মেয়েটির নাম জয়

মেয়েটির নাম জয়

আকাশটা কালো করেছে ভালোই, ঝড় আসবে বোধহয়। জানালাগুলো বন্ধ করতে ইচ্ছে হচ্ছে না জয়ের। মনের ভেতরের ঝড়টা বাইরেও দেখা যাচ্ছে। ঘুরতে ঘুরতে হাওয়া তুলে নিয়ে যাচ্ছে শুকনো পাতা, শুকনো ঘাস, বালি৷ জয়ের উড়ন্ত চুলগুলো গালের উপর এসে পড়ছে বারবার। আজ তার চুলগুলো সরিয়ে নেবার কেউ নেই। অন্যদিন হলে কাঁধে গরম নিশ্বাস পড়তো, পিঠ বেয়ে কারো ভেজা আঙ্গুল নামতো, গালের ওপর নিকোটিনে পোড়া শুকনো ঠোঁটের আদর শিহরিত করতো তাকে। সিগারেট খাওয়া সেই নিশ্বাসের গন্ধটা জয় মনে করবার চেষ্টা করে, বানিয়ে বানিয়ে বলতো সে দীপ্তকে।

 – ইশ, কেন খাও ওসব? কি বাজে গন্ধ!

না, সেই নিশ্বাসের গন্ধটাই যে কবে তার আতর হয়ে গিয়েছে জয় বুঝতে পারেনি।

বৃষ্টি কেমন ছুটে আসছে, দীপ্ত যেভাবে ছুটে আসতো আর জয়কে নিয়ে আছড়ে পড়তো বিছানায়। সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে দিতো শরীরের ঘেমো গন্ধটা।

আর থাকতে পারছে না জয়, বিছানায় ছুটে বালিশ, চাদর হাতড়ে গন্ধটা খোঁজে। নেই, নেই কোথাও নেই!

বৃষ্টির ঝাপটায় ভিজে যাচ্ছে জয়ের টেবিলটা, টেবিলে রাখা জয় আর দীপ্তর ছবিটাতেও জলের ঝাপটা এসে পড়ছে।

জানলাটা বন্ধ করে দেয় জয়, সাথে সাথেই লোডশেডিং।

মোমবাতি জ্বালিয়ে ছবিটা ভালো করে দেখতে থাকে জয়।

কলেজের প্রথম দিনগুলো মনে পড়তে থাকে ওর। জয়ের মেয়েলি স্বভাবটা স্কুলজীবন থেকেই প্রকট। সবাই হাসতো, মজা করতো, আর জয় গুটিয়ে থাকতো নিজের খোলসে।

এক দিদি ছাড়া জয়ের কেউ নেই, বাবা-মা মারা গিয়েছে সেই কবেই। কাকা-কাকীর তত্ত্বাবধানে থাকলেও তা শুধুই পেশাদারিত্ব অব্দি, ভালোবাসা-স্নেহ জোটেনি কপালে। তার মধ্যে জয়ের অন্যরকম চালচলন ছিল তাদের কাছে অসহ্য।

দিদিকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়েছিল তারা, কুড়ি হতে না হতেই। দিদি ছিল জয়ের সুপ্ত ইচ্ছের উৎস। মেয়েদের মতো কিভাবে হাঁটতে হয়, শব্দ করে হাসতে হয়, কোমর ধরে দাঁড়াতে হয়, বুকের কতদূর অব্দি ওড়না রাখতে হয়, কিভাবে কোমর নাড়িয়ে হাঁটতে হয় সবটা।

দিদি সবটাই বুঝতো, কিন্তু কিছু বলতো না।

সেই দিদিই দিব্যি ভাইকে ভুলে সংসার করতে লাগলো।

জয়ের কাছে এই ঘরটা তখন মনখারাপের ঘর,
আজকেও এক মনখারাপ ঘিরেছে ঘরটাকে।

মোম গলে হাতে পড়ছে, জয়ের ভ্রূক্ষেপ নেই। চোখের জলে ভিজছে বুক। সেখানে হাতড়ে জয় অনুভব করতে চেষ্টা করে একজোড়া না হওয়া স্ফীত স্তন।
ভেতর আর বাহির মিলিয়ে যদি যুদ্ধ হয় তো অন্তরাত্মাকে ধরে রাখবে কে?
মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় সেই খোলস ছিঁড়ে বেড়িয়ে আসে, ভেতরের সম্পূর্ণ নারীত্ব নিয়ে নগ্ন শরীরে দাঁড়ায় দীপ্তর সামনে। তাকে প্রশ্ন করে,
“দেখো দেখো আজ আর কোনো কমতি নেই। আমার স্তনযুগল দেখো, দেখো আমার যোনি, আমি আজ সম্পূর্ণা। আমাকে ঠুকরে দেবে কোন অছিলায়?”

কিন্তু তা হবার নয়। বিধাতার এক পরিহাসের পাত্র সে!

দীপ্তর আজ ফুলশয্যা!
কলেজ জীবনের প্রেম, টুকরো টুকরো স্মৃতি, জয়ের বিছানায় কাটানো একের পর এক উদ্দাম রাত- সবটা পায়ে পিষে দীপ্ত বেছে নিয়েছে এক সম্পূর্ণ নারী শরীরকে। যে তাকে গভীরতায় ডোবাবে, স্রোতে ভাসাবে নিয়ে যাবে সমুদ্র সফেনে।
জয় তো শুধু ভালোবাসতে জানে, সমুদ্রের ঢেউ আনার ক্ষমতা ওর নেই!

এসব ভাবনায় ছেদ পড়ে, বাইরের দরজায় কেউ জোরে জোরে আঘাত করছে। এতো রাতে কে?

জয়ের ভয় হয়, তারপর নিজের ভয়ের ওপরই হাসি পায়। তার আর যাই হোক ধর্ষণ তো হবে না?
দরজাটা না দেখেই খোলে। চমকে যায়,

 – দিদি! তুই?

জয়কে ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢোকে মায়া, জয়ের দিদি। জয়ের বিছানায় বসে হাঁপাতে থাকে। পুরো শরীর কাঁপছে ওর।

– কি হয়েছে তোর? এতোদিন বাদে, হঠাৎ…
 – পালিয়ে এসেছি। দীপ্ত একটা ঠগ, জোচ্চর।

জয়কে জড়িয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে মায়া।
মাত্র বাইশ বছরে বিধবা হয় মায়া। শরীর থেকে তখনও নতুন বউয়ের আদো আদো গন্ধটা যায়ইনি তার। শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে উঠলো বাবার বাড়ি, জয়ের কাছে। জয় তখন দীপ্তর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। দিদির হঠাৎ এভাবে আসাটা তার প্রেমে বিঘ্ন ঘটালেও, জয় খুশিই ছিলো। তবে দিদির একাকীত্ব ওর বুকে বাঁধতো, ও চাইতো দিদিকে খুশি রাখতে।
– জয়, তোর ঘেন্না করছে না আমাকে দেখে?
– না, যাকে ভালোবাসা যায়, তাকে ঘেন্না কি করে করবো?
– এতো মহান তুই হতে পারিস?
 – শাড়িটা পালটে ফেল, সর্দি লেগে যাবে। গরম দুধ নিয়ে আসছি তোর জন্য। তোর আলমারিতেই সব শাড়ি গুছিয়ে রাখা আছে।
– জয়…
 – দাঁড়া, আমি আসছি।
জয় প্রায় দৌড়েই রান্নাঘরে আসে। অন্ধকার ঘরে কাঁদতে খুব সুবিধা। এখন আর কাঁদার জন্য কাঁধ খোঁজেনা ও, একাই তো কেঁদে আসছে একমাস ধরে। ওর পিঠে একের পর এক বিশ্বাসঘাতকতার ছুরি বিঁধেছে পরপর।

এর কোন শাস্তিই কি প্রাপ্য নয় ওদের?

কিছুক্ষণ বাদে গরম দুধ নিয়ে দিদির ঘরে যায়। দিদি নীল শাড়িটা পড়েছে, নীল রং দীপ্তর খুব প্রিয়।
 – দিদি, দুধ।
  – জয়, তুই ভালো আছিস ভাই?
 – কেন? খারাপ মনে হচ্ছে?
 – কি জানি! জীবনের মস্ত ভুলটা করেছি রে। তোকে মুখ দেখাতেও…
 – কেন? দীপ্ত তো বিছানায় বেশ ভালো। সেটা তো তুই নিজেও জানিস।
 – জয়! এভাবে বলিস না…প্লিজ।
 – কেন, কষ্ট হয়? তা বাসর রাত ছেড়ে উঠে এলি যে বড়ো!
– দীপ্তর মতোন নোংরা ছেলে আমি, একটিও দেখিনি।
– হুম।
– জয়, দীপ্ত আমাকে খুঁজতে খুঁজতে এখানে এলে বলবি আমি আসিনি।
  – আমি মিথ্যে বলিনা, তুই জানিস সেটা।
  –  দীপ্ত আমাকে অপমান করেছে। বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ের রাতের পর রাত কাটিয়েছে আমার সাথে। এখন বলে কিনা আমি ব্যবহৃত? বিধবাকে নাকি বিয়ে করা যায় না? অথচ আমি যে স্বপ্ন দেখেছিলাম, আরেকটা সংসারের, লাল রঙের সিঁদুরের। এখনকার যুগে এসেও এসব শুনতে হয়? বিধবাদের কি ভালোবাসা বারণ?
আসলে দীপ্ত ঠগ। ও কাউকে ভালোবাসেনি, দীপ্তর মতোন ছেলেরা কাউকে ভালোবাসতে পারেনা।
– এখন কি করবি? পুলিশের কাছে যাবি?
 – না না, এতে লোক জানাজানি বেশি হয়ে যাবে। এমনিতেই ওর সাথে পালিয়ে গিয়ে অনেক চর্চা হয়েছে শুনেছি।
 – হুম, হয়েছে। আমাকে অনেক প্রশ্ন করা হয়েছে। আমি চুপ ছিলাম।
 – জয়, তুই না থাকলে যে কি হতো আমার!

বাইরের বৃষ্টিটা এতোক্ষণে ধরেছে, রাত আটটা হবে।

দুধের খালি গ্লাসটা নিয়ে রান্নাঘরে যায় জয়।

আবার দরজায় ধাক্কা, এই ধাক্কাটা জয়ের চেনা।

দরজা খুলে ফেলে জয়।

– জয়, মায়া কোথায়?
  – ঘুমোচ্ছে।

জয়কে ধাক্কা দিয়ে সরে যায় দীপ্ত, জয় ওকে আটকে দেয়।
 – দিদিকেও ঠকালে? আর কত নীচে নামবে?
 –  ঠিকাইনি, আমি শুধু বলেছিলাম যে একটি বিধবা মেয়েকে আমার বাড়ি থেকে মেনে নেবে না। আমাদের কোন বিয়েই ঠিক হয়নি। বিয়ে, ফুলশয্যা এসব গল্প তোমাকে বানিয়ে বলেছে ও।
  – তাহলে পালিয়েছিলে কেন?

 – সেটা একটা ভুল হয়েছে জয়। মানছি। ওর ও শারীরিক চাহিদা ছিল আর আমারও তাই ঝোঁকের বশে…
 – দুধ খাবে?
– হঠাৎ? বেশ দাও, নিজের মুখে বলছো যখন।

জয় রান্নাঘরে চলে যায়। কারেন্ট আসার নাম নেই এখনো।

দুধ জ্বাল দিতে দিতে জয়ের মনে পড়ে সেই রাতটা। দিদি আর দীপ্ত ওরই বিছানায়, কি কঠিন দৃশ্য!

কিছু মুহূর্ত জয় ভেবেছিল বুঝি দুঃস্বপ্ন, তারপর নিজের কানে শুনেছিল কিভাবে ওরা জয়ের হাসি হাসছে। আদিমতার খেলায় মেতে উঠতে উঠতে কিভাবে জয়ের ভালোবাসাকে নিয়ে পৈশাচিক মজায় মাতছে।

ADVERTISEMENT
Tuhu Momo Video Teaser



জয়ের অসম্পূর্ণ শরীরের গল্পটা রসিয়ে বলছিল দীপ্ত আর দিদি হেসে হেসে শোনাচ্ছিল জয়ের শৈশব থেকে শুরু করে কৈশোরের জয়ের মেয়েলি স্বভাবের কথা। কেমন করে সে বউ সাজতো, মেয়েদের মতোন আইটেম সঙ্গে নাচবার চেষ্টা করতো, সিঁথির গোড়ায় লিপস্টিক টেনে সিঁদুর পড়বার চেষ্টা করতো!

কি দারুণ আনন্দ ছিলো ওদের। তাদের আনন্দের প্লাবনে টুকরো টুকরো হচ্ছিল জয়ের আত্মবিশ্বাস, ভালোবাসা, সাহস, স্বপ্ন। মোমের মতোই গলছিল তার এতোদিনকার সঞ্চয় করা বিশ্বাস যে দিদি আর দীপ্ত সত্যিকারের ওকে ভালোবেসেছিল!



দীপ্ত একচুমুকে সবটা দুধ শেষ করে। মোমবাতি নিয়ে জয় একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে দীপ্তর দিকে।

দীপ্ত চেয়ার ছেঁড়ে উঠে এসে জয়ের চুলগুলোতে হাত বোলায়, গাল কাঁধে হাত বোলাতে বোলাতে জয়কে টেনে নেয় বুকে।
মোমবাতি ছিটকে মেঝেতে গড়াগড়ি যায়।

দীপ্তর উদ্দামতা জেগেছে আবার, কেমন কেমন নেশাড়ুর মতোন আদর করছে সে জয়কে।
কতদিন পর এই স্পর্শ! সেই পোড়া সিগারেট মাখা নিশ্বাসের গন্ধ!



