স্বপ্নপূরণের ইতিকথা

স্বপ্নপূরণের ইতিকথা

সকালে ঘুম সবে ভেঙেছে। বাসি বিছানা থেকে নামার আগেই মায়ের কথা কানে এলো নৈঋতার।

মা বাবাকে বলে চলেছে…. দিনকাল যা পড়ছে আর তারওপর মিমির বয়স ও তো কম হল না! এবার ওর নিজের পায়ে দাঁড়ানোর অজুহাতের তোয়াক্কা না করে ছেলে দেখতে শুরু করো। ২৪ গিয়ে সামনের মাসেই তো ২৫ এ পড়বে।
মানুষজন এখন পশু হতে বেশি সময় নেয় না। যতক্ষণ বাড়ি না ফেরে আমার দুশ্চিন্তায় হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে। বুঝি কাজে আছে। তাও শান্তি মেলে না।



বাবা বলছে… এতো গুলো দিন যখন দেখলে তখন আর কিছু দিন না হয় দেখলেই!

….. আর না গো। মিমির পরে তো ছুটকিও আছে নাকি! ও মিমির থেকে প্রায় ৬ বছরের ছোট হলেও ওর বয়স ও তো ১৮ হতে চলল।
আর দুই মেয়ের বিয়ের মাঝে হাতে তো একটু সময় ও রাখতে হবে নাকি নিজেদের গোছানোর মতো!

…. বেশ।

ADVERTISEMENT
Swades Times Book

 

ঘর থেকে মিমি শুনলো বাবা চুপ করে গেল মায়ের কথা শুনে। আগে খুব মন খারাপ করত মিমির ওর বিয়ে নিয়ে বাবা-মা দুশ্চিন্তা করছে শুনে। রাগও করত। এখন আর কোনো হেলদোল দেখায় না। বোন যে বড় হচ্ছে ও নিজেও জানে; কিন্তু তাই বলে ওকে বিয়ে করতে হবে এই কথাটা ভাবলে ওর অবাক লাগে। মনে হয় আগে জন্মে কি ভুল করেছি নাকি!!

বিছানা ছেড়ে ব্রাশ করতে গেল মিমি মানে নৈঋতা। বোন তখনও ঘুমোচ্ছে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিল।

ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে বাবা’ই কথাটা তুলল।

…. মিমি অনেক হয়েছে তোর নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জেদ। এবার আমরা ছেলে দেখবো।

মা বললো… বোনটাও তো বড় হচ্ছে না কি! এরপর তোকে দেখতে এসে ওকে পছন্দ করলে তো তোর আগে ওকে বিয়ে দিতে হবে। আর আমরা কি ওমন বড়লোক যে দুই মেয়ের বিয়ে এক বছরের মাথায় দিতে পারবো!

মিমি বললো….সবই বুঝলাম মা! কিন্তু যেটা বুঝছি না সেটা হল আমি আমার মতো আছি তো; তোমাদের কাছে বিয়ে করতে চেয়েছি?
নাকি বলেছি আমার আগে বিয়ে বোনের বিয়ে দিতে পারবে না?

আমি বলেছি তো নিজের পায়ে না দাঁড়িয়ে বিয়ে আমি করবো না!

…. তোর এই জেদের জন্য আমাদের দুশ্চিন্তা বাড়ছে! তোর বাবার শরীর খারাপ হচ্ছে। এবার কি না মরলে শান্তি দিবি না??



…. মানে টা কি মা! তোমরা যদি ফালতু চিন্তা করো তাতে আমার কি কিছু করার আছে?

নাকি আমি তোমায় চিন্তা করতে না করলে তুমি চিন্তা করা বন্ধ করে দেবে বলতো?

আর তুমি জানো না আমি কতদূর যেতে পারি স্বপ্নপূরণের জন্য?



…. হ্যাঁ সে তো জানিই! এতদিন তাও ভরসা ছিল সুমিতটা আছে যখন বলবে ঠিক ওকে বিয়ে করে নিবি; কিন্তু ওকেও না করেছিস। এখন তাহলে চিন্তা হবে না?

….মা এটা অমূলক চিন্তা! বিপদ যে কারো যে কোনো জায়গায় হতে পারে। আর ধর্ষণ হওয়ার জন্য রাত করে বাড়ি ফেরা বা দুর্ভাগ্য দায়ী নয়। দায়ী তো নোংরা দু’পেয়ো দের বিকৃত মস্তিষ্ক।

আর বিয়ে হলে বুঝি ধর্ষণ হয় না!

ধর্ষণ ছাড়লাম; কোনো গ্যারান্টি আছে যে যার সাথে বিয়ে দেবে সে খুব ভালো মানুষ হবে? কোনো দিন বধূহত্যার তালিকায় আমার নাম থাকবে না তার কি কোনো নিশ্চয়তা আছে?

…. এসব কি কথা! আমরা কি জেনে শুনে তোকে এমন পরিবারে বিয়ে দেব নাকি যেখানে তোকে মেরে ফেলতে চাইবে??

…. মা কেউই সেটাকে দেয় না; কিন্তু তাও বধূহত্যা হয়! ৭ বছরের ভালোবাসার মানুষ নিমেষে বদলে যায়; সব প্রতিশ্রুতি ভুলে যায়; ২৪ বছর ধরে যে বাবা-মা রাখল তারা ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলতে চায় তাহলে দু-এক মাসের চেনাশোনা পরিবারে বিয়ে দিয়ে অমন দুর্ঘটনা ঘটলে সত্যিই কি তাকে দুর্ভাগ্য বলা চলে?



তাকে তখন আফসোস করবে নিজেদের ভুল বলে আর এখন উদ্যত হচ্ছ সেই ভুল করতে!

…..এমন হলে তো কেউ বিয়েই করতো না। আমাদের বাবা-মা ও তো দেখেশুনে বিয়ে দিয়েছিল আমরা নেই আজ ২৭ বছর একসাথে?
মানুষ তো ভালো-খারাপ দুইই হতে পারে। ওটা তো যার যার ভাগ্য!

…. ভাগ্য কে সৌভাগ্য হওয়ার সুযোগ না দিয়ে দুর্ভাগ্যতে পরিণত হওয়ার সুযোগ দেবার পর সেটাকে ভাগ্য বলে মেনে নেওয়া বোকামি নয় কি?

আর ভেবে দেখো মা; নিজের পায়ে দাঁড়ানোর আগে একটা মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দেওয়ার পর সারাদিন যখন শ্বশুরবাড়িতে কাজ করেও দিনের শেষে শুনতে হয় কোনো কাজ করো না; রোজগার করতে শেখনি; কোনো কাজ হয় না তোমার দ্বারা…. তখন তার মানসিক অবস্থা কেমন হয়?



সে মেনে নেয় বাবা-মায়ের সম্মানের কথা ভেবে আর নিজের পায়ে দাঁড়ায়নি বলে। যদি দাঁড়াতো তাকে ওসব কথা শুনতে হতো না আর ভুলেও কেউ অমন বললে পায়ের তলায় শক্ত জমি থাকত; প্রতিবাদ করার মতো মনের জোর থাকতো। তাই নয় কি?

…. তোর মত রেজাল্ট করে অনেকে বসে আছে। তাদের বাদ দিয়ে তোকে কেন চাকরি দেবে?

…..চাকরিই পাবো বলিনি; আবার পাবো না তাও না! চেষ্টা করলে হয়তো পাবো ঠিকই তবে যে কোনো মূল্যেই হোক না কেন আমি নিজের পায়ে দাঁড়াবো। তারপর বিয়ের কথা ভাববো।

….অত কথা শুনতে চাইনি! কার কি হল কার কি হবে সব ভাবনা একদিকে রেখে নিজের বিয়ের জন্য তৈরি হ ব্যাস!

….. পারলাম না মা; যদি বিয়ে করারই হত সুমিতকেই করতাম না কি? যতই হোক ৭ বছর ধরে তো কম চিনি নি ওকে।

তাও দেখো চেনায় ফাঁক থেকে গেছিল। নইলে ওর ব্যবসা দাঁড়াতেই বাড়ির কথা শুনে আমার স্বপ্নের কথা না ভেবে কি বিয়ের কথা বলতো!

…. আর ও দাঁড়িয়ে যাবার পরেও তুই কি করে নিজের জন্য ওকে ওয়েট করতে বললি? ও তো বাড়ির এক ছেলেই নাকি! ওর বাবা-মা কেন তা মানবে?



…. আমায় ও তোমরা গ্রাজুয়েশন এর পরে বলেছিলে বিয়ের কথা আমি কিন্তু মানিনি!

…. সে তো ওকে ভালোবাসতিস আর নিজের ক্যারিয়ার এর জন্য।

…. তখন বিয়ে না করার দুটো কারণ থাকলেও এখন কারণ একটাই! নিজের স্বপ্নপূরণ।

…. বয়স বাড়ছে বই কমছে না!

…. আজ মরেও যাচ্ছি না! তবে বিয়ে করে মরার চেয়ে স্বপ্ন পূরণের জন্য মরা বেশি ভালো।

…. যা খুশি কর।

 

 


“যা খুশি কর”….বাবা-মায়ের বলা এই তিনটি শব্দ অনেক নিরাশার মুহূর্তেও আশার আলো এনে দেয় প্রাণে।মিমির জীবনেও সেরকমই কিছু ঘটনা ঘটার অপেক্ষা করছিল।শুধু তিনটে শব্দ যেন সব অপেক্ষার অবসান ঘটিয়েছিল।
…………..……………….
কেটে গেছে ৫ বছর..

হ্যাঁ চাকরি পায়নি মিমি; আর চাকরির অপেক্ষায় বসেও থাকেনি।

নিজের পায়ে দাঁড়ানো মানে কখনই চাকরি করা হতে পারে না শুধু। ভাবনার এই গন্ডি পেরিয়ে মিমি নিজের স্বপ্নের ব্যবসা খুলেছে; ড্রেস ডিজাইনিং এর।

না এই বিষয়ে পড়া করবার মত সামর্থ্য ওর ছিলনা; তবে ছোটো থেকেই আঁকার হাত ভালো। এই গুণ কাজে লাগিয়েই আজ ফ্যাশান জগতের অন্যতম নাম হয়ে উঠেছে নৈঋতা সেন।
………

আজ ওর বিয়ে। পাত্র সে ফটোগ্রাফার। মিমির ডিজাইন করা ড্রেসের ফোটো শ্যুট করতে গিয়েই দুজনের আলাপ।বিয়ে করলেও নিজেদের মধ্যে শর্ত করে নিয়েছে কেউ কারো স্বপ্নপূরণের পথে কখনোই বাঁধা হবে না।
আর ছুটকি!
দিদিকে দেখে সেও নিজের পায়ে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে জোরকদমে।
…………

একাগ্রতা আর নিষ্ঠা হয়তো অনেক প্রতিকূলতাকেই জয় করায়। শুধু আপনজনদের ভরসাটা একটু দরকার।

নৈঋতারা কখনও থেমে থাকে না কারও ভরসার আশায়; কিন্তু ওদের ভরসা না করে পায়ে বেড়ি পরাতে চাওয়া মানুষ গুলোকে আফসোস করতে বাধ্য করে নিজেদের যোগ্যতায়।

আর দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে। যেখানে সাড়ে তিন বছর,,সাত-আট বছরের শিশুরা ছাড় পায়না সেখানে একটা পরিণত মেয়েকে নিয়ে বাবা-মায়ের দুশ্চিন্তা স্বাভাবিক। তাই বলে সেই ভয়ে ভীত না হয়ে ভয়কে জয় করে যে কোন রকম পরিস্থিতিতে নিজের সন্তানের পাশে থাকলে সবার স্বপ্ন পূরণ হতে বাধ্য। দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে; স্বপ্ন পূরণের পথে অনেক বাঁধা-বিপত্তি আসবেই তবে তার জন্য জীবন যেন না থামে। তবেই তো হবে সবার স্বপ্ন পূরণ।


(সমাপ্ত)

 
 
  •  

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait