বিনায়ক কর্তৃক বিঘ্নাসুর বধের কাহিনী

বিনায়ক কর্তৃক বিঘ্নাসুর বধের কাহিনী

আবার নবযুগের প্রারম্ভকাল। সৃষ্টিকর্তা তখন সৃজনসুখে ব্যাপৃত, সৃষ্টিভিলাষী ব্রহ্মা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে শুরু করেছেন ঘোর থেকে ঘোরতর তপস্যা। দিনরাত, সময়কাল অতিবাহিত হচ্ছে ভীষণ তপস্যার মাধ্যমে। তপস্যা চলাকালীন হটাৎ তাঁর হৃদয়ে এক অদ্ভুত অহংবোধ জাগরিত হল, নিজের প্রতি তিনি নিজেই বিমুগ্ধ হলেন, এরূপ অবস্থায় তাঁর চিত্তবৈকল্য ঘটলে তিনি ভাবলেন আমিই এ জগতের একমাত্র কর্তা ও ভোক্তা, আমা ভিন্ন অন্য কেউ নেই,

কর্ত্তা অহঞ্চ ভোক্তা চ নান্যোহস্তীতি স চাব্রব্রীৎ...
(দেবীপুরাণ)


তিনি ভাবলেন তিনিই সব, বিষ্ণু ও মহেশ্বর তাঁর কাছে তুচ্ছ। তিনি নারায়ণ ও মহেশের প্রতি অবজ্ঞা জ্ঞাপন করতে লাগলে তাঁর আননের ডানদিক হতে এক তীব্র জ্বালাময়ী অগ্নিশিখা নির্গত হল— সৃষ্টি হল এক ভয়ঙ্কর অসুর, বিঘ্নাসুর! ব্রহ্মার অহংবোধ হতে নিঃসৃত সে অসুরের চক্ষু ও ভ্রূমধ্য ক্রোধে রক্তবর্ণ, তার হাতে চক্র ও ত্রিশুল, সে জন্মমাত্র ব্রহ্মার প্রতি গর্জন বর্ষণ করে তাঁকে উত্তেজিত করে তুললো।
ব্রহ্মা বুঝলেন তিনিই সব হট্টগোলের মূলে, তাই তিনি যুদ্ধ শুরু করলেন তাঁরই সৃষ্টির সঙ্গে এবং অব্যবহিত পরাজিত হয়ে হলেন।

ওদিকে অসুরকে দেখে দৈত্যগণ ভারী হর্ষিত হয়ে উঠলো, আর দেবতারা প্রমাদ গুনলেন। ভগবান বিষ্ণু অবস্থা দেখে দেবাদিদেবের শরণাপন্ন হলেন ও অনেক স্তব স্তুতি করে তাঁকে সন্তুষ্ট করতে লাগলেন (অনেক হে প্রভো প্রভো আছে, আমি আর বিস্তারিত গেলাম না)। এত গুণগান শুনে আশুতোষ তাঁর অর্ধনিমীলিত নয়ন উন্মীলিত করে মধুসূদনকে বর প্রার্থনা করতে বললেন। জনার্দন সবিস্তারে ত্রিপুরারিকে সব খুলে বললে তিনি পদ্মনাভকে মালব্যপর্বতে লক্ষ্মীদেবীর সাথে গমন করতে বললেন—সেখানে জগতের মূলকারণস্বরূপিণী দেবী তাঁর সঙ্গে লক্ষ্মীদেবীর মিলন ঘটাবেন ও তারই ফলস্বরূপ সর্ব্বদেবময়, সর্ব্ববিঘ্নবিনাশী, নরদেহধারী, সর্ব্ব দেবগণের নায়ক, স্বয়ম্ভু দেব বিঘ্নহর্তা গজাননের উদ্ভব হবে।

ADVERTISEMENT


গজবক্ত্রং নরকায়ং সৰ্ব্ববিগ্নবিনাশনম্
সৰ্ব্বদেবময়ং দেবং ভবিষ্যাত সুরোত্তমম্
নায়কং সর্ব্বদেবনামনায়কস্বম্ভুবম্…
শিব আরও বললেন, তোমার পুত্ররূপে এলেও হে চক্রপাণি তুমি তাঁর অর্চনা করবে, তাঁকে দেখা মাত্রই বিঘ্নাসুর হীনবল হবে।

শূলপাণির কাছ থেকে উপদেশ গ্রহণ করে লক্ষ্মীনারায়ণ মালব্য পর্বতে উপস্থিত হলেন। সে স্থান অতিশয় অপূর্ব ও মনোরম, সেখানে শ্রীসহ হরি রমণ করতে লাগলেন। সৃষ্টি রক্ষার্থে এ ক্রিয়ার সঙ্গে অন্যান্য দেবতারাও যোগ দিলেন, তাঁরাও সেখানে তপস্যা শুরু করলেন। বাগ্দেবী সেখানে বেদরূপ ধারণ করে শ্রীহরির সাথে তপস্যায় রত হলেন। ক্রিয়ার প্রাবল্যে ভগবান শ্রীবিষ্ণুর মনে রজভাব সৃজনেচ্ছা উপস্থিত হল, তিনি তাঁর করতল মথিত করে গজাননের সৃষ্টি করলেন।


তদা তস্যাভবদ্ভাবো রাজসঃ পরমেচ্ছয়া
পাণৌ সংমথয়িত্বা তু নরকায় গজাননম্...

বিনায়কের জন্ম হলে সকল দেবতারা উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন। অপূর্ব রূপ তাঁর— চন্দ্র, সূর্য, অগ্নি তাঁর নয়নে। ব্রহ্মা অধিষ্ঠিত তাঁর মস্তকে। বৃক্ষরাজি তাঁর কেশ। একাদশরুদ্র তাঁর গ্রীবা। নক্ষত্র তাঁর দন্তসমূহ। ধর্ম-অধর্ম তাঁর দুই ওষ্ঠ। সরস্বতী তাঁর জিহ্বায় বিরাজমানা। দশদিক তাঁর কান। দেবরাজ তাঁর নাসিকা হলেন। স্বয়ং মহাদেব তাঁর ভ্রূ-মধ্য। সপ্তসাগর তাঁর উদর অধিগ্রহণ করলেন। ঋষিগণ তাঁর রোমকূপ হলেন। যক্ষ, রাক্ষস, দৈত্য, গন্ধর্ব, কিন্নর, পিশাচ দ্বারা জঠর নির্মিত হল। নদী হল বাহুদ্বয়। সর্পগণ আঙ্গুল, তারারাজি নখ হল। হৃদমূলে আদিদেবী, লিঙ্গে সৃষ্টিদেবী অধিষ্ঠিতা হলেন। ধর্ম ও যম নাভি অধিকার করলেন। পৃথিবী কটিদেশে। অশ্বিনীকুমারদ্বয় জানুতে। পর্বত উরুদেশে। মনুষ্যলোক চরণ স্থানাধিকার করলো। পায়ের আঙুলে অবস্থান করলেন রুদ্র ও প্রলয়াগ্নি। গণপতির সর্বাঙ্গে যুগ, মনু, কল্প (ব্রহ্মার একদিন), দিন, কাষ্ঠা (অতি সূক্ষ্ম কালপরিমাণবিশেষ), কলা (তিরিশ কাষ্ঠা= এক কলা) ও লব(অতি সূক্ষ্ম কালাংশ) শোভিত হতে লাগলো। এহেন অপরূপী বিঘ্নেশকে দেখে নারায়ণ স্তব করলেন,
হে গজানন আপনি দেবতাদের শত্রু বিনাশ করুন। আপনার দেহকান্তি অতি মনোহর তাম্রবর্ণ। আপনার দন্তরাজি কুন্দফুলের ন্যায় শুভ্র। আপনার বপু সূর্যের পথ রোধ করে, আপনার দেহভার সুমেরু পর্বতকেও ভূ মাঝে দমন করেছে। আপনার তর্জনে দৈত্যগণ কম্পমান হয়। আপনি দেবতাদের প্রথম ভ্রাতা ও দেবাদিবের দ্বিতীয় মূর্তির ন্যায় অবলোকিত। আপনার এক হস্তে লাড্ডু ও ওপর হস্তে সিদ্ধার্থ। রক্তাভ আকর্ণ বিস্তৃত নয়নযুগল আপনার। যোগিনীগণ আপনার নিত্য সেবা করে। আপনি আমাদের রক্ষা করুন— গণেশ প্রভূত স্তুতিতে অতিশয় তৃপ্ত হলেন।
সিদ্ধিদাতা বললেন, হে বিষ্ণু আপনাকে সন্তুষ্ট করার জন্য ও দেবরাজ ইন্দ্রের শত্রুসংহারর্থে মহাদেব আমায় প্রেরণ করেছেন, অতএব বলো আমায় কী করতে হবে? আমি অবিলম্বে সকল অরিদমন করবো।

এবার মহাদেবসহ সব দেবতাগণ স্থূলকর্ণকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করলেন, মহেশ্বর তাঁকে অর্ধচন্দ্র (একপ্রকার আয়ুধ) প্রদান করলেন। ব্রহ্মা দিলেন শ্বেতমেখলা। সূর্য দিলেন বিদ্রুম (পদ্মরাগমণি)। বিষ্ণু দিলেন শঙ্খ ও ধনুক। ইন্দ্র দিলেন বজ্র, যম দিলেন দন্ড, বরুণ দিলেন গদা, অঙ্কুশ ও পাশ।
উমা প্রদান করলেন বিজ্ঞান, মহাদেব যোগ, যোগীগণ দিলেন তেজ, বল ও সিদ্ধি, সমুদ্র দিলেন গাম্ভীর্য্য— ধীরে ধীরে শস্ত্র ও শাস্ত্রে সজ্জিত করে বিঘ্নহর্তাকে সকল দেবতাদে অধিপতিরূপে অভিষিক্ত করা হল ও সর্বাগ্রে তাঁরই পূজা হবে এরূপ বর প্রদান করা হল।

শুরু হল গজপতির বিঘ্নাসুরের উদ্দেশ্যে উদয়াচল যাত্রা, সঙ্গে মিলিত হলেন সকল দেবগণ। বিঘ্নাসুর উদায়াচলে তাঁর সমগ্র সেনাসহযোগে বাস করছিল, সেখানেই এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধ শুরু হল। কিন্তু সে যুদ্ধে অচিরেই দানবসৈন্যগণ গজসৈন্যদের পরাভূত করে ফেললে দেবতাগণ ভীত হলেন। ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ ও ইন্দ্রাদি দেবগণ একযোগে সকল দিব্যাস্ত্র প্রয়োগ করলেন ও ঠিক সেই মুহূর্তে কুপিত বিঘ্নরাজ নিদারুণ গর্জন করে রুদ্রাস্ত্র ক্ষেপণে বিঘ্নাসুরের কণ্ঠ ছিন্ন করলেন। নিজেদের মহারাজকে মৃত দেখে অসুরের হীনবল সেনাদলও মুহূর্তে গণেশ দ্বারা নিঃশেষিত হল। ইন্দ্র তাঁর রাজ্যসঙ্কট হতে মুক্ত হলেন ও পুনরায় ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠিত হল।

যদিও বিভিন্ন পুরান ও লোককথা অনুযায়ী গণেশের জন্মকাহিনী ভিন্ন ভিন্ন। একটি মতে শিব তাঁকে সৃষ্টি করেছিলেন, অন্যমতে তাঁকে সৃষ্টি করেছিলেন পার্বতী।আরো একটি মতে, শিব ও পার্বতী এক রহস্যময় উপায়ে তাঁকে সৃষ্টি করেছিলেন। লিঙ্গপুরাণ অনুযায়ী গণেশের জন্ম হয়েছিল দেবাদিদেব মহাদেবের অংশে উমার গর্ভে সকল তমোনাশ হেতু আবার দেবীপুরাণ অনুসারে বিঘ্নাসুর বধের উদ্দেশ্যে নারায়ণ কর্তৃক তাঁর জন্ম হয়।

কলিকালে গণপতির নাম জপে সকল অন্ধকার দূর হয়। পুরাকাল হতে বর্তমানে সভ্যতার সঙ্কটকালে আজও সিদ্ধিদাতা বিনায়ক তাঁর ভক্তদের উদ্ধার করে চলেছেন। তবে তাঁকে এ চর্মচক্ষুতে উপলব্ধি করা যায় না, তিনি নির্গুণ, তিনি নিরাকার— তাঁর এ রূপ আমরাই তাঁকে প্রদান করেছি। তিনি আমাদের হৃদয়াকাশে ব্রহ্মজ্যোতিস্বরূপ নিত্য প্রোজ্জ্বল, তাই বিবিধরূপে বিবিধ কাজে মানুষেরই মাধ্যমেই তিনি সতত সর্বতভাবে রত আমাদের বিঘ্ননাশে।।

তথ্যসূত্র:
দেবীপুরাণ
লিঙ্গপুরাণ
ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরাণ

ছবি: Deccan Chronicle


0 comments

Saurav Chakraborty

Saurav Chakraborty

Shared publicly - 21st Sep, 21 09:51 pm

খুব ভাল লাগল...

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait