অচেনা
একবার পড়া খবরের কাগজের প্রথম পৃষ্ঠাটাতে আবার চোখ বোলাচ্ছিলেন অসিত বাবু। পুরোনো কাগজ আর ন্যাতানো পাঁপড়-কোনো ফারাক নেই তাঁর কাছে। যদিও কাগজের আনকোরা নতুন নতুন গন্ধটা চলে যায় নি এখনও। সময়ের হিসেবে পুরোনোও বলা যায় না এটাকে। এই তো ঘন্টা খানেক আগেই কিনলেন। তবু একবার পড়া কাগজ তো, বুড়িয়ে যাওয়া বউয়ের মতই বিস্বাদ।
কিন্তু কীই বা করার আছে এছাড়া....? আবরণটুকু খসে গেলেই তো সেই নগ্ন দৃষ্টির মুখোমুখি হওয়া…। তেত্রিশ বছরের পুরোনো ওই দৃষ্টি। তেত্রিশ? নাকি আরও বেশি?
মনে মনে আঁক কষতে থাকেন অসিতবাবু। কৃষ্ণনগরের বাড়ি ছেড়ে কলকাতায় চলে এসেছেন পঁচিশ বছর বয়সে। এখন আটান্ন হলে, তেত্রিশ বছরই তো হয় সময়টা।
আচ্ছা, চিনতে ভুল করছেন না তো তিনি? এত বছর আগেকার স্মৃতি! কিছুটা মালিন্য, কিছুটা বিবর্ণতা আসাই তো স্বাভাবিক!
আড়চোখে সামনের সিটের দিকে তাকালেন তিনি। না, ঠিকই তো আছে।...সেই চোখ, সেই মুখ, কপালের ওপরের সেই কাটা দাগটা...এমনকি বাঁ দিকের গালে সেই লাল জরুলটাও রয়েছে ঠিকঠাক। এ মুখ আর কারও হতে পারে না,কক্ষনো নয়।
বেশীক্ষণ তাকিয়ে থাকা চললো না,ওদিক থেকেও অনুরূপ একটা বাঁকা দৃষ্টি এসে পড়েছে তাঁর দিকে। চোখাচোখি হতেই লজ্জিত হয়ে চোখ নামিয়ে নিলেন।
নাঃ! এভাবে তো আর চলে না! অফিস টাইমের কৃষ্ণনগর লোকাল। ঠাসাঠাসি ভিড়। কৃষ্ণনগর থেকে ওঠার সুবাদে বসার জায়গা একটা পেয়েছেন বটে কিন্তু সে ও কোনোরকমে।
ও বোধহয় রানাঘাট থেকে উঠেছে। ভিড়ের জন্য খেয়াল করতে পারেন নি ঠিক করে। বাবা! ব্যাগ খুলে আবার লেডিস ম্যাগাজিন বের করা হয়েছে একটা! মনে মনে খুব একচোট হেসে নিলেন অসিতবাবু। -"হুঁ হুঁ বাবা, ও ম্যাগাজিন যে কতখানি পড়ছো তুমি, তা আর আমার চেয়ে ভালো করে কে জানে!"
আচ্ছা, ও কি আদৌ চিনতে পেরেছে তাঁকে? না পারলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। কতদিনেরই বা আর পরিচয়!
কৃষ্ণনগরের যে বাড়িটায় মেস করে থাকতো ওরা, তার ঠিক পিছনেই অসিতবাবুদের পৈত্রিক বাড়ি। সে আজ কত বছর আগেকার কথা। ও তখন বি.এ. ফার্স্ট ইয়ার। কিসে একটা অনার্সও ছিল যেন! ফিলজফিতে? নাকি পলিটিক্যাল সায়েন্স? মনে পড়ছে না তো ঠিকঠাক! অসিতবাবু তখন সদ্য গ্রাজুয়েট আর কাঠ বেকার। দিন কাটে পাড়ার রকে আড্ডা মেরে আর মা-কাকিমাদের ফাই-ফরমাস খেটে। তাঁর চিলেকোঠার ঘরের জানালা থেকে স্পষ্ট দেখা যেত ওর মেসের ঘরের জানালার পর্দা। অবসরে ঘরে বসে বিড়ি ফোঁকার ফাঁকে ফাঁকে সপ্রেম দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেন ওই দিকে। একবার যদি ওকে দেখা যায়! সব সময় যে হতাশ হতে হত এমনটিও নয়।
দাদ, হাজা, চুলকানির মলমওয়ালা উঠেছে। রমা একটা হাজার ওষুধ নিয়ে যেতে বলেছিল। এসব জিনিস ট্রেনেই পাওয়া যায় ভালো। রোজ রোজ তো আর ট্রেনে চাপা হয় না। জমি জমা সংক্রান্ত একটা কাজে পৈত্রিক বাড়িতে গিয়েছিলেন গতকাল। কিছু সই সাবুদ করার ছিল। খুড়তুতো ভাইয়ের ওখানেই উঠেছিলেন। আজ সেখান থেকেই সরাসরি অফিস। তাই ট্রেনে চাপা। কিনে নেবেন জিনিসটা?
রমাটার হাতে পায়ে বড্ডো ঘা হয়…! হবে না, যা জল ঘাটে সারাদিন! সংসারটাকে ওই তো বুক বুক করে আগলায়! তিন ছেলেমেয়ে, বৃদ্ধা মা নিয়ে কলকাতার ভাড়াবাড়িতে অসিতবাবুর অভাবের সংসার। সবটুকুই রমার একার ওপর। অসিতবাবু আর সময় পান কোথায়!
জল ঘেঁটে ঘেঁটে বেচারির আঙ্গুলের ফাঁকগুলো সব সাদা। পকেট থেকে টাকা বের করতে গিয়েও উল্টো দিকে চোখ পড়তেই থমকে যান অসিতবাবু। থাক না হয় আজ….এত বছর পরে মুখোমুখি.. কী জানি কী ভাববে আবার!
প্রথম জীবনের রোমান্টিক ভাবটা ফিরে ফিরে আসছিল। বারবারই চোখ চলে যাচ্ছে ও-দিকে। ধরা পড়ার ভয়ে আনন্দবাজারের পাতাটা দিয়ে নিজেকে ভালো করে আড়াল করে নিলেন অসিতবাবু। আজ ও ঘিয়ে রঙের তাঁতের শাড়ি পরেছে। তখন কিন্তু উজ্জ্বল রঙের শাড়িই বেশি পরত। টুকটুকে ফর্সা রঙে, উজ্জ্বল ঝকমকে শাড়িতে কী চমৎকারই না মানাতো! যখন যেখানে যেত, যেন আলো হয়ে উঠতো চারপাশ।
- "একি দাদা! সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছেন না, ঠেলছেন কেন এমন! আশ্চর্য!"
হঠাৎ বিরক্তির সুরে ঘোর কেটে যায় অসিতবাবুর। চোখ তুলে দেখেন তাঁর ঠিক সামনেই ভূঁড়িওয়ালা কালো মত এক দেহাতী হিন্দুস্থানী দাঁড়িয়ে পড়েছে। উঁকি মেরে দেখছে পাশের সিটের তাসুড়েদের কল ব্রীজের রেজাল্ট। আর তার মস্ত ভূঁড়ির আড়ালে চাপা পড়ে গেছেন উল্টোদিকের সহযাত্রিণী।
যাক! এতক্ষণে নিশ্চিন্তি! কতক্ষণ আর পড়া কাগজ পড়া যায় বারবার!
মেয়েরা বড্ড স্বার্থপর হয়। নারী চরিত্রের এই নিগূঢ় তত্ত্ব আবার নতুন করে উপলব্ধি করলেন অসিতবাবু। নিশ্চয়ই চিনতে পেরেছে তাঁকে! আড়েঠাড়ে তাকাচ্ছে ও তো! অথচ যেচে কথা বলতে পারছে না একবার! আর কিছু নয়, অন্ততঃ কেমন আছেন তিনি, কোথায় থাকেন এখন, জানতে তো চাইতে পারতো একবার। মনের মধ্যে অভিমান জমে উঠছিল। তার সঙ্গে কৌতুহলও। নিজেই আলাপ করবেন নাকি? কিন্তু চিনতে না পারলে তো কেলেঙ্কারির একশেষ। আশপাশের লোকজন যদি কিছু ভাবে?অসম্মানজনক কথাবার্তা বলে! তাঁর বয়সী পুরুষ মানুষদের অনেকেই সন্দেহের চোখে দেখে আজকাল।
আজ ও না চেনার ভান করে মুখ ফিরিয়ে বসে আছে ঠিকই কিন্তু একটা সময় ওর জন্য কি কম কিছু করেছেন অসিতবাবু? ওদের মেসের রাঁধুনী ঠাকুর চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়লো যে'বার, ছাটাই হলো কাজ থেকে, অসিতবাবু লোক জোগাড় করে না দিলে তো হাত পুড়িয়ে রান্না করে খেতে হতো। ডকে উঠতো পড়াশোনা। তারপর সেই বর্ষার সময়, লিলি না মিলি,কোন একটা মেয়ের যেন ডায়রিয়া হলো,যায় যায় অবস্থা। কী বৃষ্টি সেদিন! পাড়ার ছেলেদের জুটিয়ে ডাক্তার-ওষুধ-হাসপাতাল সমস্ত ব্যবস্থা তো এই শর্মাই করেছিল, নাকি?
তার ঠিক পরে পরেই তো চিঠিটা লিখেছিলেন অসিতবাবু। সেই চিঠি পড়ে লুকিয়ে দেখাও তো করতে এসেছিল ও। যদিও ব্যাপারটা আর এগোয় নি তারপর। অনেক রকম অসুবিধা ছিল। তখন দিন কালও ছিল অন্যরকম….।
তাই বলে ভুলে যাবে সব? মেয়েদের জাতটাই আসলে এমন অকৃতজ্ঞ!
ADVERTISEMENT
শ্যামনগর চলে এলো। ভূঁড়িওয়ালা হিন্দুস্থানী ব্যস্ত হয়ে দরজার দিকে এগোচ্ছে। সামনের সিটটার দিকে চোখ ফেললেন অসিতবাবু। নাঃ! ওর মধ্যে কোনো তাড়া নেই। নিস্পৃহ ভঙ্গিতে বসে ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাচ্ছে। বয়সের একটা ছাপ পড়েছে চেহারায়। আগের চেয়ে ভারী হয়েছে অনেকটা। পানের রঙে ঠোঁট দুটো লাল। পান খেতো না তো আগে! পরে ধরেছে বোধহয়। মাথার চুল ও উঠে গেছে অনেক। হবে না! ওর ও তো বয়স কিছু কম হলো না! তবে মুখের ঢলোঢলো লাবন্যটা আছে কিন্তু একই রকম।
বাদাম, ডালমুট, ঝুড়িভাজা নিয়ে উঠেছে একটা লোক। হঠাৎই সেই রিনরিনে পরিচিত স্বর, "আমাকে দু প্যাকেট বাদাম দেবেন তো"। ব্যাগ খুলে টাকা বের করছে ও। দু প্যাকেট কেন রে বাবা! সঙ্গে তো আর কেউ নেই। একটা কি তবে অসিতবাবুর জন্য? হঠাৎই নড়েচড়ে বসলেন অসিতবাবু।
ও বাবা। দুটো প্যাকেটই চালান হয়ে গেল হাতের ব্যাগের ভিতর। আবার খুলেছে ম্যাগাজিনের পাতা।
ট্রেন শিয়ালদহ ঢুকছে। প্রায় একসঙ্গেই সিট ছেড়ে উঠলেন তাঁরা। দাঁড়ালেন পাশাপাশি। বহু বছর পর। কেমন মিষ্টি একটা গন্ধ আসছে ওর শরীর থেকে। দরজা কাছে এখনও যথেষ্ট ভিড়। সকলেরই নামার তাড়া। তার মধ্যেই অসিতবাবুকে অবাক করে ভেসে এলো একটা রিনরিনে স্বর।-"চিনতে পারছেন?"
অসিতবাবুর বুকের মধ্যেটা দুলে উঠলো। কী বলবেন! কিন্তু সে ক্ষণিকের জন্য। হঠাৎই রমার মুখটা মনে পড়লো। ক্ষয়াটে পরিশ্রমী,আত্মপ্রত্যয়হীন একটা মুখ। দীর্ঘ দাম্পত্যে আজ আর রোমান্টিকতা হয়ত নেই, তবে ভালোবাসা আছে, যত্ন আছে, আছে সব অবস্থায় পাশে থাকার আশ্বাস।
একটু গলা খাঁকাড়ি দিয়ে অসিতবাবু বললেন,"আপনি…..নরুর বড় পিসিমা না? গত বছর বইমেলাতে গিয়ে আলাপ হয়েছিল তো?"
0 comments