গলায়,কাঁধে গরম নিশ্বাসের ছ্যাঁকা পড়ছে দীপ্তর। সে বলছে,
 – তোমার মতোন কেউ নয় জয়া। তুমি জয় নও, আমার জয়া।
দীপ্তর পিঠ খামচে ধরে জয়।
– মনে আছে দীপ্ত, আমার শেষ ইচ্ছে কি ছিলো?
– কি?
 – তোমার বুকে মাথা রেখে মরবো। তুমিই আমার শেষ আশ্রয় হবে। মনে আছে?
 – হবে হয়তো। বাদ দাও এসব।আরেকটু কাছে এসোনা।
 – দীপ্ত, আমাকে কেন বলোনি যে আমার মতোন যারা তাদের প্রেম করতে নেই? কেন দিদি বলেনি আমার মতোন যারা তাদের নিজের ইচ্ছেগুলো বাইরে আনতে নেই? আমাদের ভালোবাসা পেতে নেই?
 – জয়া, এসব কি বকছো বলোতো? আদরের সময় এসব ভালোলাগে?
– আমি কিন্তু ভালোবেসেছিলাম দীপ্ত। তোমার জন্য ট্রান্সজেন্ডার হতেও রাজি ছিলাম তুমিই কৃত্রিমতা চাওনি।
– দেখো জয়, সমাজে বাস করতে হয় আমায়। তোমাকে বিয়ে করলে লোকে যেমন থুতু ছেটাতো, তেমনি তোমার দিদি যে কিনা বিধবা, তাকে বিয়ে করলেও লোকে হাসতো। ভাবতো আমার কোন কমতি আছে। আসলে তোমাদের সাথে আদরের খেলাটা খেলা যায়; প্রেম, ভালোবাসা, সংসার এসব কিছুই করা যায়না।
– দুটো মানুষের মন ভেঙে তোমার এতো সুখ?
– উফ।

জয়কে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় দীপ্ত। মাথাটা কেমন ঘুরছে ওর। দৃষ্টি ক্রমশ ঘোলাটে।

 – ঠিক বলেছো দীপ্ত, আমাদের ভালোবাসতে নেই, কিন্তু অপমানের জবাব দেওয়ার অধিকার তো আছে!
চোখ বন্ধ হতে হয়ে দীপ্ত দেখে জয় হাসছে।

পরদিন সকাল।

পুলিশের ধাক্কায় ঘুম ভাঙে দীপ্তর, সে পড়ে আছে জয়ের ঘরের বিছানায়, একপাশে মাথা নীচু করে বসে মায়া।

পুলিশ গ্রেফতার করে দুজনকেই, জয়ের হত্যার সন্দেহে।

পুলিশের ধারণা, কাল রাতে মায়া আর দীপ্তকে অপ্রস্তুত অবস্থায় দেখে প্রতিবাদ করে জয়। ঘরের কোনায় দুজনের জামাকাপড় তার প্রমাণ। লোক জানাজানি হবার ভয়ে মায়া দুধের সাথে বিষ মেশায় আর জোর করে দীপ্ত তা জয়কে খাওয়ায়। দীপ্তর পিঠে জয়ের আঁচড়ের দাগ রয়েছে। দুধের গ্লাসে দুজনেরই হাতের ছাপ স্পষ্ট। তারপর তার লাশটা স্টোররুমে বন্ধ করে পরে গতি করবে দেখে।

কিন্তু সকালবেলা নিউজপেপার দিতে এসে, দুধ দিতে এসে লোকেরা ফিরে যায় বারবার। সন্দেহ হতেই ফোন করে পুলিশকে।
দীপ্ত বুঝতে পারে, এসব কিছু জয়ের কারসাজি।

কাল রাতে দুজনের দুধের গ্লাসেই ঘুমের ওষুধ অল্প মিশিয়েছিল। দীপ্ত ঘুমিয়ে পড়তেই ওকে ধরে মায়ার পাশে শুইয়ে দেয় জয় তারপর দীপ্তর শার্ট আর মায়ার শাড়ি খুলে একসাথে রাখে। পরে ওদের হাতে ধরা গ্লাস হ্যান্ডগ্লাফস পড়ে বিষ মেশানো দুধ খেয়ে নেয় স্টোররুমে বসেই।

পুলিশের জিপে ওঠার আগে মায়া জয়ের দিকে তাকায়, কেমন যেন
এক তৃপ্তির হাসি হাসছে ও!

 

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait