তিনি দয়ার সাগর, তিনি পরম মাতৃভক্ত, তিনি পন্ডিত শ্রেষ্ঠ, তিনি বর্ণপরিচয় উদ্গাতা, তিনি দীনবন্ধু, তিনি শিক্ষাবিদ, তিনি আরো কত কত কত কিছু। কিন্তু শুধু এটুকুতেই তাঁর পরিচয় সীমাবদ্ধ নয়। ১৮২০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ শে সেপ্টেম্বর মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় নামের যে আগুন জ্বলে উঠেছিল, তার উদাহরণ আধুনিক যুগে শুধু তিনি। তাঁর জীবন সম্বন্ধে কমবেশি সবাই জানেন, কিন্তু তাঁর পরিকল্পনাগুলিকে বাস্তবে রূপায়িত করতে যে আগুনের ওপর দিয়ে তাঁকে হাঁটতে হয়েছিল, তা হয়ত তিনি নিজে অগ্নিপুত্র ছিলেন বলেই পেরেছিলেন।
শৈশব কেটেছে ভীষণ দারিদ্রে। পিতা ঠাকুরদাস বন্দোপাধ্যায় এর সাথে কলকাতা এসে তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। কিন্তু এই শিক্ষাজীবনের পদে পদে এসেছে আঘাত ও কষ্ট। পদে পদে দারিদ্র্যের সাথে লড়তে থাকা ঈশ্বর রাতে রাস্তার গ্যাসবাতির আলোয় পড়াশোনা করতেন। নিজের সাথে অবিরাম যুদ্ধ করে চলা ঈশ্বর পড়তে বসে ঘুমের কোলে ঢলে পড়লে প্রদীপের তেল নিজের চোখে ঘষে ঘুম তাড়াতেন। সেই ছেলে যে আগামীতে একজন ঝকঝকে কষ্টিপাথর হয়ে উঠবেন তাতে আর আশ্চর্য কি? এইভাবেই সংস্কৃত সাহিত্য এবং নানাবিধ বিষয়ে সুপন্ডিত হয়ে তাঁর ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি ধারণ।
ADVERTISEMENT
সাধারণ বাঙালির তুলনায় তাঁর তেজ ছিল জগৎবিখ্যাত। তিনি যখন সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ, তখন একবার কোনো এক সাহেবের কাছে তাঁকে দেখা করতে যেতে হয়েছিল। সাহেব ছোটোখাটো চাদর ও ধুতি পরিহিত এক বাঙালিকে দেখে তাচ্ছিল্যভরে তার টেবিলের ওপর পা দুটিকে তুলে দিয়ে বিদ্যাসাগর মশাই এর সাথে কথা বললেন। বিদ্যাসাগর মশাই চূড়ান্ত অপমানিত হলেও তখনকার মতো কিছু না বলেই চলে এলেন। এরপর কিছুদিন পর ওই সাহেব বিদ্যাসাগর মশাই এর সাথে দেখা করতে সংস্কৃত কলেজে এলেন। বিদ্যাসাগর মশাই নিজের ঘরে টেবিলের ওপর চটিসুদ্ধ পা দুখানি তুলে সাহেবের সাথে কথা বললেন। সাহেব বিলক্ষন বুঝলেন যে ধুতি চাদর পরিহিত ছোটোখাটো বাঙালির ছদ্মবেশে তিনি আসলে এক সিংহের সাথে দেখা করতে এসেছেন। এইরকম তেজ ছিল বলেই হয়ত সমাজের অকালবিধবা ছোট ছোট কন্যাদের কৃচ্ছসাধন তাঁর অন্তরকে এমনভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিলো যে সারাটা জীবন তিনি লাগিয়ে দিলেন বাল্যবিবাহ রোধ এবং বিধবাদের পুনর্বিবাহ আইন লাগু করানোর জন্য। এর জন্য তাঁকে সমাজের বিরুদ্ধে একা লড়তে হয়েছে। যদিও তৎকালীন সমাজের বাঘা বাঘা প্রথিতযশা ব্যক্তিদের যেমন রানী রাসমণি, রাধাকান্ত দেব, লর্ড ডালহৌসির মতো ব্যক্তিদের তিনি নিজের সাথে পেয়েছিলেন কিন্তু গোঁড়া ব্রাহ্মণসমাজের বিরুদ্ধে লড়তে লড়তে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েন নি। সেখানেও তিনি শাস্ত্র উজাড় করে প্রমান করে দেন যে বিধবাবিবাহ শাস্ত্রসম্মত। নিজের মত প্রতিষ্ঠা করার জন্য তিনি নিজের পুত্রের সাথে এক বিধবা কন্যার বিবাহ দেন।
মানুষকে সাহায্য করতেন অকাতরে। তারা সেই অর্থ ফেরত দেবেনা জেনেও তাদেরকে সাহায্য করতে তিনি কখনো পিছপা হন নি। এ প্রসঙ্গে একটি কাহিনী বলা যায়। একজন সরকারি পুলিশ কে তিনি একবার কিছু অর্থসাহায্য করেছিলেন, ফেরত পাবেন না জেনেই। কিন্তু তাঁকে অবাক করে দিয়ে নির্দিষ্ট দিনে সেই পুলিশ ভদ্রলোক যখন টাকা ফেরত দিতে এলেন, বিদ্যাসাগর মশাই বললেন যে এই পৃথিবীতে কে সেই লোক যার কথার এতো দাম? তিনি অনেককে সাহায্য করেছেন কিন্তু কেউ তাঁকে টাকা ফেরত দেয় নি। সেখানে একজন পুলিশ ধারের টাকা তাঁকে ফেরত দিতে এসেছেন? সেই পুলিশকে তিনি যথেষ্ট তিরস্কার করলেন, বোকা বললেন এবং ধারের টাকা তার কাছ থেকে নিলেন না। পুলিশ ভদ্রলোক যখন চোখে জল নিয়ে ফিরে গেলেন তখন বিদ্যাসাগর মশাই এর চোখেও জল। স্বয়ং মাইকেল মধুসূদন দত্ত পর্যন্ত তাঁর কাছ থেকে অনেক সাহায্য পেয়েও তা মনে রাখেন নি। সেই ঘটনা বিদ্যাসাগর মশাই এর মনে প্রবল অভিমানের জন্ম দিলেও তিনি মানুষকে সাহায্য করার পথ থেকে কখনো সরে আসেননি।
আরও পড়ুনঃ শ্রী রামকৃষ্ণ ও তাঁর চারজন গুণমুগ্ধ ভক্তের কাহিনী – “জাদুকর ও তাঁর জাদুদন্ড”
তাঁর কাহিনী তো বলে শেষ করা যাবে না। শুধু বলা যায় এই প্রবল তেজি মানুষটি হয়ত কারো কাছে আত্মসমর্পন করতে চাইছিলেন। তাই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সাথে যখন তাঁর দেখা হলো তখন তিনি ঠাকুরের প্রতি ভীষণরকম আকৃষ্ট হন। ঠাকুর তাঁকে বলেন, ‘খাল বিল পেরিয়ে এবার সমুদ্রে এসে পড়লাম’। বিদ্যাসাগর মশাই এর রসবোধ ছিল প্রবল। তিনি উত্তর দিলেন, ‘সমুদ্রে যখন এসে পড়েছেন তখন নোনাজল একটু খেয়ে যান’। ঠাকুরও কম যান না। উত্তর দিলেন, ‘তুমি তো ক্ষীরসমুদ্র’। এরপর ঠাকুরের সাথে তাঁর অনেক কথা হয় এবং বেশ কয়েকবার দেখাও হয়। ঠাকুরের সরলতা এবং ঈশ্বরের প্রতি অকপট বিশ্বাস বিদ্যাসাগর মশাইকে আকৃষ্ট করে।
শেষ জীবনে নিজের জাতি ও দেশবাসীর প্রতি এক নিদারুন অভিমানে তিনি জনসমাজ থেকে সরে গিয়ে সাঁওতাল পরগনায় মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োগ করেন। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করে তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মানুষের সেবা করে যান।
‘বর্ণপরিচয়’ এর মাধ্যমে শিক্ষাজগতে যে আগুন তিনি জ্বালিয়েছিলেন তা কখনো নেভানো যাবে না। মেরুদন্ড শক্ত করে নিজের লক্ষ্যে অবিচল থাকার শিক্ষা আমরা তাঁর কাছ থেকেই পেয়েছি। 1891 খ্রিস্টাব্দের 29 শে জুলাই তিনি দেহত্যাগ করেন। কিন্তু আমার বিশ্বাস, তিনি আমাদের মধ্যে বারবার ফিরে ফিরে আসবেন আমাদের ‘আত্মবিশ্বাস’ কে জাগিয়ে তোলার জন্য।
এই মহাজীবনকে জানাই শতকোটি প্রণাম।
ছবি সৌজন্যঃ গুগুল
0 comments