ছোটগল্প : মেঘ-মল্লার

ছোটগল্প : মেঘ-মল্লার

শুয়ে শুয়ে জানালা দিয়ে দূরের আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল মেঘদত্তা। আকাশটা কালো মেঘে ভরে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়বে পৃথিবীর বুকে। কেরালার কালপেট্টা, একটা ছোট গ্ৰাম। ভারতবর্ষে সবার প্রথম বর্ষা ঢোকে এই গ্ৰামে। দূরের কলাগাছগুলোর মাথায় কালো মেঘগুলো ভেসে বেড়াচ্ছে। মল্লারের রেওয়াজের সুর কানে ভেসে আসছে। কী রাগ সাধছে মল্লার? কান পেতে শোনার ও বোঝার চেষ্টা করে মেঘদত্তা। কোমল নিষাদ কানে ভেসে আসছে। ‘মেঘমল্লার’! ‘মেঘমল্লার’ সাধছে মল্লার। শরীর জুড়িয়ে যাচ্ছে মেঘদত্তার। তাই কী আজ নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই বর্ষা প্রবেশ করলো এ’খানে?

ভাবতে ভাবতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল মেঘদত্তা। বৃষ্টির ছাঁট এসে মুখে লাগতেই ঘুমটা ভেঙে গেল তার। ঘরে মল্লারকে দেখে বলল—
— তুমি কখন এলে এ’ঘরে?
— এই তো কিছুক্ষণ আগে। তোমার গায়ে মলম লাগিয়ে দেব, মেঘ?
মেঘদত্তা হেসে বলল—
— আজ অনেক দিন পর ‘মেঘমল্লার’ সাধলে। তাতেই আমার শরীর জুড়িয়ে গেছে।
— তোমার জন্যই সাধলাম, মেঘ। তোমার ভালো লেগেছে?
— খুব ভালো করেছ। আমি তো ভাবলাম, সে’জন্যই আজ সময়ের আগেই বর্ষা এলো নাকি।
মল্লার মেঘদত্তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল—
— কি যে বলো, মেঘ?
— সত্যি, মল্লার, তোমার গলায় জাদু আছে।
— আমি গুরুজীর কাছে যাব, তারপর সে’খান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাব। আম্মা তোমাকে আজ খাইয়ে দেবে।
মেঘদত্তা আলতো করে মাথা নাড়লো।
বাইরে প্রচণ্ড মেঘ গর্জন করছে। একটা থালায় খাওয়ার নিয়ে আম্মা এসে ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে বলল—
— মা জী, খাওয়ার নিয়ে এসেছি।

মেঘদত্তা আস্তে আস্তে উঠে বসলো। বৃষ্টির দাপটে দূরের কলাগাছগুলো মাটিতে প্রায় নুইয়ে পড়েছে। আম্মা আস্তে আস্তে মেঘদত্তাকে খাইয়ে দিতে লাগলো। মেঘদত্তা দেখলো, জানালায় একটি কাক-দম্পতি প্রায় কাক-ভেজা হয়ে আশ্রয় নিয়েছে। পাশের কদমফুল গাছটাতেই ওদের বাসা। এত বৃষ্টিতে ওদের বাসাটা ভেঙে পড়েছে কি না দু’জনে সেই চিন্তাতেই হয়তো মগ্ন। মেঘদত্তা মনে মনে ওদের আশ্বস্ত করলো, সব শেষের পরই আবার শুরু থাকে। ভেঙে পড়ার কিছু নেই। ভয় পেও না। আম্মা মেঘদত্তার মুখ মুছিয়ে দিয়ে বলল—

— একটা কথা জিজ্ঞাসা করব, মা জী?
— হ্যাঁ, বলো না।
আম্মা ইতস্তত করে বলল—
— আপনার সারা শরীর কীভাবে এত পুড়ে গেল?
মেঘদত্তা একটু চুপ করে থেকে বলল—
— সে তো অনেক বড় কাহিনী, আম্মা। শুনবে?
আম্মা ঘাড় নেড়ে সায় জানালো।
মেঘদত্তা শুরু করলো—

— বাবার চাকরিসূত্রে আমরা সপরিবারে থাকতাম কেরালায়। জায়গাটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখেও আমরা সকলে এ’খানে থাকারই সিদ্ধান্ত নিই। আমার মা ছিলেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে পারদর্শী। ছোট থেকে তাঁর কাছেই আমি তালিম নিয়েছি। মায়ের আগ্ৰহেই আমি বিভিন্ন সঙ্গীতানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতাম। এ’রকমই একটি সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় আমার আলাপ হয় মল্লারের সাথে। কেরালার একজন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পণ্ডিতের কাছে তালিম নেওয়ার জন্য সেইসময় সে এ’খানে আসে। প্রতিযোগিতাটিতে মল্লার দ্বিতীয় হয় ও আমি তৃতীয় হই। মল্লারের সাথে সেই পরিচয় ধীরে ধীরে গাঢ় বন্ধুত্বের রূপ নেয়। কলকাতা থেকে মাঝে মাঝেই মল্লার আমার জন্য এ’খানে আসত। আমরা দু’জনে প্রচুর শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অনুষ্ঠানও করতাম একসাথে।

এ’ভাবেই যখন আমাদের সম্পর্কটা গড়ে উঠতে থাকে, তখন বাড়ি থেকে আমার জন্য পাত্র দেখা শুরু হয়। একে অপরের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে যখন পরস্পরের স্বরলিপির ছোঁয়া লেগেছে, তখনই বাবা জানায় আমার বিয়ের কথা। বাধ্য হয়ে আমি আর মল্লার বাবার কাছে গিয়ে সমস্ত সত্যিটা জানাই কিন্তু বেকার মল্লারের সাথে বাবা তখন বিয়ে দিতে নারাজ। এখন যে বাবুজীকে তুমি দেখছ, আম্মা, সে’রকম বড় পণ্ডিত তখনও সে হয়ে ওঠেনি। অনেক চেষ্টা করেও মল্লার তখন কোনো চাকরি যোগাড় করতে পারে নি। বাবা বলল—
— গান নিয়ে কোনো ভবিষ্যৎ তৈরী হয় না।
গানকে ও এত ভালোবাসত, সেই গান ছেড়ে অন্য কিছু কীভাবে করবে ও? একপ্রকার জোর করেই বাবা আমাকে অন্য জায়গায় বিয়ে দিয়ে দেয়। সেই ছেলেটি বাঙালী হলেও কেরালায়ই থাকত। এরপর মল্লার কলকাতায় ফিরে গেলে আর তার সাথে আমার দেখা হয় নি।

এতখানি বলে মেঘদত্তা চুপ করলো। আম্মা আগ্ৰহের সুরে বলল—
— তারপর কী হলো, মা জী? 
জানালা দিয়ে সোঁদা-মাটির গন্ধ মেঘদত্তার নাকে এসে লাগলো। বাইরে তাকিয়ে ও দেখল, কাক-দম্পতির বাসাটা ভেঙে মাটিতে পড়ে রয়েছে। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতেই কাক দুটো বাসাটাকে ঘিরে ‘কা-কা’ করছে ঠিক তার আর মল্লারের স্বপ্নগুলো যখন ভেঙে গেছিল, সেইসময় তাদের বুকের মধ্যে যে হাহাকার হয়েছিল, অনেকটা সেইরকম।

আম্মার দিকে তাকিয়ে মেঘদত্তা জিজ্ঞাসা করলো—
— তানসেনের নাম শুনেছ, আম্মা?
 কিছুক্ষণ বোকার মতো তাকিয়ে থেকে আম্মা বলল—
— আমি মূর্খ মানুষ, এত লোকের নাম জানি না, মা জী। কে হন উনি?

— মোঘল সম্রাট আকবরের নবরত্ন সভার একজন গায়ক। তিনি ছিলেন ভুবনবিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত তাঁর গলায় জাদুর মতো খেলত। তখনকার বিভিন্ন সাহিত্যিকের লেখায় পাওয়া যায়, গান গেয়ে তিনি বর্ষা বা বৃষ্টি আনতে পারতেন। আজ সকালে তোমার বাবুজী যে রাগ গাইছিলেন, সে’টা ‘মেঘমল্লার’। এই রাগ গেয়েই তিনি বৃষ্টি আনতে পারতেন আবার ‘দীপক’ রাগ গেয়ে তিনি আগুন ধরিয়ে দিতে পারতেন।

আম্মা চোখ গোল গোল করে বলল—
— সত্যি, মা জী? তানসেন এ’রকম করতে পারতেন?
মেঘদত্তা হেসে বলল—
— ইতিহাস তো তাই বলে, আম্মা।
বিস্মিত গলায় আম্মা বলল—
— তবে তো, তাঁর গলায় জাদু আছে, মা জী।
– ঠিক যে’রকম তোমার বাবুজীর গলায় রয়েছে।
আম্মা সম্মতিসূচক ঘাড় নেড়ে বলল—
— হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন, মা জী।
মেঘদত্তা একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বলল—

– এই তানসেনের জীবনের একটি দুর্ঘটনা, জানো? যখন তানসেনের প্রতিভা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে, তখন তার অনেক শত্রুপক্ষ তৈরী হয়। সম্রাট আকবরকে তারা অনুরোধ করে, তানসেনকে দিয়ে ‘দীপক’ রাগ গাওয়ানোর জন্য। তানসেন তাদের সেই দুরভিসন্ধি আগে থেকেই জানতে পারেন। ‘দীপক’ রাগ গাইলে তাঁর নিজের শরীরে আগুন লেগে যাবে এবং তাতে তিনি পুড়ে যাবেন। তাই, তিনি নিজের মেয়ে সরস্বতী দেবী ও গুরু-কন্যাকে তালিম দেন ‘মেঘমল্লার’ রাগ গাওয়ার জন্য, যাতে যে’মুহূর্তে ‘দীপক’ রাগ গেয়ে তাঁর শরীরে আগুন জ্বলে উঠবে, সেই মুহূর্তে তাঁর মেয়ে ‘মেঘমল্লার’ রাগ গেয়ে বৃষ্টি নামাতে পারেন। শত্রুপক্ষের প্ররোচনায় সম্রাট আকবর তাঁকে সরলভাবে ‘দীপক’ রাগ গাইতে বলেন।

পরিকল্পনামাফিক, তানসেন গাইতে গাইতে তাঁর গায়ে যখন আগুন লেগে যায়, সে’সময় সরস্বতী দেবী ‘মেঘমল্লার’ গেয়ে বৃষ্টি আনেন এবং সেই বৃষ্টির জলে তাঁর শরীর জুড়িয়ে যায় ও তিনি প্রাণে বাঁচেন।

ADVERTISEMENT

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে মেঘদত্তা থামে। আম্মা কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বলল—
— খুবই দুঃখজনক ঘটনা, মা জী কিন্তু আপনার জীবনের গল্পটাতো এখনো আপনি শেষ করেন নি।
 মেঘদত্তা বাইরের বৃষ্টিভেজা গাছগুলো দেখতে দেখতে বলল—

— বিয়ের পর মল্লারকে ভুলে যাওয়ার অনেক চেষ্টা আমি করি কিন্তু কিছুতেই ভুলতে পারি নি। কিছুদিনের মধ্যেই স্বামীর আসল রূপ বেরিয়ে আসে। প্রতি রাতে মদ্যপ অবস্থায় চলত তার অকথ্য অত্যাচার। একদিন সহ্য করতে না পেরে প্রতিবাদ করলাম। সেই দোষে আমার গায়ে কেরোসিন তেল ঢেলে সে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। পাড়ার লোকেরা আমার চিৎকার শুনে ছুটে এসে আমার গায়ের আগুন নেভায় কিন্তু ততক্ষণে অনেকখানি পুড়ে গেছে। তারাই আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করে বাবা-মাকে খবর পাঠায়। শুনতে শুনতে রাগে আম্মার চোখগুলো জ্বলে উঠল। শিউরে উঠে সে বলল—
— ঐ পশুটার কোনো শাস্তি হলো না, মা জী?
— হ্যাঁ, এই অপরাধে সে এখনও জেল খাটছে। বাবা-মা সবসময়েই আমার সামনে অপরাধীর মতো মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। তানসেনের মতো পুড়ে যাওয়া সেই শরীরের অসহ্য জ্বালা তখন আমার বাঁচার ইচ্ছেটাই শেষ করে দিচ্ছিল। এ’রকম সময় কোথা থেকে আমার খবর পেয়ে মল্লার ছুটে আসে আমার কাছে। দিনরাত হাসপাতালে থেকে আমার সেবা করে। কিছুটা সুস্থ হয়ে যখন আমি বাড়ি ফিরে আসি, মল্লার বাবার কাছে অনুমতি চায়, আমাকে তার কাছে রাখার। ততদিনে মল্লার একজন নামকরা শাস্ত্রীয় পণ্ডিত। বাবা দ্বিতীয়বার আর তাকে ‘না’ করতে পারে নি। আমাকে নিয়ে মল্লার কেরালার এই ছোট্ট, সুন্দর গ্ৰামে চলে আসে। তারপর থেকে আমি এ’ভাবেই তার কাছে রয়েছি। একইভাবে সে এখনও আমার সেবা করে চলেছে।

বাইরের দরজায় ‘খটখট্’ আওয়াজ শুনে চমক ভেঙে আম্মা বলল—
— ঐ বোধহয় বাবুজী এলেন।
আম্মা দরজা খুলতেই মল্লার ঘরে ঢুকে মেঘদত্তাকে বলল—
— শরীর ঠিক আছে তো, মেঘ?
মেঘদত্তা হেসে বলল—
— ভিজে গেছ একেবারে। বাইরে কী খুব জোরে বৃষ্টি হচ্ছে?
— না, খুব একটা জোরে নয়। কেন, মেঘ?
— আমাকে একবার বাইরের উঠোনে নিয়ে যাবে?
মল্লার কিছুক্ষণ অবাক চোখে তাকিয়ে মেঘদত্তাকে হ্যুইল-চেয়ারে করে উঠোনে নিয়ে আসলো। মল্লার বলল—
— ভিজে যাচ্ছ তো তুমি, মেঘ।
মেঘদত্তা বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে হেসে বলল—
— জানো, মল্লার, যখন জানতে পারলাম যে, আগুনে পুড়ে আমার ভোকাল-কর্ডটাও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, আমি আর কখনো গান গাইতে পারব না, তখন খুব কষ্ট হয়েছিল। তারপর ভাবলাম, তুমি তো আছ। তুমিই আমার হয়ে গাইবে।
— তানসেনের মতো ‘মেঘমল্লার’ গেয়ে আমি তোমার শরীরের দগ্ধ-জ্বালা নিরাময় করতে পারছি না ঠিকই, মেঘ, কিন্তু নিজের ভালোবাসার বৃষ্টিধারায় তোমার সব ক্ষত একদিন সারিয়ে তুলব। তোমাকে ছাড়া তো আমি অপূর্ণ, মেঘ। মেঘকে ছাড়া কী কখনো ‘মেঘমল্লার’ সৃষ্টি হতে পেরেছে?

মেঘদত্তা বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে মল্লারের কোমল নিষাদে ডুবে গেল আর তাকিয়ে দেখতে পেল, কাক-দম্পতি তাদের ভেঙে যাওয়া বাসাটা আবার মুখে তুলে নিয়ে কদম গাছের ডালে রাখল আবার নতুন সংসার গড়ার আশায়...।


0 comments

Saurav Chakraborty

Saurav Chakraborty

Shared publicly - 21st Jun, 21 12:00 pm

অসাধারণ একটি গল্প। মনটা কেমন উদাস হয়ে যায়!!♥️

Ria Mitra

Ria Mitra

Shared publicly - 20th Jun, 21 01:06 am

Excellent cover. Thank you.

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait