বালির গোস্বামী পাড়ার মৌ কে চেনেন তো? হাঁ, ঠিক ধরেছেন ঐ যে মাঠের পাশের ছোট্ট সাদা বাড়ি টা, যার সামনে একটা বড়ো পেয়ারা গাছ আছে সেই বাড়ির একমাত্র মেয়ে হলো মৌ। সেই মেয়ের ছোটো বেলা থেকেই অনেক গল্প আছে, দাঁড়ান দাঁড়ান সব বলছি আস্তে আস্তে, অতো অধৈর্য হলে তো আর চলবে না!
মিষ্টি টুকটুকে ফর্সা মৌ যখন মায়ের কোল আলো করে ঘরে এলো ঠিক তখনই ওর ঠাকুর্দা ওকে ডার্লিং বলে সম্মোধন করে আপন করে নিলো। ব্যস সেই যে ডার্লিং এর সাথে জুড়ি বাঁধা হলো একেবারে ছাড়ার নাম গন্ধ হলো না। দুজনেই দুজনকে এক মুহূর্ত ছেড়ে থাকতে পারতো না। দাদু নাতনি বলতে অজ্ঞান আর নাতনি তো দাদুর নামে আত্মহারা। নেহাত মায়ের সাথে খাবারের সম্পর্ক, তাই রাত টুকু মৌ মায়ের খাটের ভাগিদার হতো। বিকেলে ঘুরতে যাওয়া, সকালে বাজারে যাওয়া, বই নিয়ে পড়তে বসা সবকিছুতেই মৌ এর একমাত্র সাথী হলো ওর প্রিয় ডার্লিং দাদু।
ADVERTISEMENT
সেই দাদু হঠাৎ বিনা নোটিশে দশ মিনিটের বুকের যন্ত্রনায় জীবনের ছোট্ট প্রেমিকাকে ছেড়ে পাড়ি দিলেন ফিরে না আসার দেশে।
মৌ কে তো প্রায় তিন/ চার দিন কিছু খাওয়ানোই যায় নি। অনেকদিন পর্যন্ত ঘুমের ঘোরে দাদু দাদু বলে কঁকিয়ে কেঁদে উঠেছে মৌ। তারপর সময়ের পলি তে মৌ তার ডার্লিং এর কথা আস্তে আস্তে ভুলেছে। ছ বছর বয়স হলে বাড়ীর সামনের প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হবার পর মৌ এর অনেক বন্ধু হলো। সব থেকে প্রিয় বন্ধু হলো মাঠের ওপাশের ঘোষে দের বাড়ীর রাজু। রাজু স্কুলে তো মৌ এর পাশে বোসতই , আবার ছুটি থাকলেও ওদের বাড়ী বা মাঠে দুজনে মিলেই খেলাধুলো করতো। মানে মৌ আর রাজু ছিলো এক্কেবারে বেস্ট ফ্রেন্ড। সব রকম গল্প, পড়া, খেলা ,টিফিনের ভাগ হতো একেবারে আধাআধি।
এই রাজু আর মৌ যখন ক্লাস ফাইভ এ উঠলো, তখন ওদের সেকেন্ডারি স্কুল আলাদা হয়ে গেলো ঠিকই, কিন্তু পাড়ার বন্ধুত্বটা একটুও কমলো না।
কিন্তু এখানেও বিচ্ছেদ এসে দাঁড়ালো দুজনের মাঝখানে রাজুর বাবার চাকরির হাত ধরে। রাজুর বাবা যে কোম্পানি তে কাজ করতেন সেখান থেকে ওনাকে বদলি করা হলো জামশেদপুরের একটা শাখা অফিসে। এটা জানার পর থেকে তো দুই বন্ধুর চোখের ঘুম, দিনের খাওয়া, বিকেলের খেলা সব উধাও হয়ে গেলো। কান্নাকাটি থেকে শুরু করে মৌ দের বাড়িতে রাজুকে রেখে দেবার কথাও উঠে এলো। কিন্তু দশ বছরের একমাত্র ছেলেকে ছেড়ে কোনো মা বাবাই অন্য জায়গায় যেতে পারে না। অগত্যা বিদায় নিতেই হলো। কিছু প্রিয় খেলনা, বই এর আদানপ্রদানের মাধ্যমে শুরু হলো দুজনের বিচ্ছেদের দিন।
মিষ্টি মৌ তারপর বড়ো হতে হতে teen age এ পরলো, ও তখন আরো সুন্দর ,আরো সুন্দর হয়ে উঠেছে। ক্লাস নাইন এ তিন জায়গায় টিউশন পড়তে গিয়ে বেশ কিছু রুপ মুগ্ধ চোখের নজরে পরে যেতে হয়েছে তাকে। তার মধ্যে আবার এক জোড়া চোখ যেন বারে বারে ওকেও টানে। কিশোর বন্ধুটির নাম জীবন। পড়তে গিয়ে মাঝে মাঝে আড় চোখে চাওয়া, বই দেবার ছলে একটু হাত ছোঁয়া, ঘরে পড়তে বসে হঠাৎ মনটা উদাস হয়ে যাওয়া এ সব চলছিল গোপনে , নিভৃতে।
মাধ্যমিকের পর পরিচয়টা আরো বাড়ল। বিজ্ঞান নিয়ে দুজনেই ভালো স্কুলে ভর্তি হয়ে মানসিক ভাবে আরো কাছাকাছি চলে এলো। অনেক বড়ো কিছু চিন্তা ভাবনা না করতে পারলেও এখন ওরা একসাথে পড়তে যায়, পড়া নিয়ে আলোচনা করে, ভবিষ্যত নিয়ে টুকটাক স্বপ্নও দেখে। ভালো লাগা টা কি ভাবে যেন ভালোবাসায় পরিণত হয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু জীবনের বাবা ছিলেন বরাবর কিছুটা অসুস্থ, বুকের একটা vulb খারাপ হয়ে গেছিল অনেক আগেই। যেদিন জীবন আর মৌ এর উচচ মাধ্যমিকের ফল প্রকাশ হলো, সেদিন রাত্রেই সকলকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন তিনি পরিবার টা কে ভাসিয়ে দিয়ে। জীবনের মা ছাড়া এখানে আর কেউ ছিলো না। ওর মামা কেরালায় চাকরি করতেন, এখানে এসে নিয়ে যেতে চাইলেন বোন আর ভাগ্নে কে। জীবন কিছুতেই যেতে চায় না তার ছোটোবেলার শহর, পাড়া, বন্ধু, সবাইকে ছেড়ে। কিন্তু অর্থ আর নিরাপত্তার কারনে , কেরালা তেই নতুন উচ্চতর কলেজে ভর্তি হবার জন্য জীবন কে মেনে নিতে হয় ভাগ্যের পরিহাস। তাছাড়া ওরা নিজেরাই তো অন্যের ওপর নির্ভরশীল, তাই যোগাযোগ রাখার আশ্বাস , ফোনের নম্বর , আর অনেক মধুর স্মৃতি নিয়েই মৌ এর কাছ থেকে বিদায় নিতে হলো জীবন কে। পড়াশোনাকে আঁকড়ে ধরা
মৌ আর কারুর সাথে সেভাবে মিশতে চায় না। গুটিয়ে নিয়েছে নিজেকে। ছোট্ট মিষ্টি উচ্ছল মৌ আজ অনেক বেশি গভীর আর শান্ত।
কলকাতার এক ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে ভালো ভাবে পাশ করে চাকরি পেয়ে যেতে হয় তাকে বাঙ্গালোরে। আবার নতুন জীবন শুরু হয় মৌ এর। ঐ অফিসেই কর্মরত এক বাঙালী ছেলের সাথে ক্রমে ঘনিষ্ঠতা হলো মৌ এর। নিজের মধ্যে গুটিয়ে যাওয়া মৌ অনেক, অনেক ভেবে তবেই এই সম্পর্ক টায় এগিয়েছে যদিও ঠিক প্রেমে পরে তৈরি হযেছে এই স্পেশাল সম্পর্কটি তা কিন্তু নয়। জীবন কে না ভুলতে পারা মৌ কলেজের শেষের দিক থেকে আর ওকে ট্রেস করতে পারে নি। হঠাৎ করে ওর ফোন জানাতে থাকে ঐ নম্বরের কোন অস্তিত্ব না থাকার কথা।
এদিকে অচেনা শহরে মৌ এর বয়স্ক মা বাবা চায় যে কোন ভাবে মেয়েকে একটা নিরাপত্তার সম্পর্কে আবদ্ধ করতে। বাস্তবিক অনেকটা সেই কারণেই মৌ এগিয়ে যায় নতুন বন্ধুত্বে । যদিও বার বার ওর প্রিয় মানুষ, প্রিয় সম্পর্ক চলে গেছে ওকে ছেড়ে, করে গিয়েছে একা বার বার। তাই মনে মনে এবার বলেছে যে আর মন থেকে সম্পর্কে ঢোকা নয়, এবার প্রয়োজনেই নতুন পথে হাঁটা। কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর হয় আর এক। অভির সরলতার কারণেই হোক আর মৌ এর আর্দ্র মনের কারণেই হোক মৌ ভালোবেসে ফেলে অভি কে। ছোটো বেলায় মা বাবা মরে যাওয়া অভির ছোট্ট কোয়ার্টারটাকে সুন্দর করে অনেক ভালোবাসা দিয়ে গড়ে তোলার চেষ্টা করতে থাকে।বাড়ির সামনে চারটে গোলাপের টব সাজিয়ে প্রেম কে আরো গভীর করে তুললো। নিজের চাকরি, নিজের সংসার, নিজের স্বপ্নে সওয়ার হয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলো মৌ। অভিও যেন মৌ কে পেয়ে কেমন একটা সব পেয়েছির দেশে বিচরণ করতে লাগল।
হাওয়ার গতিতে এক বছর যেতে না যেতেই বিধাতার কুনজরে আবার বিচ্ছেদ।
এবার ট্রেনের সাংঘাতিক এক্সিডেন্টে ভেঙে গেলো মৌ এর নতুন করে গড়ে তোলা আশা, নতুন স্বপ্ন, নতুন সম্পর্ক। আবার বিচ্ছেদ?? এই অকাট্য ভাগ্যের পরিহাস থেকে মৌ বেরোবে কি করে? মৌ এখন আর রোজ অফিসে যেতে পারে না, মন দিয়ে নিজের কাজটুকু ও করতে পারে না। মৌ এখন প্রেম হীন করে তুলতে চায় পৃথিবীকে। তাই যাকে দেখে , যার সাথেই পরিচয় হয় তাকেই বোঝাতে বসে কাউকে না ভালবাসার কথা, কাউকে প্রেম না করার কথা। কাউকে মন না দেবার কথা। যদি প্রেমকে রক্ষাকরতেই না পারল তাহলে প্রেম দিল কেন ভগবান ওকে? বারবার দিয়েও ছিনিয়ে নিল কেন ওর কাছ থেকে ওর প্রেম কে? তাই প্রেম না করাই ভালো মানুষের , আর তাই মৌ এর প্রেমে পড়াই যে বারণ। প্রেম শব্দটাই যে বিভীষিকা। প্রেমের পথ টাই যে কাঁটায় ভরে গেছে মৌ এর জীবনে। যেখানে দাদু, রাজু, জীবন, অভি সবাই একাকার হয়ে যাচ্ছে বার বার।
0 comments