ছোটগল্প - ত্রিমাত্রিক

ছোটগল্প - ত্রিমাত্রিক

আমি

এই শোনো না গো তোমরা আমার একটা কথা। শুনবে? আমি তো কাউকে বলতে পারিনা, তাই সবাই ভাবে আমি বুঝি একটা পাগলী। আচ্ছা পাগলী কী গো? আমার মতো কেউ? তার কি দুটো হাত, দুটো পা, দুটো চোখ, নাক, মুখ আছে? সে কি আমার মতোই কথা বলতে পারেনা? রেগে গেলে হাত পা ছোড়ে আর মুখ থেকে লালা গড়ায়? আমি তো করি এরকম। আমি কে? এবাবা! এটাও জানোনা? আমি তো মিতুন। মা বাবা আমাকে এই নামেই তো ডাকে। আমি যেখানে খেলতে যাই সেখানে নীল জামা পরা আন্টিগুলোও এই নামেই ডাকে। সেখানে কত ছেলেমেয়ে আসে, সবাই আমার মতো। ওরাও কথা বলেনা, মা বাবার সাথে চুপ করে বসে থাকে, মাঝেমাঝে দোল দোল দুলুনি করে আর রেগে গেলেই হাত পা ছোড়ে। জানো তো আমি না আমাকে পাখি বলে ডাকি। কেউ ডাকেনা, আমিই ডাকি। আমি এখন পাখি চিনতে পারি, ওই যে যারা উড়ে বেড়ায় না? আর কী সুন্দর আওয়াজ করে! ওগুলোই তো পাখি। আমি তো ফুলও চিনতে পারি, রঙও চিনতে পারি। লাল, নীল, হলুদ। ওই সুন্দর লোকটা শিখিয়েছে তো।

আমার খেলতে যাওয়ার সাদা বাড়িটাতে চারটে আন্টি আর দুটো লোক থাকে জানো। একটা তো ওই সুন্দর লোক, আরেকটা লোকের সাদা সাদা চুল আর চোখের ওপর একটা কী যেন লাগানো থাকে, গোল গোল। লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে হাসে, মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, মিষ্টি মিষ্টি ওষুধ খেতে দেয়। আমি কিন্তু হাসি না। আমার হাসতে ভাল্লাগেনা। আন্টিগুলো আমাকে খাইয়ে দেয়, তারপর নিজে নিজে চামচ ধরতে শেখায়, মুখ দিয়ে সুন্দর সুন্দর শব্দ করে। আমি তাও হাসি না। শুধু ওই সুন্দর লোকটাকে দেখে হাসি। ও ও তো হাসে। আমাকে বলে “তুমি তো মিতুন। বলো আমার নাম মিতুন, মিতুন সেন”। আমি বলিনা। ও আমাকে পাখি বলে ডাকেনা কেন? তাই তো আমি কথাই বলিনা। কিন্তু ওর ওপর আমি একটুও রাগ করিনা। ও থাকলে আমি ওর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে পুরো ভাতটা খেয়ে নিই, লাল নীল বলগুলো রঙ মিলিয়ে মিলিয়ে সাজিয়ে রাখি, এ বি সি ডি বলে দিই, কারুর ওপর রাগ করিনা, দুষ্টু মেয়েটা আমার পাশে এসে বসলেও ওকে কামড়ে দিইনা। ওই লোকটা আমাকে তখন বলে “গুড গার্ল”। কিন্তু ও কেন রোজ রোজ আসে না? আমার তো কষ্ট হয় ওকে না দেখলে। আমি রেগে যাই, হাত পা ছুড়ি। আন্টিগুলো আমাকে আদর করে, খেলনা দেয়, আমি সব ভেঙে ফেলি। মা কাঁদে। বাবা মাকে কীসব যেন বলে আর মাথায় হাত বুলোয়। ও থাকলে তো আমি শান্ত মেয়ে হয়ে যাই। সবাই ওকে এনে দেয় না কেন? আমাকে তো ওর কাছে নিয়ে যেতে পারে।

সে

আমি অনির্বাণ রায়চৌধুরী, একজন পিডায়েট্রিক নিউরোলজিস্ট। আজ প্রায় বারো বছর হলো সোনারপুরের এই ‘হোপ অটিজম সেন্টার’এ রয়েছি। স্যারের স্বপ্নের প্রকল্প। স্যারের একমাত্র ছেলে রাতুলের অকালে হারিয়ে যাওয়া মেনে নিতে পারেননি বৃদ্ধ মানুষটি । তাই কলকাতার নার্সিংহোমের বাইরে আমার এই পথচলা, স্যারের ছায়াসঙ্গী হয়ে। আমার এই বিশেষ শিশু কিশোরদের সান্নিধ্য এখন অনিবার্য হয়ে পড়েছে। কেউ কেউ বেশ হাসিখুশি, তবে অধিকাংশই একা একা চুপ করে থাকতে পছন্দ করে। ওদের জোর করা যায়না, উচিতও না। তবে আমার এই বারো বছরের কেরিয়ারে সবথেকে বেশি নজর কেড়েছে মিতুন, মিতুন সেন।

চার বছর বয়সের ছোট্ট মিতুনকে ওর বাবা মা আমাদের কাছে নিয়ে আসেন আমাদের সংস্থার প্রথম বছরেই। আজও মনে আছে, প্রথম দিনে কিছুতেই সে মায়ের কোল ছেড়ে আসবেনা। এদিকে জোর করারও আমাদের উপায় নেই। প্রায় বছর পাঁচেক ও মায়ের কোলে বসেই আমাদের ট্রিটমেন্ট নিত। দীর্ঘদিনের ট্রিটমেন্টে অল্প হলেও সাড়া দিয়েছে। চিনতে পেরেছে মা বাবাকে, গাছ ফুল পাখিকে। ডাকতে পেরেছে একে একে, নাম ধরে। কিন্তু কেন জানিনা কিছুতেই নিজের নাম বলেনা। ইদানীং কেমন যেন আঁকড়ে ধরেছে আমাকে। সেন্টারের বাকি সবার সঙ্গেও খারাপ ব্যবহার যে করে তা নয়, তবে আমি থাকা পর্যন্তই। বাকি সময়টা চুপ করে গুম হয়ে থাকে। খেতে চায়না, মা বাবা কাছে এলে গায়ে হাত দিলেও দূরে ছিটকে সরে যায়। যত দিন যাচ্ছে ততই যেন এটা বাড়ছে। নার্সিং স্টাফরা মাঝেমাঝে স্যারের কাছে অভিযোগ জানান, কখনও খাবারের বাটি ছুড়ে মারছে কারুর মুখে, কখনও আবার দেওয়ালে মাথা ঠুকছে, মুখ থেকে অবিরাম ‘গোঁ গোঁ’ আওয়াজ। সবটাই হয় আমার অনুপস্থিতিতে। আমি সামনে থাকলেই অদ্ভুত শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, মুখে লাজুক মিষ্টি হাসি। কাছে গেলেই চেপে ধরে আমার হাত, কী যেন একটা অব্যক্ত আকুতি সেই স্পর্শে। এরমধ্যে শুনলাম একদিন নাকি রুমেলাকে কামড়ে দিয়েছে। সে এক রক্তারক্তি কাণ্ড। আমি সেদিন কলকাতায় ছিলাম, ডিউটিতে। রুমেলা আমার বান্ধবী। ও সাইক্রিয়াটিস্ট। নিজেই বলেছিল, “তোমার সেন্টারে যদি কোনো হেল্প লাগে আমি যাব কিন্তু। তুমি না কোরো না প্লিজ”। তারপর থেকে মাঝেমাঝে আসে, দেখে যায় ওদের। কিন্তু মিতুনের এই ব্যবহার আমাকে অবাক করে। আমি যা আন্দাজ করছি সেটা কীভাবে সম্ভব! অটিস্টিক মানুষ কি ভালোবাসতে পারে?

সখা

ওই মেয়েটা, ওই মেয়েটাকে আমি ডাকি তো। “মিইইই তুউউউ” এরম করে ডাকি তো আমি। তাকায় না। একদম তাকায় না আমার দিকে। হাসে না, একটুও হাসে না। শুধু আকাশ দেখে, আর যেগুলো উড়ে যায় ওগুলো দেখে। আচ্ছা আমি কি পচা? আমি ডাকলে হাসে না, আর ওই লোকটা ডাকলেই হাসে কেন? আমার তো ওকে ডাকতেই ভাল্লাগে। ওর পাশে বসতে ভাল্লাগে। ওর আঙুল ধরতে ভাল্লাগে। ও হাত ছাড়িয়ে নেয়। দূরে গিয়ে একলা বসে থাকে। আমি রাগ করি, পা ছুড়ি, আঙুল কামড়ে দিই।

বুড়ো লোকটা আমাকে বলে, “রনি, ডোন্ট বি আ ব্যাড বয়”। আমি ব্যাড বয় নই। আমি তো মাম্মামকে বিরক্ত করিনা। মাম্মাম বলে আমি মাম্মামের কেউ না। আমাকে পাপা ডাস্টবিন থেকে নিয়ে এসেছে। ডাস্টবিন মানে কী গো? আমি তো কথা বলতে পারিনা, তাই পাপাকে জিজ্ঞাসাও করতে পারিনা। মাম্মাম আমাকে দেখলে অন্য ঘরে চলে যায়। দরজা বন্ধ করে দেয়। আমি একা একা বসে থাকি। একটুও রাগ করিনা। পাপা বলে, “রনি তো গুড বয়”। পাপা আমাকে রোজ এই সাদা বাড়িটাতে নিয়ে আসে। ওই বুড়ো লোকটাকে কী যেন বলে রোজ রোজ। আমি তো ওদের সব কথা বুঝতে পারিনা। পাপা বলেছে এখন থেকে এটাই আমার বাড়ি। এখানেই আমি থাকব, খেলব। পাপা রোজ আসবে আমাকে দেখতে। কিন্তু এখানে আমার শুধু ওই মেয়েটাকেই ভালো লাগে তো। আমার ওকে দেখতে ইচ্ছে করে। ও হাসলে আমার ভালো লাগে, আমিও হাসি। ওরা জানেনা তো সেটা। আমি বলিনি তো। বলতে পারিনা যে।

পরিশিষ্ট

জীবন ঘড়ির তিনটে কাঁটা ঘুরতে থাকে। একজন ছুঁয়ে থাকে আরেকজনকে। এগিয়ে চলে নিজেদের পথে। ধীরে ধীরে বদলে যায় সময়, জীবনচক্র। ষাট সেকেন্ড এক হয়ে জন্ম নেয় মিনিট, আর ষাট মিনিট মিশে যায় ঘন্টায়। কিন্তু মিলেমিশে এক হওয়ার সময়টা বুঝি আসেনা।

ADVERTISEMENT

 

______________

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait