প্রত্যাশার পরাজয়

প্রত্যাশার পরাজয়

সদ্য শীত পড়েছে। এখন নভেম্বর মাস। আজ বাইশে নভেম্বর। গত বছর দীপ্তজয় এমন দিনে পৃথিবীর মায়া  ত্যাগ করে চলে গেছিলো। দেখতে দেখতে এক বছর কেটে আজ আবার বাইশে নভেম্বর এসে হাজির। দীপ্তজয়ের মা দময়ন্তী দেবী গত বছর থেকে অপরাধ বোধে ভুগে চলছেন।  আজ দীপ্তজয়ের ফটোর  সামনে দাঁড়িয়ে উনি কাঁদছেন। 

*************

দীপ্তজয়, দময়ন্তী দেবীর ছোট ছেলে। দময়ন্তী পাল এবং ওনার স্বামী অর্কদীপ পাল থাকেন বেহালা সরশুনায়। ওনাদের  দুই সন্তান৷ দীপ্তজয় ছোট ছেলে। আর রণজয় বড় ছেলে।দময়ন্তী দেবী এবং অর্কদীপ বাবু দুজনেই সরকারী দপ্তরে কর্মরত। রণজয় দীপ্তজয়ের চেয়ে বছর সাতেকের বড়। 

রণজয় বরাবরই পড়াশোনায় ভালো। সাউথপয়েন্টের ছাত্র। উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞান নিয়ে  পড়ার পর আই.আই.টি কানপুর থেকে ইজ্ঞিনিয়ারিং পড়ার পর বিদেশে মাস্টার্স করতে চলে যায়। 

ADVERTISEMENT

দময়ন্তীর নিজের বড় ছেলেকে নিয়ে গর্বের শেষ নেই। ছোট ছেলেকে খালি কথা শোনাতেন, 
– “দেখ , দাদা কি ভালো রেজাল্ট করে এগিয়ে গেলো। তুই কিছু করতে পারলি  না। তোর দ্বারা কিছু হবে না!!” ইত্যাদি ইত্যাদি।
এই সব ডিমোটিভেটেড কথা বার্তা দীপ্তজয়ের কোনোদিনই ভালো লাগে নি। 

মা’কে বলতো, – “তোমার দাদাকে  নিয়ে  আদিখ্যেতা নিজের কাছে রাখো! আমায় বলতে এসো না।”
দীপ্তজয়ের দাদার উপর রাগ ছিলো প্রবল। মাঝে মাঝেই রণজয়ের সঙ্গে ঝগড়া বাঁধায়। 
দীপ্তজয় ছোটবেলা থেকেই রণজয়কে সহ্য করতে পারতো না। বরাবর রণজয় ভালো রেজাল্ট করেছে। বিজ্ঞান বিভাগে দক্ষতার সাথে ভালো ফলাফল করেছে। বাড়িতেও সর্বদা নিজের কেরিয়ার, ড্রিম নিয়ে  বড় বড় করে আলোচনা করতো রণজয়। 

কখনও বলতো, -“আমি নাসার বিজ্ঞানী হবো!! 
মেডিকেল লাইন নিয়ে  পড়লে ক্যান্সার নিয়ে  কিছু আবিষ্কার করতে হবে যাতে নোবেল প্রাইজ পাওয়া কেউ আটকাতে পারবে না!!”
ইত্যাদি ইত্যাদি। দীপ্তজয় বিষয়টা একেবারে সহ্য করতে পারতো না।

রণজয়কে তাচ্ছ্বিল্য করে বলতো, – “থাম। তোর ভাটের স্বপ্নের কাহিনী নিজের কাছে রাখ। এতো চিল্লাস না।”

কারণ দীপ্তজয় নিজে খুব সাধারণ মানের ছেলে। কমার্স নিয়ে  পড়লেও খুব ভালো রেজাল্ট নয়। কর্মাস  নিয়ে  টেনে টুনে  পাশ করে গ্র্যাজুয়েশন। তারপর চাটার্ড অ্যাকাউন্ট নিয়ে  পড়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু পরীক্ষা দিয়েও সফল হয় নি।

বাড়িতেও সর্বদা নিজের কেরিয়ার, ড্রিম নিয়ে বড় বড় করে আলোচনা করতো রণজয়। দীপ্তজয় বিষয়টা একেবারে সহ্য করতে পারতো না।

কিন্তু দারুণ গিটার বাজায়  আর ব্যান্ডে গান গায়। চমকে দেওয়ার মতো গলা। কিন্তু দময়ন্তী দেবী আর স্বামীর ছোট ছেলের এই গুণাবলী গুলো নগণ্য লাগে। 

অর্কদীপ বাবু ছোট ছেলেকে প্রায়ই বলতো, – “গিটার বাজিয়ে কি পেট চলে? নাকি গান গেয়ে আর গান শুনিয়েই কোন মেয়েকে বিয়ে করবে ? সংসারে তাকে এনে খাওয়াবে কি? তুমি একটা হোপলেস  চাইল্ড! দাদাকে  দেখে কিছু শেখোও নি! শুধু বাপ মায়ের  ঘাড়ে বসে তাদের পয়সায় উড়ে বেড়াও। নিজের স্ট্রীমেও পড়াশোনা টা ভালো করে, করো না।”

দীপ্তজয় রাগে দুঃখে হতাশায় ভুগতো। মনে মনে ভাবতো, – ‘তাহলে দাদা ই জীবনে সব কিছু অ্যাচিভ করতে পারলো! আমার গান, আমার গিটার বাজানোর দক্ষতা এগুলোর কোনো মূল্য নেই বাবা, মায়ের  কাছে! তাদের কাছে কি আমি বোঝা!’

দময়ন্তী ছোট ছেলেকে বলতেন, – “দাদার মতো কোনো দিন হলি না। তোর ঘটে তো বুদ্ধি নেই। জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মতো জেদও তোর মধ্যে নেই। তোর দ্বারা কিছু হবে না। শুধু আমাদের চিন্তা বাড়াস। নিজে কর্মাস  নিয়ে  পড়লি  যে, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট পড়ার যোগ্যতা ও তোর নেই যে চেনা জানা মানুষকে গর্ব করে বলবো!!”

আসলে আমাদের সমাজে লেখাপড়া করে প্রতিষ্ঠিত হওয়াটা যতটা অভিভাবকের কাছে গর্বের, ততটা হয়তো সংস্কৃতি মূলক ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা পাওয়াটা গর্বের নয়। জীবনে পড়াশোনাই শেষ কথা, সবার জন্য নয়।

সবই যেন টাকা, অত্যধিক সম্মান অর্জনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। কিন্তু জীবনে পড়াশোনা তেই এগিয়ে যাওয়াই শেষ কথা নয়। জীবনে প্রকৃত অহংকারহীন মানুষ হওয়াটা প্রয়োজনীয়। এটা আমরা অনেকেই বুঝতে চাই না।

ফলস্বরূপ দীপ্তজয়ের মতো অনেক যুবক যুবতী আজকের দিনে পরিবারের আপন জনের দুর্ব্যবহারে  দুঃখ পায়, হতাশায় ভোগে।

চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট পড়ার পরীক্ষায় বেশ কয়েক বার অনুত্তীর্ণ হওয়ার পর বেশ কিছুদিন দ্বীপ্তজয় হতাশায় ভুগতে থাকে। সঙ্গে জোটে অর্কদীপবাবুর তির্যক মন্তব্য।

তিনি বলেন, -“এই বার নিজের টা নিজে করে খাও। জীবনে তো কিছু করলে না!! চাকরি দেখো। গান বাজনা বন্ধ রাখো। আর আমাদের মুক্তি দাও।”

এর মধ্যে গতবছর ঠিক পুজো শেষে দীপ্তজয় বাংলা সিরিয়ালে প্লে ব্যাকে  গান গেয়ে টাকাও পায়। কিন্তু তার মূল্য দীপ্তজয়ের আপন জনের কাছে নেই। 

দময়ন্তী দেবী আর অর্কদীপ বাবু বিষয়টা জেনে প্রশংসা করা অপেক্ষা উদাসহীন থাকে। রণজয় ঐ দিকে জীবনে অর্থের পিছনে ছুটে অনেক দূর এগিয়েছে বটে। তবে বাবা মায়ের  প্রতি কর্তব্যে  উদাসীন থাকে। 

তবু দময়ন্তী দেবী আর তার স্বামীর রণজয়কে নিয়ে গর্ব এবং প্রশংসার শেষ নেই। পাড়া প্রতিবেশীর কাছে বলে বেড়ান, – “রণজয়ের মতো ভালো ছেলে নাকি হয় না।”

পড়াশোনার জন্য পরীক্ষা দিয়ে কিছু ছাপানো সার্টিফিকেট দিয়ে  মানুষ কে বিচার করা যায় না। আর সঙ্গীত আর শিল্পের প্রতি একনিষ্ঠ আত্ম নিবেদন থাকলে জীবনে দেরীতে হলেও প্রতিষ্ঠা লাভ করা যায়। এই ধারণা গুলো আমাদের সমাজে অনেক পরিবারে আজও নেই। 

ফল স্বরূপ দিনের পর দিন অপমানে জর্জরিত হয়ে  দীপ্তজয় গত বছর দীপাবলীর দিন পাঁচেক  আগে নিজের হাতের প্রধান শিরা কেটে আত্মহত্যা করে। এবং ইহলোক ত্যাগ করে।

আত্মহত্যার আগে চিরকুটে লিখে যায়, – ” আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়, শুধু আমার মেধা আর ভাগ্য দায়ী। গান গেয়ে  সত্যিই পেট চলে না। এই বোধ আমার হয় নি। আমার মতো নির্বোধের পৃথিবীতে বাঁচা  উচিত নয়।”

পুলিশ কেস হয়। দীপ্তজয়ের বডি পোস্ট মর্টেম হয়। তীব্র হতাশা আর ব্যর্থতার শোক তার মৃত্যুর কারণ হিসাবে চিহ্নিত হয়। 

রণজয় সেই দিনও বাড়ি আসে নি। কলকাতায় ফেরার প্রয়োজনই বোধ করে না। 

দীপ্তজয়ের মৃত্যু দময়ন্তী দেবী আর অর্কদীপ বাবুকে চরম শিক্ষা দিয়ে  যায়। নিজেরা অপরাধ বোধে ভুগতে থাকেন। 

বহুবার নিজেদের আত্মা আর বিবেকের কাছে হেরেছেন। 

দময়ন্তী দেবী কাঁদতে কাঁদতে ভেঙ্গে পড়েছেন এবং বলেছেন, – “আমাদের জন্য ই, আমাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে না পারায়  , ছেলেটা নিজেকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে নিলো। ঈশ্বর আমাদের ক্ষমা করো না।”

গত এক বছরে রণজয় আর কলকাতায় ফেরে নি। 

দময়ন্তী দেবী ও বুঝেছেন, – ‘কেরিয়ারের  উচ্চাশা আর স্বপ্নে কোথাও ওনারা  দুজনে রণজয়ের থেকে দূরে হয়ে  গেছেন।’ 

দীপ্তজয়ের মৃত্যুর জন্য গত এক বছরে নিজেদের  দায়ী  ভেবে  অনুশোচনায় দময়ন্তী দেবী আর অর্কদীপ ভেঙ্গে পড়েন।

দেখতে দেখতে আজ বাইশে  নভেম্বর এসে হাজির। পুরোনো নানা কথা ভেবে আজ দময়ন্তী দেবী দীপ্তজয়ের মৃত্যু শোকের জন্য কেঁদে চলেছেন।

জীবনে প্রতিযোগিতায় জয় আর কেরিয়ারে সফল ভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়াই সব নয়। 

অভিভাবকরা অনেকেই আজও বোঝেন না প্রকৃত মানুষের মতো সন্তানকে বড় করাটাই আসল। 

** সমাপ্ত**

** সব ঘটনা এবং চরিত্র কাল্পনিক**

 

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait