিনটা আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে। ঝরাপাতা বিছনো রাস্তায় হাঁটছিলাম জিষ্ণুর সঙ্গে। হাঁটতে হাঁটতে বলেছিলাম,
-“এই যে, একটু শুনবে? তোমাকে একটা কথা বলব।” 
সে শব্দ করে হেসে উঠেছিল।
-“কী বলবি? বল না। কত বার তোকে বলেছি যে আমাকে জিষ্ণুদা বলবি? তুই আমার কাছে ফ্রি হতে পারিস না কেন বল তো?” 
আমার মুখচোখ বোধ হয় লাল হয়ে গিয়েছিল লজ্জায়। সে আবারও হাসল। বলল,


-“কী রে? তোকে এরকম দেখাচ্ছে কেন রে? নার্ভাস লাগছে?”
-“মানে। ওই আর কী। একটু।”
আমতা আমতা করে বললাম কথাগুলো। সে বিস্মিত হয়ে বলল,
-“অ্যাঁ! সত্যি নার্ভাস লাগছে তোর? কেন?”
-“তোমাকে একটা কথা বলব।”
-“কী এমন কথা? টাকাপয়সা সংক্রান্ত?”
-“না না।”
-“তবে? করুর প্রেমে পড়েছিস?”
-“হুঁ।”
-“উঁ? কার রে?”
জিষ্ণু ভ্রূকুটি করল।
-“ত্-তোমাকে…তোমাকে…”
-“তোতলাচ্ছিস কেন? বল? কী আমাকে? সাহায্য করতে হবে? কাব্য করে প্রেমপত্র লিখে দিতে হবে?”
-“ন্-না।”
-“তাহলে?”
-“তোমাকে ভালোবাসি।”
-“মানে? কী বলছিস আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না!”
এবারে আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না। জিষ্ণুকে জড়িয়ে ধরে পাগলের মতো বলতে লাগলাম আমার ভালোবাসার কথা, ভালো লাগার কথা। কিন্তু অত জন মেয়েকে আমি প্রত্যাখান করেছি। তাদের অভিশাপ লাগল আমার ওপর। সে আমাকে প্রত্যাখান করল। করবে যে তাও এক প্রকার জানতামই। তবু ব্যথা পেলাম খুব। তবে পরের ঘটনাটা যে ঘটবে তা ভাবতেও পারিনি। সেই দিন পিকনিক থেকে আরম্ভ করে যখন যেখানে দেখা হয়েছে, সে সকলের কাছে সমকামী বলে আমাকে চিনিয়ে দিয়েছে। সেই তকমা আজও আমি গায়ে বয়ে বেড়াচ্ছি। সমকামী হওয়াটা কি অপরাধ? আমার কি প্রেমে পড়া বারণ? কীভাবে পাল্টাবো নিজেকে? সে-ই শুধু নয়, আরো অনেকে এসেছে আমার জীবনে। উঁহু, ভুল বললাম। আমি গেছি তাদের জীবনে। সংগীত, অরিন। ওরা সকলেই প্রথমে ভীষণ চমকে গেছে। তারপর প্রত্যাখান করেছে। অবশেষে করেছে ব্যঙ্গ। অত জন মেয়েকে ফিরিয়ে দিয়েছি আমি। আমাকে তো ফিরে আসতেই হবে। আমার জীবনে যে অভিশাপ লেগে গেছে! সেই থেকে একা থাকি। নাহলে আবার কাউকে ভালোবাসবার মতো ভীষণ অপরাধ করে ফেলব হয়তো।

  •  

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait