একদিন যারা মেরেছিল তাঁরে গিয়ে

একদিন যারা মেরেছিল তাঁরে গিয়ে

সাধারণ ব্রাহ্মসমাজভুক্ত বিশিষ্ট কর্মী অধ্যাপক ধীরেন্দ্রচন্দ্র চৌধুরী In search of Jesus নামে একটি সুবৃহৎ গ্রন্থ রচনা করে ঐতিহাসিক যীশুখৃষ্ট (Jesus Christ) যে অলীক কল্পনা সেটা একশ্রেণীর পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের বহু গ্রন্থ থেকে সংকলন করে প্রমাণ করেন। রবীন্দ্রনাথের (Rabindranath Tagore) সাথে সাক্ষাৎ করতে আসলে কবি তাঁকে বলেন যে, ইতিহাসে সেটাই সত্য যেটা মানুষ নিজের অভিজ্ঞতা বা বোধ থেকে সৃষ্টি করেছে। যীশু ছিলেন কি না সে প্রশ্ন সত্য নয়; এ কথা নিশ্চিত যে যীশুখৃষ্ট বহু মানুষের অন্তরে স্থান পেয়েছেন। যীশুর মহত্বই মানব হৃদয়ে সুপ্রতিষ্ঠিত।

 

কবি বলেন, “আমাদের জীবনে তাঁর জন্মদিন দৈবাৎ আসে, কিন্তু ক্রুশে বিদ্ধ তাঁর মৃত্যু সে তো আসে দিনের পর দিন। … লোভ আজ নিদারুণ, দুর্বলের অন্নগ্রাস আজ লুণ্ঠিত, প্রবলের সামনে দাঁড়িয়ে খৃষ্টের দোহাই দিয়ে মার বুকে পেতে নিতে সাহস নেই যাদের তারাই আজ পূজাবেদীর সামনে দাঁড়িয়ে মৃত্যুশূলবিদ্ধ সেই কারুণিকের জয়ধ্বনি করছে অভ্যস্ত বচন আবৃত্তি করে। তবে কিসের উৎসব আজ। … আজও তিনি মানুষের ইতিহাসে প্রতিমুহূর্তে ক্রুশে বিদ্ধ হচ্ছেন”।

ADVERTISEMENT

 

এই কথাই ‘মানবপুত্র’ (পুনশ্চ) কবিতায় প্রকাশ করেছিলেন (১৩৩৯ শ্রাবণ)।

মৃত্যুর পাত্রে খৃস্ট যেদিন মূত্যুহীন প্রাণ উৎসর্গ করলেন

রবাহূত অনাহূতের জন্যে,

তার পরে কেটে গেছে বহু শত বৎসর।

আজ তিনি একবার নেমে এলেন নিত্যধাম থেকে মর্তধামে।…

 

আমাদের ধর্মশাস্ত্রে বলে, ‘রুদ্র বলহীনকে ক্ষমা করেন না’। দুর্বলের অভিমান কবির কাছে অসহ্য। মানুষ চিরদিন দুঃখকে বরণ করেছে স্বেচ্ছায়। “সে কোন মহাশক্তির সাধনায়? সে শক্তি প্রাকৃতিক নয়, মানসিক নয়, সে আত্মিক। সেখানেই মানুষ আপন দেবতার সঙ্গে যুক্ত। আপনার মধ্যে যখন সেই মহত্ত্বের উপলব্ধি করে তখন সে কোনো ত্যাগে ক্লেশে দীনাত্মার মতো শোক করে না”। এটাই হচ্ছে এই জগৎব্যাপী অশান্তির দিনে কবির অন্তর্দেবতার বাণী। কবির এই অন্তর্বেদনা প্রকাশ পেয়েছে ‘বড়দিন’ কবিতায় খ্রীষ্ট-স্মরণে। বিশ্বব্যাপী যুদ্ধায়োজনে সকলেই দেবতার দোহাই পড়ছে – তারা দেবতার নামে নরহত্যা করে দেবতার আশীর্বাদ মাগিতেছি। কবি নিরতিশয় কাতর হয়ে লিখছেন:

একদিন যারা মেরেছিল তাঁরে গিয়ে রাজার দোহাই দিয়ে

এই প্রসঙ্গে মৈত্রেয়ী দেবী লিখছেন; “দুটি দিনের কথা আমার খুব মনে পড়ে। একটি গানের 'কথা' অবশ্য একটি কবিতা থেকে নেওয়া-- খৃষ্টের উপর পুনশ্চতে একটি কবিতা আছে 'মানবপুত্র' [রচনাকাল:  ৯ পৌষ, ১৩৪৬ (২৫ ডিসেম্বর, ১৯৩৯)]। বড় দিনের ঠিক আগের দিন, আমাকে বিকেলবেলা বললেন, "খৃষ্টের উপর আমার একটা গদ্যকবিতা কোথায় আছে বার কর”। আমার মনে ছিল, আমি বের করে দিলুম। তখন বললেন, "এবার তুমি যাও আমি একটা গান তৈরী করব কালকের জন্য, খৃষ্ট জন্মদিনে এই গানটি হলে সাহেব খুশী হবেন। "সাহেব অর্থ সি এফ এন্‌ড্রুজ। তিনি তখন শান্তিনিকেতনে ছিলেন। সেই সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঘনঘোর বিভীষিকা এঁদের দুজনের মনকেই ভারাক্রান্ত করে রাখত।  ...  কারণ সে সময় প্রতি পক্ষই অপরের নিধন ও নিজের সাফল্যের জন্য ধর্ণা দিচ্ছে।... সন্ধ্যেবেলা গান [একদিন যারা মেরেছিল] তৈরী হয়ে গেছে, গুন্‌গুন্‌ করছেন। ডেকে পাঠালেন ইন্দুলেখা দেবীকে [ঘোষ], তিনি তখন শান্তিনিকেতনে একজন প্রসিদ্ধ সুগায়িকা-- বার বার করে গলায় তুলে নিলেন ইন্দুলেখা দেবী। কবি বললেন, "কাল থেকে এ গান তোমার সম্পত্তি, আমি আবার গাইতে গেলে তুমি ভুল ধরবে”। 


১০ পৌষ [রবি 25 Dec 1910] মন্দিরে প্রথম খ্রীষ্টোৎসব পালিত হয়। রবীন্দ্রনাথ এই উপলক্ষে যে ভাষণ দেন তার সারমর্ম ‘যিশুচরিত’ নামে মুদ্রিত হয়। ঘটনাটি অভিনব। খ্রিষ্টধর্ম সম্পর্কে মহর্ষির বিরূপতা কোনো গোপন ব্যাপার ছিল না, খ্রিষ্টান হওয়ার কারণেই ব্রহ্মবান্ধব ও রেবাচাঁদকে ব্রহ্মচর্যাশ্রম থেকে বিদায় গ্রহণ করতে হয়েছিল। কিন্তু অসাম্প্রদায়িক মনোভাব-সম্পন্ন রবীন্দ্রনাথ পিতার এই গোঁড়ামির অংশীদার ছিলেন না। কিন্তু এর জন্য তিনি পিতাকে দায়ী করেননি। ইংরেজ-সংসর্গের প্রথম পর্বে বাঙালির স্বধর্মভ্রষ্টতার পটভূমি বর্ণনা করে তিনি উক্ত মনোভাবকে স্বাভাবিক বলেই মনে করেছেন: “আমাদের খৃষ্টের পরিচয় প্রধানত সাধারণ খৃষ্টান মিশনরিদের নিকট হইতে। খৃষ্টকে তাঁহারা খৃষ্টানি-দ্বারা আচ্ছন্ন করিয়া আমাদের কাছে ধরিয়াছেন। এ পর্যন্ত বিশেষভাবে তাঁহাদের ধর্মমতের দ্বারা আমাদের ধর্মসংস্কারকে তাঁহারা পরাভূত করিবার চেষ্টা করিয়াছেন। সুতরাং আত্মরক্ষার চেষ্টায় আমরা লড়াই করিবার জন্যই প্রস্তুত হইয়া থাকি”।

 

রবীন্দ্রনাথ বড়দিন বা যিশুখ্রিস্টের আবির্ভাব তিথিকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতেন। দেশে থাকলে তিনি যেমন বড়দিন পালন করতেন, তেমনি বিদেশেও তিনি বড়দিনের আয়োজন করতেন। তিনি একবার একটি চিঠিতে হেমলতা দেবীকে লিখেছেন,

আজ খৃষ্টমাস। এইমাত্র ভোরের বেলা আমরা আমাদের খৃষ্টোৎসব সমাধা করে উঠেছি। … আমরা তিনজনে আমাদের শোবার ঘরের একটি কোণে বসে আমাদের উৎসব করলুম— কিছু অভাব বোধ হল না— উৎসবের যিনি দেবতা তিনি যদি আসন গ্রহণ করেন তা হলে কোনো আয়োজনের ত্রুটি চোখে পড়েই না। তাঁকে আজ আমরা প্রণাম করেছি, তাঁর আশীর্বাদ আমরা গ্রহণ করেছি। আমরা একান্তমনে প্রার্থনা করেছি যদ্ ভদ্রং তন্ন আসুব। আমাদের সমস্ত ইচ্ছাকে নিঃশেষে পরাস্ত করে দিয়ে তাঁর ইচ্ছাকে আমাদের জীবনে জয়ী করুন, জীবন একেবারে পরিপূর্ণরূপে সত্য হোক।

 

রবীন্দ্রনাথ বাইবেল মন দিয়ে পড়েছিলেন। বাইবেলের ওল্ড টেষ্টামেন্ট অংশ তিনি পছন্দ না করলেও নিউ টেষ্টামেন্টে বর্ণিত যিশুচরিতের অলৌকিকতা-বর্জিত মানবপ্রেমিক রূপটি তাঁকে আকর্ষণ করেছে। গতবছর পৌষোৎসবের সান্ধ্য-উপাসনায় কথিত ‘ভক্ত’ শীর্ষক ভাষণে তিনি ‘মানুষের ধর্মরাজ্যে যে তিনজন মহাপুরুষ সর্বোচ্চ চূড়ায় অধিরোহণ করেছেন’ যিশুকে তাঁদের অন্যতম বলে ঘোষণা করেছিলেন, ‘যিশুচরিত’-এ তাঁর সাধনার ও বাণীর তাৎপর্য ব্যাখ্যা করলেন। রচনাটি অজিতকুমার চক্রবর্তী-প্রণীত ‘খৃষ্ট’ গ্রন্থের ভূমিকারূপে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু অজিতকুমার যে লিখেছেন: ‘১৩১৬ সালে মহাপুরুষদিগের জন্ম কিংবা মৃত্যু দিনে তাঁহাদিগের চরিত ও উপদেশ আলোচনার জন্য [শান্তিনিকেতনে] উৎসব করা স্থির হইল। খৃষ্টমাসে প্রথম খৃষ্টোৎসব হইল। তার পরে চৈতন্য ও কবীরের উৎসব হইয়াছিল।

 

৯ পৌষ [মঙ্গল 25 Dec 1923] - এবার বহু বছর পরে খ্রীষ্টোৎসবের দিন অ্যান্ডরুজ আশ্রমে ছিলেন না বলে রবীন্দ্রনাথ এই উপলক্ষে উপসনা করেন, তাঁর ভাষণটি চৈত্র-সংখ্যা শান্তিনিকেতন-এ ‘৯ই পৌষ / (খৃষ্টোৎসব)’ শিরোণামে মুদ্রিত হয়। ‘তাই তোমার আনন্দ আমার পর’ গানটি দিয়ে উৎসবের সূচনা করে রবীন্দ্রনাথ বলেন,

“দুইয়ের মধ্যে একের যে প্রকাশ তাই হল যথার্থ সৃষ্টির প্রকাশ। নানা বিরোধে যেখানে এক বিরাজমান সেখানেই মিলন, সেখানেই এককে যথার্থ ভাবে উপলব্ধি করা যায়”। 

 

কিন্তু মানুষ নানাভাবে এই সত্যের অবমাননা করেছে। খ্রীষ্টধর্মের দীর্ঘ ইতিহাস, বিশেষ করে প্রথম মহাযুদ্ধের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, “এই মহাত্মার বাণী যে তাঁর ধর্মাবলম্বীরাই গ্রহণ করেছিল তা নয়। তারা বারে বারে ইতিহাসে তাঁর বাণীর অবমাননা করেছে, রক্তের চিহ্নের দ্বারা ধরাতল রঞ্জিত করে দিয়েছে— তারা যিশুকে এক বার নয়, বার-বার ক্রুশেতে বিদ্ধ করেছে। সেই খৃষ্টান নাস্তিকদের অবিশ্বাস থেকে যিশুকে বিচ্ছিন্ন করে তাঁকে আপন শ্রদ্ধার দ্বারা দেখলেই যথার্থ ভাবে সম্মান করা হবে”। - ধর্মে খ্রিষ্টান হয়েও যারা খ্রিষ্টের উপদেশের বিরোধিতা করেছে তাঁদের সম্পর্কে ‘খ্রীষ্টান নাস্তিক’ অভিধাটির প্রয়োগ একেবারে যথাযথ।

 

১০ পৌষ [শুক্র 25 Dec 1914] খ্রিষ্ট-জন্মদিনে মন্দিরে তিনি যে উপাসনা করেন, সেটি ‘খৃষ্টধর্ম’ নামে সবুজপত্রের জন্য লিখে দেন। অ্যান্ডরুজ, স্টপফোর্ড ব্রুকের মতো খ্রিষ্টানকে দেখে খ্রিষ্টধর্মের যে মহিমা তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, বিলেত থেকে ফেরার পথে জাহাজে দুই খ্রিষ্টান মিশনারীর আচরণ তাতে আঘাত করেছিল। ভারতে মিশনারীদের কীর্তিকলাপ তাঁর অজানা ছিল না। ‘খ্রিষ্টধর্ম’ প্রবন্ধের সূচনা হয়েছে সেই তিক্ততা দিয়ে: “খৃষ্টান খৃষ্টধর্মকে নিয়ে যখনই অহংকার করে তখনই বুঝতে পারি তার মধ্যে এমন খাদ মিশিয়েছে যা তার ধর্ম নয়, যা তার আপনি। এই জন্যে সে যখন দাতাবৃত্তি করতে আসে তখন তার হাত থেকে ভিক্ষুকের মতো সত্যকে গ্রহণ করতে আমরা লজ্জা বোধ করি। অহংকারের প্রতিঘাতে অহংকার জেগে ওঠে—এবং যে অহংকার অহংকৃতের দানগ্রহণে কুষ্ঠিত সে নিন্দনীয় নয়”।

 

কিন্ত তিনি এও জানতেন যে, সাম্প্রদায়িক অহংকার কেবল খৃষ্টধর্মের একচেটিয়া নয়, আদি ব্রাহ্মসমাজের ক্ষুদ্র গোষ্ঠীও তা থেকে মুক্ত নয়। সেই জন্য তিনি এর পরেই বললেন: “এই জন্যেই মানুষকে সাম্প্রদায়িক খৃষ্টানের হাত থেকে খৃষ্টকে, সাম্প্রদায়িক বৈষ্ণবের হাত থেকে বিষ্ণুকে, সাম্প্রদায়িক ব্রাহ্মের হাত থেকে ব্রহ্মকে উদ্ধার করে নেবার জন্যে বিশেষ ভাবে সাধনা করতে হয়।

 

আমাদের আশ্রমে আমরা সম্প্রদায়ের উপর রাগ করে সত্যের সঙ্গে বিরোধ করব না। আমরা খৃষ্টধর্মের মর্মকথা গ্রহণ করবার চেষ্টা করব— খৃষ্টানের জিনিস ব’লে নয়, মানবের জিনিস ব’লে”।

 

রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমারের বর্ণনা অনুযায়ী ১০ পৌষ [শুক্র 25 Dec 1914] তিনি বারবার করে য়ুরোপের প্রলয়ংকর যুদ্ধের কথা বলেছেন। ক্ষুদ্র জাতীয়তা য়ুরোপকে যেভাবে বিভ্রান্ত করছে সেটা উল্লেখ করে তিনি বললেন: “কোনো জাতী তার জাতীয় স্বার্থকে পুঞ্জীভূত করে তার জাতীয়তাকে সংকীর্ণ করে তুলবে তা হবে না, ইতিহাসবিধাতার এই আদেশ। মানুষ সেই জাতীয় স্বাৰ্থদানবের পায়ে এত দিন ধরে নরবলির উদযোগ করেছে, আজ তাই সেই অপদেবতার মন্দির ভাঙবার হুকুম হয়েছে”। খৃষ্টোৎসবের দিন তিনি অ্যান্ডরুজকে

দেখেছিলেম হাটের লোকে তোমারে দেয় গালি,

গায়ে তোমার ছড়ায় ধুলাবালি।

এই কবিতাটির অনুবাদ করে উপহার দেন – “WHEN, MAD IN their mirth, they raised dust to soil thy robe, 0 Beautiful, it made my heart sick”.

 

১২ পৌষ [রবি 27 Dec 1914] তিনি ‘খ্রিস্ট’-জন্মদিনের ভাষণটির কাব্যরূপ দিলেন ‘হে মোর সুন্দর’। কবিতাটি ‘Judgement’ নামে অনুবাদ করে রবীন্দ্রনাথ অ্যান্ডরুজকে উপহার দেন।

হে মোর সুন্দর,

যেতে যেতে

পথের প্রমোদে মেতে

যখন তোমার গায়

কারা সবে ধুলা দিয়ে যায়,

আমার অন্তর

করে হায় হয়।

রবীন্দ্রনাথ ঋগ্বেদ পাঠেই প্রথম যিশুখ্রিস্টের পরিচয় পান। বাল্যকাল থেকেই খ্রিস্ট–‌অনুরাগ কবির মধ্যে ছিল। এর ফলে যিশু হয়ে উঠেছিলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে ‘‌মানবপুত্র’‌ ‘‌মহাত্মা’‌, ‘‌পরম মানব’‌ ‘‌কল্যাণের দূত’‌ ‘‌সেবা পরায়ণ প্রেমের দীক্ষাগুরু’‌। তাঁর ছেলেবেলায় খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করতেন। একজন ইউরোপীয় মিশনারির বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর অল্প বয়সে শ্রীকণ্ঠ সিংহ–‌র সঙ্গে প্রায়ই যেতেন। এই অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেখতে পাই কবির লেখা ‘‌জীবনস্মৃতি’‌ বইটিতে।


সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে পড়াকালীন একজন খ্রিস্টান ধর্মযাজক অধ্যাপক ফাদার ডি পেনেরান্ডার–‌এর গভীর প্রভাব কবির জীবনে বিশেষ ভাবে ছায়া ফেলেছিল। এ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ‘‌জীবনস্মৃতি’‌ গ্রন্থে লিখেছেন—

“… সেন্ট জেভিয়ার্সের একটি পবিত্র স্মৃতি আজ পর্যন্ত আমার মনের মধ্যে অম্লান হইয়া রহিয়াছে— তাহা সেখানকার অধ্যাপকদের স্মৃতি।.‌.‌.‌ ফাদার ডি পেনেরান্ডার সহিত আমাদের যোগ তেমন বেশি ছিল না;‌ বোধকরি কিছুদিন তিনি আমাদের নিয়মিত শিক্ষকের বদলি রূপে কাজ করিয়াছিলেন। তিনি জাতিতে স্পেনীয় ছিলেন।.‌.‌.‌ তাঁহার মুখশ্রী সুন্দর ছিল না, কিন্তু আমার কাছে তাহার কেমন একটি আকর্ষণ ছিল। তাঁহাকে দেখিলেই মনে হইত, তিনি সর্বদাই আপনার মধ্যে যেন একটি দেবোপাসনা বহন করিতেছেন, অন্তরের বৃহৎ এর নিবিড় স্তব্ধতায় তাঁহাকে যেন আবৃত করিয়া রাখিয়াছে।.‌.‌.‌ অন্য ছাত্রদের কথা বলিতে পারি না কিন্তু আমি তাঁহার ভিতরকার একটি বৃহৎ মনকে দেখিতে পাইতাম;‌ আজও তাহা স্মরণ করিলে আমি যেন নিভৃত নিস্তব্ধ দেবমন্দিরের মধ্যে প্রবেশ করিবার অধিকার পাই”।…


রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন আশ্রমে বড়দিন পালন করতেন। তখনো তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার পাননি। অর্থাৎ ১৯১০ খ্রিস্টাব্দ থেকেই স্থায়ীভাবে শান্তিনিকেতনে বড়দিন পালিত হয়ে আসছে। যা আজও প্রতিবছর ২৫শে ডিসেম্বরে 'খৃষ্টোত্সব' অনুষ্ঠিত হয়। একদিকে মাঠে চলতে থাকে পৌষমেলা আর অন্যদিকে উপচে পড়া ভিড়ে শান্তিনিকেতনে ধ্বনিত হয় মধুর খ্রিস্টীয় প্রার্থনাসংগীত। যিশুখ্রিস্টের ওপর রবীন্দ্রনাথের দশটি রচনা পাওয়া যায়। তার মধ্যে সাতটি প্রবন্ধ ও তিনটি কবিতা। এবং আশ্চর্যের বিষয় হলো—বেশির ভাগ প্রবন্ধ ও কবিতা ২৫শে ডিসেম্বরেই লেখা। রবীন্দ্রনাথের ‘‌মানসী’‌ কাব্যগ্রন্থর অন্তর্গত ‘‌ধর্মপ্রচার’‌ কবিতাটিতে

“.. ধন্য হউক তোমার প্রেম,

      ধন্য তোমার নাম,

ভুবন-মাঝারে হউক উদয়

      নূতন জেরুজিলাম।..

..তৃষিত যাহারা, জীবনের বারি

      করো তাহাদের দান।

দয়াময় যিশু, তোমার দয়ায়

      পাপীজনে করো ত্রাণ”।…

 

মাত্র ১৭ বছর বয়সে প্রথম যিশু খ্রিস্টের কথার শিল্পিত রূপ দেখতে পাই। কবিতাটির রচনাকাল ৩২ জৈষ্ঠ, ১২৯৬ বঙ্গাব্দ, ইংরেজি ১৮৮৮ সাল। আবার বড়দিন সম্পর্কে বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ খৃষ্টের জন্মের বিশ্বজনীনতার গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন যে, বড়দিন নিছক এক উৎসবের বিষয় নয় কিন্তু খৃষ্টানদের আত্মনবায়নের সময়। তিনি লিখছেন, -

“….আজ তাঁর জন্মদিন এ কথা বলব কি পঞ্জিকার তিথি মিলিয়ে। অন্তরে যে দিন ধরা পড়ে না সে দিনের উপলব্ধি কি কালগণনায়। যেদিন সত্যের নামে ত্যাগ করেছি, যেদিন অকৃত্রিম প্রেমে মানুষকে ভাই বলতে পেরেছি, সেইদিনই পিতার পুত্র আমাদের জীবনে জন্মগ্রহণ করেছেন, সেইদিনই বড়োদিন-- যে তারিখেই আসুক। আমাদের জীবনে তাঁর জন্মদিন দৈবাৎ আসে, কিন্তু ক্রুশে বিদ্ধ তাঁর মৃত্যু সে তো আসে দিনের পর দিন”।….

খৃষ্টের ভালবাসা তার অনুগামীদের প্রলোভন জয় করতে এবং খৃষ্টের ভালবাসা প্রচার অন্যের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে সক্ষম করে তোলে। তিনি লিখছেন, -

“… খৃষ্টকে যাঁরা প্রত্যক্ষভাবে ভালোবাসতে পেরেছেন তাঁরা শুধু একা বসে রিপু দমন করেন নি, তাঁরা দুঃসাধ্য সাধন করেছেন। তাঁরা গিয়েছেন দূর-দূরান্তরে, পর্বত সমুদ্র পেরিয়ে মানবপ্রেম প্রচার করেছেন। মহাপুরুষেরা এইরকম আপন জীবনের প্রদীপ জ্বালান; তাঁরা কেবল তর্ক করেন না, মত প্রচার করেন না। তাঁরা আমাদের দিয়ে যান মানুষরূপে আপনাকে”।

 

25 Dec 1937, খ্রীষ্টমাস দিনে কবি লিখলেন দুটি কবিতা

দেখিলাম একালের

আত্মঘাতী মূঢ় উন্মত্ততা, দেখিনু সর্বাঙ্গে তার

বিকৃতির কদর্য বিদ্রূপ। এক দিকে স্পর্ধিত ক্রূরতা,

মত্ততার নির্লজ্জ হুংকার, অন্য দিকে ভীরুতার

দ্বিধাগ্রস্ত চরণবিক্ষেপ …

জাগতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা পৌষ-উৎসবের ভাষণে ছিল – “অপর দিকে আছে আপন-সাম্রাজ্য-লোভী ভীরুর দল, তারা এই দানবদের কোনো প্রতিবাদ করতে সাহস করে না। ক্ষীণ এরা, ইতিহাসে এদের স্বাক্ষর লুপ্ত। চীনকে যখন জাপান অপমান করেছে সিনেমার ভিতর দিয়ে, সাহিত্যের ভিতর দিয়ে— যেমন অপমান আমাদের দেশেও হয়ে থাকে— তখন এই প্রতাপশালীর দল কোনো বাধা দেয় নি, বরং চীনকে দাবিয়ে দিয়েছে, বলেছে চীনের চঞ্চল হবার কোনো অধিকার নেই। আমাদের দেশেও দেখি, দুর্বলকে অবমাননার কোনো প্রতিকার নেই”। 

 

খ্রীষ্টের জন্মদিনে দেশে দেশে দেবতার মন্দিরে মন্দিরে ধার্মিক দল শান্তির জন্য প্রার্থনা করে। কিন্তু কোথায় সে শান্তির প্রয়াস:

নাগিনীরা চারি দিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস,

শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস--

চীনাদের সঙ্গে যুদ্ধে জয়ী হবার জন্য জাপানী সৈন্যদল বুদ্ধমন্দিরে বর প্রার্থনা করেছিল – এই সংবাদ সংবাদপত্রে পড়ে বড় বেদনায় লিখলেন, ‘বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি’।

যুদ্ধের দামামা উঠল বেজে।

ওদের ঘাড় হল বাঁকা, চোখ হল রাঙা,

          কিড়্‌মিড়্‌ করতে লাগল দাঁত।

মানুষের কাঁচা মাংসে যমের ভোজ ভর্তি করতে

                     বেরোল দলে দলে।

সবার আগে চলল দয়াময় বুদ্ধের মন্দিরে

                      তাঁর পবিত্র আর্শীবাদের আশায়।

 

যুগ যুগ ধরে মানুষ বারবার দিগ্‌ভ্রান্ত হয়ে পড়েছে, হিংসা আর অন্ধকারের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছে, আবার সেখান থেকে বেরোবার রাস্তা খুঁজে পেয়েছে এক-এক জন সত্যদ্রষ্টার হাত ধরে। আবার পথ ভুলেছে, কখনও বা যাঁরা পথ দেখাচ্ছেন তাঁদেরই ধ্বংস করতে চেয়েছে। এই আরোহণ-অবরোহণের মধ্যে দিয়েই কিছু জ্ঞানী মানুষ আমাদের নিয়ে চলেন এমন গন্তব্যে, যেখানে নতুন প্রাণ জন্ম নিচ্ছে, নতুন আশা নিয়ে সূর্যোদয় হচ্ছে। খড়ের বিছানায়, মাতৃক্রোড়ে জিশুর আবির্ভাব এমনই এক নতুন আলোর দিশা। রবীন্দ্রনাথ ‘শিশুতীর্থ’-তে আহ্বান জানালেন

“… মা বসে আছেন তৃণশয্যায়, কোলে তাঁর শিশু,

উষার কোলে যেন শুকতারা।

দ্বারপ্রান্তে প্রতীক্ষাপরায়ণ সূর্যরশ্মি শিশুর মাথায় এসে পড়ল।

কবি দিলে আপন বীণার তারে ঝংকার, গান উঠল আকাশে--

জয় হোক মানুষের, ওই নবজাতকের, ওই চিরজীবিতের।

ঋণ: রবীন্দ্রজীবনকথা – প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়। রবিজীবনী – প্রশান্তকুমার পাল। রবীন্দ্ররচনাবলী।

 

সাধারণ ব্রাহ্মসমাজভুক্ত বিশিষ্ট কর্মী অধ্যাপক ধীরেন্দ্রচন্দ্র চৌধুরী In search of Jesus নামে একটি সুবৃহৎ গ্রন্থ রচনা করে ঐতিহাসিক যীশুখৃষ্ট যে অলীক কল্পনা সেটা একশ্রেণীর পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের বহু গ্রন্থ থেকে সংকলন করে প্রমাণ করেন। রবীন্দ্রনাথের সাথে সাক্ষাৎ করতে আসলে কবি তাঁকে বলেন যে, ইতিহাসে সেটাই সত্য যেটা মানুষ নিজের অভিজ্ঞতা বা বোধ থেকে সৃষ্টি করেছে। যীশু ছিলেন কি না সে প্রশ্ন সত্য নয়; এ কথা নিশ্চিত যে যীশুখৃষ্ট বহু মানুষের অন্তরে স্থান পেয়েছেন। যীশুর মহত্বই মানব হৃদয়ে সুপ্রতিষ্ঠিত।

 

কবি বলেন, “আমাদের জীবনে তাঁর জন্মদিন দৈবাৎ আসে, কিন্তু ক্রুশে বিদ্ধ তাঁর মৃত্যু সে তো আসে দিনের পর দিন। … লোভ আজ নিদারুণ, দুর্বলের অন্নগ্রাস আজ লুণ্ঠিত, প্রবলের সামনে দাঁড়িয়ে খৃষ্টের দোহাই দিয়ে মার বুকে পেতে নিতে সাহস নেই যাদের তারাই আজ পূজাবেদীর সামনে দাঁড়িয়ে মৃত্যুশূলবিদ্ধ সেই কারুণিকের জয়ধ্বনি করছে অভ্যস্ত বচন আবৃত্তি করে। তবে কিসের উৎসব আজ। … আজও তিনি মানুষের ইতিহাসে প্রতিমুহূর্তে ক্রুশে বিদ্ধ হচ্ছেন”।

 

এই কথাই ‘মানবপুত্র’ (পুনশ্চ) কবিতায় প্রকাশ করেছিলেন (১৩৩৯ শ্রাবণ)।

মৃত্যুর পাত্রে খৃস্ট যেদিন মূত্যুহীন প্রাণ উৎসর্গ করলেন

রবাহূত অনাহূতের জন্যে,

তার পরে কেটে গেছে বহু শত বৎসর।

আজ তিনি একবার নেমে এলেন নিত্যধাম থেকে মর্তধামে।…

 

আমাদের ধর্মশাস্ত্রে বলে, ‘রুদ্র বলহীনকে ক্ষমা করেন না’। দুর্বলের অভিমান কবির কাছে অসহ্য। মানুষ চিরদিন দুঃখকে বরণ করেছে স্বেচ্ছায়। “সে কোন মহাশক্তির সাধনায়? সে শক্তি প্রাকৃতিক নয়, মানসিক নয়, সে আত্মিক। সেখানেই মানুষ আপন দেবতার সঙ্গে যুক্ত। আপনার মধ্যে যখন সেই মহত্ত্বের উপলব্ধি করে তখন সে কোনো ত্যাগে ক্লেশে দীনাত্মার মতো শোক করে না”। এটাই হচ্ছে এই জগৎব্যাপী অশান্তির দিনে কবির অন্তর্দেবতার বাণী। কবির এই অন্তর্বেদনা প্রকাশ পেয়েছে ‘বড়দিন’ কবিতায় খ্রীষ্ট-স্মরণে। বিশ্বব্যাপী যুদ্ধায়োজনে সকলেই দেবতার দোহাই পড়ছে – তারা দেবতার নামে নরহত্যা করে দেবতার আশীর্বাদ মাগিতেছি। কবি নিরতিশয় কাতর হয়ে লিখছেন:

একদিন যারা মেরেছিল তাঁরে গিয়ে রাজার দোহাই দিয়ে

এই প্রসঙ্গে মৈত্রেয়ী দেবী লিখছেন; “দুটি দিনের কথা আমার খুব মনে পড়ে। একটি গানের 'কথা' অবশ্য একটি কবিতা থেকে নেওয়া-- খৃষ্টের উপর পুনশ্চতে একটি কবিতা আছে 'মানবপুত্র' [রচনাকাল:  ৯ পৌষ, ১৩৪৬ (২৫ ডিসেম্বর, ১৯৩৯)]। বড় দিনের ঠিক আগের দিন, আমাকে বিকেলবেলা বললেন, "খৃষ্টের উপর আমার একটা গদ্যকবিতা কোথায় আছে বার কর”। আমার মনে ছিল, আমি বের করে দিলুম। তখন বললেন, "এবার তুমি যাও আমি একটা গান তৈরী করব কালকের জন্য, খৃষ্ট জন্মদিনে এই গানটি হলে সাহেব খুশী হবেন। "সাহেব অর্থ সি এফ এন্‌ড্রুজ। তিনি তখন শান্তিনিকেতনে ছিলেন। সেই সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঘনঘোর বিভীষিকা এঁদের দুজনের মনকেই ভারাক্রান্ত করে রাখত।  ...  কারণ সে সময় প্রতি পক্ষই অপরের নিধন ও নিজের সাফল্যের জন্য ধর্ণা দিচ্ছে।... সন্ধ্যেবেলা গান [একদিন যারা মেরেছিল] তৈরী হয়ে গেছে, গুন্‌গুন্‌ করছেন। ডেকে পাঠালেন ইন্দুলেখা দেবীকে [ঘোষ], তিনি তখন শান্তিনিকেতনে একজন প্রসিদ্ধ সুগায়িকা-- বার বার করে গলায় তুলে নিলেন ইন্দুলেখা দেবী। কবি বললেন, "কাল থেকে এ গান তোমার সম্পত্তি, আমি আবার গাইতে গেলে তুমি ভুল ধরবে”। 


১০ পৌষ [রবি 25 Dec 1910] মন্দিরে প্রথম খ্রীষ্টোৎসব পালিত হয়। রবীন্দ্রনাথ এই উপলক্ষে যে ভাষণ দেন তার সারমর্ম ‘যিশুচরিত’ নামে মুদ্রিত হয়। ঘটনাটি অভিনব। খ্রিষ্টধর্ম সম্পর্কে মহর্ষির বিরূপতা কোনো গোপন ব্যাপার ছিল না, খ্রিষ্টান হওয়ার কারণেই ব্রহ্মবান্ধব ও রেবাচাঁদকে ব্রহ্মচর্যাশ্রম থেকে বিদায় গ্রহণ করতে হয়েছিল। কিন্তু অসাম্প্রদায়িক মনোভাব-সম্পন্ন রবীন্দ্রনাথ পিতার এই গোঁড়ামির অংশীদার ছিলেন না। কিন্তু এর জন্য তিনি পিতাকে দায়ী করেননি। ইংরেজ-সংসর্গের প্রথম পর্বে বাঙালির স্বধর্মভ্রষ্টতার পটভূমি বর্ণনা করে তিনি উক্ত মনোভাবকে স্বাভাবিক বলেই মনে করেছেন: “আমাদের খৃষ্টের পরিচয় প্রধানত সাধারণ খৃষ্টান মিশনরিদের নিকট হইতে। খৃষ্টকে তাঁহারা খৃষ্টানি-দ্বারা আচ্ছন্ন করিয়া আমাদের কাছে ধরিয়াছেন। এ পর্যন্ত বিশেষভাবে তাঁহাদের ধর্মমতের দ্বারা আমাদের ধর্মসংস্কারকে তাঁহারা পরাভূত করিবার চেষ্টা করিয়াছেন। সুতরাং আত্মরক্ষার চেষ্টায় আমরা লড়াই করিবার জন্যই প্রস্তুত হইয়া থাকি”।

 

রবীন্দ্রনাথ বড়দিন বা যিশুখ্রিস্টের আবির্ভাব তিথিকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতেন। দেশে থাকলে তিনি যেমন বড়দিন পালন করতেন, তেমনি বিদেশেও তিনি বড়দিনের আয়োজন করতেন। তিনি একবার একটি চিঠিতে হেমলতা দেবীকে লিখেছেন,

আজ খৃষ্টমাস। এইমাত্র ভোরের বেলা আমরা আমাদের খৃষ্টোৎসব সমাধা করে উঠেছি। … আমরা তিনজনে আমাদের শোবার ঘরের একটি কোণে বসে আমাদের উৎসব করলুম— কিছু অভাব বোধ হল না— উৎসবের যিনি দেবতা তিনি যদি আসন গ্রহণ করেন তা হলে কোনো আয়োজনের ত্রুটি চোখে পড়েই না। তাঁকে আজ আমরা প্রণাম করেছি, তাঁর আশীর্বাদ আমরা গ্রহণ করেছি। আমরা একান্তমনে প্রার্থনা করেছি যদ্ ভদ্রং তন্ন আসুব। আমাদের সমস্ত ইচ্ছাকে নিঃশেষে পরাস্ত করে দিয়ে তাঁর ইচ্ছাকে আমাদের জীবনে জয়ী করুন, জীবন একেবারে পরিপূর্ণরূপে সত্য হোক। …

রবীন্দ্রনাথ বাইবেল মন দিয়ে পড়েছিলেন। বাইবেলের ওল্ড টেষ্টামেন্ট অংশ তিনি পছন্দ না করলেও নিউ টেষ্টামেন্টে বর্ণিত যিশুচরিতের অলৌকিকতা-বর্জিত মানবপ্রেমিক রূপটি তাঁকে আকর্ষণ করেছে। গতবছর পৌষোৎসবের সান্ধ্য-উপাসনায় কথিত ‘ভক্ত’ শীর্ষক ভাষণে তিনি ‘মানুষের ধর্মরাজ্যে যে তিনজন মহাপুরুষ সর্বোচ্চ চূড়ায় অধিরোহণ করেছেন’ যিশুকে তাঁদের অন্যতম বলে ঘোষণা করেছিলেন, ‘যিশুচরিত’-এ তাঁর সাধনার ও বাণীর তাৎপর্য ব্যাখ্যা করলেন। রচনাটি অজিতকুমার চক্রবর্তী-প্রণীত ‘খৃষ্ট’ গ্রন্থের ভূমিকারূপে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু অজিতকুমার যে লিখেছেন: ‘১৩১৬ সালে মহাপুরুষদিগের জন্ম কিংবা মৃত্যু দিনে তাঁহাদিগের চরিত ও উপদেশ আলোচনার জন্য [শান্তিনিকেতনে] উৎসব করা স্থির হইল। খৃষ্টমাসে প্রথম খৃষ্টোৎসব হইল। তার পরে চৈতন্য ও কবীরের উৎসব হইয়াছিল।

 

৯ পৌষ [মঙ্গল 25 Dec 1923] - এবার বহু বছর পরে খ্রীষ্টোৎসবের দিন অ্যান্ডরুজ আশ্রমে ছিলেন না বলে রবীন্দ্রনাথ এই উপলক্ষে উপসনা করেন, তাঁর ভাষণটি চৈত্র-সংখ্যা শান্তিনিকেতন-এ ‘৯ই পৌষ / (খৃষ্টোৎসব)’ শিরোণামে মুদ্রিত হয়। ‘তাই তোমার আনন্দ আমার পর’ গানটি দিয়ে উৎসবের সূচনা করে রবীন্দ্রনাথ বলেন,

“দুইয়ের মধ্যে একের যে প্রকাশ তাই হল যথার্থ সৃষ্টির প্রকাশ। নানা বিরোধে যেখানে এক বিরাজমান সেখানেই মিলন, সেখানেই এককে যথার্থ ভাবে উপলব্ধি করা যায়”। 

 

কিন্তু মানুষ নানাভাবে এই সত্যের অবমাননা করেছে। খ্রীষ্টধর্মের দীর্ঘ ইতিহাস, বিশেষ করে প্রথম মহাযুদ্ধের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, “এই মহাত্মার বাণী যে তাঁর ধর্মাবলম্বীরাই গ্রহণ করেছিল তা নয়। তারা বারে বারে ইতিহাসে তাঁর বাণীর অবমাননা করেছে, রক্তের চিহ্নের দ্বারা ধরাতল রঞ্জিত করে দিয়েছে— তারা যিশুকে এক বার নয়, বার-বার ক্রুশেতে বিদ্ধ করেছে। সেই খৃষ্টান নাস্তিকদের অবিশ্বাস থেকে যিশুকে বিচ্ছিন্ন করে তাঁকে আপন শ্রদ্ধার দ্বারা দেখলেই যথার্থ ভাবে সম্মান করা হবে”। - ধর্মে খ্রিষ্টান হয়েও যারা খ্রিষ্টের উপদেশের বিরোধিতা করেছে তাঁদের সম্পর্কে ‘খ্রীষ্টান নাস্তিক’ অভিধাটির প্রয়োগ একেবারে যথাযথ।

 

১০ পৌষ [শুক্র 25 Dec 1914] খ্রিষ্ট-জন্মদিনে মন্দিরে তিনি যে উপাসনা করেন, সেটি ‘খৃষ্টধর্ম’ নামে সবুজপত্রের জন্য লিখে দেন। অ্যান্ডরুজ, স্টপফোর্ড ব্রুকের মতো খ্রিষ্টানকে দেখে খ্রিষ্টধর্মের যে মহিমা তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, বিলেত থেকে ফেরার পথে জাহাজে দুই খ্রিষ্টান মিশনারীর আচরণ তাতে আঘাত করেছিল। ভারতে মিশনারীদের কীর্তিকলাপ তাঁর অজানা ছিল না। ‘খ্রিষ্টধর্ম’ প্রবন্ধের সূচনা হয়েছে সেই তিক্ততা দিয়ে: “খৃষ্টান খৃষ্টধর্মকে নিয়ে যখনই অহংকার করে তখনই বুঝতে পারি তার মধ্যে এমন খাদ মিশিয়েছে যা তার ধর্ম নয়, যা তার আপনি। এই জন্যে সে যখন দাতাবৃত্তি করতে আসে তখন তার হাত থেকে ভিক্ষুকের মতো সত্যকে গ্রহণ করতে আমরা লজ্জা বোধ করি। অহংকারের প্রতিঘাতে অহংকার জেগে ওঠে—এবং যে অহংকার অহংকৃতের দানগ্রহণে কুষ্ঠিত সে নিন্দনীয় নয়”।

 

কিন্ত তিনি এও জানতেন যে, সাম্প্রদায়িক অহংকার কেবল খৃষ্টধর্মের একচেটিয়া নয়, আদি ব্রাহ্মসমাজের ক্ষুদ্র গোষ্ঠীও তা থেকে মুক্ত নয়। সেই জন্য তিনি এর পরেই বললেন: “এই জন্যেই মানুষকে সাম্প্রদায়িক খৃষ্টানের হাত থেকে খৃষ্টকে, সাম্প্রদায়িক বৈষ্ণবের হাত থেকে বিষ্ণুকে, সাম্প্রদায়িক ব্রাহ্মের হাত থেকে ব্রহ্মকে উদ্ধার করে নেবার জন্যে বিশেষ ভাবে সাধনা করতে হয়।

 

আমাদের আশ্রমে আমরা সম্প্রদায়ের উপর রাগ করে সত্যের সঙ্গে বিরোধ করব না। আমরা খৃষ্টধর্মের মর্মকথা গ্রহণ করবার চেষ্টা করব— খৃষ্টানের জিনিস ব’লে নয়, মানবের জিনিস ব’লে”।

 

রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমারের বর্ণনা অনুযায়ী ১০ পৌষ [শুক্র 25 Dec 1914] তিনি বারবার করে য়ুরোপের প্রলয়ংকর যুদ্ধের কথা বলেছেন। ক্ষুদ্র জাতীয়তা য়ুরোপকে যেভাবে বিভ্রান্ত করছে সেটা উল্লেখ করে তিনি বললেন: “কোনো জাতী তার জাতীয় স্বার্থকে পুঞ্জীভূত করে তার জাতীয়তাকে সংকীর্ণ করে তুলবে তা হবে না, ইতিহাসবিধাতার এই আদেশ। মানুষ সেই জাতীয় স্বাৰ্থদানবের পায়ে এত দিন ধরে নরবলির উদযোগ করেছে, আজ তাই সেই অপদেবতার মন্দির ভাঙবার হুকুম হয়েছে”। খৃষ্টোৎসবের দিন তিনি অ্যান্ডরুজকে

দেখেছিলেম হাটের লোকে তোমারে দেয় গালি,

গায়ে তোমার ছড়ায় ধুলাবালি।

এই কবিতাটির অনুবাদ করে উপহার দেন – “WHEN, MAD IN their mirth, they raised dust to soil thy robe, 0 Beautiful, it made my heart sick”.

 

১২ পৌষ [রবি 27 Dec 1914] তিনি ‘খ্রিস্ট’-জন্মদিনের ভাষণটির কাব্যরূপ দিলেন ‘হে মোর সুন্দর’। কবিতাটি ‘Judgement’ নামে অনুবাদ করে রবীন্দ্রনাথ অ্যান্ডরুজকে উপহার দেন।

হে মোর সুন্দর,

যেতে যেতে

পথের প্রমোদে মেতে

যখন তোমার গায়

কারা সবে ধুলা দিয়ে যায়,

আমার অন্তর

করে হায় হয়।

 

রবীন্দ্রনাথ ঋগ্বেদ পাঠেই প্রথম যিশুখ্রিস্টের পরিচয় পান। বাল্যকাল থেকেই খ্রিস্ট–‌অনুরাগ কবির মধ্যে ছিল। এর ফলে যিশু হয়ে উঠেছিলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে ‘‌মানবপুত্র’‌ ‘‌মহাত্মা’‌, ‘‌পরম মানব’‌ ‘‌কল্যাণের দূত’‌ ‘‌সেবা পরায়ণ প্রেমের দীক্ষাগুরু’‌। তাঁর ছেলেবেলায় খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করতেন। একজন ইউরোপীয় মিশনারির বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর অল্প বয়সে শ্রীকণ্ঠ সিংহ–‌র সঙ্গে প্রায়ই যেতেন। এই অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেখতে পাই কবির লেখা ‘‌জীবনস্মৃতি’‌ বইটিতে।


সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে পড়াকালীন একজন খ্রিস্টান ধর্মযাজক অধ্যাপক ফাদার ডি পেনেরান্ডার–‌এর গভীর প্রভাব কবির জীবনে বিশেষ ভাবে ছায়া ফেলেছিল। এ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ‘‌জীবনস্মৃতি’‌ গ্রন্থে লিখেছেন—

“… সেন্ট জেভিয়ার্সের একটি পবিত্র স্মৃতি আজ পর্যন্ত আমার মনের মধ্যে অম্লান হইয়া রহিয়াছে— তাহা সেখানকার অধ্যাপকদের স্মৃতি।.‌.‌.‌ ফাদার ডি পেনেরান্ডার সহিত আমাদের যোগ তেমন বেশি ছিল না;‌ বোধকরি কিছুদিন তিনি আমাদের নিয়মিত শিক্ষকের বদলি রূপে কাজ করিয়াছিলেন। তিনি জাতিতে স্পেনীয় ছিলেন।.‌.‌.‌ তাঁহার মুখশ্রী সুন্দর ছিল না, কিন্তু আমার কাছে তাহার কেমন একটি আকর্ষণ ছিল। তাঁহাকে দেখিলেই মনে হইত, তিনি সর্বদাই আপনার মধ্যে যেন একটি দেবোপাসনা বহন করিতেছেন, অন্তরের বৃহৎ এর নিবিড় স্তব্ধতায় তাঁহাকে যেন আবৃত করিয়া রাখিয়াছে।.‌.‌.‌ অন্য ছাত্রদের কথা বলিতে পারি না কিন্তু আমি তাঁহার ভিতরকার একটি বৃহৎ মনকে দেখিতে পাইতাম;‌ আজও তাহা স্মরণ করিলে আমি যেন নিভৃত নিস্তব্ধ দেবমন্দিরের মধ্যে প্রবেশ করিবার অধিকার পাই”।…


রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন আশ্রমে বড়দিন পালন করতেন। তখনো তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার পাননি। অর্থাৎ ১৯১০ খ্রিস্টাব্দ থেকেই স্থায়ীভাবে শান্তিনিকেতনে বড়দিন পালিত হয়ে আসছে। যা আজও প্রতিবছর ২৫শে ডিসেম্বরে 'খৃষ্টোত্সব' অনুষ্ঠিত হয়। একদিকে মাঠে চলতে থাকে পৌষমেলা আর অন্যদিকে উপচে পড়া ভিড়ে শান্তিনিকেতনে ধ্বনিত হয় মধুর খ্রিস্টীয় প্রার্থনাসংগীত। যিশুখ্রিস্টের ওপর রবীন্দ্রনাথের দশটি রচনা পাওয়া যায়। তার মধ্যে সাতটি প্রবন্ধ ও তিনটি কবিতা। এবং আশ্চর্যের বিষয় হলো—বেশির ভাগ প্রবন্ধ ও কবিতা ২৫শে ডিসেম্বরেই লেখা। রবীন্দ্রনাথের ‘‌মানসী’‌ কাব্যগ্রন্থর অন্তর্গত ‘‌ধর্মপ্রচার’‌ কবিতাটিতে

“.. ধন্য হউক তোমার প্রেম,

      ধন্য তোমার নাম,

ভুবন-মাঝারে হউক উদয়

      নূতন জেরুজিলাম।..

..তৃষিত যাহারা, জীবনের বারি

      করো তাহাদের দান।

দয়াময় যিশু, তোমার দয়ায়

      পাপীজনে করো ত্রাণ”।…

মাত্র ১৭ বছর বয়সে প্রথম যিশু খ্রিস্টের কথার শিল্পিত রূপ দেখতে পাই। কবিতাটির রচনাকাল ৩২ জৈষ্ঠ, ১২৯৬ বঙ্গাব্দ, ইংরেজি ১৮৮৮ সাল। আবার বড়দিন সম্পর্কে বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ খৃষ্টের জন্মের বিশ্বজনীনতার গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন যে, বড়দিন নিছক এক উৎসবের বিষয় নয় কিন্তু খৃষ্টানদের আত্মনবায়নের সময়। তিনি লিখছেন, -

“….আজ তাঁর জন্মদিন এ কথা বলব কি পঞ্জিকার তিথি মিলিয়ে। অন্তরে যে দিন ধরা পড়ে না সে দিনের উপলব্ধি কি কালগণনায়। যেদিন সত্যের নামে ত্যাগ করেছি, যেদিন অকৃত্রিম প্রেমে মানুষকে ভাই বলতে পেরেছি, সেইদিনই পিতার পুত্র আমাদের জীবনে জন্মগ্রহণ করেছেন, সেইদিনই বড়োদিন-- যে তারিখেই আসুক। আমাদের জীবনে তাঁর জন্মদিন দৈবাৎ আসে, কিন্তু ক্রুশে বিদ্ধ তাঁর মৃত্যু সে তো আসে দিনের পর দিন”।….

 

খৃষ্টের ভালবাসা তার অনুগামীদের প্রলোভন জয় করতে এবং খৃষ্টের ভালবাসা প্রচার অন্যের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে সক্ষম করে তোলে। তিনি লিখছেন, -

“… খৃষ্টকে যাঁরা প্রত্যক্ষভাবে ভালোবাসতে পেরেছেন তাঁরা শুধু একা বসে রিপু দমন করেন নি, তাঁরা দুঃসাধ্য সাধন করেছেন। তাঁরা গিয়েছেন দূর-দূরান্তরে, পর্বত সমুদ্র পেরিয়ে মানবপ্রেম প্রচার করেছেন। মহাপুরুষেরা এইরকম আপন জীবনের প্রদীপ জ্বালান; তাঁরা কেবল তর্ক করেন না, মত প্রচার করেন না। তাঁরা আমাদের দিয়ে যান মানুষরূপে আপনাকে”।

 

25 Dec 1937, খ্রীষ্টমাস দিনে কবি লিখলেন দুটি কবিতা

দেখিলাম একালের

আত্মঘাতী মূঢ় উন্মত্ততা, দেখিনু সর্বাঙ্গে তার

বিকৃতির কদর্য বিদ্রূপ। এক দিকে স্পর্ধিত ক্রূরতা,

মত্ততার নির্লজ্জ হুংকার, অন্য দিকে ভীরুতার

দ্বিধাগ্রস্ত চরণবিক্ষেপ …

জাগতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা পৌষ-উৎসবের ভাষণে ছিল – “অপর দিকে আছে আপন-সাম্রাজ্য-লোভী ভীরুর দল, তারা এই দানবদের কোনো প্রতিবাদ করতে সাহস করে না। ক্ষীণ এরা, ইতিহাসে এদের স্বাক্ষর লুপ্ত। চীনকে যখন জাপান অপমান করেছে সিনেমার ভিতর দিয়ে, সাহিত্যের ভিতর দিয়ে— যেমন অপমান আমাদের দেশেও হয়ে থাকে— তখন এই প্রতাপশালীর দল কোনো বাধা দেয় নি, বরং চীনকে দাবিয়ে দিয়েছে, বলেছে চীনের চঞ্চল হবার কোনো অধিকার নেই। আমাদের দেশেও দেখি, দুর্বলকে অবমাননার কোনো প্রতিকার নেই”। 

 

খ্রীষ্টের জন্মদিনে দেশে দেশে দেবতার মন্দিরে মন্দিরে ধার্মিক দল শান্তির জন্য প্রার্থনা করে। কিন্তু কোথায় সে শান্তির প্রয়াস:

নাগিনীরা চারি দিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস,

শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস--

চীনাদের সঙ্গে যুদ্ধে জয়ী হবার জন্য জাপানী সৈন্যদল বুদ্ধমন্দিরে বর প্রার্থনা করেছিল – এই সংবাদ সংবাদপত্রে পড়ে বড় বেদনায় লিখলেন, ‘বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি’।

 

যুদ্ধের দামামা উঠল বেজে।

ওদের ঘাড় হল বাঁকা, চোখ হল রাঙা,

          কিড়্‌মিড়্‌ করতে লাগল দাঁত।

মানুষের কাঁচা মাংসে যমের ভোজ ভর্তি করতে

                     বেরোল দলে দলে।

সবার আগে চলল দয়াময় বুদ্ধের মন্দিরে

                      তাঁর পবিত্র আর্শীবাদের আশায়।

 

যুগ যুগ ধরে মানুষ বারবার দিগ্‌ভ্রান্ত হয়ে পড়েছে, হিংসা আর অন্ধকারের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছে, আবার সেখান থেকে বেরোবার রাস্তা খুঁজে পেয়েছে এক-এক জন সত্যদ্রষ্টার হাত ধরে। আবার পথ ভুলেছে, কখনও বা যাঁরা পথ দেখাচ্ছেন তাঁদেরই ধ্বংস করতে চেয়েছে। এই আরোহণ-অবরোহণের মধ্যে দিয়েই কিছু জ্ঞানী মানুষ আমাদের নিয়ে চলেন এমন গন্তব্যে, যেখানে নতুন প্রাণ জন্ম নিচ্ছে, নতুন আশা নিয়ে সূর্যোদয় হচ্ছে। খড়ের বিছানায়, মাতৃক্রোড়ে জিশুর আবির্ভাব এমনই এক নতুন আলোর দিশা। রবীন্দ্রনাথ ‘শিশুতীর্থ’-তে আহ্বান জানালেন

“… মা বসে আছেন তৃণশয্যায়, কোলে তাঁর শিশু,

উষার কোলে যেন শুকতারা।

দ্বারপ্রান্তে প্রতীক্ষাপরায়ণ সূর্যরশ্মি শিশুর মাথায় এসে পড়ল।

কবি দিলে আপন বীণার তারে ঝংকার, গান উঠল আকাশে--

জয় হোক মানুষের, ওই নবজাতকের, ওই চিরজীবিতের।

 

ঋণ: রবীন্দ্রজীবনকথা – প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়। রবিজীবনী – প্রশান্তকুমার পাল। রবীন্দ্ররচনাবলী।

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait