যে সব গ্রীষ্মে গরম ছিল না

যে সব গ্রীষ্মে গরম ছিল না


সেই সময়ে গ্রীষ্মে শীতলপাটি বিছানো থাকতো। এক টাকার কমলা পেপসি আর সাদার ওপর ফুল ছাপ জামা ঠাণ্ডা রাখতো সেই গরমকালগুলো। ‌প্রতি গরমের ছুটিতে বিজ্ঞান বইয়ের পাতায় পড়া খসখস তৈরির পদ্ধতি বাচ্চাগুলো রপ্ত করতো নিয়ম করে। ঘরে ঘরে এমন এসি ছিল না তখন। তাতে কী? ঘর ঠাণ্ডা করে রাখতো ওদের মায়ের শাড়ি, পুরনো গামছা। কাপড় ভিজিয়ে জানলার গরাদে গুঁজে দেওয়াই ছিল প্রতি দুপুরের রেওয়াজ।
 

 

গরমের দুপুরে ঘরের লাল মেঝেতে বালিশ পেতে শুতো মেয়েটা। একেবারে ছোট্টবেলাটায় প্রতি রবিবার হলে বাবা তাকে গল্প পড়ে শোনাতেন। শুনে শুনে সে মুখস্থ করে ফেলেছিল সে সব গল্পগুলো। তবুও হাঁ করে গিলতো ! বড় হতে গল্পের পড়ার ভার নিলো নিজেই। এক গরমের ছুটিতে সে মেয়ে 'পথের পাঁচালি' শেষ করেছিল। দিনগুলো তখন যেন ওর কাছে সত্যিই নিশ্চিন্দিপুরের নিশ্চিন্ত আশ্রয় ছিল। সারা দুপুর জুড়ে লাল মেঝেয় আরামে শুয়ে এপাশ ওপাশ করে গা ঠাণ্ডা করতো ওরা। জানলার কাপড় রোদের তাতে শুকিয়ে খটখটে হয়ে যেতো। নতুন করে আবার ভিজিয়ে আনতে ক্লান্তি লাগতো না মোটেই ! 
 

ADVERTISEMENT

 

 

দুপুরের ঘুম ভেঙে যেতো তাড়াতাড়ি। গরমে নয়, তরমুজের লোভে! টুকরো টুকরো করে তরমুজ কেটে রাখতো মেয়েটার মা। ফ্রিজ ছিল না, তবে গরম সেই তরমুজের ফালি পেটে পরতেই কোন জাদুতে যেন ঠাণ্ডা হয়ে যেতো! চেঁচেপুছে সবটা খাওয়ার পর সবুজ খোলাগুলো  ছোট ছোট টুকরো করে নেওয়া হতো। ঝুড়িতে খোলা নিয়ে সে চলে যেতো পাশের বাড়ির গোয়ালে। বাছুরের পেট ঠাণ্ডা করার মহান দায়িত্ব তখন মেয়েটারই কাঁধে! ফিরে এসে খোঁজ পড়ত থালায় পড়ে থাকা দু'ছটাক রসের। সেটুকুতে চুমুক দিতে দিতে বিকেল হয়ে যেতো। ততক্ষণে পুরসভার কলে জল  আসতো। বড় একটা বালতিতে জল ভরে তার মধ্যে ডুবিয়ে রাখা হতো বাকি জলের বোতল। ওটাই ছিল ওদের ফ্রিজ। 
বাকি জল থাকত কুঁজোয়। কুঁজো থেকে জল ছোটরা প্রায় ঢালতেই পারতো না, পারলেও জল ফেলে যাতা অবস্থা!  জল পড়ে গেলে অবশ্য তখন ছিল আরও অন্য রকম মজা! শুকিয়ে যাওয়ার আগেই বড়দের চোখ এড়িয়ে জলের আঁকড় কাটা চলতো।  ওরা বলতো আল্পনা! বড়রা দেখতে পেলেই বকতেন, এতে নাকি ঋণ বাড়ে। বাধ্য ছিলো মেয়েটা।
 জলে আঁকড় কাটেনি কোনও দিন। ঋণ তবু যে বেড়েই চলল ! মেয়েটার ।
কুঁজোর ঠাণ্ডা জল দিয়ে মাঝেমধ্যে বেলের শরবত বানাতেন মেয়ের মা। অফিস ফেরতা বরফের দোকান থেকে কুঁচো বরফ আনতেন বাবা। তড়িঘড়ি বেলের শরবতে বরফের কুঁচো মিশিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে ফেলতো ওরা । তখন হাতে হাতে মোবাইল ছিল না, বারবার

 

 

'কতদূর এলে' জিজ্ঞাসা ছিল না, তবু ওর মা কেমন করে যেন বুঝে নিতেন বাবার বাড়ি ফেরার সময়টা! 
 গরমের ছুটি পড়ার দিন স্কুলে পৌঁছে দিতেন যে কাকু তিনি আইসক্রিম খাওয়াতেন সেই মেয়েটিকে আর ওর বন্ধুদের। হাতে টাকা দিয়ে বলতেন পছন্দ মতো আইসক্রিম কিনে আনতে। ওদের সবারই ইচ্ছে থাকত সাদা আইসক্রিম কেনার। স্কুলে যাওয়ার সময় বাড়ি থেকে যেটুকু টাকা হাতে আসতো তাতে সাদা আইসক্রিম নসীব হতো না বেশিরভাগেরই। এক টাকার পেপসিই ছিল ভরসা, বড় জোর কমলা রঙের আইসক্রিম। মেয়েগুলোর কেমন যেন একটা ধারনা ছিল, সাদা আইসক্রিম বড়লোকরা খান! ওদের সাদা আইসক্রিমের খাওয়ার দিন ওই একটাই, গরমের ছুটি শুরুর দিনটা! 
গরমের দুপুরে বাড়ি ফিরেই স্কুলের ইউনিফর্ম খুলে ফ্যানের ঠিক তলাটায় মুখ উঁচু করে হাওয়া খেতো মেয়েটা। ফ্যানের গতির বিশেষ হেরফের হতো না , বরং প্রায় গরমেই লো- ভোল্টেজ আর লোডশেডিং ছিল সঙ্গী। মাথায় স্কুলের ফিতে বেঁধেই জল ঢালা ভাত আর আলুভাজা খেয়ে নিতে হতো।  তাপের হাত থেকে বাঁচতে থাকত এক টুকরো পেঁয়াজও। সাদা খেতে হয় যে গরমে, শরীর ঠাণ্ডা থাকে তাতে, মনও!
পয়লা বৈশাখের আগে মায়ের হাত ধরে যেতো পাড়ারই একটা বাড়িতে। কাপড় বিক্রি করতেন সে বাড়ির কাকু। গরমের দিন। তাই ছাপা শাড়ি কেনাই ছিল দস্তুর। বাড়ির সবার জন্যে গুনে গেঁথে কাপড় কিনতেন ওর মা। মন দিয়ে কাপড় পছন্দ করে দিতো ও! এটা মাসিমণির, এটার মামমামের... মায়ের শাড়িটা প্রতিবার কেনা হতো না, 'অনেক শাড়ি' থাকার অজুহাতে! চৈত্র সেলে ফুল ফুল ছাপ ফ্রক কেনা হতো মেয়েটার জন্য। ওর চোখ তখনও পলাশ চেনেনি, চিনতো কেবল স্কুল মাঠের কৃষ্ণচূড়া গাছটা! জামার বুকে লাল কৃষ্ণচূড়া নিয়ে ঘুরতো সে। যে কোনও লাল ফুলই তখন সুন্দর লাগতো। সাদার ওপর লাল ছাপ ফ্রক ছিল বেশিরভাগের গরমের সাজ! তবুও পছন্দ হতো না যেন! 

 

 

 

সেকালের গরমের অভ্যেস ছেড়েছে অনেক দিন হল। এই তো সেই দিন গরম দুপুরে অতীতের ঠাণ্ডা খুঁজতে বেরিয়েছিল সেই মেয়ে ! দেখল , ওর শহরতলীর জমজমাট বাজারে এখনও চৈত্র সেল বসে। মফস্বলি মায়েরা সংসারের খরচ বাঁচিয়ে জমানো টাকায় বাচ্চাদের ফুলছাপ টেপ জামা কিনে দেন আজও। বাচ্চাগুলোকে কেমন যেন ওর মতোই... । সেলের চটি কিনতেও ভিড়ে হয় এখনও। সকলেই ঝাড়াইবাছাই করে সবথেকে মজবুত চটি সওদা করেন, যাতে অনেক দিন টেঁকে! মাদুর কেনেন, গেরস্থালির প্রায় সবই কিনে ফেলেন কম দামে! অনেকের জন্য কেনেন অনেক কিছু কেনেন , ইয়াব্বড় একটা মন নিয়ে কেনেন। 
মেয়েটা আজকাল আর সেলের বাজারে যায় না । এয়ারকন্ডিশন্ড আউটলেট কেনাকাটির ঠিকানা এখন। সে দোকানে কিনতে গেলে ঘাম হয় না! কখনও কখনও দোকানেও যেতে হয় না ।

 

 

উল্টে ঘরে বসেই মেলে পছন্দের জিনিস। না যাওয়ার আরামটুকু মেলে, তবুও কোথায় যেন একটা কাঁটা খচখচ করে! এখন আর পয়লা বৈশাখে দোকানে-দোকানে হালখাতার নেমতন্নও হয় না ওদের। অনলাইনেই দিব্যি মিটিয়ে দেওয়া যায় ধার-কর্জ! এক গ্লাস শরবতের জন্যে হাপিত্যেশ করতে হয় না আর। অফিস ফেরতা আমূল কুল, ঠাণ্ডা রাখে গলা। এককালে বাবাকে  কাপ আইসক্রিম কিনে দেওয়ার কথা বলতে দ্বিধা করতো মেয়েটা, বেশি দাম যে! আর এখন দেদার আইসক্রিম কিনে, ফ্রিজে জমিয়ে রেখে ভুলেই যায় আইসক্রিম খাওয়ার কথা! এখন আর মাটিতেও শোয় না, শীতলপাটি নেই যে ! 
 

 

অনেক ভেবে মেয়েটা দেখেছে, কেবল দুর্গাপুজো আর সরস্বতী পুজোর দিনক্ষণ জানানো ছাড়া বাংলা পাঁজি ক্যালেন্ডারের প্রয়োজন ফুরিয়েছে ওর। তবুও বাংলা বছরের শুরুতে পাতলা টিকটিকে একখানা পাঁজি ক্যালেন্ডার হাতে পেলে মন্দ লাগে না এখনও। বছর শেষে চৈত্রের হাওয়ায় এগারোটা মাস হারিয়ে ফেলে পাতলা ক্যালেন্ডারের একটাই পাতা যেমন একলা একলা ওড়ে, সেই মেয়েও তেমন একলা হয়ে যায় দিন দিন, বারোর বাঁধন হাতছানি দেয় তবু...॥

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait