স্বেচ্ছাবন্দী

স্বেচ্ছাবন্দী

ছোটবেলায় দুষ্টুমি করলেই মা বলতো, তবে রে দেখবি, নিচের পাম্পের ঘরে আটকে দেবো! আর বেরুতে পারবি না। ভয় পেতাম, আর দুষ্টুমি করবো না বলে তখনকার মত ছুটে পালাতাম। এখন আমাদের সেই অবস্থা। বাইরে ঘুরলেই ঘর বা শ্রী ঘর। বারবার কানে  গববরের হুঙ্কার কিতনে আদমি থে! রাস্তা ঘাট শুনশান। গৃহবন্দী সবাই। একটা বোমা পড়লে তার আতঙ্কে মানুষ ঘরে যায়, ডেঙ্গুর মশা কামড়ালে গায়ে হাতে মশার তেল মেখে নেওয়া যায় কারণ ওই দুটোই দৃশ্যমান। কিন্তু এই ভাইরাস তো মোটে চোখে দেখা যাচ্ছে না। হবেই এমন গ্যারান্টি কই!.তাই যাই একটু মোড়ের মাথায় ঘুরে আসি যে কাজের মাসি একদিন কামাই করলে আমরা দিশেহারা, এত রান্না, এত বাসন, ঘর মোছা কোনদিক সামলাবো, এফ বি তে তে স্ট্যাটাস,,আজ আমার কাজের দিদি আসেনি, ফিলিং ডিপ্রাইভড। আজ আমরাই মনে সাহস এনে তাদের স্বেচ্ছা ছুটি দিচ্ছি। গরজ বড় বালাই। আর ভাইরাস আরো বড়।

ADVERTISEMENT

 এমন একটা পরিস্থিতি আসবে কেউ ভাবিনি আমরা, লক ডাউন সব। বাড়িতে মুখোমুখি সবাই। আর সন্ধ্যে হলে আর একজন মেম্বার বাড়ে, সঙ্গে সুমন। আবার আতঙ্ক ছড়ায়। কতজন অসুস্থ হলেন , কতজন মারা গেলেন, চীন, ইতালি, ইরান আমাদের টিভির ঘরে হাজির। সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট, বারবার সাবধান বাণী, রাগ, মিম। ভেতরে অদ্ভুত ধুকপুক আওয়াজ। কী করে উদ্ধার হওয়া যায় তার কোনো সুলুক সন্ধান নেই। সবার ভেতরে চাপা হতাশা। বাড়ির দরজা বন্ধ করে আমরা কী আটকাছি, করোনা নাকি মৃত্যু! এই অনুভব সবার ভেতরে, তাই আমরা কখনো রেগে যাচ্ছি লক ডাউন এর পরও মানুষের মূর্খামি দেখে। আমরা প্রাণপণে আটকাতে চাইছি নিজের অস্থিরতা কে।  ছোটবেলার কবিতা মনে পড়লো, হাওয়ার সঙ্গে যুদ্ধ করে গাত্রে হলো ব্যথা। হাওয়া নয়, মানুষের নিশ্বাসে আজ বিষ। সেই বিষ নীলকণ্ঠের মত পান করতে পারছি না আমরা।কে কখন আক্রান্ত হব, কী ভাবে এই ভাবনাটা জাঁকিয়ে বসেছে। কত কী বাকি রয়ে গেল যে। বৃষ্টি ভিজে পাহাড়ের পাকদন্ডী বেয়ে হাঁটা, কফি হাতে দূরের পাহাড় বা নোনা জলে পা ডুবিয়ে সূর্যাস্ত। পরের শীতে কড়াই সুটির কচুরি বা নলেন গুড়ের পায়েস। বারান্দার বোগেনভেলিয়া আমি না থাকলেও বেড়ে উঠবে আমি জানি, কিন্তু আমি যে থাকতে চাই। মেয়ের বড়ো হওয়া দেখতে চাই। বাড়ি রং করাতে চাই, বইমেলায় কেনা গল্পের বই গুলো শেষ করতে চাই, নতুন কেনা ঢাকাই টা পরা হলো না তো এখনও, পরতে চাই। চাই চাই। চাওয়ার শেষ নেই। আর তাই আমি উদগ্রীব, ব্যস্ত, অস্থির, সতর্ক, হতাশ। এত কিছুর পরও আয়নায় মুখ দেখি, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে।  আজ আর কেউ আমরা মুখোশ খুলে মুখ দেখি না। এই মুখে ভয়ের ফাউন্ডেশন, ঠোঁটের কোনে টেনশন। ভবিষ্যত হাতরে যাচ্ছি, এরপর কী, ৭দিন ১০দিন নাকি এক মাস দুমাস। কে বলবে, কে? বাড়িতে থাকো, বাড়িতে। কিন্তু কত দিন ! কেউ উত্তর দিল কী! নাকি আমি শুনতে পেলাম না, আর একবার বলবে প্লিজ। সাড়া দাও, সাড়া।

আরও পড়ুন : শরীরী সাক্ষাতে নয়, বেঁচে থাকি হৃদয়ের লাবডুবে

 এই তো একমাস আগেও অভিযোগ ছিল, একটু বাড়িতে থাকা হয় না,  আর আজ তুমি মুক্ত, থাকো বাড়িতে, খাও দাও, ঘুমাও, কাজ করো। নেটফ্লিক্স, আমাজন, হইচই আছে তো, দেখো। কিন্তু তোমার ভেতরের ওই যে মেঠো ইঁদুরটা , যে তোমার সব আছেতে কুটকুট করে কামড়াচ্ছে।  তোমার শান্তি,  তোমার ভালোলাগায় ছোট ছোট গর্ত করে দিয়ে সেঁদিয়ে যাচ্ছে, তাকে ছাড়তে একবার তো বাড়ির পিছনের মাঠটায় যেতে হবে, খোলা হাওয়ায় বুক ভরে নিশ্বাস নিতে হবে। কিন্তু তুমি তো বেরুতে পারবে না, তোমার বাড়ির বাইরে তালা,মনের সাহসে তালা। তাই তোমার ওকে নিয়েই নিশ্চিদ্র যাপন এখন। ঝড় থেমে যায় একদিন, আমরা সবাই জানি।তাই শুধু অপেক্ষা। মরুভূমির উঠে র মত বালিতে মুখ গুঁজে অপেক্ষা। তোমার চা, জলখাবার, ভাতে রুটিতে মেখে নাও প্রেম, স্নেহ ভালবাসা আর বিশ্বাস। আর আশ্লেষে পান করো, চিবিয়ে যাও, ডান গাল থেকে বামে। পরম বিশ্বাসে থাকো আর সুস্থ থাকো।


0 comments

Illora Chattopadhyay

Illora Chattopadhyay

জন্মসূত্রে বড় হওয়া উত্তরপাড়ায়। সংস্কৃত সাহিত্যে এম.এ পাশ করার পর ১৫ বছর হুগলী জেলার একটি গ্রামীন আধাসরকারি স্কুলে শিক্ষকতা । সংস্কৃত নিয়ে পড়াশোনা করলেও প্রিয় বিষয় বাংলা। বাংলা সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা চিরকালীন। মাঝে কিছুদিন পত্র পত্রিকায় বইয়ের রিভিউ লেখা। তারপর দীর্ঘদিনের বিরতি। প্রাণের টানে আবারও ফিরে আসা সাহিত্যের প্রাঙ্গণে। তবে এবারে শুধু আর পুস্তক আলোচনা নয়, তার সঙ্গে মৌলিক লেখালেখির শুরু। মূলত সোশাল মিডিয়ায়। তারপর থেকে বিভিন্ন ওয়েবম্যাগ, কাগজের পত্রপত্রিকাতে নিয়মিত লিখে চলা।যদিও নিজেকে লেখক নয়, পাঠক মনে করতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করি।

FOLLOW

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait